গল্পটা ঠিক গল্প নয়

বাবা (জুন ২০২৩)

nani das
  • 0
  • ৩২
গল্পটা ঠিক গল্প নয়; সেদিন-
বাবা এক ধমক দিলেন রিক্সাওয়ালাকে, আহা! এই বেচারও শেষমেশ….
-এই ব্যটা তোমার বাড়ি কি তালগাছ নাই! এই মোড়ের বাজার থেকে বাসা, তাতে তুমি ভাড়া চাইলে পনেরো টাকা।
১৯৯৬ সাল; বেতন কম, ভাড়া কম, পন্য দ্রব্যের মূল্যও কম। মানুষের আকাশ চুম্বি চাহিদাও ছিল কম। এত্ত এত্ত কমের মধ্যেও রিক্সাওয়ালা যখন দশ টাকার ভাড়াতে পাঁচা টাকা বেশি চেয়ে বসলেন, বাবা তো রেগে যাবেনই। কিন্তু আমার এই দৃশ্য দেখে দেখে মুখস্ত। বাবা শেষমেশ সেই পনের টাকা-ই দেবে, তবে দু’চারটে কথা শুনিয়ে।
-স্যার আমি তো গরিব মানুষ, ঢাহায় নতুন আইছি, ভাড়াডা জানি না, তাই আন্দাজ কইরে চাইছি। যা ভাড়া আছে তাই দ্যান।
বাবা’র চিৎকারে আসে-পাশে আরো দু’চারজন এসে পাশে দাঁড়ালো
-আদাব স্যার, স্যার কি হয়েছে?
- দ্যাখো না, মোড়ের বাজার থেকো এখানে পাঁচ টাকা ভাড়া বেশি চেয়েছে এই ব্যাটা। চিন্তা করতে পারো! থাক তোমরা যাও, আমি দেখছি। নতুন আসছে তো ঢাকায় তাই হয়তো ভাড়াটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি।
আমি বাজারের ব্যাগ হাতে, দাঁড়িয়ে আছি। বাবাটা কেমন যেন কোন ফুটো পয়সার অন্যায় মেনে নিতে তার গায়ে বাঁধে। কি এমন অন্যায় করেছে, মাত্র তো পাঁচ টাকা-ই বেশি চেয়েছে। ধ্যাৎ..
-এই নাও পনেরো টাকা, শোন তুমি গরিব বলে দিলাম, আমিও বড়লোক নই, বুঝলে, নতুন এসেছো তাই তোমার অন্যায় ভাবে ভাড়া বেশি চাওয়াটা মাপ করে দিলাম, এখন যাও।
বাবা শুক্রবার হলেই আমাকে বাজারে নিয়ে যেতো, বাজার থলে হাতে এ দোকান ও দোকান ঘুরাতো আর দরদাম করে কেনাকাটা করতো। আমাকে বলতো শোন বাবা সব সময় যে দাম চাইবে তার থেকে অর্ধেক বলবি, যদি না দেয় তাহলে আরো দু’টাকা, বড়জোর পাঁচ টাকা বাড়াবি । কাঁচা জিনিস তো ওরা যেমন তেমন চাইবে, তবে কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো দাম দর করবি না,
-সেগুলো কি বাবা?
- এই যেমন ধর আলু, পিঁয়াজ, ডাল, চিনি, মুদির খানার মালামাল আর কি।
- ও আচ্ছা, কিন্তু আমি তো বাজার করি না বাবা, আপনি-ই তো করেন।
- হ্যাঁ এখনও করছি, তাই বলে সারা জীবন কি করতে পারবো! এখন তুমি বড় হচ্ছো, বাজারঘাট করার দায়িত্ব তো তোমার নিতেই হবে।
- ধুর আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে, আর বাবা কি’না আমাকে বাজার করা শেখাচ্ছে।
- কি রে কি বিরবির করছিস ?
- না তো কিছু না, আচ্ছা বাবা আপনার বাজার কখন শেষ হবে ?
- এই তো হলো বলে, এখন শুধু খাসির মাংশের দোকানে যাবো কেজি খানে মাংশ কিনেই বাসায়।

মনে মনে দারুণ খুশি হলাম, এক গাল হাসি দিয়ে বন্ধুদের অপেক্ষার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে দিলাম। যাক ওরা গোল্লায়। মাংস ভোজন তো হবে। তাছাড়া ওরা তো জানে শুক্রবার বাবা আমাকে বাজারে নিয়ে যায়। প্রতিদিন ক্রিকেট খেলতে হবে এমনটাও তো ওদের লিখিত দেই নি।
এমনই এক জৈষ্ঠ্য মাস আম কাঁঠালে বাজার সয়লাব। কাঁঠালের বোটা দেখছে কেন বাবা ? চিকন বোটা দেখে একটা গোলগাল পাকা কাঁঠাল কিনলো। কাঁঠাল নিয়ে রিক্সায় বসে বাবাকে জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম, কিন্তু আবার কি যেন ভেবে আর বলাই হলো না।
-বলতো রণ চিকন বোটা আর গোলগাল দেখে কাঁঠালটা কেন কিনলাম?
- কেন ?
-কাঁঠাল ওভাবেই কিনতে হয়, চোখা চোখা কাটা, চিকন বোটা আর গোলগাল দেখেই কিনতে হয়, তাতে কাঁঠালটা মিষ্টি হয় আর ভিতরের কোয়াগুলো বড় হয়।
-কেন হয় ?
- ওটা ডালের কাঁঠাল তাই, কাঁঠাল গাছের গায়ে যে কাঁঠাল হয় সেগুলো ডালের কাঁঠাল নয়, ডালে ডালে কিছু কাঁঠাল ঝুলে থাকে সেগুলোর বোটা দেখলেই বোঝা যায় বুঝলি তো!
- হু
বাবা জীবিত থাকতে আর কখনও আমাকে বাজারে যেতে হয়নি। খেলেছি পড়েছি এই করে করে কাটিয়েছি। কিন্তু কখন যে বাবা’র শরীরে ধীরে ধীরে বার্ধক্য বাসা বেঁধেছে বুঝতেই পারি নি। বাবা’র শ্বাস কষ্ট, সাথে হার্টের সমস্যাও দেখা দিল। তিনি উঠে পরে লাগলেন আমাকে বিবাহ দেয়ার জন্য। মাত্র গ্র্যাজুয়েশন করেছি। চাকুরি একটা করছি, সেলসের কিন্তু বেতন কি পাবো ? মনে হয় না, মাত্র এক সপ্তা হয় চাকুরিটা করছি, মাল বিক্রয় হলে কমিশন ভিত্তিক টাকা নইলে ফাঁকা। এই যখন অবস্থা বাবা তখন কি’না আমার বিবাহের কথা ভাবছে! কি খাওয়াবো ?

-কিরে যে মেয়েটার ছবি দেখিয়েছি, পছন্দ হয়েছে তো ? গ্রামের মেয়ে। ভালোই হবে। চিন্তা করিস না, আমি যত দিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমি-ই খাওয়াবো। তারপর যা হবে তাই হবে।

-দেখেছি বাবা, আপনারা যা বলবেন তাই হবে।

বিয়ে ঠা হলো, বাবা’র চাকরিটাও ছেড়ে দিলাম, টিউশন করে যা পাই তাই দিয়ে চলা শুরু করলাম। বাবাও স্কুল থেকে রিটার্ড করেছে সেও দু’বছর হয়। বাবাও টিউশন করে। বাবা একটা ইংলিশ মিডিয়াম টিউশন থেকে আট হাজার পেতেন, বাকি দু’টা থেকে দু’হাজার করে। আমাকে গার্ডিয়ানরা অত বেতন দিত কই, পাঁচ শত টাকার দু’খানা করেছি। চলে যাচ্ছে কোন রকম।
২০১০ সাল, রাত দু’টা বাবা হঠাৎ শ্বাস কষ্টে জেগে ওঠে বসে বসে কাশি দিতে থাকে। আমার আর স্ত্রী ঘুম ভেঙে যায়। বাবার রুমে গিয়ে দেখি বাবা ভীষণ ঘামাচ্ছে আর হাঁপানিতে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ইনহেলার নিয়েও কাজ হচ্ছে না। ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঔষধের দোকানে রীতিমত হামলা করি। দোকানে তালা বন্ধ। কোন রকম দোকানে লেখা মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে বাসায় আসি। স্ত্রী বাতাস করছে। বাবা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে। দোকানের মালিককে মোবাইল করতে করতে দশমবারে ঘুম ঘুম চোখে বললো কে-
-ভাই আমি স্যারের ছেলে বাবা’র শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে। নেব্যুলাইজেশন না করলে তো সমস্যা হবে।
-ভাই কাল ভোরে দিলে হবে না?
- না ভাই এখনই দিতে হবে,প্লিজ দেখেন একটু কষ্ট করে পারেন কি’না।
- আচ্ছা দেখছি, আপনি কি স্যারকে ধরে দোকানে নিয়ে আসতে পারবেন? নাকি আমি বাসায় আসবো।
- আপনি বাসায় আসুন।
-বাবা বললেন না রে আমি যেতে পারবো।
অধ্যাপকের সব ঔষধ চলছে, তবু কেন এমন হবে? বাবা তো দিব্যি টিউশন করে রাতে বাসায় ফিরলেন। বোনদের খবর দেয়া হলো, মা সেদিন বড় বোনের বাসায় ছিলেন। বোনেরা আশে পাশের এলাকাতেই থাকে। সবাই আসলো। কেউ বললো হাসপাতালে নিলে ভালো হবে, কেউ বললো আগে নেব্যুলাইজেশনটা করে বাবাকে কিছুটা কষ্ট থেকে নিরাময় করি তারপর ভাবা যাবে। নেব্যুলাইজেশন দেয়া হলো বাবা কে। রাত তখন সাড়ে তিনটা। বাবা কিছুটা ভালো, সবাই মতামত দিলো সকালেই বাবাকে হাসপাতালের অধ্যাপকের নিয়ে যাওয়া হবে। তাই হলো, কিন্তু অধ্যাপক সাহেব বাংলাদেশে নেই, তাঁর এসিষ্ট্যান্ট বাবাকে দেখলেন। বললেন-
-আগের সব ঔষধ চলবে, আর বাকিটা স্যার আসুক তখন তিনি নিশ্চই কোন পরামর্শ দেবেন। আমি শুধু একটা ইনহেলার দিলাম, আগেরটাও চলবে । নতুন ইনহেলারটা বুকে ব্যথা হলে জিহবার নিচে স্প্রে করবে।
সেদিনের মতো বাবাকে নিয়ে বাসায় আসলেও মনে শান্তি ছিল না, বাবাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আর বার বার আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। সেজো বোন বললো বাবাকে আমার বাসায় নিয়ে যাই, বাসাটা খোলা মেলা আছে। তাছাড়া আমার তো দু’টো রুম খালিই পড়ে আছে। বারান্দা আছে। আলো বাতাস সবই পাবে। সকলেই রাজি হলো। কিন্তু বাবা রাজি হলেন শর্ত দিয়ে-

-আমার সাথে যেন রণ আর ওর স্ত্রীও থাকে।
- থাকবে বাবা। মা, ভাই, আর ভাইয়ের বউ ওরাও থাকবে। কোন চিন্তা করবেন না।
রাতে বাবা তাঁর পছন্দের ভাটা মাছ, লাল শাক আর শেষ পাতে পাতলা মুশুর ডাল দিয়ে খেয়ে নিলেন। তখনও বাবা কিছুটা সুস্থ্যই আছে। কিন্তু রাত যখন তিনটে বাজে তখনই বাবা’র আবার সেই ঘাম আর শ্বাসকষ্ট, বাবা তো ওঠেই বসতে পারছে না। মা আর স্ত্রী বুকে তেল মালিশ করছে। আমি পায়ে তেল মালিশ করছি। মা বার বার কি সব বলে-টলে বাবার সমস্ত গায়ে ফু দিচ্ছে। বাবা’র পায়ের উপর ঘুমিয়ে পরলাম। মা বললো
-ও পাশের রুমে মশারি টাঙানো আছে, যা এখন একটু ঘুমিয়ে নে। ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই, এখন তোর বাবাকে তো হাসপাতালেও নেওয়া যাচ্ছে না, সকালে একটা এম্ব্যুলেন্স ডেকে হাসপাতালে ভর্তি করাবো। তুই দেখিস ঠিক হয়ে যাবে সব। আমি মায়ের কথায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে গেলাম। পাঁচ মিনিট হয়তো চোখ আমার বন্ধ ছিল। এরপরই ভীষণ চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়, বোন আর বোন জামাইও ছুটে আসে, কিন্তু ততক্ষণে বাবার সমস্ত শরীর নিস্তেজ পরে আছে, ঠান্ডা গালে একের পর এক চুমু দিচ্ছি কই বাবা তো উঠছে না, বুকে পাম্প করেও কাজ হয় নি। হাসপাতালে নিলে ডাক্তার সব চেষ্টা করে জানালো ‘নেই’ তিনি। বাবা চলে গেলেন, শুধু দেহটা পরে আছে জড় আর নিথর। কথা নেই শ্বাস নেই।
বাবা নেই এটা ভাবার কোন প্রশ্ন বা যৌক্তিকতা আমার কাছে নেই। কারণ তাঁর রক্ত আমার শরীরে, তাই বাবাও আমার আত্মার সাথে মিশে আছে। আজ আমিও বাবা হয়েছি, বাবা’র সমস্ত শিক্ষা সততা আর নিষ্ঠা বিলিয়ে দিয়ে চেষ্টা করছি আমার সন্তানকেও মানুষ করার। আজ আমিও বাবার মতো সংসার করা শিখেছি, বাজার করা শিখেছি আর শিখেছি সন্তানকে মানুষ করা। আমিও আজ সন্তানের হাত ধরে বাজারে নিয়ে যাই, বাবার মতো করে চেষ্টা করি ছাত্র/ছাত্রীদের পড়াতে। জীবন সম্পর্কেও শিখাচ্ছি। আমিও এ জগতে চীরকাল থাকবো না। এখানে কেউ স্থায়ী নয়। শুধু যে বাবাটা চলে যান তাঁর জায়গাটা শূন্য-ই পরে থাকে। বেঁচে থাকে বাবাদের দেয়া শিক্ষা, তাদের সততা আর নিষ্ঠা। বাবারা তাদের সকল স্বাদ আহ্বলাদ মাটি চাপা দিয়ে সন্তাদের মানুষের মতো মানুষ করে শুধু মাত্র ‘বাবা’ নামক শব্দটার পবিত্রতা আর সুনাম যেন বেঁচে থাকে লক্ষ কোটি বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুলিখিত, খুবই সুন্দর অনুভব । পাঠে মুগ্দ্ধ আমি ।
ধন্যবাদ প্রিয়, ভালোবাসা রইল।
বিষণ্ন সুমন বাবারা এভাবেই হারিয়ে যায়। ভারী কষ্টের গল্প।
ভালোবাসায় থাকুন প্রিয়।
শাওন আহমাদ যেদিন ভোরবেলা আমার আব্বা মারা যান, সেদিন আমরা সবাই মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিলাম আর ভাবছিলাম; আব্বাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? বাবারা বটবৃক্ষের ন্যায় আমাদের আগলে রাখেন ছায়া দিয়ে।
সেই ছায়াটা হারায় না কখনও, আমিও এখন আমার সন্তানের ছায়া, এভাবেই ছায়াগুলো জীবন্ত থাকে কিন্তু বৃদ্ধ হয় না হারায় না। ভালোবাসা রইল প্রিয়।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বাবার জন্য

০৭ জুলাই - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ১৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪