স্বাধীনতা হীনতা কে বাচিঁতে চায়।

স্বাধীনতা (মার্চ ২০২২)

Lubna Negar
  • 0
  • ৪৬৫
১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে তরাওরীর দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে মুহম্মদ ঘোরী সর্বপ্রথম আর্যাবর্তে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মাত্র কয়েক বছর পর গর্মসীরের অধিবাসী অসমসাহসী বখতিয়ার খিলজী অতর্কিতভাবে অভিযান চালিয়ে প্রথমে দক্ষিণ বিহার এবং পরে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের অনেকাংশ জয় করে এই অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। বখতিয়ার প্রথমে নদীয়া ওপরে গৌড় জয় করেন। তখন থেকে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। তবে সমগ্র বাংলা অঞ্চল তখনো মুসলিম শাসনের অর্ন্তভুক্ত হয় নি। প্রথম পর্যায়ে ছিল স্বাধীন সুলতানদের যুগ। এই কাহিনী সেই সময় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা কে উপজীব্য করে রচিত।
পিলখানায় বাহাদুরের বিশাল তেল চুকচুকে দেহটার দিকে তাকিয়ে বিষন্ন ভাবে মাথা নাড়লো আসগর। হাতির মাহুত সে। বাহাদুর কে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন করার কাজে আসগর কৈশোর থেকে নিয়োজিত। সুলতানের গজবাহিনীর হাজারখানেক হাতির মধ্যে বাহাদুর সেরা হাতিদের অন্যতম। স্বয়ং সুলতান বাহাদুরের পিঠে চড়ে শিকার করতে যেতেন। বাহাদুরের শৈশব তখন অতিক্রান্ত প্রায়। তবু সুলতান কে পিঠে চড়িয়ে সবুজ গাছপালায় শোভিত বনাঞ্চলের মধ্য যেতে যেতে হাতিটার চোখে ফুটে উঠতো উৎসুক দৃষ্টি। কেমন যেন বিহ্বল ভাবে বনভূমির দিকে তাকিয়ে থাকতো। সৈন্যদের হল্লা, ফুর্তি আর সুরার ফোয়ারার মাঝে সেই দৃষ্টি নিয়ে কেউ মাথা না ঘামালেও আসগর যেন সে চাউনির অর্থ বুঝতে পারতো। বাহাদুর তার সন্তান সম। তাছাড়া তারা উভয়ে তো সুলতানের ক্রীতদাস।
বাংলার সীমান্তবর্তী বনাঞ্চলগুলোতে হাতির পালের দেখা পাওয়া যায়। বাহাদুর ধরা পড়েছিল খ্যাদায়। খ্যাদা হলো হাতি ধরার ফাদঁ। দলছুট হাতি শিকারিরা তাড়িয়ে আগে থেকে খুড়ে রাখা গর্তের দিকে নিয়ে যায়। তারপর প্রচন্ড জোরে ঢাক, ঢোল আর বাদ্যের শব্দ করা হয়। ভয় পেয়ে হাতি যদি পালাতে গিয়ে খ্যাদার মধ্যে পড়ে যায় তাহলে আর উঠতে পারে না। তখন শিকারিরা ধৃত হাতি তুলে বন্দী করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রী করে দেয়। বাংলার অশ্ব বাহিনীর মতো গজবাহিনীর খ্যাতি তখন বিভিন্ন দেশে প্রচারিত। মাহুতের কাজ হলো হাতির প্রতিপালন করা। মাঝে মাঝে আসগর ভাবে এতো বড় একটা প্রাণী অথচ মাথায় বুদ্ধি কতো কম। প্রশিক্ষণের সময়, রণক্ষেত্রে কতোবার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু পালিয়ে যায় নি। পোষা হাতি বলে কথা। কি লাভ ওর সুলতান কে পিঠে চড়িয়ে, শিকলে ঝন ঝন শব্দ করে, রণক্ষেত্রে মৃত্যু কে উপেক্ষা করে যুদ্ধ করা? সুলতানের রাজ্য জয়ের নেশার আগুনে নিজে কে আহুতি দিয়ে লাভ কি? এই রাজাদের রাজ্য জয়ের নেশা কখনো শেষ হয়?
কিন্তু সত্যি কি বাহাদুর অনুভূতিহীন? শৈশবে হাতির যূথের সাথে দল বেধে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর কথা ও কি ভুলতে পেরেছে? সেখানে খাবারের প্রাচুর্য না থাক। ছিল অন্য এক স্বাদ। স্বাধীনতার স্বাদ। সেই সময় কেউ তাকে শিকলে বেধে রাখতো না। বাহাদুরের শক্তিশালি দেহ আর নির্মিলীত দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে আসগর হয়তো এইসব কথা কল্পনা করে।
সকাল বেলায় আসগর গিয়েছিল খাজাঞ্চিখানায়। আজ মাসের চতুর্থ দিন। এখনো তার বেতন জোটেনি। চারদিন ধরে আসগর তার বেতনের জন্য দপ্তরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছে। দুই একজন কর্মকর্তা ছাড়া কেউ তার সাথে কথা পর্যন্ত বলে নি। এদের মধ্যে একজন কর্মকর্তা খেকিয়ে বলেছে, মাসের প্রথমে খাজাঞ্চিখানায় অনেক কাজ। নতুন বছরের খাজনা তোলা, হিসাব করা, রাজকোষে জমা দেয়া, সৈন্যদলের বেতন দেয়া আরও কতো কিছু। এতো ব্যস্ততার মধ্যে সামান্য মাহুতের বেতন নিয়ে ভাবার সময় আমাদের নেই। গোমড়া মুখে আসগর ফিরেছে খাজাঞ্চি খানা থেকে। ফেরার পথে আলীর সাথে তার দেখা হলো। আলী আস্তাবলের ঘোড়ার সহিস। বেচারা আলীরও একই দশা। এখনো বেতন পায় নি। আসগরের আধাঁর মুখ দেখে আলী জিজ্ঞাসা করলো,
কি বুড়ো বাবা, তবিয়ৎ ঠিক আছে? বেতন মিলেছে?
আসগর দাড়িঁয়ে জবাব দিলো, বেতন না পেলে কি তবিয়ৎ ঠিক থাকে?
খাজাঞ্চিখানায় গিয়েছিলে? আলী প্রশ্ন করে।
আসগর বললো, সেখান থেকেই তো আসছি। বলে ওরা ব্যস্ত।
কথাটা শুনে যেন জ্বলে উঠলো আলী, ব্যটারা সদাই ব্যস্ত। খাজনার নামে রাজা কৃষকের ফসল কেড়ে নেয়। সেই টাকা আবার পোকায় খায়। মানে উজীর, মন্ত্রী, সেনাপতি, জমাদার রাজ্যের সব কর্মচারী সেই টাকায় ভাগ বসায়।
বিক্ষুব্ধ অন্তরে কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছিল আসগরের। তবে সে ভিতরে ভিতরে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। বলে, রাজার কাজই তো রাজ্য শাসন।
কিন্তু আলীর বয়স কম। তার ক্ষোভ সহজে প্রশমিত হয় না। সে বললো, রাজ্য চলে তিন বিভাগের কাজে। এদের কাজগুলো কি জানো? প্রথম হলো বর্হি বিভাগ। এর কাজ বাইরের রাজ্য লুট করা। দুই অর্ন্ত বিভাগ তথা নিজের রাজ্য লুট করা। আর বাকী হলো আভ্যন্তরীন বিভাগ, যার কাজ নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লুট করা।
এইবার সত্যি ভয় পেয়ে যায় আসগর। বলে, এসব কথা উচ্চারন করো না। রাজবাড়ীর দেয়ালের ও কান থাকে। আমরা সাধারণ মানুষ। অস্থিত্ব থাকবে না।
আলী তবু গোয়ারের মতো মাথা নেড়ে বলে , আমরা কি মানুষের মতো বেচেঁ আছি?
শৈশবে আলী তার বাবার সাথে খেতে কাজ করতো। তাদের পরিবারটা ছিল বেশ স্বচ্ছল। আলীর বাবা তাকে পাঠশালায় ভর্তি করে দিয়েছিল। সেখানে আলী লিখতে পড়তে শেখে। কিন্তু পর পর দুই বছর ঝড় এবং উপর্যপুরি বন্যার ফলে ফসলহানি হয়। আলীর পরিবার সহ বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এত কিছুর পরও খাজনা মওকুফ হয় নি। গ্রামের কৃষকরা পঞ্চায়েতের পাচঁ জন বয়স্ক সদস্য কে সুলতানের কাছে পাঠিয়েছিল খাজনা মওকুফের বিষয়ে কথা বলার জন্য। তারা হাত জোড় করে আর্জি পেশ করেছিল, বাদশাহ মালিক, যদি দয়া করে এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন, তাহলে আগামী বছর বিগত বছরের খাজনা সহ সকল পাওনা আমরা পরিশোধ করে দেবো।
সুলতান আকরামউদ্দীন রূপোর আলবোলার নল টানতে টানতে ভাবলেশহীন ভাবে তাদের কথা শুনছিলেন। এবার মুখ দিয়ে ধোয়াঁর কুন্ডলী ছেড়ে বিদ্রুপাত্নক ভাবে প্রশ্ন করলেন, আসছে বছর আকাল হলে কি করবি?
বৃদ্ধরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। তাদের প্রত্যেকের মুখে ভয়ের ছাপ। একজন তবু সাহস করে বললো, হুজুর, তিন বছরের খাজনা একসাথে এই দুঃসময়ে কিভাবে দেবো?
আলবোলার নল মুখ থেকে বের করে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন সুলতান, আমি কি দান সত্ত্ব করছি না দাতব্য খুলেছি? যে কোনো মূল্যে খাজনা আমার চাই। সুলতানের মুখের পেশী কঠিন হয়ে উঠেছে। চোখ রক্তবর্ণ।
গাওঁবুড়োরা ফিরে এসে এই খবর জানালে সমগ্র গ্রামে কথাগুলো বিদুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের জঠরের আগুনের চেয়ে ভয়াবহ কিছু হতে পারে না। কথা গুলো সেই আগুন কে আরো উস্কে দিয়েছিল। দেখা দেয় স্বতস্ফুর্ত বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল আলীর বাবা। কৃষকরা ছিল অসংগঠিত। নেতৃত্বও ছিল দূর্বল। সুলতানের বাহিনী সহজে সেই বিদ্রোহ দমন করে। তারপর শুরু হয় ধরপাকড়। বিদ্রোহের সাথে জড়িতদের বিনা বিচারে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আলীর বাবা ও তার বড় ভাই কে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। প্রকাশ্যে হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আলীর বয়স তখন ছয় বছর। শিশু বলে সে শাস্তির হাত থেকে রেহাই পায়। কিন্তু আলী সারা জীবনের জন্য সুলতানের ক্রীতদাসে পরিণত হয়। এতো বছর পরেও সেদিনের স্বৃতি আলীর মানস পটে স্থায়ী ভাবে চিত্রিত হয়ে আছে। অনেক সময় তার মনে প্রশ্ন জাগে , আল্লাহর দুনিয়ায় কি জালেমের বিচার নেই? একদিকে অভিজাত সম্প্রদায়ের বিলাস বৈভব অপরদিকে শ্রমজীবী মানুষের সীমাহীন দারিদ্র্য। সুলতানের তানপুরার সুর আর বাঈজীর ঘুঙ্গুরের আওয়াজ ছাপিঁয়ে আর কখনো কি এই মুলুকে বেজে উঠবে না বিদ্রোহের রণধ্বনি।
আলীর এই মনের কথাগুলো আলোচিত হচ্ছিল সুলতানের প্রাসাদ থেকে অদূরবর্তী একটি মহলে। মহলটির মালিক ইওজ খিলজী। তার বাড়িতে আজ গোপন বৈঠক বসেছে। বৈঠকের সভাপতি স্বয়ং ইওজ খিলজী। অবিচলিতভাবে তিনি সবার কথা শুনছিলেন। সভায় উপস্থিত পাচঁ জনের মধ্যে সবাই সম্ভ্রান্ত বংশীয়। এখন কথা বলছেন মোহাম্মদ আজম। তিনি বলছিলেন,
বর্তমানে দেশের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। গ্রামে আকাল এবং মড়ক উভয়ই দেখা দিয়েছে। পর পর দুই বছর আজন্মার ফলে বিস্তর ফসলহানি ঘটেছে। কৃষকের ঘরে ধান নেই। তারা নিজেদের খাবার জোটাতে পারে না। খাজনা দেবে কোত্থেকে?
কুতুবউদ্দীন কথার খেই ধরে বললেন, প্রজাদের এই অবস্থা অথচ সুলতান খাজনা কমাতে রাজী নন। তিনি ফৌজ কে হুকুম দিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে খাজনা তার চাই।
মৃদু কন্ঠে ইওজ খিলজী বললেন, আপনারা অস্থির হচ্ছেন কেন? দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা তো সুলতানের সাথে আলোচনায় বসতে পারি।
এবার মুখ খুললেন গাজী শাহ, আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর আগে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানরা যখন সুলতানের সাথে এই ধরনের একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিল। সুলতান তাদের বের করে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা দেশের অবস্থা সম্পর্কে সুলতান সম্যকভাবে অবগত আছেন। কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। এইসব বিষয়ের চেয়ে তারঁ কাছে সুরা এবং বাঈজীর নাচ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আলাউদ্দীন আলী এতক্ষণ কোনো কথা বলেন নি। এইবার তিনি বললেন, আপনারা সুলতানের বিরুদ্ধে যেতে চাইছেন। কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন যে, সুলতানের ক্ষমতা ঐশ্বরিক।
তীব্র কন্ঠে কুতুবউদ্দীন বলে উঠলেন, আল্লাহ কি জালেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে নিষেধ করেছেন? দেশে কোনো আইন শৃঙ্খলা নেই। সত্য কথা বললে তাকে কয়েদখানায় আটক করে রাখা হয়। সর্বত্র চলছে জুলুম। এ যেন জোর যার মুল্লুক তার।
ইওজ খিলজী সবার কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, আপনারা তাহলে কি করতে চান?
গাজী শাহ দৃঢ় কন্ঠে বললেন, বিদ্রোহ। সুলতান কে সরিয়ে দিয়ে বন্দী করা হবে। তারপর এমন একজন ব্যক্তি কে সিংহাসনে বসানো হবে যিনি হবেন প্রজাবৎসল। দেশে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
কাজটার ঝুকিঁ সম্বন্ধে আপনারা অবগত আছেন? ইওজ খিলজীর প্রশ্ন।
কুতুবউদ্দীন সবার হয়ে উত্তর দিলেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা জীবনের ঝুকিঁ নিতে প্রস্তুত।
বিষন্ন মনে ঘরে ফিরছিল আসগর। হেই বুড়া, ইধার আও। গজশালার অধিপতি কামরাঙ্গ খাঁ নিজে তাকে ডাকছে। চকিতে সজাগ হলো আসগর। কামরাঙ্গ খাঁ গজশালার রক্ষাকর্তা। কিন্তু ভাবখানা তার সেনাপতির মতো। আসগরের মতো সাধারণ কর্মচারীর সাথে সে নিজের গরজে ছাড়া কথা বলে না। আজকে কামরাঙ্গ খাঁয়ের মেজাজ প্রসন্ন। মোলায়েম সুরে জিজ্ঞাসা করলো, এই বর্ষা বাদলের মধ্যে রাস্তায় ঘুরছো কেন?
কামরাঙ্গ খাঁয়ের নরম সুর শুন প্রমাদ গুনলো আসগর। তবে মুখে বললো, আমরা নদী মাতৃক দেশের মানুষ। বৃষ্টিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। কামরাঙ্গ খাঁ বললো, তুমি দীর্ঘদিন হাতির দেখাশুনা করছো। কাজটা ভালো ভাবেই করে থাকো। সময় বা সুযোগ হলে আমি সুলতানের কাছে তোমার কথা বলবো। বলা যায় না হয়তো মোটা ইনাম জুটে যেতে পারে। আসগর হাঁ করে কামরাঙ্গ খাঁয়ের কথা শুনছিল। তার ঠিক মতো বেতন জোটে না। আর সে পাবে ইনাম। ব্যাটার মতলব খানা কি?
আসগর কে নীরব দেখে কামরাঙ্গ খাঁ বললো, সুলতানের বাহাদুরের কথা মনে আছে। শিকারের সময় বা রণক্ষেত্রে হাতিটার পারদর্শিতা অনস্বীকার্য। সুলতান এখন ভাবছেন বাহাদুরকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় কি না?
আসগর জিজ্ঞাসা করলো, কি ধরনের কাজ মালিক? প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলো কামরাঙ্গ খাঁ। শুধু বললো, সেটা তুমি সময় হলে জানতে পারবে। বাহাদুর তোমার ছাড়া আর কারও কথা শোনে না। তাই তোমার সাহায্য প্রয়োজন। এখন এই রৌপ্য মুদ্রাগুলো রাখো।
নিজের ঘরে ফিরে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলো আসগর। থলেটি সে তার তক্তপোষের উপর রেখেছে। মুদ্রাগুলো ইতোমধ্যে সে দুইবার গুণেছে। থলেতে যে পরিমান অর্থ আছে সেটা তার এক মাসের বেতনের দ্বিগুন। কিন্তু আসগর ভেবে পেলো না সে এমন কি সাহায্য করতে পারে , যার জন্য কামরাঙ্গ খাঁ তাকে এতোগুলো মুদ্রা দিল। বাইরে তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সূর্য পশ্চিমাকাশে অস্ত গেছে। আকাশে মেঘ থম থম করছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। আসগর তক্তপোষ থেকে উঠে গিয়ে প্রদীপ জ্বালালো। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর এখন সে বেশ ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত । কিন্তু আজ তার উনুন ধরিয়ে রান্না করতে ইচ্ছা করছিল না। সকালে বাইরে বের হওয়ার আগে সে আটা দিয়ে কয়েক টা চাপটি তৈরী করেছিল। তার একখানা অবশিষ্ঠ আছে। চাপটিটা মুখে গুজে পানি খেয়ে সে শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসতে বিলম্ব হলো না।
আসগরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো মধ্য রাতে। আচমকা চিৎকার, দ্রিমি দ্রিমি শব্দে ঢাকের আওয়াজ আর অসংখ্য মানুষের ছোটাছুটির শব্দ সে ঘরে বসে শুনতে পেলো। আসগর প্রথমে কিছু বুঝতে পারে নি। হতভম্ব ভাব কাটতেই সে দেখতে পেলো তার কুটিরের মধ্যে লাল রঙ্গের আলোর আভায় আলোকিত হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে উকিঁ দিলো সে। আসগর দেখতে পেলো, সুলতানের সুরম্য প্রাসাদের একাংশে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। দ্রুত বাইরে বের হলো সে। প্রাঙ্গনের কোথাও কোনো পাহাড়াদার সেপাই দেখতে পেলো না। তার সম্মুখের রাস্তা দিয়ে অসংখ্য মানুষ দৌড়েঁ পালাচ্ছে। তাদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। আসগর কয়েক জনের কাছে গিয়ে ঘটনার বিষয় বস্তু সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলো। কিন্তু হট্টগোলের মধ্যে কেউই তার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল না। এমন সময় একজন সেপাই ছুটতে ছুটতে আসগরের সামনে এসে দাড়িঁয়ে হাফাঁতে লাগলো। তার কাধেঁ মাথায় আঘাতের চিহ্ন। পিঠ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আসগর তাকে দেখে চিনতে পারলো। আরে এতো সেলিম। সুলতানের প্রাসাদের প্রবেশ দ্বারের পাহাড়াদার। সে জিজ্ঞাসা করলো, সেলিম তোমার এই অবস্থা কিভাবে হলো?
সেলিম উত্তরে বললো, সর্বনাশ হয়েছে বুড়ো বাবা। ইওজ খিলজীর নেতৃত্বে একদল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ফৌজের একাংশ বিদ্রোহীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। প্রাসাদের ভিতরে এবং বাইরে সুলতানের অনুগত পক্ষের সাথে বিদ্রোহীদের তুমুল যুদ্ধ চলছে। আসগর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করলো, সুলতান কোথায়? তার প্রাসাদে তো আগুন লেগেছে।
সেলিম বললো, আরে রাখো তোমার সুলতান। আজকের যুদ্ধে যে জিতবে সেই হবে সুলতান। এখন প্রাণে বাচঁতে চাইলে পালাও। কথা শেষ করে দম নিয়ে সেলিম আবার ছুটতে শুরু করলো।
আসগরের সারা শরীর উত্তেজনায় থর থর করে কেপেঁ উঠলো। অথচ পা দুটো তার অবশ হয়ে গেছে। ছুটতে চাইলেও সে নড়তে পারছে না। তার মনের মধ্যে তখন চলছে তুমুল আলোড়ন। এও কি সম্ভব? সুলতানের হুকুমের দাস কেচোঁর মতো মানুষগুলো মেরুদন্ড সোজা করে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িঁয়েছে। এদিকে হট্টগোল , চীৎকার বেড়ে চলেছে। কয়েদখানা থেকে শোনা যাচ্ছে পাগলা ঘন্টার আওয়াজ। বিদ্রোহী সেপাইরা কারাগারে প্রবেশ করে বিনা বিচারে আটক বন্দীদের মুক্ত করে দিয়েছে। শিকলের ঝন ঝন শব্দ পরিণত হয়েছে রণধ্বনিতে। বিপদ ভুলে আসগর তখনো দাড়িঁয়ে আছে। সে তার কর্তব্য স্থির করতে পারছে না। এমন সময় অন্য সব শব্দ ছাপিয়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেলো। সহস্র বিদ্রোহী সেপাই ঘোড়ায় চড়ে সুলতানের প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের মধ্যে সম্মুখসারিতে একটা সাদা ঘোড়ার উপর বসে আছে আলী। আসগর কে দেখতে পেয়ে চীৎকার করে আলী বললো, ভয় পেয়ো না বুড়ো বাবা। মানুষ জেগে উঠেছে। জালেমের দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার নতুন জামানা শুরু হবে।
এই ঘটনার পর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবী তার আপন নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে। বাংলা মুলুকের মানুষের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে গতানুগতিক ধারায়। সেই উদ্ভিদ সুলভ দাসের জীবন। সিংহাসনে পূর্বের সুলতানই বহাল তবিয়তে আছে বিদ্রোহের খবর সুলতানের গুপ্তচরেরা আগে থেকে জানতো। তারা সুলতান কে সময় মতো সতর্ক করে দেয়। সেদিন সুলতান সবার অলক্ষ্যে প্রাসাদ ছেড়ে দূরবর্তী স্থানে আত্নগোপন করে ছিলেন। তার অনুগত বাহিনী প্রস্তুত থাকায় সুলতানের পক্ষে বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়েছিল। এই ঘটনার পর সুলতান আরো উগ্র রূপ ধারণ করেন। তিনি চন্ড নীতি অনুসরন করতে শুরু করেন। অধিকাংশ বিদ্রোহী রণক্ষেত্রে প্রাণ হারায়। স্বয়ং ইওজ খিলজী সম্মুখ সমরে যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। যারা মারা গিয়েছিল তারা অন্তত অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়। আর যারা বন্দী হয়েছে তাদের উপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। সুলতানের আদেশে আজ এমনি কয়েক জন বন্দীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে। তাদের মৃত্যুদন্ড হবে প্রকাশ্যে। দন্ডের ভয়াবহতা দেখে প্রজারা যাতে উপলব্ধি করতে পারে সুলতানের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাড়াঁবার শাস্তি কতো ভয়ানক। তারা যেন স্বপ্নেও বিদ্রোহের কথা কল্পনা না করে।
হাতিশালায় বাহাদুরের পাশে বসে আছে আসগর। বাহাদুর বেশ খোশমেজাজে আছে। সুলতানের আদেশে গত তিনদিন ধরে বাহাদুরের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া হচ্ছে। একটু পরে তাকে রাজকীয় সাজে সজ্জিত করা হবে। এখন সে মহানন্দে কলাগাছের পাতা চিবোচ্ছে। হাতিটির দিকে বিভ্রান্ত ভাবে তাকিয়ে আছে আসগর। মনে মনে সে তার মানব জন্ম কে ধিক্কার দিচ্ছে। সে যদি ঐ হাতির মতো প্রাণী হতো তবে সে রক্ষা পেতো। বোধশক্তিহীন হলে পারিপার্শ্বিক ঘটনা গুলো তার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারতো না। এই এক সপ্তাহে আসগরের বয়স অনেক বেড়ে গেছে। বিদ্রোহে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া না যাওয়ায় আসগরের কোনো শাস্তি হয় নি।
প্রাসাদের পাশে বধ্যভূমির জন্য নিদির্ষ্ট স্থান রয়েছে। দুপুরের পর থেকে সেখানে লোক সমাগম শুরু হয়েছে। বধ্যভূমির একপাশে সুলতানের বসার জন্য নির্মিত হয়েছে সুউচ্চ বেদী। সুলতান এসে আসন গ্রহণ করে হুকুম দেবেন। তখন বিদ্রোহীদের দন্ড কার্যকর করা হবে। রাজকীয় সাজে সজ্জিত করে বাহাদুর কে বধ্যভূমিতে আনা হয়েছে। তার সাথে এসেছ আসগর। সে ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে তাকাচ্ছে। কারো মুখে কোনো সহানুভূতির চিহ্ন নেই। বধ্যভূমির কার্যক্রম পরিচালনা করছে কামরাঙ্গ খাঁ। তার চোখে মুখে হিংস্র উল্লাস। এমন সময় প্রচন্ড জোরে বেজে উঠলো ঢাক আর বাজনা। সুলতান বধ্যভূমিতে এসে পৌছেঁছেন। নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করে তিনি বন্দীদের আনতে হুকুম দিলেন। চার চাকায় টানা ঘোড়ার গাড়ির উপর নির্মিত লোহার খাচাঁয় করে বন্দীদের আনা হলো। খাচাঁর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো আসগর। তিন জন বন্দীর মধ্যে একজন হলো আলী। আলী নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার হাত ও পা শৃঙ্খলাবদ্ধ।
কামরাঙ্গ খাঁ আসগরের দিকে এগিয়ে এসে বললো, তিন জন বন্দীর মধ্যে একেক জন করে বধ্যভূমিতে ছুড়ে দেয়া হবে। বাহাদুর তাদের পায়ের তলায় পিষ্ট করে হত্যা করবে। যতো ক্ষণ না বন্দীর মৃত্যু হয় ততোক্ষণ বাহাদুর তাকে পিষ্ট করে যাবে। সমস্ত কাজটা আসগর তোমাকে পরিচালনা করতে হবে। আসগর শুনে নির্বাক হয়ে দাড়িঁয়ে রইলো । নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। কামরাঙ্গ খাঁ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খেকিঁয়ে উঠলো, কি ব্যপার? তুমি সুলতানের হুকুম শুনতে পাওনি? আসগর সোজাসুজি কামরাঙ্গ খাঁয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো, আমি এই কাজ করতে পারবো না। সুলতান যদি হুকুম দিয়ে থাকেন তবে তাকেই বলুন কাজটা পরিচালনা করতে।
গর্জে উঠলো কামরাঙ্গ খাঁ। উপস্থিত জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিলো। কথাটা সুলতানের কানে পৌছাঁতে বেশি সময় লাগলো না। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন সুলতান। হুকুম দিলেন বন্দীদের সাথে আসগরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে। বাহাদুর কে বধ্যভূমিতে এনে শিকল খুলে দেয়া হলো। তার সামনে ছুড়ে দেয়া হলো আসগর কে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে হাতিটি দাড়িঁয়ে রইলো। সম্মুখে পড়ে আছে তার প্রিয় মানুষ। তাকে সে কোনোদিন আঘাত করেনি। এদিকে কামরাঙ্গ খাঁ উচ্চ স্বরে হাতিটি কে সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলো। কিন্তু বাহাদুর সব নির্দেশ উপেক্ষা করে দাড়িঁয়ে রইলো। মরীয়া হয়ে কামরাঙ্গ খাঁ সৈন্যদের বললো, ওকে বর্শা দিয়ে আঘাত করো। তীরের মতো ছুটে এলো বর্শা। বাহাদুরের বাম পায়ে এসে আঘাত করলো। তারপর কি ঘটলো কে জানে। হাতিটি হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো। আসগর কে পাশ কাটিয়ে সে ভীড়ের মধ্যে ছুটে গিয়ে মানুষের উপর ঝাপিঁয়ে পড়লো। লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। পাগলা হাতি ক্ষেপেছে। যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো।
সুলতান কে তার ফৌজ আগেই নিরাপদ দুরুত্বে সরিয়ে নিয়ে গেছে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা আসগর ও আলীর গর্দান নেয়া হলো কয়েদ খানায়। বাহাদুরের খোজঁ করে আর পাওয়া যায় নি। লোকে বলে সে নাকি ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। পাগলা হাতির খোজঁ আর কেউ করে নি। পূর্ণিমা রাতে নদীর তীর ঘেষে হয়তো বাহাদুর ছুটছে বনভূমির দিকে। সেখানে আছে তার স্বাধীনতা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও গল্পটির ঘটনা ও চরিত্র সবই কাল্পনিক।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অসাধারণ কথামালায় মুগ্ধতা। অনেক অনেক ভালো লেগেছে লেখাটি।
বিষণ্ন সুমন প্রথমটায় সত্যি সত্যিই ঐতিহাসিক কোন কাহিনী ভেবেবেছিলাম। পরবর্তীতে পড়ার পর মনে হলো ঘটানাটা সত্যি না হলেও আপনার লেখার মুন্সীয়ানায় গল্পটা বেশ প্রাণবন্ত। লেখায় যথেষ্ট গতি ছিল। পশু প্রেমটা বেশী আবেগী করে তুলেছে। লিখতে থাকুন এমন করেই। শুভ কামনা রইলো ভাই।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত। এই গল্পে যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতার জন্য মানুষের সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে।

০৩ মার্চ - ২০১৯ গল্প/কবিতা: ৩৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী