স্বপ্ন হারা মা

মা (মে ২০১৯)

Saniul Alam
  • ২৩
বসন্তের প্রায় মঝামাঝি। চারদিকে ফুলের ছুয়াছুয়ি। মুখে হাসি আর হাতে ফুল নিয়ে যখন সবাই আনন্দে মেতে উঠে, তখন মুক্ত আকাশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঈশানের মা। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। সবাই বলে তার মুখে নাকি কখনোই হাসি দেখা যায় নি। একা একা থাকে, আর জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে।
গ্রামের নাম চানকলি। অভাবের দিনগুলি ছিল। তার ঘরে কোনো আয় ছিলো না। পুকুরের পাশে আম ঘরের নিচে তাদের ঘর। এক পাশে বাঁশের বেঁড়া, অন্যপাশে বেতের বেঁড়া। উপরে খড় দিয়ে বিছানো ঘরের ছাউনি। অল্প বৃষ্টিতেই যেনো ঘরের ভিতরে পানি ডুকে যায়। সমাজে এদের স্থান প্রায় নিন্ম স্থরেই। ঈশানের বাবা ছিলো রিকশা চালক। তবে নিজের রিকশা না, অন্যের রকশা চালাত আবার দিন শেষে অর্ধেক টাকা দিয়ে দিতে হতো। কখনো সে বেশি আয়ের মুখ দেখে নি। ঈশানের বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর। গ্রামের ছোট ছেলেদের সাথে খেলাধুলাই ছিলো তার কাজ। ছোট একটি স্কুলে পড়তো সে। স্কুলে বেতন ছিলোনা, আবার ছাত্রও ছিলোনা। পাচঁ-ছয় জনের মতো হবে। বাবা মার কষ্ট হলেও কখনো ছোট ঈশানকে কষ্ট দিতে চাইতো না। যখন যা আবদার করতো সবটুকুই পূরণ করার চেষ্টা করতো তারা। ঘরে ছিলোনা বিদ্যুৎ, তবুও রাতে ঘুমানোর সময় সারা রাত হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে যেতো ঈশানের মা। ঈশানও ছিল তখন শান্ত ছেলে। কখনো কারো সাথে রাগ করতো না। এমনকি ঝগড়া করা থেকেও বিরত থাকতো। সমাজের মানুষদের কাছে সে ছিলো প্রশংসনী। স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে আদর করতো।
ঈশানের মায়ের ছোট সংসারটি প্রায় ভাঙ্গার পথে চলে যায়। রাত প্রায় মাঝামাঝি। বাহিরে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়টিও ভয়াবহ আকার ধারণ করল। দুপুর থেকে শুরু হয়ে সারা দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। কিন্তু ঘরে ফিরে এলো না ঈশানের বাবা। এই আধাঁর ঝড়েও ঈশানের মারও ভয়ে কাদাঁর অবস্তা প্রায়।
ঝড়ের মধ্য দিয়েই পার হয়ে গেল ভয়াবহ রাত। সকালে রক্ত লাল সূর্য উঠল। গাছের পাতা গুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেল। সব মানুষের ছুটাছুট। কোথাও চমকানোর ক্ষত চিহ্ন আবার কোথাও কান্নার শব্দ, আবার কোথাও মৃত্যুর আবাস। তেমনই একটি আবাস শুনত পেল ঈশানের মা। রাস্তারধারে ভেঙে পরা গাছের ডালের নিচে রিকশা সহ একটি লাশ। সে আর কেউ নয়, ঈশানের বাবা। বাবার লাশ আর মায়ের কান্নায় নিস্তব্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে রইল ঈশান।
দিন পার হল, সপ্তাহ পার হল। গাছের পাতা গুলো শুকনো হয়ে ঝড়ে পড়ে, আবার নতুন পাতার জন্ম হয়। পাখির কিচিরমিচিরশোনা যায় প্রতিদি। তবুও শেষ হয় না কষ্ট। ঘরের এল কোণে পরে থাকে ঈশান, অন্য দিকে পরে থাকে ঈশান। কিছুদিন প্রতিবেশীরাই খাবারের ব্যাবস্থা কর। সংসার কীভাবে চলবে, এই ভাবনায় ঈশানের মা কাজ নিয়েছিল রান্নাকরার। শুধু রান্না নয় বরং কাপড় ধুয়া ও ঘরমুছা সহ সব ধরনের কাজই করান হতোঈশানের মায়ের হাতে। তবে এর জন্য আলাদা কোনো মূল্য দেওয়া হতো না। ইশানের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে নিত ঈশানের মা। মায়ের অল্প আয়ে ঘরে মাঝে মাঝে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই দুই বেলা খাবার খেয়ে দিন চালিয়ে নিত। বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পরলো ঈশান। আগের মতো আর খেলাধূলায় ব্যাস্ত থাকে না সে। তার হাসি খুশি চেহারায় আর আগের মতো হাসি দেখা যায় না। মাঝে মাঝে পানি পরে চোখ দিয়ে। প্রতিদিন স্কুলে গেলেও কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলে না সে। কোনো এক বেঞ্চে একা একা বসে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে বাহিরে। পড়ার মনোযোগও প্রায় কমে যাচ্ছে। অভাবের সংসারে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে ঈশান।
চোখের পলকে কেটে গেলো অনেকদিন। ঈশানের বয়স পৌঁছেছে দশের মাঝামাঝি। হয়তো এখন মায়ের সল্প আয়ে জীবন চলে না। এক পর্যায়ে ঈশান সিদ্ধান্ত নিল কাজ করার। বাড়ি থেকে একটু দূরেই ছিল ইটের ভাটা। মায়ের কাছে বলতো স্কুলে যাচ্ছি। কিন্তু স্কুলে না গিয়ে সে চলে যেতো ইটের ভাটায় কাজ করতে। কাজের তাগিদে দীর্ঘদিন স্কুলে যাওয়া হলো না ঈশানের। ঈশানের খবর নেওয়ার জন্য স্কুলের শিক্ষক তার বাড়িতে আসলো। কারণ ক্লাশের পাচঁ-ছয়জন ছাত্রর মধ্যে ঈশানেই ছিল সবচেয়ে মেধাবী। তাই ঈশানের লেখাপড়ার দায়ভার শিক্ষক নিজেই নিতে চাইল। ঈশানের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার।
দেখতে দেখতে ছলে গেলো অনেক দিন। এখানেই এক পর্যায়ে শেষ হয়ে গেল ঈশানের স্কুল জীবন।
ঈশানের গ্রামটি ছিলো শহর থেকে অনেক দূরে, তাই তাদের গ্রামে উচ্চ শিক্ষার কোনো কেন্দ্র ছিলনা। শিক্ষকের সহায়তা ও মায়ের দোয়া সাথে নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য গ্রাম ত্যাগ করলো ঈশান। মাঝে মাঝে চিঠির মাধ্যমে খবর পাঠাতো তার মায়ের কাছে। এমনই এক চিঠিতে জানা যায় সে ভালোই আছে। তার নাকি কয়েকজনবন্ধুও আছে। দীর্ঘদিন কথাবার্তা হল। এক পর্যায়ে সেই চিঠির আর আভাস পাওয়া গেলো না। দিন গেলোমাস গেলো ঈশানের মা ছুটাছুটি করে এদিক ওদিক। একবার যায় পোস্ট অফিসের কাছে, আরেকবার যায় স্কুলের শিক্ষকের কাছে। কখনও পুকুরপাড়, আবার কখনও গাছতলা। আবার কখনও দাঁড়িয়ে থাকতো রাস্তার মোড়ে, কখন ডাক পিয়ন আসবে সেই অপেক্ষায়। বছর কয়েক পরে শিক্ষকের সহাওজানা গেলো ঈশান নাকি ভালো চাকরি পেয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পরলো চারদিকে। মায়ের মুখে ছিল মধুর হাঁসি। ঈশানকে দেখার জন্য তার মায়ের ছিলো আকুল আগ্রহ। তবে খবরটি জানতে পেরে খুশি হতে পারলোনা ঈশান। শহরের জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে সে তার গ্রামীন জীবন ভূলে যায়। তার ধারনা গ্রামীন মানুষদের সাথে দেখা করলে বন্ধুদের সামনে সে অপমানিত হবে। কিছুদিন যাবত চিন্তার ছাপ দেখা যায় ঈশানের মুখে।
দিন কয়েক পার হলো। বাড়িতে এলো ঈশান। জানতে পেরে আনন্দিত মুখ নিয়ে বাড়িতে এলো ঈশানের স্কুল শিক্ষ। বেশ ভালোই কথাবার্তা বললো তারা। ভালো মন্দ খাবারের ব্যাবস্থা করলো ঈশানের মা।
বাড়িটা ঠিক আগের মতোই রয়েগেলো। পরিবর্তন হলো বাড়ির আশপাশ। বাড়িতে আসার জন্য যেই মাটির রাস্তাটি ছিলো সেটিও এখন ইট দিয়ে মোড়ানো। পরন্ত বিকেলে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে সূর্য। আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে বাজারের দিকে গেলো ঈশান। দেখলো বাজারের ও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। চায়ের দোকানে বসতেই আশে পাশে ভীড় করলো অন্যান্য মানুষ। কয়েকজন ব্যাক্তি ঈশানকে চিনলেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে ঈশান অচেনা। সবাই ভাবলো গ্রামের উন্নতি করার জন্যই ঈশান বাড়িতে এসেছে। এখানেই আড্ডা হয়ে গেলো দীর্ঘ সময়ের। গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে তার চলে গেলো দুই-চার দিন। রাতের খাবারের মাঝেও ঈশান তার মায়ের সাথে অনেক আড্ডা জমালো। একপর্যায়ে ঈশান তার মাকে বলল, "গ্রামে থাকতে কি তোমার ভালো লাগে?" জবাবে তার মা বলল, "গ্রামই তো আমার সব। এই গ্রামেই তুই বড় হলি, চারদিকের সুন্দরদ দৃশ্য দেখেই দিন পার হয়ে যায়।" ঈশান বলল, "তোমাকে আর গ্রামে থাকতে হবে না, আমার সাথে শহরে চলে যাবে। মাস খানিক পর ঈশান তার মাকে নিয়ে শহরে চলে এল। হয়তো শহরে আসাটাই ছিলো ঈশানের মায়ের সবচেয়ে বড় ভুল। কোনো এক ভবনের একটি রুমে রেখে চলে যায় ঈশান। পরবর্তীতে আর কোনো দেখা হয়নি ঈশানের সাথে। এমনকি কোনো খবরও পাওয়া যায়নি।
অনেক স্মৃতি আজ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হচ্ছে সময়ের পরিবর্ত। সারাদিন একলা বসে থাকা তার অভ্যাস হয়ে যায়। ঈশানের কথা মনে পড়লে চোখে চলে আসে পানি। কখনও আচলের স্পর্শে মুছে যায় পানি, আবার কখনও গড়িয়ে পরে নিচে। মাঝে মাঝে আশে পাশে থাকা বয়স্কদের সাথে কথা বলে। বয়স্কদের নিয়ে গঠিত বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছিল ঈশানের মাকে। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিলো এই বৃদ্ধাশ্রমে। হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমেই দিন গুনতে হবে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রওনক নূর সময়ের সাথে সাথে মানুষ সবকিছু ভুলে গেলেও জীবনে বাবা মায়ের অবদান কেন ভুলে যায় জানিনা। ইশানদের মনে বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা জাগ্রত হোক। কোন মায়ের স্থান যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়।
রণতূর্য ২ শহুরে সন্তানেরা তাদের মূল ভুলে যাচ্ছে।মায়েদের স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম নামের কারাগারে।ভোট ও শুভকামনা রইল।আমার কবিতায় রইল আমন্ত্রণ। আশা করি কবিতা পড়ে মন্তব্য জানাবেন।
মুহম্মদ মাসুদ বেশ ভালো লাগলো। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।
মুহম্মদ মাসুদ ভালো, তবে আরেকটু ভালো হওয়ার দরকার ছিলো।
মুহম্মদ মাসুদ ভালো, তবে আরেকটু ভালো হওয়ার দরকার ছিলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

'স্বপ্ন হারা মা' গল্পলের ছোট্ট ছেলে ঈশানের জীবন বদলে যাওয়ার ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে। শহুরে জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে সে তার গ্রামিন জীবনকে ভুলে যাই। এমনকি তার শহরের বন্ধু চলতে গিয়ে সে তার মায়ের কষ্টকে ভুলে যাই। যার পরিণতিতে, তার মা আজ বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাচ্ছে। তার মত এমন হাজারো মা আজ কষ্টের দিন কাটাচ্ছে। যাদের দেখার মতো কেউ নেই।

১৯ এপ্রিল - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪