শিমুর স্বপ্ন

শিশু (সেপ্টেম্বর ২০১৯)

তোজাম্মেল হক খোকন
  • ৮০৩
ক্লাস শেষে বাইরের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছে রিফাত, মুন, রেবেকা আর সুইটি । তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথ পড়ে । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই তারা খুব ভালো বন্ধু । ক্লাসের ফাঁকে একসাথে আড্ডা দেওয়া যেন তাদের নিয়মিত অভ্যাস । কোথাও গেলেও চারজন একসাথেই যায় । প্রতিদিনের মতো ক্লাসের ফাঁকে আজো তাদের জমজমাট আড্ডা চলছে । আড্ডায় আলোচনা হচ্ছে স্বপ্ন নিয়ে। প্রত্যেকেই নিজের স্বপ্ন বন্ধুদের সাথে শেয়ার করছে । রিফাতের স্বপ্ন, সে কানাডায় গিয়ে পড়াশুনা শেষ করবে । রেবেকার স্বপ্ন শিক্ষিকা হবে । মানুষকে সুশিক্ষা দিবে । সুইটিকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয়, তার কোন স্বপ্ন নেই। আসলে, স্বপ্ন সবারই থাকে। শুধু কিছু মানুষের স্বপ্ন পূরণের সাহস থাকে না। আর, স্বপ্ন পূরণের সাহস না থাকলে, স্বপ্নটাই মূল্যহীন মনে হয়। সে কারণেই, অনেকে নিজের স্বপ্ন প্রকাশ করতে চায় না। সুইটির ব্যাপারেও হয়তো এমন কিছু হয়েছে। কিন্তু সবার স্বপ্ন শুনে, সে নিজের স্বপ্ন গোপন করবে, তা তো হয়না! তাকে জোর করেই সবাই যেন তার স্বপ্নের কথা বলতে বাধ্য করছে। মুন বলে উঠলো, আমি সুইটির স্বপ্ন সম্পর্কে জানি। এমন কথা শুনে সবাই মুনের দিকে তাকালো। কী এমন স্বপ্নের কথা জানে সে? সুইটি মুনকে প্রশ্ন করলো, কী জানিস? তোর ইচ্ছা একটা টাক ওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করা, বলে হো-হো করে হেসে উঠল মুন। আর মুনের স্বপ্ন তো আগেই জানিয়েছে। নিজস্ব একটা বিমান কিনবে সে। আড্ডার এমন মুহূর্তে রিফাতের দৃষ্টি আটকে গেলো অদূরেই ঘটিত কোন এক ঘটনায়। একটি মিষ্টি শিশু একজনকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শিশুটির কথা না শুনে, তাকে তাড়িয়ে দিয়ে, পাশের জনের সাথে গল্পে মেতে আছে। আসলে, আমরা তো এমনই । কেউ কোন মুল্যবান কথা বললে সেটা বিরক্তিকর লাগে, কিন্তু অহেতুক গল্পগুজব করে সময় কাটাতে খুব মজা লাগে । কিছু সময় পরে, শিশুটিকে আড্ডার দিকে আসতে দেখা গেল। রিফাত সবাইকে শিশুটির দিকে দেখিয়ে বললো, দেখো কী মিষ্টি শিশুটি! শিশুটি কাছে আসলে, রেবেকা ছোট্ট শিশুটিকে প্রশ্ন করলো, তোমার নাম কী? শিশুটি ছোট্ট করে উত্তর দিলো, শিমু । রিফাত ছোট্টো শিমুকে আদর করে বললো, তোমার স্বপ্ন কী? শিমু বললো, আমার স্বপ্ন হলো আমার মাকে নিয়ে একদিন পেট ভরে ভাত খাবো । সবাই এই কথা শুনে কেমন হতভম্ব হয়ে গেলো। সকলেই চুপচাপ শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো সবাই ভাবছে, আমরা তো প্রতিদিনই প্রতিসন্ধ্যায় পেট ভরে খাই । তাই হয়তো আমাদের পেট ভরে ভাত খাওয়াটা স্বপ্ন নয়। আমাদের স্বপ্ন নিজের একটা বিমান কেনা, অথবা উন্নত কোন দেশে গিয়ে বিলাস বহুল জীবন যাপন করা। আসলে স্বপ্ন সাধারণত আকাশ ছোঁয়া হয়েই থাকে। কিন্তু যারা কখনো পেট ভরে ভাত খাইনি, তাদের কাছে পেট ভরে ভাত খাওয়াটাই একটা আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। শিমু তোমার মা কোথায় থাকেন? রেবেকা জানতে চাইলো । ছোট্ট শিমু উত্তর দিলো, পাশের বস্তিতে আমার মা আর আমি থাকি। মা অনেক অসুস্থ। আমার সাথে তোমরা যাবা? শিমুর এমন আবেদনে সবাই রাজি হয়ে গেলো। একসাথে সবাই চললো শিমুর বাড়িতে। তার অসুস্থ মাকে দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই পৌঁছে গেলো শিমুর বাড়িতে। অনেকগুলো ঠাসাঠাসি বাড়ির মধ্যে শিমুদের বাড়ি। আসলে বাড়ি বলতে একটা টিনের একচালা ঘর। সেই ঘরে শিমু আর তার মা থাকে। বাড়িতে ঢুকে শিমুর বৃদ্ধ মাকে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখলো সবাই। তিনি একা শুয়ে আছেন। ছোট্ট শিমু কী করবে, তা বুঝতে না পেরে কাউকে হয়তো খুঁজতে গিয়েছিলো। তাই হয়তো তাদের ডেকে এনেছে। এতটুকু ছোট্ট শিশুর মাথায় এমন বুদ্ধি দেখে হয়তো আশ্চর্য হওয়ারই কথা। কিন্তু, পরিস্থিতি মানুষকে অনেক সময় অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। শিমুর মা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তরে রিফাত বললো, আমরা শিমুর বন্ধু। আসলে, বন্ধু হতে তো কোন বয়স লাগেনা। যে কোন বয়সের মানুষের সাথে যে কোন মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে। বন্ধু হয়ে একজন অন্যজনের সাহায্য করতে পারে। শিমু আর তার বন্ধুরা সবাই মিলে শিমুর মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। শিমুর মা কাঁদতে কাঁদতে শিমুর সব কথা খুলে বলতে শুরু করলেন। তিনি যেন এতোদিন তাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন। আসলে তিনি শিমুর আসল মা নন। তিনি একদিন ভিক্ষা করে বাড়ি ফেরার পথে ডাস্টবিনের পাশে ক্রন্দনরত ছোট্ট শিমুকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। সেদিন আকাশে অনেক বিদ্যুত চমকাচ্ছিলো। সেই গভীর রাতে শিমুকে ডাস্টবিনের পাশে দেখে অনেক মায়া হয়েছিলো তার। তাই তিনি এই ছোট্ট শিমুকে ফেলে রেখে যেতে পারেননি। কুড়িয়ে এনে আদর, যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন তাকে। আসলে, রাস্তা থেকে মানুষ কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো মহান কাজগুলো বস্তির ভাঙা ঘরে থাকা মানুষগুলোই করে থাকেন। কারণ,অসহায়ত্ব কী জিনিস তারা সেটা বুঝে। তাদের তো আর উচ্চ ভদ্র লোকের মতো মান-সম্মান হারানোর ভয় নেই । যাদের মান-সম্মানই নেই তাদের আবার মান-সম্মান হারানোর ভয় কীসের? মান-সম্মান হারানোর ভয় তো তাদের। যারা ভদ্রতার মুখোশ পরে সমাজে ঘুরে। অথচ, নিজেদের সামান্য ক্ষুধা মেটাতে অবৈধভাবে জঘন্যতম খেলা খেলে জন্ম দেওয়া শিমুর মতো নিষ্পাপ শিশুদের ডাস্টবিনের পাশে ফেলে যায়। আর সেই নিষ্পাপ শিশুদের ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনে লালন পালন করে বস্তির লোকেরা । যাদের পেট ভরে একবেলা ভালো খাবার খাওয়াটাই হচ্ছে স্বপ্ন। যেমনটি করেছেন শিমুর এই বস্তির মা। তিনি শিমুর কুড়িয়ে পাওয়া ও সংগ্রাম করে লালন পালন করার কথা শোনান। তার সব কথা শুনে ভবিষ্যতে শিমুকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় রিফাত, মুন, রেবেকা আর সুইটি। তারা নাহয় নিজেদের অতিরিক্ত খরচের টাকা জমিয়ে শিমুর জন্য রাখবে। তাদের এই প্রতিশ্রুতির কথা শুনে একটা শান্তির নিশ্বাস নেন শিমুর মা । কিন্তু, এ নিঃশ্বাস যে শেষ নিঃশ্বাস হবে সেটা কে জানতো! তিনি এই শাস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যান। কাঁদছে শিমু। কাঁদছে সবাই। শিমুর তার মাকে নিয়ে একদিন পেট ভরে ভাত খাওয়ার স্বপ্নটা আর পুরন হলো না। তার মা যে তাকে ছেড়ে ওপারে চলে গেছে।
( দুই বছর পর ) শিমুর মায়ের মৃত্যু দুই বছর হয়ে গেছে । শিমুকে একটা আবাসিক স্কুলে ভর্তি করেছে তার চার বন্ধু। তারা প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার শিমুর সাথে দেখা করতে যায়। শিমুকে কেন্দ্র করে তাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হয়ে গেছে। তারা শিমুর মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে শিখে গেছে। তাই তারা পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণ করে। মাঝে মাঝে আগের মতো আড্ডাও মারে। তবে আলোচনার বিষয় থাকে, কীভাবে অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো যায়? প্রতিদিন ক্লাসের ফাঁকে আড্ডার মতোই সেদিন আড্ডার সময় শিমুর আবাসিক স্কুলের শিক্ষিকার ফোন আসলো। শিমুর শিক্ষিকা বললেন, কোন এক মহিলা নাকি নিজেকে শিমুর মা দাবী করেছেন। শিমুর গলাতে পরপর তিনটি তিল ও আরো কয়েকটি চিহ্ন দেখে তিনি নাকি চিনতে পেরেছেন যে, শিমুই তার হারিয়ে যাওয়া সন্তান। শিমুকে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার পর সেই ভদ্র মহিলার নাকি আর কোন বাচ্চা হয়নি এবং তিনি নাকি আর কোনদিন মা হতেও পারবেন না। তাই তিনি নাকি খুব কান্না করছেন শিমুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা যখন কোন নিয়ামত দেন তখন বান্দা না বুঝেই সেটিকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেয়। আর যখন সৃষ্টিকর্তা সেটি দেওয়া বন্ধ করে দেন তখন বান্দা বুঝতে পারে, সে কী হারিয়েছে। কিন্তু, তখন আহাজারি করা ছাড়া আর কিছু থাকে না। শিমুর চার বন্ধু রিফাত, মুন, রেবেকা আর সুইটি হয়তো আজ ভাবছে শিমুর সেই স্বপ্নের কথা। শিমুর সেই বস্তির মায়ের সাথে পেট ভরে ভাত খাওয়ার স্বপ্নটা হয়তো সফল হয়নি। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তা কিছু সময় পরে তার জন্মদাত্রী মায়ের সাথে সারাজীবন ভাত খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে ছোট কিছু চাইলে তিনি অনেক সময় সেটি সাথে সাথে দেন না। কিন্তু কিছু ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে কিছু সময় পরে সেই চাওয়াটিকে অনেক বড়ো করে দেন। একটি ছোট্ট শিশু শিমুর ঘটনা রিফাত, মুন, রেবেকা আর সুইটিকে যে শিক্ষা দিলো তা হয়তো তাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে থাকবে। যে, জীবনটাকে অবৈধ চাহিদা পূরণের জন্য ঠেলে না দিয়ে সমাজের বিভিন্ন কাজে লাগানো যায়। ভালো থাকুক শিমুরা, ভালো থাকুক সবাই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান তোজাম্মেল ভাই, প্রথমেই জানিয়ে রাখি গল্পটি ভাল লেগেছে। পরে যেটা বলতে চাচ্ছি আর সামান্য ঘষা মাঝা দিলে গল্পটি অনবদ্য হয়ে উঠতো। গল্পের পরিবেশ বলছে শিমু দ্বিতীয় মায়ের কাছে যেতে পারে এখানে আরও কিছু বাড়তে পারতো। যা হোক আরও গল্প আশা করছি।
ভালো লাগেনি ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯
ইনশাআল্লাহ । আগামীতে গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করবো । অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
ভালো লাগেনি ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

"শিমুর স্বপ্ন" গল্পে, আমাদের এই অসুস্থ সমাজে একজন নিষ্পাপ শিশু কতটা অবহেলিত হতে পারে, সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের সমাজের ভদ্রতার মুখোশ ধারী কিছু কুলাঙ্গার মানুষ নিজেদের চরিত্রকে আড়াল করার জন্য মহামূল্যবান সম্পদ একটি শিশুকে মূল্যহীন ভেবে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করে না । আবার কিছু মানুষ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সেই মহামূল্যবান সম্পদ শিশুদের মুল্য বুঝতে পেরে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করে।

২৫ জুন - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪