শীতের ভোর রাত থেকে নিজের ঘরে বসে কাঁপছিল জরিনা । ঘর বলতে কড়িকাঠ আর পলিথিনে তৈরি সারি সারি ঝুপড়ি বস্তি । রেললাইনের পাশে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠেছে । এখানে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয় । গ্রাম থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষের অনেকের আশ্রয়স্থল এসব বস্তিঘর । মাঝে মাঝে এসব বস্তিতে আগুন লেগে যায় । জমি দখলের জন্য কোনো একপক্ষই হয়তো আগুন লাগিয়ে দেয় । কেউ কেউ পুড়ে মরে । যারা বেঁচে থাকে তারা নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয় । ঢাকা শহরে শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে । অভিজাত বিপনিবিতান সহ ফুটপাথের দোকান গুলোতে গরম কাপড় , কম্বল বিক্রি বেড়ে গেছে । দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা অনুসারে ফুটপথের দোকানগুলোতে ভিড় বেশি । তবে এই ঢাকা শহরে আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে , ফুটপথের দোকান থেকেও শীতের কাপড় কেনা তাদের জন্য বিলাসিতা । বলছি রাস্তার ধারে বা রেলস্টেশনে খোলা আকাশের নীচে বসবাসরত মানুষের কথা । ঝড় , বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বাজার অর্থনীতির আগ্রাসনের ফলে জমিজমা হারিয়ে এই মানুষ গুলো ভূমিহীন শ্রমিকে পরিণত হয় । কাজের সন্ধানে তারা শহরে আসে । কিন্তু দেশে শিল্প কারখানার পর্যাপ্ত বিকাশ না হওয়ায় এদের কর্মসংস্থানের সমস্যা প্রকট । এদের জীবনযাত্রার ধরণও মানবেতর । জরিনা খাতুন তাদের একজন । আজ দিনের শুরুটা তার ভালো হয়নি । ভোরে পানি নেয়ার জন্য রাস্তার ধারে কলের পাশে লাইনে দাঁড়াবার সময় পাশের ঝুপরির জোৎস্নর মায়ের সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়েছে । হারামজাদী বেটি নিজে তো প্লাস্টিকের বালতিতে পানি ভরে , সাথে করে দুই ছেলেমেয়েও নিয়ে আসে । তারা ঘটিবাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে লাইনে জায়গা দখলের জন্য । জরিনার আজ শরীরটা খারাপ লাগছিল । লাইনে অতোক্ষণ দাঁড়াবার ধকল সহ্য করতে না পেরে জোৎস্নার মাকে দুই কথা শুনিয়ে দিয়েছিল । জোৎস্নার মাই বা ছাড়বে কেন ? নবাবের বেটি লাইনে দাড়াঁতে না পারলে তিন তলা বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকুক । যতো ইচ্ছা পানি খরচ করতে পারবে । জরিনা আর কথা বাড়াইনি । জীবনের প্রতি পদক্ষেপে হেরে যাওয়া তার নিয়তি। জরিনা বিকাল বেলা রাস্তার পাশে ফুটপথে বসে পিঠা বানিয়ে বিক্রি করে । কবে কোন শৈশবে মা- নানীর কাছে বসে ভাপা আর চিতই পিঠা বানানো শিখেছিল সে । নানী বলতেন, মেয়েদের রান্নার হাত ভালো হলে বড় ঘরে বিয়ে হয় । বিয়ে তার হয়েছিল একই গ্রামের রইস মিঞার সাথে । স্বামীর নিজের ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছু ছিল না । পাশের সর্দার বাড়িতে কামলা খাটতো রইস মিঞা । অষ্টাশির বন্যায় সেই ভিটেও নদী গর্ভে তলিয়ে যায় । তারপর স্বামী আর দুই ছেলেমেয়ের হাত ধরে জীবিকার সন্ধানে জরিনা ঢাকায় আসে । স্বামী মারা গেছে প্রায় আট বছর আগে । তার কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো জরিনা । বিকাল বেলা আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে । শীতের শেষে নগরীতে বসন্ত এসেছে । গাছপালা নবপল্লবে ঢেকে গেছে । সেটা জরিনার জন্য আনন্দের কোনো বার্তা নয় । কারণ এই সময় তার বানানো পিঠা বিক্রি হয় না । শীতের সময় সন্ধ্যাবেলা পিঠা বিক্রি ভালো হয় । যদিও ঢাকা শহরে ফার্স্টফুডের দোকান বৃদ্ধির ফলে পিঠার চাহিদা কমে গেছে । তবু রাস্তার পাশে ছোট ছোট চুল্লীতে তৈরী ভাপা আর চিতই পিঠা এখনো বেশ বিক্রি হয় । দাম কম হওয়ায় সাধারণত নিম্নশ্রেণীর লোকজনই এসব পিঠা কেনে।
জরিনা আজ পিঠা বিক্রি করে যে কয়টা টাকা পেয়েছিল , সেগুলো কেড়ে নিয়ে গেছে তার ছেলে শহীদুল। তার পাচঁ ছেলমেয়ের মধ্যে শহীদুল সবার ছোট । এই ঢাকা শহরে কোনো এক বস্তিতে তার জন্ম । জরিনার বড় দুই ছেলের মধ্যে একজন ভাড়ায় রিক্সা চালায় । অন্যজন রাজমিস্ত্রীর কাজ করে । তারা বিয়ে করার পর আলাদা হয়ে গেছে । মায়ের খোজঁ- খবরও নেয় না । জরিনা শহীদুলকেই চোখের সামনে দেখতে পায় । সেটা না দেখার মতো । শহীদুল দিনের বেলা এলাকায় ভ্যানে করে সবজী বিক্রি করে। রাতে করে নেশা । নেশার টাকায় হয়না বলে মাঝে মাঝে মায়ের কাছের থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে যায় । শহীদুলকে বিধাতার অপকর্ম ছাড়া জরিনা আর কিছু ভাবতে পারে না । বেশ অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি হওয়ায় জরিনা তার পিঠা তৈরীর সরঞ্জাম গোছাতে শুরু করে । আজ আর খদ্দের আসবে বলে মনে হয় না । বৃষ্টির দিনে রাস্তায় লোকজন কম । জরিনা তার ঝুপরি ঘরের দিকে রওনা দেয় । বড় রাস্তা থেকে রেললাইন বেশ খানিকটা দূরে । পথে যেতে একটা বড় ভাসমান ডাস্টবিন পড়ে । উৎকট গন্ধের জন্য এর আশেপাশে মানুষ আসে না । জরিনার জ্বর এসেছে । ডাস্টবিন পর্যন্ত আসতে গিয়ে সে হাপিঁয়ে ওঠে । একটু দাড়াঁয় বিশ্রাম নেয়ার জন্য ।বিড় বিড় করে বলে, জারে কাইপ্যা মরলাম আইজ । শালা বাদলা হওনের আর সময় পায় না । গালিটি কার উদ্দেশ্যে দেয়া তা বোঝা যায় না। তখনই তার কানে আসে প্রচন্ড কুকুরের ডাকের শব্দ । অদূরে একপাল কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে । জরিনা বিরক্ত হয় । তার একটু বিশ্রাম নেওয়ারও উপায় নেই । অভিজাত এলাকার অধিকার যেমন বিত্তশালীদের, ডাস্টবিনের দখল তেমন কুকুর- বিড়ালের । কয়েকটা গালি দিয়ে জরিনা উঠে পড়ে । আর তখনই চোখে পড়ে কাপড়ে জড়ানো একটা পোটলা ধরে কয়েকটা কুকুর কামড়া কামড়ি করছে । আর সেই পোটলা থেকে ভেসে আসছে শিশুর কান্না । শিউড়ে ওঠে জরিনা । সে যা ভাবছে তা কি ঠিক ? কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত নবজাতককে হয়তো কাপড়ে জড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গেছে । তড়িঘড়ি করে জায়গাটা পার হয় জরিনা । তারপর নিজের ঝুপরির দিকে ছুটতে শুরু করে । কিন্তু মাঝপথে এসে দাড়িঁয়ে পড়ে সে । হাফঁ ধরে গেছে তার । নিজের এলোমেলো চিন্তাগুলো গুছাতে শুরু করে জরিনা । মানব শিশু পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষ । সেই শিশুকে যারা ডাস্টবিনে ফেলে যায়, তারা কি মানুষ হতে পারে ? এমনও হতে পারে শিশুটি সমাজ কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনো সম্পর্কের ফসল। তাই যদি হয় তবে ডাস্টবিনে থাকাই তার শ্রেয় । কিন্তু এখানে থমকে যায় জরিনা । শিশুটি তো নিষ্পাপ । একটা মানব শিশু কুকুর- বিড়ালের খাদ্য হবে আর সে কিছু করবে না ? জীবনে জরিনা কোনোদিন মানুষের মর্যাদা পায়নি । তার শিক্ষা দীক্ষা নেই । শিশুটিকে বাচাঁতে গেলে তাকে নানা ঝামেলায় পড়তে হতে পারে । কিন্তু মানুষের সহজাত মানবিক বোধ থেকে জরিনার মন বলছিলো, শিশুটির কাছে তার ফিরে যাওয়া উচিত । আবার ফিরে এলো জরিনা ডাস্টবিনের কাছে । শিশুটির কান্না ক্ষীণ হয়ে এসেছে । কুকুর গুলো তখনও তাকে ঘিরে রেখেছে । কুকুর গুলো তাড়িয়ে শিশুটিকে নিরীক্ষণ করলো জরিনা । বাচ্চাটা আহত হয়েছে কিন্তু তখনও বেচেঁ আছে । আস্তে আস্তে কাপড়ে জড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো জরিনা । পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত । জরিনা থানায় জানাবার পুলিশ এসে নবজাতকটিকে উদ্ধার করে একটা অনাথ আশ্রমে পাঠায় । শোনা যাচ্ছে, একটি দম্পতি শিশুটিকে দত্তক নেয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
শীত ও মানবতার গল্প ।
০৩ মার্চ - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।