চোখ খুলে বীণা দেখে চারদিক ঘুট়্ঘুটে অন্ধকার। প্রথমে ভাবে সে বোধহয় মরে গেছে, কেন যেন সব সময় মনে হয় মরে গেলে সব কিছু তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর চোখ যখন আঁধার সয়ে নেয়, তখন হঠাৎ মাথার উপরে ঘুরন্ত পাখাটা দৃশ্যমান হয়, তারপর কানে আসে ঘড়ির টিকটিক শব্দ। পরপারে এমন পার্থিব কিছু থাকার কথা নয়। স্বস্তি পাবার বদলে বীণার মনে হয়, ‘হায় খোদা, আমি এখনও বেঁচে আছি!’
মাথাটা ঈষৎ নাড়াতে গিয়ে টের পায় ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যাথা। সে যখন পালানোর চেষ্টা করছিল, লোকটা তখন পেছন থেকে গলাটা আঁকড়ে ধরেছিল মনে হয়। হাত-পা উরুতেও তীব্র ব্যাথা- মাংসপেশীগুলো যেন আর্তনাদ করে শরীর সঞ্চালনের প্রতিবাদ করছে। যন্ত্রনা উপেক্ষা করেই হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে বোঝে এখানে-সেখানে চামড়া ছিলে জ্বালা করছে। হাঁচোড়পাঁচোড় করে উঠতে গিয়ে মনে হয় নিজের শরীরটা কেমন যেন বেকায়দা অবস্থায় আছে। আচ্ছা ও কি এখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল নাকি জ্ঞান হারাবার পর শরীরটা এখানে এনে স্তুপের মতন ফেলে দেয়া হয়েছে? বীণা মনে করতে পারেনা।
অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি আরেকটু অভ্যস্ত হবার পর বীণা দেখে লোকটা ঘুমাচ্ছে। লোকটা যদি এখন দেখে ওর জ্ঞান ফিরেছে, তাহলে কি আবার মারবে? মনে হয় না। বাথরুমে যাওয়া দরকার, কিন্তু শরীরটাকে টেনে তোলার শক্তি নেই। বীণা ঝিম মেরে বসে রয়। যখন মনে হয় আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, কোন মতে নিজের শরীরটাকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে যায়।
বাথরুমে আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে যায় বীণা। ঠোঁট কেটে কেমন ঝুলে গেছে, চোখ ফুলে কেমন অদ্ভুত একটা নীল রং ধারণ করেছে। এই কি সেই বীণা? মা-বাবা বা শিক্ষক যার গায়ে কোনদিন হাত তোলার কারণ পায়নি, ভার্সিটির তূখোড় ছাত্রী, নামের মতনই রিনরিনে কন্ঠের গায়িকা? কিভাবে সেই জীবন থেকে এই বন্দি জীবনের ফাঁদে পা দিল সে? এর থেকে মুক্তির উপায় আছে কি? নাকি এভাবেই একদিন মরে যাবে বীণা?
আচমকা মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। বেসিন আঁকড়ে ধরে বীণা বাথরুমের মেঝেতে বসে পড়ে। কেমন যেন একটা তীক্ষ্ণ শব্দে ঝাঁ ঝাঁ করছে কানটা। বিকট শব্দ এড়াতে কান চেপে ধরতে গিয়েও ধরে না বীণা। আগে বুঝত না কিন্তু এখন সে জানে যে এই আওয়াজ বাইরে থেকে আসছে না, নিজের মাথার ভেতর থেকে আসছে। একবার লোকটা তার কানে প্রচন্ড জোরে মেরেছিল, তারপর থেকেই শুরু। প্রথম প্রথম মনে হত সে পাগল হয়ে যাবে। তারপর নিজে নিজেই ওষুধ বের করেছে। এমন হলে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে যে সে অন্য কোথাও, খুব আনন্দের কোন স্থানে। সব সময়ই কেন যেন সেটা একটা মাঠের মধ্যে গানের অনুষ্ঠানে হয়। তারপর সে বুক ভরে বাতাস নেয়, চিন্তা করার চেষ্টা করে সে রজনীগন্ধার মালা দিয়েছে খোপায়, পড়েছে পাটভাঙা কড়কড়ে তাঁতের শাড়ি। তীক্ষ্ণ শব্দ ছাপিয়ে তখন কানে আসতে থাকে প্রিয় কোন গান।
আমি ভয় করব না ভয় করব না
দু বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না…
আজকের গানটা অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন। বীণা আস্তে আস্তে চোখ খুলে। ‘দু বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না…’
সে কেন মরার আগেই মরে যাচ্ছে? নিজেকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু কিভাবে? সে যদি এ বাসা থেকে কোনমতে বেরও হতে পারে, তারপর সে কোথায় যাবে? তার কাছে তো কোন টাকা নেই। এ শহরে সে কাউকে চেনে না। হঠাৎ মনে পড়ে শাড়ির দোকানে একদিন বড় ভাইয়ার বন্ধু রায়হান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। বীণাকে দেখে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন কিনা কে জানে, হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে সন্তর্পণে বলেছিলেন, ‘যে কোন দরকার হলে ফোন করো, রফিকের বোন মানে তুমি আমার বোন’।
সেই কার্ডটা কি রেখেছিল না ফেলে দিয়েছিল? মনে করতে পারে না।
পা টিপে টিপে বাথরুম থেকে বের হয়। ঘরের এক কোণায় পড়ার বইটা পড়ে আছে। এই বই পড়ার জন্যই তো যত বিপত্তি। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা বলে বিকেলে পড়ছিল। তাতেই লোকটার মা কথা লাগালো যে বীণা রান্নার কাজ ফাঁকি দেয়ার জন্য বাহানা করেছে। লোকটার মনে হয় আগে থেকেই মেজাজ খারাপ ছিল, রাগের পুরোটাই ঝেড়ে দিল বীণার শরীরে। আক্রমণ এড়াতে পালিয়ে বাথরুমে ঢোকার চেষ্টা করেছিল বীণা, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হল, অন্যদিনের চেয়ে বেশি আক্রোশে তাকে মারা হল।
পা টিপে এগিয়ে আহত বইটা তুলে নিয়ে মনে পড়ে কার্ডটা ফেলে দিলেও নাম্বারটা সে বইয়ের পাতায় লিখে রেখেছিল কেন যেন। কিন্তু ফোন করবে কিভাবে? লোকটার মায়ের ফোনটা বসার ঘরে অনেক সময় চার্জে দেয়া থাকে, সেটা আছে কি না দেখবে নাকি?
বসার ঘরের দিকে যেতে গিয়ে আবার একটা হোঁচট খায়। উত্তেজনায় সর্বাঙ্গে ব্যাথার কথা ভুলে গেছিল বীণা, অবশ্য সেটা নিয়ে ভাববার সময় এখন না।
হ্যা, আছে, ওই তো ফোনটা। আঁচলে ফোনটা লুকিয়ে আবার বাথরুমে চলে আসে। গভীর রাত, এ সময় কাউকে ফোন করা ঠিক না। রায়হান ভাইকে ছোটবেলা অনেক দেখেছে, কিন্তু বহু বছর যোগাযোগ নেই। আচ্ছা, সাহায্য চাইলে কি উনি করবেন? মনে আছে মিমি কেনার বায়না করলে উনি নিয়ে আসতেন। সেই ফ্রক-পরা মেয়ের কথা মনে করে কি উনি আজ বীণার জন্য এগিয়ে আসবেন?
কিন্তু সাহায্য না চাইলে, সে প্রশ্নের উত্তর জানার কোন উপায় নেই। দিনে ফোন করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এখন ছাড়া এ সুযোগ আর পাওয়া নাও যেতে পারে। বীণার নিজের ফোন বিয়ের পরপরই ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। মা-বাবার বাড়ির কারো সাথে কথা বলবার সময় লোকটা বা তার মা সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন সে কোন বেফাঁস কথা বলে ফেলতে না পারে।
কাঁপা হাতে বীণা নাম্বারটা ডায়াল করে। বাহ, কী সুন্দর রিংটোন- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি…’
আজকে এসব গানই ওর কাছে আসছে। হ্যা, ওকে যুদ্ধ করতেই হবে।
কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোনে সাড়া দেয় না। মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে রাত বাজে তিনটা, অচেনা নাম্বার থেকে ফোন না ধরারই কথা।
নিরাশ হয়ে বীণা ভাবে, আজ আর হল না। অন্য কোনদিন।
তারপর কি মনে করে মায়ের নাম্বারে ফোন দেয়। মায়ের ঘুমের সমস্যা আছে, দুবার ফোন বাজতেই ধরে ফেলেন।
‘বেয়াইন, এত রাতে? সব ঠিক আছে?’
‘আম্মা,’ পরিচিত গলা শুনে বীণা ফুপিয়ে ওঠে, ‘আম্মা, আমাকে নিয়ে যাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’
‘শান্ত হ, মা। শান্ত হ। জামাইয়ের সাথে ঝগড়া হইসে?’
‘মা, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।’
‘এমন করে না, মা। তোর বড়ভাই ছুটি পাইলে তোকে নিয়ে আসতে বলব। কিন্তু এখন নাকি অফিসে অনেক কাজ…’
‘আম্মা, আমার সময় নাই। আমাকে মেরে ফেলবে। রায়হান ভাইয়ের ফোন নাম্বার পাইছি, সে ফোন ধরলে আমি তাকে বলব আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে।’
‘তোর কি মাথা খারাপ হইছে? তুই আরেক ব্যাটাছেলের সাথে বাড়ি ফিরলে লোকে কি বলবে? একটু ধৈর্য্য ধর, মা। রফিক ছুটি পেলে কয়টা দিন থেকে যাস। সংসার করতে হলে একটু কষ্ট করতে হয়, মা।’
‘আচ্ছা আম্মা, রাখি।’ বীণা ফোন রেখে দেয়।
মুক্তির উত্তেজনায় সে ভুলে গিয়েছিল যে আজ যদি সে অন্য পুরুষের সাহায্য নিয়ে ঘর ছাড়ে, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে। আর এই স্বামী নামক পিশাচের বাড়ি ছেড়ে সে কোথায় যাবে? ‘কবুল’ বলার পর থেকেই তো বাবা-মা তার দায়ভারমুক্ত হয়েছেন।
কিন্তু এটাই ভার্সিটির শেষ পরীক্ষা। কোনমতে পরীক্ষা দিয়ে যদি সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে কি মুক্ত হতে পারবে? কিন্তু যদি না পারে, যদি এই বাড়ি থেকে পালিয়ে সে আর কোন বাড়িতে জায়গা না পায়? গলায় একটা দলা অনুভব করে বীণা, সুখ-স্বপ্ন দেখতে যে বড্ড ভয় হয়।
হঠাৎ দেখে ফোনটা ভাইব্রেট করছে। রায়হান ভাইয়ের ফোন নাম্বার থেকে কল। বীণা কাঁপা হাতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন ভয়টা বড়- মৃত্যু ভয় নাকি সমাজের ভয়?