ভোর রাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল নাজিয়ার। অগ্রহায়ণ মাস পড়েছে। বাতাসে শীতের আমেজ অনুভূত হচ্ছে। গা শিরশির করতে লাগলো নাজিয়ার। বিছানা থেকে উঠে ফ্যান অফ করে দিল সে। আবার বিছানায় শুয়ে পড়তেই সকালের একটা আলসেমি ছড়িয়ে পড়লো শরীরে। শুয়ে থাকলো বিছানায়, খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো। কিন্তু আর ঘুম আসলো না।
একটু পরে বারান্দায় বের হয়ে আসলো নাজিয়া। নীচ তলায় বাবা-মার পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। নাজিয়াও নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
নামাজ সেরে নাজিয়া দোতলার বারান্দায় এসে বসলো। সকালের আভা ফুটতে শুরু করেছে। মৃদু পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। চারিদিকে একটা নিস্তব্দ অথচ মায়াময় পরিবেশ!। অনেক দিন পরে বাড়ি এসেছে নাজিয়া। বাড়ি বলতে বাবার বাড়ি। তিন বছর বিয়ের বয়স হয়েছে তার। বাবা তার এক পরিচিতের দ্বারা খোঁজ পেয়ে পারিবারিকভাবে সেলিম আর নাজিয়ার বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের এক বছর পরে সেলিম চলে যায়। সেলিম চলে যাবার পরে শ্বশুরবাড়িতে থাকার চেয়ে নিজের মত থাকাকে শ্রেয় মনে করেছে সে। নাজিয়া তার দুই বোন রাণী কিংবা সাথীর মত না। সে নিজের মত করে থাকতে চায়। প্রথমে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছিল। পরে সেখান থেকে এসে একটা এনজিওতে চাকরি নিয়েছে। তার কর্মস্থলের পাশে একটা মহিলা হোস্টেলে থাকে সে। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো নাজিয়া। তবে মাঝখানে গতবছর নবান্নে সে বাড়ি আসেনি। চাকরিতে ছুটি পায়নি। এবার নবান্নে বাবা মা তাকে ছুটি নিয়ে আসতে অনেক অনুরোধ করেছে। বাড়িতে তার দুই মেয়ে রানী আর সাথী জামাই নিয়ে নতুন চালের পিঠাপুলির দাওয়াতে আসছে। বাড়িতে নবান্ন উৎসবে অনেক পিঠা বানানো হবে। সেখানে নাজিয়া থাকবে না তা হয় না।
দোতলার বারান্দায় বসে দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে নাজিয়া। তাদের দুইতলা পাকা বাড়িটা গ্রামের শেষের দিকে ফাঁকা জায়গায়। মাঠের ধানগুলো কাটা প্রায় শেষের দিকে। কিছু জমিতে ধান কেটে ফেলে রেখেছে কৃষকরা। সেসব দেখতে দেখতে নাজিয়া আনমনে তার অতীতে ফিরে গেল। সকালবেলা হাঁটতে হাটতে জমির আইল দিয়ে বেড়াচ্ছে সেলিম আর নাজিয়া। লোকজন এখনো তেমন রাস্তাঘাটে বের হয়নি।
সেলিম নাজিয়াকে বলছে----
-তুমি এত দূরে দূরে আছো কেন?
-আমি দূরে দূরে কিভাবে? আমি তো তোমার কাছেই আছি।
-আরো কাছে আসো।
-এহ শখ কত.... কেউ দেখুক!
-দেখলে দেখবে, তাতে কি?
-সবাই বলবে জহিরুলের মেয়ে আর জামাই কি বেহায়া! --বলতে বলতে তারা একটা ফাঁকা জমিতে নেমে গেল।
এসময় সেলিম অনেকটা জোর করে নাজিয়াকে কাছে টেনে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললো----
-লোকজন দেখুক তাদের গ্রামের মেয়ে স্বামীর ঘরে কেমন আদর ভালবাসা পাচ্ছে!.... হাহাহাহা
-ছি ছি ছি....
-তুমি এমন ভাবে ছিছি করছো মনে হচ্ছে কেউ দেখে ফেলেছে।
-আরে দেখে ফেলতে আর কতক্ষণ!
-তুমি এত লাজুক কেন?
-কেন লজ্জা কি খারাপ?
-তা খারাপ না।
-তবে?
-তবে তোমার সাথে কথা বললে বোঝা যায় না তোমার এত লজ্জা আছে।
-কি! আমাকে দেখে কি বোঝা যায়!?
-বোঝা যায় তুমি আমার আগে জনে জনে ভালবাসা নিবেদন করেছো...হাহাহা...
-সেলিম! ভালো হচ্ছেনা...
-কাছে টানতেও দেবেনা আবার রসিকতাও করতে পারবো না?
সেলিম আর নাজিয়া আরো কিছুক্ষণ এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে বাড়িতে ফিরলো।
বাড়িতে ফিরে একটু পরে নাজিয়া সেলিমের জন্য নাস্তার ট্রে সাজিয়ে আনলো। মা তার নতুন জামাই এর জন্য অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেই এসব রান্না করেছে।
সেলিম নাস্তার ট্রে দেখেই বলতো----'বাহ এই না হল শ্বশুরবাড়ির মজা! সকাল হতে কি না হতেই খাবারের ট্রে হাজির। মেসে থাকলে তো খালি পাতলা ডাল আর তরকারি।'
নাজিয়া তখন মনে মনে ভাবতো, 'ছেলেটা কি খেতে পায়না নাকি? এত খাই খাই স্বভাব কেন?'
নাজিয়া পরে বুঝেছিল সেলিম সব কিছু নিয়ে রসিকতা করতে পছন্দ করে।
'নাজিয়া, নাজিয়া....নিচে নেমে আয় তো....'--বাবার ডাকে দিবাস্বপ্ন ভাঙলো নাজিয়ার! এতক্ষণ ধরে সে বেশ একটা আনন্দের জগতে ছিল। সেলিমের কথা ভেবে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে নিচে নেমে গেল।
ঘড়িতে দেখলো ৮টা বাজে। নিচতলায় রান্নাঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মা তার দুই জামাই এর জন্য নাস্তা তৈরি করছে। নাজিয়া সেখান থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসলো। বাবা বারান্দায় বসে আছে।
বাবা বলল, 'নাজিয়া মা, তুই কতদিন পরে বাড়ি আসলি জানিস?
-কি জানি বাবা...
-প্রায় ৭ মাস
-হবে হয়তো....
-তোর কি নিজের বাড়িতে আসতে ভাল লাগেনা!?
-আসলে বাবা ব্যাপারটা তা না। আমি তোমাদের ছাড়া সমাজে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। তাছাড়া এখানে আসার সুযোগ মেলে ছুটির সময়ে। সে সময়ে আসা মানে সেলিমের সাথে এ বাড়িতে ছুটি কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে....
-তোর কষ্ট আমি বুঝি মা। কি করবি বল মেনে নিতে হবে।
-আমি যেন মেনে নিতে পারি সেজন্যই এখানে আসিনা বাবা।
-তাই বলে আমাদেরকে দেখতে তোর মন চায় না!
-বাবা তোমরা তো আমাকে সারাজীবন নিজেদের কাছে রাখতে পারবেনা। শুধু শুধু আমাকে কিছু দিনের জন্য মায়ার জালে বেঁধে আমার মনটা নরম করে দিও না বাবা...
-তোকে তো বলি তোর জন্য ছেলে দেখি,তুই তো রাজি হসনা।
-বাবা, এক জীবনে কয়বার সম্পর্কে জড়াবো বলো? আমার ভাগ্যে যদি সুখ থাকে তবে আমি এভাবেই ভাল থাকবো। আর যদি সেটা না পাই তবে বিবাহিত জীবনও সুখের হবেনা।
-এই অল্প বয়সে এত দার্শনিক চালে চলতে শুরু করেছিস?
-উপায় নেই বাবা, রাণী আর সাথীর সাথে আমার তুলনা করোনা, আমাকে তো এভাবেই চলতে হবে।
নাজিয়া চোখ মুছতে মুছতে উঠে গেল। রান্নাঘর থেকে মার ডাক শোনা গেল। নাজিয়া মার কাছে গেল। মা তাকে বলল, 'দেখতো মা সাথী আর রানী উঠলো কি না?'
নাজিয়া উপরে উঠে গেল। সাথীর ঘরের কাছে যেতেই নবদম্পতির খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল। নাজিয়া বাহিরে থেকে বললো, 'সাথী নিচে যা। মা তোকে ডাকছে।'
এরপর নাজিয়া রানীর ঘরের দিকে গেল। ঘরের ভিতর থেকে রানীর কন্ঠ শোনা গেল, 'তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো।' নাজিয়া বাহিরে থেকে বললো, আপা মা তোকে নিচে ডাকছে।'
নাজিয়া দুই বোনকে ডাক দিয়ে নিজের ঘরে এসে বসলো। সাথীর খিলখিল হাসির শব্দ শুনে নাজিয়ার মন ভারি হয়ে উঠলো। তার নিজের নববিবাহিত জীবনের স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটির কথা মনে পড়ে গেল। দুই বছর আগে এমন সময়ে সেলিমকে ডেকে তুলতো সে। সকালবেলা সেলিম উঠতে চাইতো না। নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে চাইতো। অনেক কষ্টে নাজিয়া উঠে নিচে যেত....
'নাহ এ বাড়িতে নবান্নে ছুটি কাটানো যাবেনা। অন্য সময়ে আসতে হবে।' --ভাবলো নাজিয়া।
নাজিয়া নিচে আসলো। মা দুই জামাই এর জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ট্রেটা দেখেই নাজিয়ার সেলিমের কথা মনে পড়লো। রানী আর সাথী নাস্তার ট্রে নিয়ে গেল। তাদের মুখের হাসির ঝিলিক দেখে নাজিয়ার মন আবার ভারি হয়ে গেল।
দুপুরবেলা। নাজিয়ার সাথে বাবা মা বসে আছে তাদের ঘরে। মা লিস্ট করছেন। নবান্ন এসে গেছে। মা তার জামাইদের দাওয়াত করেছেন। কি কি পিঠা আর খাবার তৈরি করা হবে, বাবার সাথে পরামর্শ করছেন। বাবা মার কাছ থেকে শুনে শুনে বাজারের লিস্ট সাজাতে লাগলেন---
১/দুধ
২/গুঁড়
৩/চিনি
৪/সাদা এলাচ
৫/নারিকেল
৬/সয়াবিন তেল,
৭/ঘি,
৮/জাফরান
৯/মধু
১০/ময়দা
১১/তেজপাতা
১২/দারুচিনি
নাজিয়া বলল, 'মা, কি কি পিঠা তৈরি হবে?'
মা বললেন, 'পুলি পিঠা,পাকান, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, নারিকেল নাড়ু, দুধরাজ, ভাপা পিঠা করার পরিকল্পনা করেছি। আর ঝাল পিঠার মধ্যে কালাই পুরি।'
নাজিয়া বলল, 'মা তোমার হাতের পিঠা জামাইরা একবার খেলে আর কোন বছর তারা নবান্ন মিস করবেনা। তাদের হাতে যত কাজই থাকুক তারা নবান্নের সময়ে জরুরি ছুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি আসবে।'
মা বললেন, 'এহ...কথার কি ছিরি!
নাজিয়ার বাবা বাজারে গেলেন। সেদিন সন্ধ্যায় পিঠা বানানোর সব উপকরণ চলে এলো নাজিয়াদের বাড়িতে। নাজিয়া এসব উপকরণ দেখে আবার ফিরে গেল দুই বছর আগে। সেলিম তাকে বলছে----
-নাজিয়া, তোমার বাবা এসব কি করেছে?
-কেন?
-তোমার বাবা কি পিঠার ব্যবসা করেন?
-কেন!?
-এতগুলো গুড়, নারিকেল দিয়ে কি হবে?
-আরে তুমি এসেছো, তোমাকে খাওয়াতে হবেনা? একে তো নতুন জামাই তার উপর প্রথম নবান্ন...
-তাই বলে এত গুড়, নারিকেল?
-আরে আমাদের বাড়িতে বাবা এটা প্রতি বছর করেন। কালকে দেখো মার হাতের পিঠা খেতে আমাদের বাড়িতে কারা কারা আসে? মার তৈরি নতুন চালের গুড়োর পিঠা একবার খেলে মনে হবে আরো খাই, আরো খাই।
নাজিয়া স্বপ্ন ভেঙে ফিরে এলো। তার মন ভারি হয়ে গেল। সে নিজের রুমে চলে আসলো।
পরদিন দুপুরবেলা বাড়িতে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে গেল। সকাল থেকে নারিকেল কোড়া, নারিকেল কাটা নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিল। খেজুরের গুড় ভাঙা আর গলানো হয়েছিল সাথে। দুপুরবেলা রান্নাঘর এবং গোটা বাড়িতে এক পিঠাময় পরিবেশ তৈরি হলো!। থেকে থেকে দুধ জ্বাল করার মিষ্টি ঘ্রান ভেসে আসতে লাগলো। একটা বিড়াল রান্নাঘরের বাহিরে মিউমিউ করতে লাগলো। নাজিয়ার মা দক্ষ হাতে পিঠা বানাতে লাগলেন। তাকে সাহায্য করছে রাণী আর কাজের মহিলা। নাজিয়ার বাবার দাওয়াতে নাজিয়ার ফুপুরা এসেছে। বাড়িতে আজ অন্যরকম পরিবেশ।
বিকেলবেলা। নাজিয়ার বাবা সবাইকে নিয়ে পিঠা খেতে বসেছেন। এটা তার পারিবারিক নবান্ন উৎসব। সবার সামনে পিঠার থালা। নাজিয়া একটা পিঠা হাতে নিয়ে এক কামড় বসালো। আবারও নাজিয়া ফিরে গেল দুই বছর আগে!। সেলিম নতুন জামাই হয়ে নাজিয়ার সাথে পিঠা খাচ্ছে। পিঠা খাচ্ছে আর মায়ের পিঠার প্রশংসা করছে।
কিছু একটার শব্দে তার দিবাস্বপ্ন ভাঙলো! আত্মপ্রত্যয়ী নাজিয়া আর পারলো না সহ্য করতে। সে বলল, 'বাবা তোমরা খাও তো, আমি একটু আসছি।' নাজিয়া উঠে গেল।
সেদিন রাতের বেলা নাজিয়া তার ঘরে শুয়ে আছে। বাবা ভিতরে আসলেন। তিনি বললেন-----
-নাজিয়া তোর কি শরীর খারাপ?
-না বাবা...
-তবে কি মন খারাপ?
-কিছুটা বাবা।
-তুই যদি কিছু বলতে চাস তো বলে ফেল...
-বাবা আমি কাল চলে যাব...
-কেন!
-আমি তোমাদের নবান্ন উৎসব মেনে নিতে পারছি না বাবা। তোমাদের এই পিঠার উৎসব বারবার আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমি শক্তপথ চলার শক্তি হারিয়ে ফেলবো।
-কেন?
-আমি বারবার সেলিমের জন্য কষ্ট পাচ্ছি। এই নবান্ন তোমাদের জন্য আনন্দের বাবা কিন্তু আমার জন্য কষ্টের...তুমি সবাইকে নিয়ে আনন্দ করো বাবা।
-নাজিয়া এ কি বলছিস তুই!
-বাবা আমাকে ক্ষমা করো, আমি তোমাদের উৎসবে থাকতে পারছিনা...
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
স্মৃতিকাতর নাজিয়ার বেদনাময় নবান্নের কথা
১১ জুন - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
২০ টি
সমন্বিত স্কোর
৩.৫৯
বিচারক স্কোরঃ ১.৪৯ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.১ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪