আজ রবিবার। আজ তো তোর আমার সাথে রাত কাটাবার কথা। আজ এতো সাজগোজ করিস কেন? ফিচলে হেসে শাহেদ প্রশ্ন করে। চৌকির নিচ থেকে টিনের বাক্স টা বের করে বিছানার উপর রাখল মরিয়ম ওরফে মৌরি । বিছানার পাশে দুটো ট্রাভেল ব্যাগ ভরা তার দামি কাপড় চোপড় রয়েছে । চটকদার শাড়ি , দামি লেহেঙ্গা, আরও কতো কিছু । সেইসব কাপড় বাদ দিয়ে মরিয়ম বাক্স খুলে একটা সাধারণ সুতি শাড়ি বের করলো । আলো ঝলমল ঘরটা তে রঙ্গিন টেলিভিশন ছাড়াও বেশ কিছু দামি আসবাবপত্র আছে। টিনের বাক্স টা শুধু পুরনো । তার বিগত দিনের স্বৃতি বহন করে চলেছে। মরিয়ম শাহেদের দিকে তাকালো। বিছানায় আধ শোওয়া অবস্থায় বসে আছে। হাতে অরিস ব্রান্ডের আধ পোড়া সিগারেট। চোখ দুটো মরিয়মের শরীরের দিকে নিবন্ধ। যেন তাকে লেহন করছে। এর নাম প্রেম? মরিয়ম একবার ভাবলো।
মুখে বললো, আজ বাবুর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার দিন। মূহুর্তের মধ্যে শাহেদের চকচকে চোখ দুটো নিষ্প্রভ হয়ে গেল। নীরস কণ্ঠে বললো, আবার সেই ঝামেলা। জলে পয়সা ঢালা। মরিয়ম কিছু বললো না। পাশের ঘর থেকে কাপড় পাল্টে শাড়ি পড়ে এলো। ঘরে এসে বললো, ডাক্তারের ভিজিটের টাকাটা দাও। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠলো শাহেদ, আমার কি টাকার গাছ আছে, যে ঝাড়া দিলে টাকা পড়বে?
মরিয়ম ঠান্ডা গলায় বললো, টাকা তুমি কামাই করো না। করি আমি। আমার টাকা আমি চাইছি। শাহেদের কণ্ঠ সপ্তমে চড়লো, হারামজাদী, শরীর বেচাঁ টাকা নিয়ে ফুটানি করিস? আমি না থাকলে তোকে শেয়াল শকুনে ছিড়ে খাইতো। এই কুৎসিত ঝগড়া আরও কিছুক্ষণ চললো। এক পর্যায়ে শাহেদ মরিয়মের চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে আছড়ে ফেললো। তারপর দুটো লাথি মেরে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। মরিয়ম নিশ্চল ভাবে মেঝে তে পড়ে ছিল। কতক্ষণ সময় পার হয়ে গেছে তার হুশ ছিল না। এই সময়ের মধ্যে সে কাদেঁনি। ডাক্তার যে দিন সমস্ত রিপোর্ট দেখে গম্ভীর মুখে জানিয়েছিল, আমি দুঃখিত শাহেদ সাহেব। আপনার ছেলে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত, সেদিন শাহেদ হাউমাউ করে কেদেঁছিল। কেবল মরিয়ম নিশ্চলভাবে বসেছিল। তার কোলে ছোট্ট রোদন। মরিয়ম শক্ত করে সন্তান কে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিল। মৃত্যুও বুঝি মায়ের বুক থেকে সন্তান কে কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
মরিয়মের ঘোর ভাঙ্গলো পাশের ঘরের অস্পষ্ট শব্দ শুনে। রোদনের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বোধহয় মাকে খুজছেঁ। তাড়াতাড়ি ছেলের ঘরে গেল মরিয়ম। গোলাপী রংয়ের বিছানার চাদর আর মাথার কাছে একটা পান্ডা ডল। এটি রোদনের প্রিয় পুতুল। ঘর ভরা খেলনা থাকলেও এই পুতুলটা কে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমিয়ে থাকে। সাত বছরের ছেলেটি দেখতে অনেকটা মায়ের মতো। মাথায় কোকড়াঁ চুল। বড় বড় চোখ দুটো একটু যেন কোটরগ্রস্থ। মূহুর্তের মধ্যে একটা আশঙ্কা মরিয়মের মনে উদয় হলো। পাশের ঘরে বাবা মায়ের ঝগড়া কি রোদন শুনে ফেলেছে? কিন্তু রোদনের মুখে অনাবিল হাসি। মরিয়মের মনে হলো এই হাসিটুকু দেখার জন্য সে এখনো বেচেঁ আছে।
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মরিয়ম জিজ্ঞাসা করলো, ক্ষুধা লাগছে সোনা? রোদন দূর্বলভাবে মাথা নাড়লো। মায়ের দিকে তাকিয়ে উৎসুক ভাবে প্রশ্ন করলো, আজ কি রান্না করছো , মা? মরিয়ম বললো, তোমার জন্য মুরগী রানছি। মুহূর্তে রোদনের উৎসাহ নিভে গেলো। রোজ রোজ মুরগী খেতে তার ভাল লাগে না। তাছাড়া অসুখের জন্য তার মুখের রুচি চলে গেছে। মরিয়ম বললো, খাবার কে অবহেলা করতে হয় না। ঠিক মতো খাইতে পারলে তুমি সুস্থ হয়ে যাবা। প্রতিদিন স্কুলে যাবা। মাঠে খেলা করবা। মাঠে ফুটবল খেলবে রোদন? বুকের মধ্যে আনন্দ যেন ছলাৎ করে উঠলো। কবে থেকে সে অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে সে জানালার ধারে বালিশে হেলান দিয়ে বসে থাকে। রাস্তার পাশে মাঠে বিকালে বাচ্চারা খেলা করে। রোদন সেদিকে তৃষিতের মতো তাকিয়ে থাকে।
শরৎ কালের বিকাল গ্রীষ্ম কালের মতো দীর্ঘ নয়। এই বছর বর্ষা শুরু হয়েছে দেরীতে। আজ সারাদিন বাইরে রোদ ঝকঝক করেছে। অথচ এখন আকাশে মেঘ জমেছে। আবহাওয়ার পরিবর্তন মরিয়মের দৃষ্টি এড়ায়নি। সে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নেয়। বৃষ্টি শুরু হবার আগেই রোদন কে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। কিন্তু বিধিবাম। বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতে না যেতে ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। তাড়াতাড়ি একটা বড় দোকানের ছাউনির নিচে দাড়াঁলো মরিয়ম। রোদন তার কোলে। শাড়ির আচঁল দিয়ে ছেলে কে ঢেকে দিলো সে। যাতে রোদনের গায়েঁ বৃষ্টির ছাট না লাগে। রোদন এখন আর নিজে হাটঁতে পারে না।
ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি মরিয়মের মুখস্থ । দিনের আলো অথবা রাতের অন্ধকারের মধ্যে এখন আর তার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। অথচ এই মরিয়ম একদিন দিনে দুপুরে শেয়ালের ডাক শুনে ভয় পেতো। ঘরের আঙ্গিনার বাইরে পা রাখতে গেলে দুরু দুরু করে বুক কাপঁতো। আজ যেন সব কিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেই শরণখোলা গ্রাম, বাপ দাদার ভিটের উপর তাদের ছোট্ট মাটির ঘর, খড়ের পালা, ধান, পাট, আর সরিষার খেত। সরিষার খেতের পাশে ছিল হাবু চাচার মৌমাছির খামার। মরিয়ম, শামীমা আর আনু বু জামরুল গাছের তলা দিয়ে মেঠো পথ ধরে স্কুলে যেত। আনু বু মরিয়মদের এক ক্লাস উপরে দশম শ্রেণীতে পড়তো। মরিয়মের বড় বোন কুলসুম ও পড়তো দশম শ্রেণীতে। গেল বছর তার বিয়ে হয়ে গেছে। বুবুর লাল শাড়ি আর গলার অলংকার যতোই লোভনীয় হোক মরিয়ম কিন্তু স্বপ্ন দেখতো সে এসএসসি পাস করবে। কলেজে পড়বে। তার বড় দুই ভাই ইতোমধ্যে বাবার সাথে খেতের কাজে লেগে গেছে।
সম্বন্ধটা এনেছিল দুলাভাই। সে তরকারির ব্যবসা করতো। প্রায় ঢাকায় আসা যাওয়া করে। পাত্র তাদের গ্রামের। বিএ পাস। ঢাকায় চাকরি করে। এক কথায় উপযুক্ত ছেলে। তবে ঢাকায় সে কি চাকরি করে সেই প্রশ্ন কেউ করে নি। এই যুগেও মেয়ের মতামত কেউ নেয়নি। মরিয়মের দ্বিধা ছিল। কিন্তু বাবা ভাইয়ের মতের বিরুদ্ধে যাবার কথা সে ভাবেনি। বিয়ের দিন শাহেদ কে দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল। অমন রাজপুত্রের মতো বর। অনাগত সুখের আশায় বিভোর হয়ে ছিল মরিয়ম। সুখ মরিয়মের কপালে জুটেছিল বৈকি। বিয়ের পর শাহেদ স্ত্রী কে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকা আসার পর মরিয়ম জানতে পারে , শাহেদ একটা অভিজাত জুতোর দোকানের সেলসম্যান। মরিয়ম যে একটু মনঃক্ষুন্ন হয়নি তা নয়। তবে এক রুমের এই ভাড়া করা বস্তি বাড়িতে শেষ বিকালে শাহেদ যখন ঘরে ফিরতো, তখন মরিয়ম কোনো অভিযোগ করতো না। তাছাড়া শাহেদ তাকে আশ্বস্ত করেছে, এই বছর পরীক্ষায় পাস করলে সে ভাল চাকরি পাবে। গত বছর বিএ পরীক্ষায় শাহেদ ফেল করেছিল। ঠিক যেন টোনাটুনির সংসার। মরিয়ম ভাত তরকারি যা রান্না করে দুইজন ভাগ করে খায়। শাহেদ নতুন বউ কে নিয়ে বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে। ফেরার পথে দুইজন গাউসিয়া মার্কেটের সামনে দাড়িঁয়ে ফুচকা খেয়েছে। মোবাইলে মমতাজের গান শুনতে শুনতে মরিয়ম ঘরের কাজ করে। আর রাতটা কাটে মধুর। এর বেশি কিছু মরিয়ম তার জীবনে আশা করেনি।
বছর দেড়েক পর তাদের ঘর আলো করে একটি শিশুর জন্ম হয়। মরিয়ম তার ছেলের নাম রেখেছিল রোদন। তখন তারা জানতো না রোদন শব্দের অর্থ কান্না। তাদের বস্তি ঘরের সামনে তিন তলার ফ্ল্যাট বাড়ির মালিকের ছেলের নাম রুম্মান। ছেলেটি রোজ গাড়িতে করে স্কুলে যায়। মরিয়ম স্বপ্ন দেখে তার সন্তানও বড় হয়ে স্কুলে যাবে। রুম্মানের নামানুসারে সে ছেলের নাম রেখেছে। শাহেদ জুতোর দোকানে কাজ করার সময় দেখে সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে মেয়েরা তাদের দোকানে আসে। শাহেদ এই শিশুগুলোর সাজসজ্জ্বা লক্ষ্য করে। তারপর রোদনের জন্য ঠিক সেই রকমের জামা জুতো কিনে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মরিয়মের সাথে তার খুনসুটি হয়। মরিয়ম বলে এতো টাকা খরচ করে জামা জুতো কেনার দরকার কি? শাহেদ উত্তর না দিয়ে হাসে। লাল জুতো পায়ে দিয়ে রোদন যখন সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায় তখন বাবা মায়ের চোখ জুড়িয়ে যায়।
সেই অভিশপ্ত শীত কালটার কথা মরিয়ম আর মনে করতে চায় না। শীতের সাথে ছিল বৃষ্টির প্রকোপ। রোদনের বয়স তখন পাচঁ বছর। ছেলেটি পানি নিয়ে খেলতে খুব পছন্দ করতো। এই শীতের মধ্যেও বাড়ির সামনে জমে থাকা পানি নিয়ে সে খেলা করতো। মরিয়ম অবশ্য তাকে চোখে চোখে রাখতো। কিন্তু একদিন রোদনের কাপুঁনি দিয়ে জ্বর আসলো। মরিয়ম ভেবেছিল বাচ্চাদের জ্বর দুই একদিন বাদে সেরে যাবে। কিন্তু জ্বর ক্রমশ বাড়তে লাগলো। সেরে ওঠার লক্ষণ নেই। শাহেদ ছেলেকে কোলে নিয়ে পাড়ার ডিসপেন্সারিতে ডাক্তার দেখিয়েছে। ওষুধপত্র চলছে অথচ রোদন ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। মরিয়ম রাত জেগে বসে ছেলের মথায় জল পট্টি দেয়। মায়ের চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরে। শাহেদের দোকানের কাজে মন বসে না। বাড়ী ফেরে ভীষণ উৎকন্ঠা নিয়ে। স্বামী স্ত্রী মিলে ঠিক করলো রোদন কে ভাল ডাক্তার দেখাবে। এবার ঈদে তারা কোনো নতুন কাপড় কেনেনি। ঈদের দিন চুলায় হাড়ি চড়েনি। উপার্জনের প্রতিটি টাকা হিসাব করে খরচ করেছে। তারপর হাতে কিছু টাকা জমা হলে ছেলেকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের দেয়া টেস্টগুলো করায়। সেখানে আসা যাওয়া, সিরিয়াল পাওয়া ইত্যাদি পর্বত সমান জটিলতা পেরিয়ে অবশেষে এক বিকালে সব রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে আসে। ডাক্তার কোনো ভণিতা না করে সরাসরি বাবা মায়ের সামনে অসুখটার কথা বলেছিল। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত মৃত্যু। নির্দিষ্ট সময় পর পর রক্ত পরিবর্তন করে যে কয়েক দিন বাচিঁয়ে রাখা যায়।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় শাহেদের হাটুঁ কাপঁছিল। রিক্সায় বসেও সে ফুপিঁয়ে ফুপিঁয়ে কেদেঁছে। ঘরে ফিরে শাহেদ একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। আল্লাহ যদি আমাকে প্রতিবন্ধী সন্তান দিতো তবু কোনো আফসোস থাকতো না। সে অন্তত চোখের সামনে বেচেঁ থাকতো। মরিয়ম এতক্ষণ একটি কথা বলেনি। শাহেদের আহাজারি নিঃশব্দে শুনে গেছে। আচমকা সে বলে উঠলো, আমার সন্তান মরবে না। হতভম্ব শাহেদ কান্না থামিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মরিয়ম দৃঢ় কন্ঠে বললো, আমরা বাবুর চিকিৎসা করাবো। যতো সমস্যা হোক, যতো টাকা লাগে লাগুক। শাহেদ জুতোর দোকানের কাজের পাশাপাশি হোম ডেলিভারি দেয়ার কাজ শুরু করলো। ময়না দর্জির দোকান থেকে ব্লাউজ, শার্ট ইত্যাদি এনে বোতাম লাগাতো। স্বামী স্ত্রী মিলে রাত দিন পরিশ্রম করেও রোদনের চিকিৎসার ব্যায় সংকুলান করতে পারতো না। তারপর এলো সেই ভয়াবহ সময়। করোনার আগ্রাসন, লক ডাউন এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। ব্যয় সংকোচনের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাটাই শুরু হলো। শাহেদের চাকরিটা চলে গেল।
সেই রাতেও আকাশে চাদঁ উঠেছিল। কর্মক্লান্ত শহরবাসী ঘরে ফিরেছিল। শাহেদ ঘরে ফেরে মাঝ রাতের পর। তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে মরিয়ম জেগে ছিল। প্রশ্ন করার আগে স্বামীর উদভ্রান্ত মুখ দেখে মরিয়ম সর্বনাশের আচঁ টা টের পেয়েছিল। সব শুনে সে বুঝলো তারা এখন গভীর খাদের দ্বার প্রান্তে। সপ্তাহ দুয়েক হন্যে হয়ে কাজ খুজঁলো শাহেদ। গ্রামে ফিরে যাবার উপায় নেই। গ্রামে গেলে রোদনের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। মাস শেষ হতে আর আট দিন বাকি। মাস শেষে ভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওয়ালা বের করে দেবে। হাতের টাকা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এবার তারা কি করবে?
প্রস্তাবটা দিয়েছিল সফেদ আলী। এই বস্তিতে বিচিত্র পেশার মানুষ বাস করে। সফেদ আলী তাদের একজন। বস্তির মানুষের কাছে সে দালাল নামে পরিচিত। সফেদ আলীকে সব সময় এড়িয়ে চলে শাহেদ। কখনো তাদের মধ্যে কথা হয়নি। কিন্তু শকুন যেমন ভাগাড়ের মরার গন্ধ পায়, সফেদ আলীও শাহেদের অবস্থার কথা জানতে পারে।বস্তির পাশে চায়ের দোকান। পিছনে ভাসমান ডাস্টবিন। তবু চায়ের দোকানে বেশ ভীড় থাকে। দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে ছিল সফেদ আলী। সন্ধ্যার আগে শাহেদ ঘরে ফিরছিল। আজকের দিনটাও তার বৃথা গেছে। সারাদিন ঘোরাঘুরি করেও কোনো কাজ পায়নি। সফেদ আলী শাহেদ কে দেখে ডাক দিল, শাহেদ ভাই নাকি? আসেন , বসেন। এক কাপ চা খান। শাহেদ মাথা নেড়ে বললো, চা খাওয়ার পয়সা আমার কাছে নেই। হা হা করে উঠলো সফেদ আলী, আমরা এক জায়গায় থাকি। পরষ্পরের আত্নীয়ের মতো। আজকে চায়ের দামটা না হয় আমি দিই। লোকটার গলায় আন্তরিকতার সুর। শাহেদ আর না করতে পারলো না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সফেদ আলী জিজ্ঞাসা করলো, কাজ কর্ম কিছু পাইছেন? শাহেদ পাল্টা প্রশ্ন করলো, আমার কাজ নাই আপনি জানলেন কি করে? সফেদ আলী মিঠে গলায় বললো, মানুষের খবর তো মানুষই রাখে। শাহেদের বাধ এইবার ভেঙ্গে পড়লো, আমি রিক্সা চালাতে রাজী আছি। কিন্তু লক ডাউনের মধ্যে সেই কাজও নাই। সফেদ আলী বললো, আপনি শিক্ষিত মানুষ। রিক্সা চালাবেন কেন? মানুষের আয়ের কতো পথ আছে। শাহেদ কিছু না বুঝে প্রশ্ন করলো, আমি কি কাজ করতে পারি? সফেদ আলী বললো, দুনিয়াটা আজব জায়গা। আপনার ফিল্ম স্টারের মতো সুন্দরী বউ আছে। আপনার চিন্তা কি?
ইঙ্গিতটা বুঝতে শাহেদের অসুবিধা হয়নি। রাগে তার ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠেছিল। কাপের বাকি চা টুকু ঢেলে ফেলে দিয়ে দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেড়িয়ে এসেছিল শাহেদ সেদিন। তারপর টলতে টলতে ঘরে ফিরেছিল সে। মানুষের মানসিকতা এতো কুৎসিত হতে পারে? ক্রমে রাত বাড়ছিল। শাহেদ অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভাবনাটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আজ খাবার জুটেছে। মাথার উপর ছাদ আছে। কিন্তু কাল কি হবে? মরিয়ম স্বামীর পাশে নিঃসাড় ভাবে শুয়ে ছিল। শাহেদ তাকে আস্তে আস্তে ডাকে, বউ ঘুমায় পড়ছিস? মরিয়ম উত্তর দেয়, না, কি কও। শাহেদ বলে এই মাসের আর আট দিন বাকি। হাতে টাকা পয়সা কিছু নাই। মরিয়ম নীরব হয়ে থাকে। ইতস্তত করে শাহেদ বলে, আজ চায়ের দোকানে সফেদ আলীর সাথে দেখা হইছিল। হে একটা কাজের কথা বলছে। কাজটা কি শোনা মাত্র থর থর করে কেপেঁ উঠলো মরিয়ম। একি কথা তার স্বামীর মুখে? তার আপনজন, সবচেয়ে নির্ভরের জায়গা। শাহেদের কন্ঠে অনুনয়, আমারে ভুল বুঝিস না বউ। চিন্তা করে দেখ, বাবুর চিকিৎসার খরচপাতি হইবো। আমাদের আর অভাব থাকতো না। সর্বনাশের পথ বোধহয় এমনি করে মানুষ কে ডাকে।
কাজের খোজঁ আনতো সফেদ আলী। আর শাহেদ মরিয়ম কে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছেঁ দিত। কাজ শেষ হলে প্রাপ্ত টাকা থেকে সফেদ আলী কে বখরা দিতে হতো। টাকার সুবাস বোধহয় স্বতন্ত্র। এই কাজ করতে শাহেদের যে গ্লানি ছিল, ক্রমে সেটা মুছে যেতে শুরু করলো।মরিয়মের সর্বাঙ্গ শিউরে উঠতো বিতৃষ্ণায়। এক ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করতো। কিন্তু কার কাছে যাবে? শাহেদ পাশের ঘরেই বসে আছে। বসে বসে স্ত্রী কে ভাড়া খাটানোর টাকা গুনছে। খুব শীঘ্র এই লাইনে ব্যবসায় পোক্ত হয়ে উঠেছে শাহেদ। হাতে মোটা অঙ্কের টাকা আসতে শুরু করেছে। মরিয়ম আপত্তি জানালে বলতো, তুই মা হয়ে ছেলের চিকিৎসার জন্য এইটুকু করতে পারবি না? কিন্তু মরিয়ম ততোদিনে বুঝে গেছে, সন্তানের অসুখ শাহেদের কাছে বিজ্ঞাপন মাত্র। রোদন বা মরিয়ম কারো কোনো প্রয়োজন শাহেদের কাছে নেই। সে স্ত্রী সন্তান ভাড়া খাটিয়ে টাকা আয় করা শুরু করেছে।
দোকানের নিচে দাড়িঁয়ে ছিল মরিয়ম। অদূরে একটা বাস এসে থামলো। সে তাড়াতাড়ি রোদন কে নিয়ে উঠে পড়লো। ভিতরে তিল ধারনের জায়গা নেই। বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে কোনো রকমে দাড়িঁয়ে ছিল মরিয়ম। রাস্তায় যানজট দেখে ভাবছিল সময়মতো হাসপাতালে পৌছঁতে পারবে কিনা? ঠিক তখনই শরীরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ টের পেলো। হাতটা কার বুঝতে পারেনি। চীৎকার দিয়ে উঠলো মরিয়ম, কোন হারামজাদা গায়েঁ হাত দেয় রে? ভীড়েরমধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। সবাই জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করলো। একদল বললো, দেশের যা অবস্থা। কোথাও নিরাপত্তা নেই। আরেক জন বললো, অবক্ষয় কোন পর্যায়ে পৌছেঁছে দেখেছেন? মেয়েরা এখন নিজেই নিজের সম্ভ্রমহানির অভিনয় করে। স্তম্ভিত হয়ে গেল মরিয়ম। সে মিথ্যা কথা বলছে?
এমন সময় বাসের হেলপার সালিশ করতে এগিয়ে এলো। সে মরিয়মকে জিজ্ঞাসা করলো। আপনার শরীরে পুরুষ মানুষ হাত দিছে?
মরিয়ম কোনো রকমে বললো, হ্যাঁ।
কে দিছে? হেলপারের প্রশ্ন।
মরিয়ম মাথা নেড়ে বললো, আমি তারে দেখি নাই। হেলপার যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কোনো সাক্ষী আছে? বাসের সবাই নীরব হয়ে রইলো। হেলপার আবার বললো, আপনি দেখেন নাই। কোনো সাক্ষী নাই। তার মানে ঘটনা ঘটে নাই। অহন বাস থেকে নামেন। মরিয়ম জিজ্ঞাসা করে, বাস থেকে নামবো মানে? আমি টিকিটের পুরো ভাড়া দিছি।
রুঢ়ভাবে হেলপার বললো, নামেন আপনি। অন্য যাত্রীদের সময় নষ্ট কইরেন না। মরিয়ম একবার যাত্রীদের দিকে তাকালো। সবাই নীরব। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। মরিয়ম বাস থেকে নেমে গেল। পিছন থেকে কে যেন বললো, যদি খ্যামটা নাচতে হয় তবে সতীত্ব দেখিয়ে লাভ কি? চকিতে পিছনে ফিরলো মরিয়ম। কোনো বীর পুরুষের চিহ্ন নেই।
বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। রাস্তায় পানি জমেছে। তার মধ্যে হাটঁছে মরিয়ম। মাতৃত্ব তো ভালবাসারই এক রূপ। তার দায় মেটাতে অসুস্থ সন্তান কে নিয়ে সে হেটেঁ চলেছে।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বৃষ্টি ও প্রেম মানুষের মনে কোমল অনুভূতির
অনুরনণ সৃষ্টি করে। কিন্তু বৈষম্যমূলক সমাজে
সবার জন্য বিষয়টি প্রযোজ্য নয়। এইরকম একটি
তিক্ত বিষয় নিয়ে গল্পটি লিখিত।
০৩ মার্চ - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৩৬ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৭১
বিচারক স্কোরঃ ৩.০১ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৭ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪