তাজমহল রোডে নির্দিষ্ট ফার্স্ট ফুডের দোকানের সামনে এসে রিক্সা থেকে নামলো শিলা । সে ঈষৎ বিরক্ত হয়েছে বোঝা যায় । কোনো বিলাসবহুল রেস্তোরাতে বসার
সামর্থ্য তার আছে । কিন্তু বাধ সেধেছে সমীর । তার একই কথা । আমার ঐসব রেস্তোরাতে বসার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই । তবে ভিতরে প্রবেশ করে মনটা ভাল
হয়ে গেল শিলার । ভিতরটা বেশ প্রশস্থ । ছিমছাম পরিবেশ । ঘড়িতে সময় দেখলো । চারটা বাজতে দশ মিনিট বাকি । সমীরের আসার কথা চারটায় । কাচেঁর জানালা দিয়ে
আনমনে বাইরে তাকালো শিলা । আকাশ এতক্ষণ মেঘলা ছিল । এখন বৃষ্টি পড়ছে । বাড়িতে গ্যারেজে দুইটা গাড়ি থাকা সত্বেও শিলা আজ মতিঝিল থেকে বাসে এসেছে ।
তারপর শ্যামলিতে নেমে সোজা রিক্সায় করেএখানে এসেছে । সমীর নিশ্চয় বলবে এটা বড়লোকদের খেয়াল । ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় শিলার ইচ্ছা হয়েছিল,
সে প্রীতিলতা হবে । ক্যাম্পাসে প্রায় বামপন্থী ছাত্রদের সভা সমাবেশ হতো । তাদের বক্তব্য শুনে সমাজ পরিবর্তনের জন্য ঝোক হয়েছিল শিলার ।তাই
একদিন তার শৌখিন পোশাক বাদ দিয়ে সাধারণ তাতেঁর তৈরী পোশাক পড়ে হাজির হয়েছিল ক্লাসে । শুধু তাই নয়, তার কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো দীর্ঘ ঘন
কালো চুল ছেটে কাধঁ অব্দি তুলে ফেলেছিল । ক্লাসমেটরা সবাই অবাক । রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল এই নতুন বিপ্লবী । শুধু সমীর এই দলে যোগ দেয়নি । একপাশে দাড়িঁয়ে মৃদু হেসেছিল ।
সমীর পড়তো ইতিহাস বিভাগে । আর শিলা ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রী । সেমিনারে ক্লাসমেটদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় সে লক্ষ্য করতো ,
একটা ছেলে প্রায় তন্ময় হয়ে সেলফের বই দেখছে । ছেলেটি কে সে বামপন্থী ছাত্রদের সমাবেশে ও দেখেছে । খুবই আটপৌরে পোশাক আর সাধারণ
মুখচ্ছবি । তার পড়ার প্রতি আগ্রহ ছাড়া আর কোনো বৈশিষ্ঠ্য চোখে পড়ার মতো নয় । তবু কেন যেন একদিন শিলা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
আপনি কোন ইয়ারে পড়েন ?
তার দিকে তাকিয়ে সমীর সহজভাবে উত্তর দিয়েছিল , আমি ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। থার্ড ইয়ারে পড়ি।
একটু অবাক হয়ে শিলা প্রশ্ন করেছিল, ইতিহাসের ছাত্র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বই দিয়ে কি করেন ?
ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী পরষ্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একটা বিষয় অতীতের ঘটনাবলীর উপর গুরুত্ব দেয় । আর আরেকটা বিষয়
বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করে । এগুলো পড়তে আমার ভাল লাগে । সমীরের সাবলীল উত্তর ।
ঢোক গিললো শিলা । পড়তে ভাল লাগে এমন কোনো মানুষ কি সত্যি হওয়া সম্ভব? তার বন্ধু আবীর বা তুহিনরা সারা বছর লেখাপড়া করে না ।
পরীক্ষার আগের দিন রাতে হল থেকে নোট নিয়ে আসে । তারপর পাচঁটা প্রশ্নের উত্তর পড়ে পরদিন সকালে পরীক্ষা দেয় ।আর এই ছেলে দেখি
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় । শিলা আবার প্রশ্ন করলো, এত লেখাপড়া করে লাভ কি ?
এতক্ষণে একটু হাসির রেখা দেখা দিলো সমীরের মুখে ।সে বললো, মানুষ সবকিছু লাভের জন্য করে না । সেই প্রথম পরিচয়ের পর প্রায়ই দুইজনের কথা হতো ক্যাম্পাসে ।
মধুর ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে শিলা বলতো, বর্তমান একমেরু কেন্দ্রিক বিশ্বে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা বৃথা । ইতিহাসের গতি বোধহয় এখানে থেমে গেছে । সমীর বিচলিত না হয়ে উত্তর দিতো , মধ্যযুগ প্রায় এক হাজার বছর স্থায়ী হয় । তারপরও কিন্তু ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল । সমীরের চোখেমুখে আশাবাদের ছাপ ।প্রত্যয়ের সুরে সে
বলতো, বুঝলে শিলা, একটা স্ফলিঙ্গ থেকে দাবানল জ্বলে উঠতে পারে। ফার্স্টফুডের দোকানে কোণের একটা চেয়ারে বসে এইসব কথা ভাবছিল শিলা । অতীত থেকে ফিরে এসে ঘড়ির দিকে তাকালো সে। চারটা বেজে দশ মিনিট । অতীতের সেই দিনগুলোর সাথে আজকের দিনটার কতো পার্থক্য। তখন চোখে স্বপ্ন ছিল। সমাজ পরিবর্তনের
সংগ্রামের প্রত্যয় নিয়ে দুইজন একসাথে মিছিলে যেতো। আট বছর পর এইসব চিন্তা অবাস্তব বলে মনে হয়। চারটা বেজে পনের মিনিট তখন।
শিলা দেখলো একটা লোক বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দোকানের দিকে আসছে। দেখেই চিনলো সে। সমীর আসছে। সেই আটপৌরে পোশাক।
সাধারণ মুখভঙ্গী । একটু যেন বিভ্রান্ত হলো শিলা। এত বছর পর কি বলবে সমীরকে। সমীর দোকানে ঢুকে শিলার মুখোমুখি বসলো। শিলা প্রথম
কথা বললো, যাক চিনতে পেরেছো। একদম ভিজে গেছো। একটা রিক্সায় আসতে পারতে। সমীর বললো, বাস থেকে নামার সাথে সাথে
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভাবলাম হেটেঁই যাই। তোমার খবর কি ? এত দিন পর জরুরী তলব। শিলা বললো, চলছে একরকম। কিছুক্ষণ দুজনই
নীরব থাকলো। সমীর একটু আনমনা হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় ক্যাম্পাসের কথা। সারি সারি কৃষ্ণচুড়া গাছ। লাল আর হলুদ বর্ণের ফুলে ছেয়ে আছে।
তার তলা দিয়ে শিলা আর সমীর হাটঁছে। শিলা বলতো লাল রংটা আমার পছন্দ নয়। সমীর মনে করিয়ে দিতেো, বিপ্লবের পতাকার রং কিন্তু লাল হয়।
নীরবতা ভাঙ্গলো শিলার প্রশ্নে, এখন কি করছো ? সমীর বললো, আমি পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। শিলা বললো, তুমি তো মাস্টার্সে ফার্স্টক্লাস পেয়েছিলে।
ইচ্ছা করলে ইউনিভার্সিটির টিচার হতে পারতে।
সমীর স্বাভাবিক ভাবে বললো, আমার ইচ্ছা করে নি। তাছাড়া ওখানে দলাদলি আছে। অসহিষ্ণু ভাবে প্রশ্ন করলো শিলা, এই জীবন কি আমরা চেয়েছিলাম?
শান্তভাবে সমীর বললো, কেনো , আমি তো বেশ আছি। জনগণের সাথে আছি। শিলা বললো, বিপ্লব, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন এইসব মরীচিকার পিছনে ছুটে
জীবনটা শেষ করলে? সমীর বললো, আমি তো তোমাকে যেতে বলিনি শিলা। তুমিই আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। কেপেঁ উঠলো শিলা। শিলার বাবা ব্যাংকের
অফিসার। মাস্টার্সে পড়ার সময় তার বিয়ে ঠিক হয় আহসানের সাথে। আহসান বুয়েট থেকে পাস করা ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকা
যাবার কথা। শিলা আপত্তি করেনি তা নয়। মনে দ্বিধা ও ছিল। কিন্তু আহসানের সাথে দুইবার রেস্তরাতে বসার পর শিলা তাকে বিয়ে করার সিধান্ত নেয়। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই প্রত্যাশার জোয়ারে ভেসে যায়, প্রেম, বিপ্লব, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন।
শিলাকে নিশ্চুপ দেখে এবার সমীর প্রশ্ন করে, এত দিন পর এইসব কথা উঠছে কেনো? শিলা আস্তে আস্তে বললো, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে । দুই বছর
আগে। ডিগ্রি আর টাকা ছাড়া আহসানের যে বৈশিষ্ঠ্য ছিল, তা হলো স্মার্টনেস এবং বহু নারীর প্রতি আসক্তি।
সমীর চুপ করে থাকে। কোনো কথা বলে না। শিলা ক্লান্ত স্বরে বলে, আমি হাফিঁয়ে উঠেছি সমীর। এই জীবন যাপন করা আমার জন্য অসহনীয় ।
সমীর শান্তভাবে বললো, তুমি ইচ্ছা করলেই কাউকে ভালবাসতে পারো। নতুন জীবন শুরু করতে পারো। শিলা বললো, তুমি আমি কি আবার নতুন করে একসাথে
পথ চলতে পারি না? বিচিত্র ভাবে হাসলো সমীর। বললো, সেই জন্য আমাকে কি করতে হবে? শিলা বললো, রাজনীতি করা ছেড়ে দাও। বাবার ব্যবসা তুমিই দেখাশোনা
করতে পারবে। আমি একটা এনজিও তে চাকরি করি। আমাদের অসুবিধা হবে না। সমীরের মুখে বিচিত্র হাসিটি এখনো আছে। সে বললো, সেই ভোগ সর্বস্ব জীবন।
সমষ্টি কে বাদ দিয়ে ব্যক্তির চিন্তা। অর্থ, যশ, প্রতিষ্ঠা। না, এইসব আমার দরকার নেই। আমি পারবো না ।
উত্তেজিত হয়ে উঠলো শিলা, শুধু অলীক স্বপ্নের পেছনে ছোটা। এই পার্টি তোমাকে কি দিয়েছে? তুমি নেতা হতে পেরেছো? ভবিষ্যতে মন্ত্রী হতে পারবে? সমীর এখনো
অবচলিত। বললো, আত্নস্বার্থের মানদন্ডে সবকিছু বিচার করা যায় না শিলা। তোমরা হয়তো পারো । কিন্তু সবাই সেটা করতে পারে না। আমাদের নীতি এবং গন্তব্য যেহুতু
ভিন্ন, সেকারণে পথ ও আলাদা হয়ে যাক। তোমার জন্য শুভ কামনা রইলো। উঠে দাড়াঁলো সমীর । তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
দেশের প্রতি ভালবাসার জন্য অনেক সময় আত্নস্বার্থ
ত্যাগ করে সমষ্টি কে প্রাধান্য দিতে হয়। গল্পে সেই
বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
০৩ মার্চ - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৩
বিচারক স্কোরঃ ১.৪ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৯ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪