উপহার

বৃষ্টি ভেজা (জুলাই ২০১৯)

সুপ্রিয় ঘোষাল
  • ৬৭০
সমুদ্র-শহরের হোটেলের বারান্দায় বসে সে বৃষ্টি দেখছিল। গতকাল রাত্রি থেকেই প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে এখানে। এখন যদিও বৃষ্টির প্রাবলতা খনিক কম। কিন্তু তাদের হোটেলের চত্বর আর তার ভেতরের নুড়ি-পাথর ফেলা পথে জায়গায় জায়গায় জল দাঁড়িয়ে গেছে। বারান্দা থেকে ক্ষণে ক্ষণে থেকে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। বৃষ্টির মধ্যে ঢেউ ভাঙছে আর আছড়ে পড়ছে তটে। আবার ফিরে যাচ্ছে ঢেউ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চলেছে সেই ঢেউ-এর ভাঙা-গড়া। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এই সমুদ্র শহরে এই প্রথম তাদের একত্রে আসা। বিয়ের পর তারা হানিমুনে গেছিল এক শৈল-শহরে। সেও প্রায় দুবছর হয়ে গেল। আসলে তার বর সঞ্জীব একটি নামকরা আই-টি কোম্পানির বেশ উঁচুতলার কর্তা। সময়ের খুব অভাব। সে যদিও স্কুল-শিক্ষিকা তবুও তাদের বেড়াতে আসাটা সঞ্জীবের ছুটি পাওয়া না পাওয়ার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। দু-বছর বিয়ে হলেও এখনও তারা সন্তানহীন। তাই একটা নিঃসঙ্গতা প্রায়শই গ্রাস করে তাকে। মনে হয় যেন জীবন বড় একঘেঁয়ে। সেই একাকীত্ব কখনও কখনও তাকে, তার নারিসত্ত্বাকে, এমন কী তার অস্তিত্ত্বকেও বিপন্ন করে তোলে।
- ‘সঞ্জু শুনছ’? ওই নামেই সঞ্জীবকে ডাকে সে।
- ‘হুঁ। বল, শুনছি’। তার প্রশ্ন শুনে বই-এর থেকে মুখ না তুলেই জবাব দেয় সঞ্জীব।
- ‘দেখো কুকুরছানাটাকে, বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে কি রকম কী রকম গুটিসুটি মেরে বসে আছে’।
সঞ্জীবকে এবার বই-এর পাতা থেকে মুখ তুলতেই হল। বারান্দা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখল সত্যিই একটা কুকুরছানা। পাটকিলে রঙের অপর কালো ছোপ ছোপ। ভিজে প্রায় ন্যাতা হয়ে গেলেও প্রাণপণে চেষ্টা করছে বৃষ্টির ছাট থেকে নিজের গা বাঁচাতে। আর তা করতে গিয়ে মাঝেমাঝেই গা ঝাড়া দিচ্ছে আর তারপর আবার গুটিসুটি মেরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে একতলার ঘরগুলোর একটার বারান্দার তলায়। বারান্দায় কিছুতেই উঠতে পারছে না। গ্রিলের গেট আটকানো। বারান্দায় ওঠার চেষ্টা তাই বিফলে। বারান্দার নীচটা জলে ভিজে। জল বাড়ছে। তাই বারান্দার তলাটায় জল ভরে গেলে বেচারার যাবার আর কোনো জায়গা থাকবে না।
-‘শোনো না? ওটাকে নিয়ে আসি? ওটাকে পুষব আমি। না কোরো না, প্লীজ’। অনুনয়ের সুর তার গলায়।
- ‘নিয়ে এসো যাও। সাবধানে যেও কিন্তু। পিছলে পড়লে কেলেঙ্কারি। তার ওপর ভিজে যদি ঠান্ডা লেগে সর্দি-জ্বর বাঁধাও তাহলে আরও ঝামেলা। যা দুর্যোগ, তাহলে কলকাতায় ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকবে না’। কথাগুলো বলে আবার বই-এর পাতায় মনোনিবেশ করে সঞ্জীব।
সে যেন সঞ্জীবের এই অনুমোদনের অপেক্ষাতেই ছিল। কামরার দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে।
উপকূল শহরে এই দুর্যোগ অনেক সময় ভয়াবহ রূপ নেয়। যদিও আবহাওয়ার পূর্বাভাষ জানাই ছিল। হাওয়া অফিসে সতর্কতা সত্ত্বেও তারা এখানেই ছুটি কাটানো মনস্থ করে। হোটেলটা ছিমছাম। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও বেশ সুন্দর। কামরার সংখ্যা প্রায় শ-খানেক। অধিকাংশই ফাঁকা। দুর্যোগের ভয়ে অনেকেই অবকাশ কাটছাঁট করে ফিরে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দু-একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হলেও কেউ কোনো কথা না বলায় আপনমনেই নেমে আসে সে। নীচের লাউঞ্জে তেমন লোকজন নেই। লবিটা বেশ বড়। হলুদ আলোয় খানিকটা যেন মায়াবী হয়ে আছে। তাকে দেখে হোটেল মালিক-কাম-ম্যানেজার রিশেপসন থেকে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ান। ভদ্রলোক বৃদ্ধ। বয়েস কম করেও পঁয়ষট্টি। লম্বা সুঠাম চেহারায় আভিজাত্য আর সহৃদয়তার সুষম মিশেল। মুখে একটা হাসি যেন লেগেই আছে।
- ‘এই দুর্যোগে বাইরে কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম’? তাকে বাইরে যেতে উদ্যত দেখে প্রশ্ন করেন মালিক সাহেব।
- ‘ দেখুন না। এই বৃষ্টিতে বাইরে দেখলাম একটা কুকুরছানা ভিজে একেবারে কাদা হয়ে গেছে। যাই ওটাকে নিয়ে আসি। বাঁচাতে পারলে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পুষব ওটাকে। গাড়ি নিয়ে তো এসেছি। নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না’।
- ‘ কিন্তু এই বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে অসুখ বাঁধাবেন যে আপনি। দাঁড়ান, দাঁড়ান। একটুখানি দাঁড়িয়ে যান’। বলে মালিক সাহেব কাকে যেন ডাকলেন চোখের ঈশারায়।
দু-এক মিনিটের মধ্যেই এক মহিলা বেশ বড়সড় একটা ছাতা নিয়ে উপস্থিত।
- ‘যান ম্যাডাম, ওর সাথে যান’।
- ‘আচ্ছা’। বলে বেরিয়ে আসে সে পেছন পেছন সেই মহিলা ছাতা-ধরা অবস্থায়।
নুড়ি ছড়ানো পথে নামতেই দমকা হাওয়ার দাপটে চোখেমুখে বৃষ্টির ছাট এসে লাগল তার। চুর্ণ কুন্তল ওড়ানো হাওয়া তার আঁচল প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। কোনক্রমে সবকিছু সামাল দিয়ে সে খুঁজতে লাগল কুকুরছানাটাকে। সঙ্গে ছাতা হাতে সেই মেয়েটি। না! কোথাও পাওয়া গেলো না সেটাকে। এরই মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল সেটা। বিষন্নতায় মনটা ভারি হয়ে আসে তার। ফিরে গিয়ে আবার সেই একাকীত্ব গ্রাস করবে তাকে। ভাবতে ভাবতে চোখেও বৃষ্টির ধারা নেমে আসে তার। কিন্তু কেমন যেন মনে হল সঙ্গের মেয়েটি তার পোশাকের ভিতরে আড়াল করে কিছু একটা লুকোতে চেষ্টা করছে।
- ‘পেলেন’? তাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে প্রশ্ন করেন মালিক-কাম-ম্যানেজার সাহেব।
- ‘না’। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার অন্তর থেকে। ধীরে ধীরে লাউঞ্জ পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় সে তার কামরার উদ্দেশ্যে।
কামরায় ঢুকে সে দেখে সঞ্জীব বিয়ারের বোতল থেকে গ্লাসে বিয়ার ঢালছে। তাকে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় – ‘ কী হল খালি হাতে যে? পেলেনা’।
- ‘না। কোথাও পেলাম না গো ওটাকে। সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেও’। কান্না ভেজা গলায় ভেসে আসে তার উত্তর।
- আর কী হবে মন খারাপ কোরো না। কলকাতায় গিয়ে গালিব স্ট্রিট থেকে তোমার জন্যে কিনে আনব একটা ছোট্ট সুন্দর বিগেল’। বেশ নেশাগ্রস্ত শোনায় সঞ্জীবের গলাটা।
সে কোনো উত্তর করেনা। হোটেলের কামরার বিছানায় বসে আয়নায় প্রথমে দেখে তার নিজের চেহারা। বেশ খানিকক্ষণ ধরে। তারপর তাকায় সঞ্জীবের দিকে। সঞ্জীব কি সুখী তাকে নিয়ে? প্রশ্নটা হঠাৎ যেন পেরেকের মত খোঁচা মারে তার চেতনাকে।
- ‘তুমি কি আমাকে এখনও ভালবাসো সঞ্জু?’ সে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দেয় সঞ্জীবের উদ্দেশে।
- ‘হঠাৎ’। স্পষ্টত বিব্রত শোনায় সঞ্জীবের গলা।
- ‘আমাকে কি এখনও একঘেঁয়ে লাগেনা তোমার’?
- ‘কী যে বল। পাগল হলে নাকি একটা কুকুরছানার শোকে’?
- ‘না, এমনিই বলছিলাম। সে সঞ্জীবের দিকে সরাসরি তাকায় না, কিন্তু অনুসন্ধিৎসা আজ যেন পেয়ে বসেছে তাকে।
- ‘আমি জানি’। অকস্মাৎ বলে ওঠে সে।
- কী জানো?
- ‘পুরুষ মানুষ সব সময় চঞ্চল’।
- ‘কী সব প্রলাপ যে বকে চলেছ? তার চেয়ে বরং একটা গান শোনাও। কতদিন যে তোমার গলায় ছায়া ঘনাইছে শুনিনি’?
গানের বদলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার গলা থেকে। সঞ্জীব চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে। জড়িয়ে ধরে তাকে। ঠোঁট সরিয়ে নেয় সে। আজ কিছুতেই সে সমর্পণ করবে না নিজেকে। সঞ্জীবের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে সে চলে যায় স্নানঘরে।
আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। হঠাৎ করেই কামরার বেল বেজে ওঠে। চমকে উঠে দরজাটা খোলে সে। চেয়ে দেখে সেই মেয়েটি, যে সকালে তার সাথে বেরিয়ে ছিল ছাতা হাতে। তার হাতে এখন একটা বেতের ঝুড়ি আর তার ভেতর তোয়ালে মোড়া সেই ছোট্ট কুকুরছানাটা ঘষে মেজে বেশ পরিষ্কার করা। তার দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে আর ছোট্ট লেজটা নাড়াচ্ছে।
- ‘সামসের সাহেব এটা আপনার জন্যে পাঠালেন ম্যাডাম’। বলে মেয়েটি।
- ‘সামসের সাহেব’? বিস্ময় ঝরে পড়ে তার গলায়।
- ‘হ্যাঁ। এই হোটেলের মালিক। নীচে সকালবেলা যাঁর সাথে কথা হল আপনার’। আপ্লুত গলায় বলে ওঠে মেয়েটি।
কৃতজ্ঞতার হাত বাড়িয়ে উপহার সাগ্রহে গ্রহণ করে সে। হঠাৎ করে তার মনে হয় কে যেন গেয়ে উঠল – ‘ আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই
মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই’।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত গল্পের প্রকাশ , বর্ণনার গভীরতা ভাল লাগল । শুভকামনা রইল ।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এটি বৃষ্টি ভেজা সমুদ্র শহরে এক নিঃসঙ্গ দম্পতির অবকাশ যাপনের গল্প। অবকাশেও একাকীত্ব। কিন্তু বৃষ্টির বিষন্নতা ছাপিয়ে পরিণতিতে বড় হয়ে ওঠে এক সহৃদয় মানুষের ছোঁয়া।

১৭ এপ্রিল - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী