নয়নাভিরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার প্রাক্তন শিক্ষক শশাঙ্ক চক্রবর্তী স্যারকে 'প্রিয় শিক্ষক' হিসেবে সংবর্ধনা জানানো স্যারের প্রিয় ছাত্রদের অনেক দিনের ইচ্ছা। অবশেষে ০৫ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে স্যারের আশি বছর পূর্তিতে সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নের সুযোগ হল।
আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্যারের প্রিয় ছাত্র তালাত মাহমুদ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আয়োজনের শেষ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। শশাঙ্ক স্যারের প্রিয় ছাত্রদের অনেকেই বেশ স্বনামধন্য। শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার কিংবা মাহমুদের মত কলেজ শিক্ষকসহ সমাজের সর্বস্তরের লোকজনই আছে এই তালিকায়। প্রিয় ছাত্রদের অনেকেই আর্থিক অনুদান দেয়ায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটিতে জাঁকজমকের কোনো ঘাটতি ছিল না। 
তবে অনুষ্ঠানের দিন মাহমুদদের আয়োজক কমিটি প্রথমেই হোঁচট খেলো স্টেজে বসার ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কারণ স্টেজের আসন সংখ্যার চেয়ে বসতে চাওয়া স্যারের প্রিয়ভাজনদের সংখ্যাধিক্য। পরে স্যারের পরামর্শ অনুসারে স্টেজে চেয়ারের পরিবর্তে তৎক্ষণাৎ শতরঞ্জি এনে অধিক সংখ্যক প্রাক্তন ছাত্রদের বসার ব্যবস্থা করা হয়।
এরপর আসে বক্তৃতার পালা। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সকলের বক্তৃতা যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করে স্যারের স্মৃতিচারণের জন্য বেশিরভাগ সময় বরাদ্দ রাখা হবে এবং দুপুরের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ করে ফেলা হবে। সকাল সাড়ে নয়টায় অনুষ্ঠান শুরু করে এডিসি মহোদয়ের উদ্বোধনী বক্তব্যের পর স্যারকে উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে মানপত্র পাঠ শেষে হস্তান্তর করা হয়। পরে স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এবং প্রাক্তন কয়েকজন শিক্ষক সংক্ষিপ্ত সময়ের স্মৃতিচারণ করেন। এর পর ছাত্রদের বক্তৃতা পর্ব শুরু হওয়ার পর অনুষ্ঠান যেন চুইংগামের মত লম্বা হতে শুরু করে। সকলেই নতুন করে আবিষ্কার করে যে, স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে বক্তার কোন অভাব নেই। বক্তাদের লম্বা তালিকার বক্তৃতার মঞ্চায়নে কখনো মনে হচ্ছিল অনুষ্ঠানটি যেন একটি রাজনৈতিক মঞ্চ, কখনো মনে হচ্ছিল সাবেক ছাত্রদের প্রাচুর্যের বাচনিক শোডাউন অথবা ব্যক্তিগত অর্জনের ফিরিস্তি। এসব বক্তার বক্তৃতায় স্লোগান ও হাততালি দেওয়ার মত লোকেরও কোন অভাব ছিল না, আর সেলফি এবং ছবি তোলার আধিক্যের বিষয়টি নাই বা বললাম।
অবাক হয়ে সবাই লক্ষ্য করল, একেকজন বক্তা বক্তৃতা শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে গিয়ে সরাসরি অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে যাচ্ছে এবং অনুষ্ঠানস্থল থেকে তাদের সাথে আসা বেশ কিছু লোকও অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এরূপ ঘটনার পরিক্রমায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ক্রমশ: খালি হতে লাগল। এরপর অনুষ্ঠানের মধ্যমণি শশাঙ্ক স্যার যখন বক্তৃতার জন্য দাঁড়ালেন, তখন বেলা আড়াইটা পার হয়ে গিয়েছে, উপস্থিত জনদের সংখ্যাও তখন প্রায় এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। অভ্যাগত অতিথি হিসেবে এসে এ ধরনের অবহেলায় মধ্যে পড়ে স্যার একটু বিচলিত হলেও তা কাউকে বুঝতে দেননি।
দেখলাম, এই আশি বছরেও স্যারের সাহিত্যের রসবোধ বিন্দুমাত্রও কমেনি ! আমাদের বন্ধু আয়োজক মাহমুদসহ উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে স্যার বললেন, "স্কুল আসলেই তোমাদের শিখার স্থান। এখানে আমি তোমাদেরকে একসময় শিখিয়েছি, আজ এখানে পরিবেশ তোমাদের নতুন কিছু শিখিয়েছে। তবে আগে আমি তোমাদের যে আদর্শ আর নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছিলাম, সময়ের বিচারে এখন তা ধারণ করলে তোমরা অচল হিসেবে পরিগণিত হবে।" স্বভাবসুলভ ভাবে স্যার সেই আগেকার সময়ে ক্লাস নেয়ার মতো করে বললেন, "কি বললাম, 'অচল', বুঝতে পারছ?" এইটুকু বলে স্যার একটু থামলেন। 
এরপর আবেগ জড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, "আমি স্কুলের শিক্ষক, আমার পড়াশোনার দৌড় কম, দূরদর্শিতা আরও কম। এজন্য আমি তোমাদের যুগোপযোগী হওয়ার শিক্ষাটা দিতে পারিনি, কারণ যুগের সাথে নৈতিকতার কদর এভাবে কমে যাবে, তা বোঝার মতো দূরদর্শী আমি ছিলাম না। এ ব্যর্থতা আমার। তবে এর মধ্যেও যারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়েছ, তাদের আমি সাধুবাদ জানাই।" এই বলে স্যার উপস্থিত সকলকে এক এক করে লক্ষ্য করতে থাকলেন। উল্লেখ্য, নিজ ছাত্রদের নাম, শ্রেণী, রোল নাম্বার সহ পরিবার বৃত্তান্ত স্যারের মুখস্ত ছিল। 
উপস্থিত আমাদের সকলকে একে একে লক্ষ্য করার পর দুই একজনকে স্যারের অপরিচিত মনে হল। তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা আমার বয়স হয়েছে, তোমার নামটা আমি স্মরণ করতে পারছি না। তুমি কোন ব্যাচের ছাত্র ছিলে?"
উপস্থিত সেই জন নিজের কথা না বলে অতি উৎসাহে পাশের দুই জনকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, "স্যার, ওরা সাউন্ড সিস্টেমের লোক, অনুষ্ঠান শেষ হলে সাউন্ড সিস্টেম অন্য প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।" 
- আর তুমি?
- "আমরা এসেছি মধ্য বাজারের 'আলিফ শতরঞ্জি এন্ড কার্পেট' থেকে, স্টেজে বিছানো শতরঞ্জিগুলো আমাদের", আরও দু'জনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে বলল।
এরপর স্যার বক্তব্য আর দীর্ঘায়িত না করে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তৎক্ষণাৎ অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করলেন। মাহমুদরা স্যারকে এগিয়ে দিতে চাইলেও স্যারের নিষেধাজ্ঞায় আর এগোয়নি। 
পরেরদিন স্থানীয় সংবাদপত্রে শশাঙ্ক চক্রবর্তী স্যারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের খবর ছবিসহ যথারীতি প্রকাশিত হয়। বিশাল সেই আয়োজনের উপলক্ষ্য হয়েও স্যার নিজেকে যে রকম অবহেলার মাঝে আবিষ্কার করেছিলেন, অনুষ্ঠানটির সফল আয়োজনের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা যারা করেছিল, তাদের জন্যও এমন কিছুরই প্রতিফলন ছিল সংবাদপত্রের পাতায়। কারণ সেখানকার ছবিতে 'বরেণ্য'দের ভীড়ে ঘামঝরানো আয়োজকদের বেশিরভাগই হারিয়ে গিয়েছিল। এমনকি লেজুড়বৃত্তির দলীয় রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলা মাহমুদকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি পত্রিকার পাতার সেই ছবিতে। 
                                                                                   -  -  -  -  -  -  -  -  -  -  -  -            
                        
            
            
            
                        
            
            
                        
            
         
        
               
   
            
                
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
                ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
                নয়নাভিরাম উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলার প্রাক্তন শিক্ষক শশাঙ্ক চক্রবর্তী স্যারকে 'প্রিয় শিক্ষক' হিসেবে সংবর্ধনা জানানো স্যারের প্রিয় ছাত্রদের অনেক দিনের ইচ্ছা। অবশেষে ০৫ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে স্যারের আশি বছর পূর্তিতে সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নের সুযোগ হল।
            
    
    
                    
        
        
            
            
                 ১৬ জুলাই  - ২০১৯ 
                                        
                            গল্প/কবিতা:
                            ১৭ টি
                        
                    
            
            
         
     
    
        
বিজ্ঞপ্তি
        এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
    
    
        প্রতি মাসেই পুরস্কার
        
            বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
        
        
            লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
            
                - 
                    
                    
                        প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
                        প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
                     
- 
                    
                    
                        তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
                     
 
     
    
        
        বিজ্ঞপ্তি
        “নভেম্বর ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
        প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী