“চোখের জলে সমুদ্র বিলাস”

কষ্ট (জুন ২০২০)

জুলফিকার নোমান
  • ৪৯

“তোর কথা না শুনে যে মোহের জালে আমি জড়িয়েছিলাম, তা থেকে আর মুক্তি মিলছে না"-  বান্ধবী নওশীনকে জড়িয়ে ধরে বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মোনা খান।  
নওশীন মোনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের একজন। মায়মুনা খানম থেকে মোনা খান হয়ে উঠার পর  তাদের সম্পর্কে একটু ছেদ পড়েছিল, সেটা অবশ্য মোনা খানের সাম্প্রতিক বদলে যাওয়া ও অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে।


একই ক্লাসে পড়া নওশীন ও মায়মুনা দুজনেরই বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলায়। মায়মুনার বাবা মোজাহার আলী খান সেটেলমেন্ট অফিসে চাকরি করেন, পারিবারিকভাবে তারা বেশ ধার্মিক। তবে পারিবারিক রক্ষনশীলতার চেয়ে আধুনিকতাকেই মায়মুনার বেশি ভালো লাগত। 


এইচ এস সি পাশের পর নওশীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলেও মায়মুনাকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। নওশীন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠে যায়, মায়মুনাও একটি ছাত্রীনিবাসে সিট নিয়ে নেয়। 


বাড়ির বাইরে মায়মুনার জীবনের আধুনিকতা আরও উজ্জীবিত হয়। হঠাৎ একদিন মোনা খান নামের ফেসবুক আই ডি থেকে নওশীনের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে, যার প্রোফাইল পিকচারে বান্ধবী মায়মুনা খানম। সাথে সাথে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস জানতে চায় নওশীন, "হঠাৎ নতুন ফেসবুক আই ডি, ঘটনা কি?"
- পুরোনো আই ডি’র সাথে নতুনটাও থাকবে, নতুনটাতে নতুন বন্ধুরা অ্যাড হবে।
- তাহলে আমি কোন দলে?
- তুই তো সর্বদলে।
- ফেসবুক আই ডির নামে যে পরিবর্তন?
- নামে পরিবর্তন কোথায়? নামটা একটু সংক্ষেপ করে নিয়েছি।     


তার আধুনিকতার তেজে এক পর্যায়ে নওশীনও তার কাছ থেকে 'সেকেলে ধ্যান-ধারণার মানুষ' হিসেবে আখ্যা পায়। রক্ষণশীলতা আর আধুনিকতার টানাপোড়নে  ফার্স্ট ইয়ার  থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে উঠতেই মায়মুনার সাথে নওশীনের যোগাযোগে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে ফেসবুকে অ্যাড থাকার কারণে মায়মুনারর গতিবিধি মাঝে মাঝেই চোখে পড়ত নওশীনের।


তার 'মায়মুনা খানম' নামের ফেসবুক আই ডি’তে স্টেটাস পরিবর্তন খুব একটা হত না। এ আই ডি’তে অ্যাড থাকা তার পরিবারের সদস্যরা বুঝতো যে, মেয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকায় ফেসবুকে সময় দিতে পারে না। আর 'মোনা খান' নামের আই ডি’তে থাকতো ছবি আর স্ট্যাটাসের সমারোহ।


এর মধ্যে হঠাৎ একদিন মায়মুনার বয় ফ্রেন্ড ম্যাক-এর বার্থডে পার্টির দাওয়াত পেল নওশীন, অনুষ্ঠান স্থল গুলশানের নামি দামি এক রেস্টুরেন্ট। পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত বনানীর রেইন ট্রি হোটেলের বার্থডে পার্টির ঘটনা তখনও নওশীনের স্মৃতি থেকে ফিকে হয়ে যায়নি, তাই কোন মতেই সে যেতে রাজী ছিল না। তার পরেও 'ম্যাকের সাথে শুধু পরিচিত হয়েই চলে আসবে' - এই শর্তে তাকে অগত্যা রাজী হতেই হল। কারণ, ঢাকায় মায়মুনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলতে সে-ই ছিল।  
বার্থডে পার্টিতে শালীন পোশাকে উপস্থিত নওশীনের অভিজ্ঞতাটা খুব সুখকর ছিল না। ম্যাক-এর সাথে হ্যান্ডশেক না করায় উপস্থিত 'স্মার্ট' লোকজনের কাছে 'ক্ষেত' উপাধি পেয়ে  সেই যাত্রা সে রক্ষা পেল। সেদিন পোশাকের বাহার আর ম্যাকের বাহুলগ্ন মায়মুনাকে দেখে নওশীন বুঝে গিয়েছিল, 'আধুনিক' হওয়ার জন্য কতটুকু প্রাণান্তকর চেষ্টায় আছে তার বান্ধবী!


পরের দিন মায়মুনা ফোন করে অনেকবার 'সরি' বলে নওশীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করেছে। সেদিন নওশীন মায়মুনাকে শুধু একটি কথাই বলেছে, "তুই যে পথে হাটঁছিস, এজন্য তোকে পরে পস্তাতে হবে; সময় থাকতে ফিরে আয়।"


এরপর কয়েকদিন পর মোনা খানের ফেইসবুক আই ডি তে দেখা গেল মায়মুনা ও ম্যাকের সী বিচে  তোলা বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি। নওশীন মনে করেছিল, এরই মধ্যে হয়তো বিয়েটাও হয়ে গিয়েছে তাদের, হানিমুনে আছে তারা। জানতে মায়মুনাকে দিল ফোন, অবশ্য সেসময়  ফোন ধরেনি সে।


ঐ দিন বিকেলে মায়মুনাই ফোন ব্যাক করল। কণ্ঠ  শুনেই বোঝা গেল, বেশ ভাল সময় পার করছে সে।
- আমার বান্ধবী নওশীনের এতদিন পরে আমার কথা মনে পড়ল !
- তুই বিয়ে করলি, আর আমি জানতেই পারলাম না।
- বিয়ে করলাম কোথায় ? করলে তো সবাই জানবেই।
- এখন তুই কোথায়? তোর ফেস বুকের স্টেটাস বলছে, এখন ম্যাকের সাথে তুই হানিমুনে কক্সবাজার।  
- ম্যাকের সাথে কক্সবাজার, ঠিক আছে। বাট হানিমুনে এসেছি, তোকে কে বলেছে?
- ম্যাকের সাথে তোর ছবি দেখে ধারণা করলাম। 
- সব ধারণা কি ঠিক হয়?
- তুই আছিস কোন হোটেলে। 
- হোটেল সী-গালে। 
- দুজন একসাথেই আছস?
- তোকে বুঝতে হবে নওশীন, ম্যাক আমার বয় ফ্রেন্ড। আমরা কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে করব। 
- "সময় তাহলে ভালই যাচ্ছে?"- প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল নওশীন। 
- ‘তা যাচ্ছে না’ বললে ভুল হবে। তবে আজ ম্যাকের সাথে বেশি হুলস্থুল করতে গিয়ে সী বিচের ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, কিছু পানিও খেয়ে ফেলেছি। সমুদ্রের নোনা পানির বিশ্রী স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।


এরপর থেকে নওশীন মায়মুনাকে এড়িয়ে চলতে চাইত। সেই সময়টাতে ফেসবুকের দুই আই ডি তে মায়মুনার নতুন স্টেটাসও খুব একটা চোখে পড়ত না। নওশীন নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়ল পরীক্ষা নিয়ে, এভাবে  কেটে গেল প্রায় দুই মাসেরও অধিক সময়। 


হঠাৎ একদিন মায়মুনার ফোন, কোনো প্রশ্ন না করে জরুরি ভিত্তিতে নওশীনকে মিরপুরে এক ডাক্তারের চেম্বারে যেতে বলল সে।
গাইনী ডাক্তারের চেম্বারের সামনে মায়মুনার মুখের দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠলো নওশীন, বুঝলো 'সামথিং রং'। তাকে নিয়ে বেশ কিছু রিপোর্টসহ ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকল মায়মুনা। রিপোর্ট দেখে কিছুক্ষন চুপ থেকে ডাক্তার বললেন, "গতকাল তার কাছ থেকে সব শুনে আমি যা ভেবেছিলাম, তা-ই।" 


নওশীনকে মায়মুনার সাথে দেখে এবং বান্ধবী হিসেবে পরিচয় পেয়ে ডাক্তার বললেন, "আপনাদেরও তো দায়িত্ব ছিল এই মেয়েটাকে বোঝানো, সঠিক পথে নিয়ে আসা।"
- কেন, কি হয়েছে মায়মুনার?
- কি হয়নি বলেন? সে এখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তার শারীরিক অবস্থাও ভাল না। কী করবেন, আপনারাই  সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানান। 


শুনে আমি অবাক হলেও আকাশ থেকে পড়লাম না। বাইরে বের হয়ে একটু আড়ালে গিয়ে মায়মুনাকে জিজ্ঞেস করলাম, "ম্যাক কি জানে? সে কি বলে?"
- ম্যাক সবই জানে। সে আমাকে 'এবোরশন' করে ফেলতে বলে, টাকা লাগলে সে দিয়ে দিবে। আর আমার মতো 'সস্তা' মেয়েকে সে বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। 
- তাহলে তো সর্বনাশ।
- আমি বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার কাছে থাকা আমাদের অন্তরঙ্গ ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দিবে বলে হুমকিও দিয়েছে।
- তোর বাড়িতে জানে?
- বাড়িতে জানে না। তবে ছাত্রীনিবাসে আমি যাদের সাথে থাকি, তারা বুঝে গিয়েছে। তারা আর আমাকে তাদের সাথে রাখতে চাইছে না।


এই পর্যন্ত বলে নওশীনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মায়মুনা। কান্নার তোড়ে মায়মুনার  চোখ থেকে নেমে আসা  নোনা গরম জলের উষ্ণতাটা নওশীন অনুভব করতে থাকল। 


আর ভাবতে লাগল, আধুনিকতার মোহজালে জড়িয়ে কক্সবাজারে মায়মুনার নোনা জলের স্বাদ নেয়া সেই যে শুরু হয়েছিল, চোখের নোনা জলের ধারাবাহিকতায় তা কখন কীভাবে শেষ হবে?

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অনুপম, অতুলনীয় লেখা। 
অশেষ ধন্যবাদ, আপনার ভাল লাগা আমাকে অনুপ্রাণিত করবে।

১৬ জুলাই - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪