শিমুলতলা গ্রাম। বসন্ত দিন শিমুলতলা গ্রামে শিমুল ফুলের গন্ধে গ্রামটি ভরে যায়। গাছে গাছে পাখি আসে ফুলে মধু খেতে, তা দেখতে কতই না ভাললাগে। গ্রামটির নাম শিমুলতলা হয়েছিল কেন হয়তো এখনো কেউ বলতে পারে না। তবে অনেকের ধারণা এই গ্রামে অনেক শিমুল তুলার উৎপাদন হতো বলেই সেই গাছের নাম অনুসারে গ্রামটির নাম দিয়েছে শিমুলতলা গ্রাম। এখন আর সেই আগের দিনের মত এই গ্রামে শিমুল গাছ নেই, নেই কোন বসন্তের আগমনের পাখিদের আভাস। শিমুল তলা গ্রামটি আগের মত বড় নেই, নদীতে বিলিন হয়ে গেছে দুই-তৃতীয়াংশ। গ্রামটিতে এখন হাতে গুনা বিশ-ত্রিশটি পরিবারের বসবাস। আগের মত এই গ্রামে ব্যস্থতা দেখা যায় না। গ্রামটি হয়েগেছে শান্ত নিবির গ্রাম।হানিফ সেই গ্রামের একজন কৃষক। তেমন লেখা পড়া জানে না।নিজের জামিতে কাজ করে তার সংসার চলে। অন্যেরা কি বলে সেইদিকে তার খেলা হয় না। সে নিজে যা বুঝে তাই করে। একদিন রাতে হানিফ কাজ শেষে ঘরে ফিরে। তার স্ত্রী তাকে বলে,
:এই শুনছ।
:হু, শুনছি। বলল কি বলবে?
: মেয়ে বড় হয়েছে তোমার কোন খেয়াল আছে।
হানিফ হাসির ছলনায় বলে, কত বড় হয়েছে?
: অনেক বড়।
: তা এখন আমার কি করতে হবে?
: মানে?
: আরে কি করতে হবে, না বললে বুঝব কেমন করে?
: মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে না।
: ওর বয়স সবে মাত্র ১৩ পেরিয়ে ১৪বছরে পা রাখল। আর...
: সরকার ঘোষণা দিয়েছে ১৬ বছরের মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যাবে।
: আমাগো কুসুমের ১৬ বছর এখনো হয়নি।
: বয়স বানিয়া আনবা।কুসম স্কুলে যাওয়া আসার পথে অনেকেই অনেক কথা বলে। তাছাড়া পাশের গ্রাম থেকে আমগো কুসুমকে দেখতে আসছিল। তারা পছন্দ করে গেছে। তুমি রাজি থাকলে, কথা বাড়াব।
: এখনই এতো বিয়ের তাড়া ক্যান? আরেকটু বড় হোক আমাগো কুসুম।
: কুসুমকে এই ব্যপারে কিছু বলস?
: না। তারা শুধু হাঁটা পায়ে মেয়েকে দেখে গেছে। কুসুম জানবে কি করে।
: এখন ঘুমাও পরে দেখা যাবে।
জসির উকালতি পড়া পড়তেছে। তার মায়ের ইচ্ছা সমাজের সবাইকে তার ছেলে আইন বিষয়ে সাহায্য করবে। তার ছেলের গ্রামে নাম ডাক ফুটবে। সকলে তাকে জানবে চিনবে। সকালবেলা তার মা কাছে্ এসে বলছে, বাবা জসিম, তোর এল্ এল্ বি শেষ হলে কচি করে লাল টুকটুকে একটা বৌ নিয়ে আয়।
: মা, এখনো চাকুরী ধরতে পারলাম না।
: সব হবে আগে বিয়ে করে নে। আমি আর কত দিন...
: মা, ও কথা বলনা।
: বাবা, আমি তোর জন্য মেয়ে দেখে রেখেছি।
: কোথায়?
: শিমুলতলা গ্রামে। তুই একদিন গিয়ে দেখে আয়।
জসিম কিছুতেই রাজি হচ্ছিলনা, কিন্তু মায়ের পিরাপিরেতে সে রাজি হয়ে গেল। জসিম মেয়ে দেখে এলে তার মা জিজ্ঞাস করে, বাবা জসিম কুসুম কে দেখেতে কেমন লাগল?
জসিম মার জব্বাবে বলে, মা! তোমার তো সেই পছন্দ।
: দেখতে হবেনা ছেলেটা কার।
তাহলে বিয়ের দিন তারিখ পাকা করব।
: হ্যা। তবে
: তবে আবার কি?
: আমার চাকুরী না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
: তাহলে মেয়েকে আংটি পরিয়ে রাখি।
যেহেতু ছেলে মায়ের কথা রেখেছে সেহেতু মাও ছেলের কথা রাখতে চায়, তাই জসিম ও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু মেয়ের কি বিয়ের বয়স হয়েছিল? তার জসিমের মাথায় একটুকো ধরলো না। মেয়ে দেখে পছন্দ হয়েছে ব্যাচ তাতে তার চলবে।
হানিফের স্ত্রী সব কাজ শেষ করে, পাকা কথা দিয়ে ফেলেছে কিন্তু হানিফকে জানায়নি। হানিফও এই ব্যপারে জানতে চাইনি। রাতে আবার একদিন হানিফের সাথে কথা বলে, এই ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
: না।
: আমার একটি কথা ছিল।
: কি কথা বলে ফেল? আমার ঘুম পাচ্ছে।
: বলছিলাম, আমাগো কুসুমরে আংটি পরিয়ে রাখতে চায়।
: কে?
: ছেলের পক্ষ।
: কেন?
: ছেলের মা ছ'মাস সময় চেয়েছে। ছেলের চাকুরী হবে তার পরে।
: তোমার কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
: আমাগো কুসুমরে তাগো পছন্দ হয়েছে, তারা তাদের ছেলের বৌ বানাতে চায়।
: কুসুমের বয়স তো কম?
: তুমিও তো আমাকে বিয়ে করেছিলে তখন আমার বয়স কত হবে? পনেরো কিংবা ষোলো। তাতে আমার কি হয়েছিল।
: ছেলের বাবার তো অনেক আছে, তবে বিয়ে পিছিয়ে রাখতে চায় কেন?
: বাবার যতই থাক। ছেলে বেকার বলে কথা।
: মেয়ের মতামত নেওয়া উচিত ছিল।
: মেয়ে মানুষের আবার কিসের মতামত, আমার বিয়ের সময় তো আমার বাবা-মা আমাকে জিজ্ঞাসও করেনি। মেয়ের বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
: তোমাদের যা ভাল মনে হয় তাই করো। আমি এর কিছুই জানি না...
জসিম তার বিয়ের জন্য কার্ড বানিয়ে এনেছে। সে নিজ হাতে বন্ধুতের মাঝে কার্ড বিলি করেছে। তার সবচেয়ে অসল বন্ধুর সাথে তার দেখা হলে সে বলে, আদনান দাড়া।
আদনান পিছু ফিরে তাকায় এবং সে মনে মনে ভাবে কিসের জন্য আমাকে ডাকলো?
জসিম তার সামনে এসে বলে, বন্ধু এই নে আমার কার্ড।
আদনান বলে, তোর কার্ড মানে?
: তোর সাথে আমার প্রথম দেখা হলো তাই তোকে দিয়ে শুরু করলাম। এটা আমার বিয়ের কার্ড।
: মেয়ে দেখলি কবে, কিছুই তো জানলাম না?
: মা দেখে রেখেছিল। এজন্য কোন বন্ধুকে জানাতে পারি নাই।
: মেয়ের বাবা কাছে কিছু চাসনি ?
: আরে কোন যৌতুক আনব না।
: ভাল। আমি যৌতুক একদম পছন্দ করি না।
: আদনান এখন আর কথা না বললাম সবাইকে দাওয়াত দিতে হবে। তুই কিন্তু বিয়ের আগের দিন থেকেই থাকবি কেমন?
হলুদ বাটো মেন্দি বাটো...
জসিম আদনানের কাছে এসে বলে, বন্ধু তোকে নগ্গনের সাথে যেতে হবে।
আদনান অবাক হয়ে বলে, আমাকে যেতে হবে কেন? গায়ে হলুদ দিতে কি ছেলেরা যায়।
:আমি তোর কোন কথা শুনব না। তোকে যেতেই হবে।
আমিও দেখলাম গায়ে হলুদ দিতে তেমন কোন মানুষ সে খুজে পাচ্ছে না, তাই আমি সহ আরো তিন জন মিলে গায়ে হলুদ দিতে মেয়ের বাড়ি যাই।পরে জানতে পারলাম আমাদের পিছনে আরো ত্রিশ জন লোক আসবে।আমাদেরকে আগে পাঠিয়েছে অবস্থা জানার জন্য। আমরা মেয়ের বাড়ি পৌঁছালাম। মেয়েকে দেখে আমার মনে হলো বয়স ১৪± হবে। তাহলে এ্যাডভোকেট হয়ে বন্ধু বাল্য বিবাহ করবে। মেয়ের সঠিক বয়স জনার জন্য আমি বন্ধুকে ফোন দিয়ে বলি, বন্ধ এতো বুড়া মেয়ে বিয়ে করবি?
জসিম হাসি দিয়ে আমাকে বলে, তুই সত্যি একটা মজার লোক। বুড়ো মেয়েকে বিয়ে করব কেন? মেয়ে তোর পছন্দ হয়েছে নাকি, তোর সাথে কুসুমের কোন সম্পর্ক আছে?
: বন্ধু সব সময় হাসি ঠাট্টা করা যায় না। আমার সাথে এই মেযের সম্পর্ক তো দুরের কথা আমি এই মেয়েকে আগে কখনোই দেখি নাই।
: তাহলে বুড়ো বুড়ো বলছস কেন?
: আমি সত্যি বলছি, যে মেয়ে গায়ে হলুদের প্যান্ডেলে বসে আসে তার বয়স ৩০+ হবে।
: আমার বিশ্বাস হয়না। কুসুমের বয়স১৫ বছরের বেশি হবে না।
তখন আদনান বলে, ছরি বন্ধু। মেয়েকে এইমাত্র গায়ে হলুদের প্যান্ডলে আনা হচ্ছে।
: আদনান তুই আমাকে একদম চমকে দিয়েছস।
:তাহলে ওটা দাদি হবে?
: হু।
: রাখি।
জসিম বাল্য বিবাহ করবে। আমি এ বিয়ে বন্ধ করে দিব।
না, বন্ধ করব না, এই মুহুর্তে বন্ধ করলে লোক ভাববে মেয়েকে আমি পছন্দ করি। তার জন্য...
লোকে ভাবুক আমি মেয়েক পছন্দ করি তবুও একটি জীবন বাঁচবে।
এখন এই মুহুর্তে বিয়ে বন্ধ করলে মেয়ে গলায় দড়ি দেবে। মেয়ের বাবা সমাজে মুখ দেখাতে পাবে না। মেয়ের মা এই শোকে মারা যাবে।
আমি এখন কি করব?
বরং আমি এখান থেকে চলে যাই।আর আমি চলে গেলেই কি্ এর সমাধান হবে? আমি চলে গেলে অনেকে অনেক কিছু ভাববে।ভাবলে আমার কিছু যায় আসে না। তবুও মনকে বুঝাতে পারব বাল্য বিবাহ আমার পছন্দ না।আমি তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছি।
অন্যদের না জানালাম। চলি বন্ধু আমাকে ক্ষমা কর।
গায়ে হলুদ দিয়ে সবাই বাড়ি চলে যায়। কিন্তু আদনান আর ফিরে আসে না। সেই চিন্তায় জসিম তাকে ফোন করে বলে, হ্যালো আদনান, তুই এমন কাজ করতে পারলি?
: কি কাজ?
: তুই গায়ে হলুদ দিয়ে আমাদের এখানে না এসে বাড়ি চলে গেলি। আমি তোর জন্য...
: আমি বাড়ি আসি নাই। ওহ বন্ধু! তোকে বলতে ভুলেই গেছি। গত কাল আমার চাকুরীর জয়েন্টের শেষ তারিখ। আমি সেখানেই যাচ্ছি। তোর বিয়েতে থাকতে পারলাম না। ক্ষমা করিস আমাকে। আল্লাহ হাফেজ।
জসিম বলে, আদনান আমার সাথে এমনটি করতে পারল। ওর চাকুরী হয়েছে আমাকে আগে বলেনি? নাকি আদনান আমার সাথে চালাকি করেছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আদনানের কথায় কেমন যেন আমার সন্দেহ সন্দেহ হলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে আমার বিশ্বাস আদনান কোন সময় মিথ্যা কথা বলবে না।
বিয়ের দুই বছর পরে...
কুসুম তিন মাসের পুয়াতি।পেটের ব্যথা লজ্জায় কাউকে বলেনি, ছয় মাসের ব্যথা জিহ্বায় কামরে রাখে, সাত মাসের ব্যথায় চিৎকার দিয়ে বলে-
: মা! ওমা! আমি আর পারছি না।
কুসম জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।কুসুমকে ধরে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার চেক আপ করে বলেন, সম্ভব্যত পেটে দুটো বাচ্চা হবে কিন্তু একটি নিশ্চিত অন্যটি কি বলতে পারছি না।
: ডাক্তার! একি বলছেন?
: হ্যাঁ।আর একবার চেকাপ করব। তারপরে...
ডাক্তার দ্বিতীয় বার চেক করে একটি বাচ্চা অন্যটি টিউমার নিশ্চিত করে।
বাচ্চার সাথে সাথে টিউমারটি বড় হয়েছে। ডাক্তার বলেছে-
: বাচ্চা ডেলিভারির সময় অপারেশন করে দিবে, আগে হলে...
জসিমের ক্যান যেন আদনানের কথা মনে পরে গেলে, তাই সে আদনানকে ফোন করে বলে, বন্ধু তুই কোথায়?
আদনান জসিমের কথা শুনে বলে, তোর কি হয়েছে?
: কিছু হয়নি আবার হবে।
: কিছুই বুঝতে পারছি না।
: আমি বাবা হয়েছি কিন্তু...
আমি জসিমের মুখে সব কথা শুনলাম।কুসুমে মেয়ে হয়েছে তার নাম রাখছে মুক্তি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে জসিম আমাকে বলে, কুসুমের আবাব জরায়ুর মুখে ক্যান্সার দেখা দিয়েছে। আমি এখন কি করব? অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কোন কাজে আসতেছে না।
১বছর পরে...
কুসুম হাটতে পারে না। ডাক্তার তার আশা ছেড়ে দিয়েছে কখন যে...
কুসুমের সেইদিনের অবস্থা দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। আমি জসিমকে বললাম, তোদের বিয়ের সময় আমি চাকুরীর কথা মিথ্যা বলে ছিলাম।
জসিম আমাকে বলে, কেন সেইদিন তোর চাকুরী হয় নাই।
: আমার কোনদিনও চাকুরী হয় নাই। আজ আমার জন্য এমনটি দেখতে হচ্ছে তোদের।
: তোর কথা কিছুই বুঝতেছিনা। কি হলো বলবি তো?
আদনান কান্না স্বরে বলে: তোদের বিয়েটা যদি সেদিন কচি করে ভেঙ্গে দিতাম, তাহলে আজ এ দৃশ্য দেখতে হতো না...
[আগে নিজে সচেতন হন।তারপরে অন্যদের কথা বলুন।]
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
গ্রাম বাংলার নিম্ন বৃত্ত ও মধ্যবৃত্ত সমাজের বিবাহের দৃশ্য তুুলে ধরা। বিবাহতের আগের অনুভুতি এবং পরের খেশারত তুলে ধরা হয়েছে।
২৬ জানুয়ারী - ২০১৯
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪