চার ভাঁজ করা কাগজটা, পিছন দিয়ে সাদা পেইজটাই দেখা যাচ্ছে । কাগজটা যখন আমার হাতে এসে পৌঁছায়, তখন এটা নিতান্তই সাধারণ একটা কাগজ বলে মনে হয়েছিল । ভাঁজ খোলার প্রয়োজন বোধ করি নাই তখন, এত কাজের মধ্যে সময় বের করা বেশ কঠিন । এইতো আজ অফিসে কি ছোট বিষয় নিয়ে কি তুমুল কাণ্ডটাই না বাধাল শামিমা । আরে ফেসবুকে একটা খারাপ কমেন্ট করেছে তো কি হয়েছে, এই নিয়ে সে অফিসে বসেই কাঁদাকাটি । আজিজুল সাহেবেরও বেহাল দশা, কমেন্ট রিমুভ করেও নেই শান্তি । এতক্ষনে নাকি শামিমার চারটা ফ্রেন্ড কমে গেছে ফেসবুকে । আজিজুল সাহেব এতটাই চড়ে গেলেন যে এখন নাকি মেয়েদের ন্যাকামোর উপর লেখা লিখবেন তিনি । আমি বুঝিয়ে অবশেষে তাকে শান্ত করলাম । তারপর কাজ সেরে বাসায় পৌছাতেই তীব্র মাথা ব্যাথাতে টেকা দায় । তবুও কাজ তো করতে হবে, তাই ড্রয়ার খুলে বসলাম পুরনো কাগজপাতি সরাতে । তখনি হাতে এল কাগজটা, মনে পড়ল দুদিন আগে এক মহিলা দিয়ে গেছে বলেই কাগজটা আমার হাতে দিয়েছিল দারওয়ান । না জানি কি আছে এর মধ্যে, একবার খুলে দেখা প্রয়োজন । সাংবাদিক মানুষ, সারাদিন তো কতই ছাইপাস খবর লিখতে পড়তে হয়, আজ আরেকটা না হয় বেশিই পড়লাম, লাভ না হলেও ক্ষতিতো নেই। তাই আরাম করে কেদারায় বসে পড়তে লাগলাম কাগজটা । গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, একটা চিঠি । আমাকে তো চিঠি লেখার কেউ নেই, তবে কে লিখল, এটা ভেবে আরেকটু মনোযোগ আনলাম । পড়তে শুরু করলাম চিঠিটা,
প্রিয় মা,
আজ কেন এলে না ? তোমায় আজ বড় প্রয়োজন ছিল । সবাই অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল, কেন দেখছিল আমি জানিনা । তবে এ দিনে বুঝি সবাই অবাক তাকিয়েই দেখে, তাই আমি বেশি অবাক হই নাই । বড্ড মনে পড়ছিল তোমাকে, মা । আমার অভিমান রইল অনেক কেন তুমি এলে না । আজ এলে না, কাল অবশ্যই এসো । ভাবছো চিঠি কেন লিখলাম, ফোনও তো করতে পারতাম । ইচ্ছে হয় নাই । লিখতেও ইচ্ছা হচ্ছে না তবু লিখছি । আজ জীবনের সেই লগ্নে এসে পৌঁছিয়েছি, যেখানে তোমাকে বলা কিছুটা হলেও প্রয়োজন মনে হচ্ছে । মনে আছে মা, যেদিন আমার গর্ভে প্রথম সন্তান আসে, সেদিন তুমি আমায় কেমন করে মেরেছিলে, আমাকে মেরেছিলে ঠিক ছিল, জানা সত্ত্বেও তুমি আমার পেটে ঘুসি দিচ্ছিলে । সেদিন প্রশ্ন করি নি তবে আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হচ্ছে, কেন অবৈধ সন্তান বলে কি তার জন্মের অধিকার নেই? আমি কত কেঁদেছিলাম মা, তবুও তুমি, দাদি, চাচি মিলে আমাকে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করালে । আমি নিরুপায় ছিলাম, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করলাম । তারপর ভাবলাম, যার পিতাই যাকে অস্বীকার করে তাকে পৃথিবীতে এনে কষ্ট কেন দিব ? আমি আমার সন্তানকে প্রতিরাতে স্বপ্নে দেখতাম, ও মা বলে কাঁদছে । ঐ বয়সে আমার মাতৃত্বের অনুভব না হলেও কেন জানি অনেক কষ্ট হত, মুহুর্তেই আমার আত্মা শুকিয়ে যেত, বুকটা খালি খালি লাগত । মধ্যরাতে জেগে উঠে আমি থরথর কাঁপতাম । আমার অনেক ভয় লাগত । তোমাকে একদিন বলেছিলামও কিন্তু তুমি আমায় মাগী বলে গালি দিয়েছিলে । উঠোনে গাছের নিচে হেলান দিয়ে বসে আমি ভাবতাম আমার ভুল কি হয়েছে ? কেন আমাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে ? আমি তো ভালবেসেছিলাম মা, সত্যিকারের ভালবাসা । জানি আমি ভালবেসেছিলাম ভুল মানুষকে, তবুও তো মা । ওর কেন শাস্তি হল না? এই প্রশ্ন আমাকে কুঁড়েকুড়ে খাচ্ছিল, তাই ঐ সোমবারে আমি তৈরি হয়েছিলাম পুলিশের কাছে যাব বলে । যে আমার সাথে এত বড় প্রতারনা করল তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম আমি । কিন্তু মুখ ধুতে গিয়ে আড়ালে শুনলাম তোমাদের কথা, ওরা নাকি তোমাদের ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে, তাই তোমরা আর কোন হাঙ্গামা চাও না । আমি এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন যে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল, আজ এখনও মাথা কাজ করছে না, আর লিখতে ইচ্ছে করছে না মা । আরেকটু পর লিখি । আরেকটা প্রশ্ন মা, তোমরা আমাকে, তোমাদের নাতনীকে টাকার কাছে এভাবে বেঁচে দিলে ? একবার আমার দিকে তাকালে না ? যে অন্যায় আমার সাথে হল তার কথা ভাবলে না ?
চিঠিটা এখানেই শেষ হল আপাতত । আরও আছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু বাকি কাগজটুকু আমার কাছে নেই । কিছুক্ষনের জন্য হলেও মাথাটা ঝিম ধরে থাকল, খুব আগ্রহ হল চিঠির বাকি অংশটুকু পড়তে । কিন্তু তা পেতে হলে আমাকে যেতে হবে মেয়েটির মায়ের কাছে । কিন্তু তার ঠিকানা আমার জানা নেই, কোথায় পাব তাকে । খুব দেখতে ইচ্ছা হল সেই মাকে যাকে তার মেয়ে এত কঠিন প্রশ্ন করেছে । সাথে সাথে না হয় চিঠিটা আমাকে পাঠানোর উদ্দেশ্যও জিজ্ঞাসা করব । ঠান্ডা বাতাসে মাথাটা একটু ঠান্ডা করা দরকার তাই বারান্দার উদ্দ্যেশে পা বাড়ালাম, কলিংবেলের শব্দে আমার মৌনতাপূর্ন ভাবনায় ছেদ পড়লো । অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । কি হোল দিয়ে দেখলাম যে দারওয়ান এসেছে । তখন পরবর্তী চিঠিটা পাওয়ার আনন্দে আমার চোখ খুশিতে ঝিলিক দিল । চোখ কিভাবে খুশিতে ঝিলিক দেয় আমি জানি না তবে মনে হল যে ঝিলিক দিল । খুললাম দরজা, দারওয়ান ভাই এগিয়ে দিল চিঠিটি । চিঠি নিয়েই ধড়াম করে বন্ধ করলাম দরজা । সিক্সথ সেন্স আমার ভালোই কাজ করা শুরু করেছে ইদানিং, সাংবাদিকতার এই একটা লাভ হয়েছে বলতে গেলে । এবার বসে নয় দাঁড়িয়েই পড়তে লাগলাম বাকি চিঠিটা, আগের ন্যায় চার ভাঁজ করা আছে । এবারও আগের মতই সম্বোধন করে লেখা হয়েছে,
প্রিয় মা,
কিছু মনে করো না এভাবে উঠে চলে গেলাম বলে, চোখের পানিতে চিঠিটা ভিজে যাচ্ছিল তাই উঠে গেলাম । কি মনে করবে বলো এতকিছুর পর যখন আমিই কিছু মনে করি নাই, সেখানে তুমি কিছু মনে করলে তা অন্যায় হবে । যা বলছিলাম, তারপর আমার পা আটকে গিয়েছিল, এরপরও যদি আমি পুলিশের কাছে যেতাম, তাহলে আমি তখন একা থাকতাম, তাই ভয়ে আর সাহস হয় নাই । তার কিছুদিন পর আমার জন্য বিয়ে ঠিক হল । জানো মা আমার মনে একটুও খুশি ছিল না । যাকে ভালবাসলাম তাকেই তো জয় করতে পারলাম না, তাহলে এই লোককে আমি কিভাবে খুশি রাখব, এই ভেবে সেদিন আমি অত কেঁদেছিলাম, তোমায় ছেড়ে চলে যাবার দুঃখে নয় । তুমি বুঝি অভিমান করছো, তাই না মা । অভিমান করো না মা । একটিই তো মেয়ে আমি তোমার । বিয়ের পর আমার খালি মনে হত তার সাথে আমি বুঝি অনেক প্রতারনা করছি ।জানি মা এই তুচ্ছ জীবনে যদি দুই একটা প্রতারনা করেও ফেলি তাও তা আমার সাথে হওয়া প্রতারনার সামিল হত না । তাকে আমার ভাল লাগত না মা । আমি এখনও ওকেই ভালবাসি । জানি সে খারাপ কিন্তু এই তুচ্ছ মনটা আজও তাকেই মনে রেখেছে............. । ও কি আমাদের বাসায় আসে এখনও ? বাদ দেই । লোকটিকে আমার ভাল লাগত না, কেমন করে রাতে আমার কাছে এসে ঘুমাত, বড় ঢং করত বুঝি আমায় ভালবাসে । তাই তাকে এই একতরফা ভালবাসা থেকে মুক্তি দিতেই একদিন রাতে তাকে আমার পুর্বের কথা বলে দিলাম, কি অবাক হচ্ছ মা ? জানি, তুমি জানো না, হ্যাঁ আমিই বলেছিলাম । পরে অবশ্য কথা ঘুরিয়ে নিয়েছি, কারন অত বড় সত্যের সামনাসামনি হওয়ার সাহস আমার ছিল না। ঐ কথা শোনার পর সে আমায় অনেক মেরেছিল ঐ রাতে । তখন মনে হচ্ছিল মার খেতেই বুঝি এসেছি পৃথিবীতে । আর কি ? তারপরের ঘটনা তো জানোই । লোকটির থেকে মুক্তি পেয়ে অনেক শান্তি লাগত আমার কিন্তু আমার কপালে তো শান্তিই লেখা নেই । তোমাদের একটুও সাহস ছিল না মা , নিজের মেয়েকে ঘরে রাখতে এত কিসের সমস্যা ছিল ? আরেকটা প্রশ্ন ।
তারপর সানাই বাজল আমার ২য় বিয়ের । তখন আমার কোন অনুভুতি ছিল না , মনেও হচ্ছিল না কোন প্রতারনা করছি । খালি চোখের সামনে দুইটা রঙ দেখছিলাম আমি, হলুদ ও লাল, আমার জীবনের দুই রঙ । আমার ২য় বিয়ে হল, এই লোকটাও ঐ লোকটার মত, বিয়ের রাতেই বলেছিল, ‘‘তোমাকে বিয়ে করেছি কেন জানো ? একটা বাচ্চার জন্য । আর ঘরের কাজ তো করবেই, লক্ষিটি আমাকে জলদি বাপ বানায় দেও ।’’ ঘৃনা আসেনি আমার লোকটির উপর, বয়স একটু বেশি বলেই একটু বেশি তাড়া বাবা হওয়ার । আমিও মানা করলাম না, মনে হচ্ছিল আমি আমার প্রথম সন্তানকে ফিরে পাব, তাই তাকে আর পূর্বের কথাও কিছু বলি নি, ওর সাথে যা চেয়েছিলাম তা না হয় এই লোকটির সাথে হল, মন্দ কি ? না থাক ভালবাসা, ভালবাসা যদি অমন স্বার্থপর হয় তবে তা না থাকাই ভাল । আমি গর্ভবতী তা তো তুমি জানো, মা । তবে আজ যে জীবনের এত বড় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে তা ভেবেছিলাম না কখনও । প্রতি সকালের মত আজও টিফিন বানিয়ে তাকে দিলাম, অফিস যাওয়া দেখলাম । দুপুরবেলা দেখি সে ফিরে আসল কিন্তু লাশ হয়ে । আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম । জীবনের এত বড় পরিহাসের জন্য তৈরী ছিলাম না আমি । চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল না মা, সবাই হা করে দেখছিল আমাকে । কেউ বলছিল আমি শোকে পাথর হয়ে গেছি, আসলে আমি আশ্চর্যে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম । জানাজার জন্য যখন তার লাশ নিয়ে যাচ্ছিল তখন তাকে দেখলাম আমি, গাড়িতে চাপা পড়ে তার মাথার একপাশ রক্তে ভরে গেছে । তবু তাকে চিনলাম আমি, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘আর ৪মাস অপেক্ষা করলেই তো বাচ্চার মুখটা দেখতে পেতেন, এতটুকু অপেক্ষা করতে পারলেন না?” মা তিনি উত্তর দিলেন না, অনেক ভাল মানুষ ছিলেন । খুব শখ ছিল বাবা হওয়ার, হতে পারলেন না । এমন কেন করেন খোদা, মা ? বয়স বেশি হওয়ায় অনেক খেয়াল রাখতেন আমার । কার খেয়াল রাখতেন জানিনা, তবে ধরে নিতাম আমারই রাখছেন । এখন রাত, কেউ রাতে কিছু খায় নাই । আমিও না । আজ জীবনের এক নতুন রঙের সাথে পরিচয় হল, সাদা রঙের । মা, আমার পরনে এখন সাদা শাড়ী । তোমার আগেই আমি পড়লাম । ভেবে দেখেছ, বিষয়টা কত গভীর । আজ আমি একটু খুশি এই ভেবে যে আমার জীবনে এখন তিনটি রং, হলুদ, লাল আর সাদা ।
এইটুকু পড়ে বন্ধ করলাম কাগজটা, চোখ ভিজে গেছে । পরের পৃষ্ঠা উলটে দেখি আর অল্পখানিক লিখা, তাই আবার শুরু করলাম পড়তে,
কারও প্রতি কোন অভিমান নেই মা, আমি নারী, আমি মা, তাই অভিমান করার অধিকার আমার নেই, নেই সেই শক্তিটুকু । মা, আমার আর ইচ্ছা হচ্ছে না জীবনের পুরাতন কোন রঙে নিজেকে রাঙাতে । এখন একটি রঙই ডাকছে আমায়, কাল রঙ ।
ইতি,
তোমার একমাত্র মেয়ে ।
চিঠিটি শেষ এখানেই, কেন এসেছিল আমার কাছে জানি না । তবে এসে জানান দিয়ে গেল তার মনের প্রতিটি না বলা কথা । কত দূরের হয়েও যেন হয়ে গেলাম কত আপন । এরপর কি হয়েছিল তা বুঝতে বাকি রইল না আমার, কিন্তু তা ভাবতে ইচ্ছা করছে না । বারান্দায় চলে গেলাম । আকাশ ভরা মিটিমিটি তারা জ্বলছে, বিরামহীনভাবে । সামনে নিকুশ কাল অন্ধকার রাত্রি, তারার আলো যেন হার মেনেছে । ভাবতে লাগলাম আমি, কি নাম হতে পারে মেয়েটার, কেমনই বা সে দেখতে, কতটুকুই তার বয়স । আচ্ছা, ওর বাচ্চাটার নাম কি ভেবেছিল ? দূরে একটা কুকুর ডেকে উঠল, বুঝতে পারলাম অনেক রাত, কি জানি কত।