রাত প্রায় বারোটা। মেয়ে এখনো বাড়ি না ফেরায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন নমিতা দেবী ও তার ছেলে শুভো। স্বামী রণজিৎ বসু ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসার নমিতা দেবীর। কিন্তু আজ তার ছোটো মেয়ে সোহিনী সেই কখন বন্ধুদের সাথে জিনিস পত্র কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছে , রাত বারোটা বেজে গেলো এখনও ফেরার নাম পর্যন্ত নেই। অফিসে নাইট ডিউটিরত স্বামী কে ফোন করতেই যাচ্ছিলেন এমন সময় ক্রিং ক্রিং শব্দে কলিংবেল বেজে উঠলো। নমিতা দেবী তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই দেখলেন সামনে এলোমেলো চুলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। মেয়ের এমন হাল দেখে নমিতা দেবী মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে একটু রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করলেন ,‘ কীরে সোহিনী সেই কখন বেড়িয়েছিস , কোথায় ছিলিস এতক্ষণ ?’ বারতিনেক একই প্রশ্ন করার পর মেয়ের দিক থেকে কোনো উত্তর না পাওয়ায় নমিতা দেবী রাগের বশে মেয়েকে সপাটে একটা থাপ্পড় মারতেই মেয়ে টকটকে লাল চোখে নমিতা দেবীর দিকে তাকিয়ে অন্য মহিলার গলায় চিৎকার করে উঠল,‘ কী ! এতবড়ো সাহস তুই আমাকে মারবি !’ মেয়ের এই রকম রুদ্র রূপ দেখে নমিতা দেবী কয়েকহাত পিছিয়ে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোহিনীর দাদা শুভ বলে উঠলো,‘ কীরে বোন মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন ?’
‘ কী! তুই এখন আমাকে শেখাবি কার সাথে কীভাবে কথা বলবো ’ বলেই সোহিনী শুভকে সপাটে এক লাথি মারতেই শুভ ছিটকে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সোহিনী খিল খিল করে হাসতে হাসতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিল। ভয়ে , দুশ্চিন্তায় কাঁপতে কাঁপতে নমিতা দেবী স্বামী রণজিৎ বাবু কে ফোন করে সব জানিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে বললেন।২০-২৫ মিনিটের ভিতর রণজিৎ বাবু হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকতেই নমিতা দেবী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। স্ত্রীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে রণজিৎ বাবু দরজায় করাঘাত করে, মেয়ের নাম ধরে ডেকেও কোনো সাড়া শব্দ পেলেন না। সারারাত্রি উৎকন্ঠায় কাটানোর পর ভোরের দিকে আপনা আপনি ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে যেতেই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তড়িঘড়ি মেয়ের ঘরে ঢুকে পড়লেন। তাদের মেয়ে সোহিনী তখন বিছানায় শুয়ে আছে। নমিতা দেবী কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর সোহিনী আস্তে আস্তে চোখ মেলে ক্লান্ত গলায় বলে উঠলো, ‘ মা একটু জল দেবে ? খুব তেষ্টা পেয়েছে ’ । ‘হ্যাঁ মা দিচ্ছি ’ বলে নমিতা দেবী এক গ্লাস জল মেয়েকে খাওয়াতে যেতেই সোহিনী খিল খিল করে হেসে উঠে এক ধাক্কায় গ্লাস টা মাটিতে ফেলে দিয়ে বিকট গলায় বলে উঠলো , ‘ যতক্ষণ না আমি চাইবো ততক্ষন তোর মেয়ে খাবার এমনকি জল পর্যন্ত খেতে পারবেনা ’ কিছুক্ষণ পরেই মেয়ে আবার জল খেতে চাইলে নমিতা দেবী জল নিয়ে গেলেন কিন্তু পূর্ববর্তী ঘটনারই আবার পুনরাবৃত্তি হলো। নমিতা দেবী মেয়ের এই করুন দশা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রনজিৎ বাবু তাদের পারিবারিক ডাক্তার সুজন বাবু কে ফোনে ডেকে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর সুজন বাবু আসতেই রণজিৎ বাবু পূর্বে ঘটা যাবতীয় ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা পেশ করলেন তার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সোহিনী কে পরীক্ষার পর সুজন বাবু গম্ভীর মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন দেখো বাবা রণ সোহিনী মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো ঠেকছে না, নাড়ি খুবই ধীর গতিতে চলছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সোহিনী মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাও। রণজিৎ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, ডাক্তার জেঠু সোহিনী কে তো অনেক বার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু বার বার নানান উদ্ভট ঘটনা ঘটছে কখনও আসবাবপত্র এদিক ওদিক ছিটকে পড়ছে তো কখনও দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুজন বাবু সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন দেখো বাবা রণ আমার একজন ডাক্তার হিসেবে এইসব কথা বলা শোভা পায় না, কিন্তু বহু বছর ধরে তোমাদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য এবং একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমার মতে সোহিনী মাকে সুস্থ করা কোনো ডাক্তারের কম্ম নয় বরং তুমি কোনো ভালো ওঝার খোঁজ করো।
রণজিৎ, ‘ এ আপনি কি বলছেন ডাক্তার জেঠু ! ’
সুজন বাবু,‘ হ্যাঁ বাবা আমি ঠিকই বলছি এবার তোমার ব্যাপার তুমি কি করবে ’
রণজিৎ,‘ কিন্তু এখানে এখন ওঝা কোথায় পাই ?’
‘ তাতো বলতে পারবো না তবে যত শীঘ্র সম্ভব খোঁজ করো নয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে ’ এই বলে সুজন বাবু বিদায় নিলেন। সারাজীবন অলৌকিক, ভূত-প্রেত এ অবিশ্বাসী রণজিৎ বাবু আজ সত্যিই দিশাহারা, বুঝে উঠতে পারছেন না যে এখন কি করবেন। নানা চিন্তা করতে করতে গঙ্গার ঘাটের পাশে দিয়ে হেঁটে আসছিলেন তিনি এমন সময় কিছুটা দূরে গঙ্গার ঘাটে নজর চলে গেল তার। দেখতে পেলেন একজন গেরুয়া ধুতি পরিহিত, ছাই-ভস্ম মাখা সাধুবাবা হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন। রণজিৎ বাবু গুটি গুটি পায়ে তার কাছে গিয়ে প্রণাম করতেই ইশারায় পাশে বসতে বললেন। তারপর ধীর শান্ত গলায় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কীরে বেটা মেয়ের জন্য খুব চিন্তায় আছিস ? ’ রণজিৎ বাবু অবাক চোখে সাধুবাবার দিকে তাকাতেই সাধুবাবা স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি সব জানি রে বেটা, চল তোর বাড়ি চল তোর মেয়ের খুব বিপদ তাড়াতাড়ি কিছু না করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে’ । রণজিৎ বাবু সাধুবাবা কে নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই ভেতর থেকে মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলেন, ‘ খবরদার আর এক পা ভেতরে ঢুকলে তোর মেয়েকে প্রাণে মেরে দেবো’ । সাধুবাবা হাত তুলে রণজিৎ বাবু কে আশ্বস্ত করে সরাসরি সোহিনীর ঘরে প্রবেশ করলেন। সাধুবাবা ঘরে প্রবেশ করেই তার গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘ ব্যোম্ ব্যোম্ ভোলে ’ সারা ঘর গমগম করে উঠলো। সোহিনী কানে হাত চাপা দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। সাধুবাবা কাঁধে থাকা ঝোলা থেকে একটু ছাই মুঠোয় নিয়ে সোহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারতেই সে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগলো। সাধুবাবা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সোহিনীর দিকে তাকিয়ে গমগমে কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘ তুই কে ? তোর একটুও লজ্জা করলো না এই নিরীহ , নিরপরাধ মেয়েটাকে কষ্ট দিতে ?’
সোহিনী বিকট কন্ঠে বলে উঠলো,‘আমি কেয়া পাল বেশ করেছি ওকে কষ্ট দিয়েছি , আমার সাথেও তো নোংরামি করে আমাকে কিছু লোক কষ্ট দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল’। সাধুবাবার কন্ঠস্বর এবার কিছুটা নরম হলো বললেন, ‘ দেখ বেটি তোর সাথে যা হয়েছে তা অনুচিত ঠিকই কিন্তু এই নিরীহ মেয়েটার তাতে কী দোষ বল ? তুই ওকে ছেড়ে দে, আমি বলছি অপরাধীদের অবশ্যই বিচার হবে ’।
‘ না আমি ওকে ছাড়বো না, কিছুতেই না ’ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো সোহিনী। সাধুবাবা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন, ‘ তোকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু তুই আমার কোনো কথাই মানছিস না, এবার দেখ আমি কি করি ’ বলে তিনি ঝোলার ভিতর থেকে একমুঠো ছাই নিয়ে সোহিনীর চারিদিকে গোল করে রেখা টানলেন তারপর বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন প্রতিটা মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সোহিনী বিকট কন্ঠে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে লাগলো। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে এইধরনের অলৌকিক ঘটনা দেখে বিস্ময়ে হতবাক রণজিৎ বাবু সহ তার স্ত্রী ও পুত্র। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সোহিনী বলে উঠলো , ‘ ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমার অপরাধীদের কি বিচার হবে না ?’ ‘অবশ্যই হবে তোর অপরাধীদের বিচার, কিন্তু তুই যে চলে যাচ্ছিস তার একটা চিহ্ন তোকে রেখে দিয়ে যেতে হবে ’ বলে উঠলেন সাধুবাবা।
‘ ঠিক আছে তবে ঐ ঘরের কোণে রাখা ফ্রিজ টা আমি ভেঙ্গে দিয়ে যাবো ’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে যেন একটা ঝড় আছড়ে পড়ল , জিনিস পত্র সব এদিক ওদিক ছিটকে যেতে লাগলো। কিছুক্ষন এইভাবে চলার পর দড়াম আওয়াজ করে ফ্রিজ টা দু-হাত ধরে ছিটকে পড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সশব্দে সেগুন কাঠের মস্ত সদর দরজাটার মাঝখানটা ফেটে গিয়ে ঘরের মধ্যে থাকা একটা দমবন্ধ করা বাতাস যেন বাইরে বেরিয়ে গেল। সোহিনীও অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ করে বিছানায় অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো। এইবার সাধুবাবা রণজিৎ বাবুর দিকে ফিরে হাসিমুখে বললেন,‘ আর কোনো চিন্তা নেই বেটা, তোর মেয়ে এখন সম্পূর্ণরূপে সুস্থ , তবে হ্যাঁ যদি পারিস তবে ঐ মেয়েটার অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করিস ’
রণজিৎ বাবু সাধুবাবা কে প্রণাম করে বললেন,‘ হ্যাঁ বাবা আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো অপরাধীদের খুঁজে বের করতে’
সাধুবাবা অত্যন্ত প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন।
দু সপ্তাহ পর .....
রণজিৎ বাবু রোজকার মতন অফিসের কাজ শেষ করে বাড়ি ঢুকছিলেন এমন সময় ভিতর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলেন নিজের স্ত্রী নমিতা দেবী একটা চেয়ারে বসে পাগলের মতো আচরণ করছেন চোখদুটো লাল হয়ে উঠেছে , মাথার চুলও উশকো-খুশকো তার দুই ছেলে মেয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাকে চেপে ধরে রাখার। রণজিৎ বাবু স্ত্রীর কাছে এগিয়ে যেতেই নমিতা দেবী তার মুখে থুঃ করে কিসব যেন ছুঁড়ে মারলেন হাত দিতেই দেখতে পেলেন তাজা রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে নমিতা দেবী খিল খিলিয়ে হেসে উঠলেন। রণজিৎ বাবুর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নিচের দিকে নেমে গেল।
( সমাপ্ত )
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এই গল্প টি ভৌতিক অলৌকিক বিষয়ের উপর আধারিত।
২৫ নভেম্বর - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪