বছর চারেক আগেকার কথা। তখন আমি থাকতাম ঢাকার অদুরে সাভার থানার অন্তর্গত সুগন্ধা হাউজিং- এ। এই হাউজিং-এ ঢুকতেই চোখে পড়ে স্টাচু অব লিবার্টি কিংবা ক্রাইস্ট রিডিমারের মত সুউচ্চ এক আলিশান বাড়ি। ধবধবে সাদা রং আর চৌকোণাকার স্টাইলিশ ঝুল বাড়ান্দা যেকোন পথচারীদের নজরকারে । বাড়িটির নাম " আরজু ভিলা "।
এই আরজু ভিলার মালিক আজিজুর রহমান আরজু নিঃসন্তান। তবে তার পালিত মেয়ে আছে একটি । নাম তার আনুশা। শেষ বিকেলের আলোয় আনুশাকে আমি টিউশনি পড়াতে যেতাম। আনুশা তখন পড়ে মাত্র ক্লাস নাইনে। ওরা থাকত তৃতীয় তলার পুরো একটি ফ্লাটের অর্ধাঅর্ধি অংশ জুড়ে। তিনটি মাত্র রুম। কোনো ড্রইং রুম নেই। শুধু একপাশে চাপাচাপি করে ছোট একটি ডাইনিং টেবিল পাতা। আনুশাকে পড়াতাম আমি ঝুল বারান্দায় বসে। বেশ লাগতো পড়াতে। পড়ন্ত বিকেলের নরম রোদ আমাদের গায়ে এসে পড়ত আর মাঝে মাঝে বইত খুব জোর এলোমেলো হাওয়া। আনুশা কথা বলত নিচু স্বরগ্রামে আর হাসতো অল্প পরিমানে। সেই কথা ও হাসি আমার কাছে মনে হতো ডিপ ক্লোড স্টোরেজ মাদকের মতই নেশা ধরানো।
একদিন ও এক কাপ কফির সাথে দামী কিছু বিস্কিট আর টোস্ট নিয়ে এলো। খাওয়া শেষ হলে ও বলল, কেমন লাগলো খেতে?
--মারভেলাস, খুব মজা লাগলো। আচ্ছা, কই পাওয়া যায় এত মজার বিস্কিট?
--দুবাই থেকে ছোট চাচা এনেছে। ওই যে চাচার কথা আপনাকে বললাম না সেদিন, সেই চাচা।
--ও তাই বলো, আমি ভাবছিলাম ঢাকায়ই কোথাও পাওয়া যায় হয়তো, তা তোমার জন্য কি আনলো তোমার চাচা?
--কি আর আনবে কসমেটিকস এনেছে।
--খারাপ কি বিদেশী কসমেটিকস ব্যবহার করবা।
--এসবতো এখন বাংলাদেশও পাওয়া যায়.....
আনুশা! আনুশা! ভিতর থেকে আনুশার মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
--কি মা?
-- ভিতরে শুইনা যা।
--কি হইছে?
--কিছু হয় নাই, শুইনা যা।
তারপর যা হলো সেটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। আমাকে মহামূল্যবান বিস্কুটগুলি খেতে দেওয়ার খেসারত পেতে হলো আনুশাকে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এলো চাপা গালিগালাজ। আনুশা বার বার বলছিল, মা তুমি থামবে....
এই আনুশার মা আফ্রিকার হেভিওয়েট কোন মহিলার মত। হাঁটলে থপথপ শব্দ হয়।মনে মনে তাকে আমি বলি, জলহস্তি। ভদ্রতার খাতিরে একদিন বললাম, আপা শরীর ভালো? এর উত্তরে তিনি লম্বা এক ইতিহাস আর গল্প জুড়ে দিলেন। শ' খানেক রোগের বসতি নাকি তার অঙ্গ প্রতঙ্গে। মনে হলো এতে তিনি বেশ আনন্দিত ও গর্বিত। দু'বার মাদ্রাজ গেছেন। আবার যাবেন, হার্টে নাকি রিং পড়াতে হবে। আর তার নিত্যদিনের ওষুধ কিনতেই পেরিয়ে যায় হাজারের অঙ্ক।
একদিন এক ভারাটে ভাড়া দিতে এসেছে। টোটাল ভাড়া চার হাজার আটশ টাকা। আর সিঁড়ি পরিষ্কার করার মহিলার জন্য অতিরিক্ত একশ টাকা দিতে হয়। অতিরিক্ত ভাড়ার কথা নতুন ভাড়াটে জানত না। তাই সে আনেনি। আনুশার মা বলল, আর একশ টেহা কই?
--কিসের টাকা?
--কামের মাইয়্যার লাইগা।
--ও আমি ভাবছি....
--যান এহুনি নিয়া আহেন, আমার আবার মনে থাকবো না।
প্রথম যেদিন আনুশার মা আমাকে টিউশনির বেতন দিল, সেদিন আমি আকাশ থেকে মুক্তবেগে ভূ- মন্ডলে পতিত হলাম। আমাকে তিনি তেইশশো টাকা দিলেন। বললেন, পুরো মাসে চারদিন গ্যাপ থাকার কারনে দুইশ টাকা কর্তন করেছেন। আমাকে শাসিয়ে দিলেন ভূলেও যেন আর না কামাই করি। এরপর থেকে তিনি দিন প্রতি একশ টাকা কর্তন করবেন।
ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল সেদিন। বাড়ান্দায় বৃষ্টির ছাট্ আসছিল। তাই রুমেই পড়াচ্ছিলাম আনুশাকে । আনুশার বাবা সাপ্তাহিক বাজারে যাবেন। আনুশার মা তাকে একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন।
আরজু সাহেব বিগলিত গলায় বললেন, খুচরা দশ বিশ টেহা থাকলে দেও, রিকশায় জাইগা, বাইরে যে বৃষ্টি....
কথা শোনামাত্রই ঝাঝিয়ে উঠলেন আনুশার মা, রিকশায় যাওয়া লাগবো ক্যা, হ্যা, কয় মাইল রাস্তা হাইটা যাও।
আমি লজ্জায় আরজু সাহেবের মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না।
সাভারে আরজু সাহেবের "আনুশা মেশিনারিজ এন্ড হার্ডওয়্যার " নামে একটি দোকান আছে। সেখানেই তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাটিয়ে দেন। সেই দোকানে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে আসছিল একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। ওর বেতন ছিল আট হাজার টাকা। বছর পাঁচেক পর ওর বেতন এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলেন আরজু সাহেব। কথাটা আনুশার মার কানে যায়নি, যখনি গেল তখনি লোকটা চাকরি হারালো। নতুন নিয়োগ পেল তরিকুল নামে তার দুর সম্পর্কের এক ভাই। স্বয়ং আনুশার মা তার বেতন নির্ধারণ করলেন দশ হাজার টাকা। কিন্তু তরিকুলের কাজ কর্মে কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না আরজু সাহেব। একদম আনাড়ি আর সপ্তাহে তিন- চার দিন নামমাত্র হাজিরা হাকেন, এই যা।
-- তুমি কারে ঠিক করছো?
--ক্যান কি হইছে?
--কি হইছে মানে, দুনিয়ার ফাঁকিবাজ, ধান্দাবাজের একশেষ।
--ক্যাঠা ধান্দাবাজ? ধান্দাবাজ হইলা তুমি।
--আমি ধান্দাবাজ, কাইলি ওরে আমি কামে আইতে না কইরা দিমু।
--তুমি না করার ক্যাঠা, ও যেমন খুশি তেমন কাম করবো, তাতে তোমার কি, আমি ওরে বেতন দিমু।
--কি কইলা?
--বয়রা নিহি, কথা কানে যায় না।
--তুমি খুব বাইড়া গ্যাছো, এত বাড়া ঠিক না।
--কোনটা ঠিক কোনটা ব্যাঠিক সেডা আমি বুজুম।তোমার বুজান লাগবো না।
শেষমেষ হাল ছেড়ে দিলেন আরজু সাহেব। তরিকুলকে নিজের বাসায় এনে তুললেন আনুশার মা।
আনুশা একদিন বলল, কিছু দেখতে পেয়েছেন?
-- কি?
-- ডাইনিং টেবিলে মা আর তরিকুল মামাকে।
--হু।
-- খাওয়ার স্টাইলটা যেন....
--কি?
-- হবু বর কনের।
আনুশা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে নিচু গলায় বলল, স্যার, এই বয়সে এসব হয়?
-- হয় হয়, কথায় আছে না মুনীনাঞ্চ মতিভ্রম, জ্ঞানীগুণিদেরই মতিভ্রম হয়, আর তোমার মাতো একজন সাধারণ মহিলা।
--স্যার, আমার মায়ের মত কৃপণ মহিলা পৃথিবীতে আরো আছে কিনা জানিনা, তবে এই লোককে যে তিনি জলের মত টাকা দিচ্ছেন, এর কারনটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না।
--বুঝতে পেরেছো, কিন্তু না বোঝার ভান করছো।
--উহু, আসলেই বুঝতে পারিনি। সুন্দর করে হাসে আনুশা।
--সাদামাটাভাবে বলতে গেলে এর কারন হলো, বুড়ি বয়সে ভিমরতি , পেপারে সেদিন একটা ঘটনা পড়লাম বললে বুঝতে পারবে, স্ত্রী স্বামীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে একদিন ব্যাংকে সঞ্চিত তাদের সব টাকা তুলে আনতে বলে, সম্ভবত স্বামীটা কিছুটা ক্যাবলাকান্ত টাইপ ছিল, তাই বউয়ের কথামত সব টাকা নিয়ে বাসায় হাজির, এদিকে স্ত্রী তার সাগরেদকে রাতের বেলা আসতে বলে রেখেছে, তারপর দুজন মিলে স্বামীকে হত্যা করে পগারপার।
--স্যার আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, আমার বাবা একজন রং মিস্ত্রী ছিলেন, একটা স্টীলের আলমারির দোকানে কাজ করতেন। তিল তিল করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই সম্পদ করেছেন তিনি।
--এ কারনেই তিনি ভোগ করতে পারবেন না, তাল গাছ যে বোনে সে তাল খেতে পারে না, আমি একজন শিল্পপতিকে জানি, তিনিও তোমার বাবা মায়ের মত পিঁপড়ে জমিয়ে চা খান।
--মানে?
--এ গল্প জানো না, একজন কৃপণ লোকের চিনির কৌটায় কয়েকটা পিঁপড়া ঢুকে চিনি খেয়েছিল, তিনি ভাবলেন চিনিতো পিঁপড়ার পেটের মধ্যেই আছে, তাই সে পিঁপড়ে দিয়ে চা করে খেলেন....
আনুশা হাসতে হাসতে বলল, ও এই ঘটনা তাহলে।
--শোনো, সেই শিল্পপতির মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে। ধানমন্ডিতে তার প্রধান কার্যালয়। আমি সেখানে চাকরি নিয়েছিলাম SR পদে। একদিন তিনি সমস্ত SR আর কর্মীদের নিয়ে মিটিং -এ বসলেন। ঘন্টাখানিক মিটিং হয়েছে, এর মধ্যে তিনি দু'বার উঠে গেছেন। তৃতীয়বার এসে লজ্জিত মুখে স্বীকার করলেন, তার খুব খারাপ ধরনের ডায়াবেটিস আছে, মিটিং- এ বিঘ্ন ঘটায় সে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। এই যদি হয় জীবন কি দরকার আছে অঢেল টাকা পয়সা আর আরাম আয়েশের। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ কি বলেছেন জানো, Addicted for the people is the love of desires, such as women, and children, and piles upon piles gold and silver, and branded horses, and livestock and fields....
--স্যার, আপনিতো জানেন আমি ইংরেজী ভালো বুঝিনা,এর বাংলা বলেন।
--এর বাংলা হলো, মানবকূলকে মোহগ্রস্থ করেছে....
আনুশার মা ধীরপায়ে টেবিলের পাশে এসে দাড়ালেন। তারপর কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই শীতল গলায় বললেন, ছার, সামনের মাস থেইকা আপনের আর আহা লাগবো না।
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ক্যান সমস্যা কি?
--সমস্যা কিছু না, মাইয়্যা বড় হইতাছে, ওর লাইগ্যা ম্যাডাম ঠিক করছি।
--আগেতো কিছু বলেননি।
--কি বলুম?
--আনুশাওতো আমাকে কিছু বলেনি।
আনুশা দৃঢ় গলায় বলল, স্যার আমি আপনার কাছেই পড়বো।
আনুশার মা রাগী গলায় বলল, তুই চুপথাক, তুই কি বুঝোস?
--বুঝি মানে, তোমার চেয়ে ভালো বুঝি আমি।
--ছোট মুখে বড় কথা।
-- আমি কথা বলতে চাইনি, তুমি বলতে বাধ্য করাচ্ছ।
--আনুশা, আর একটা কথা কইবি না আমি যেডা ভালো বুঝুম সেইডা করুম।
--না, আমি সেটা হতে দেব না, এই বাড়িতে থাকলে সেটা হবে না, অনেক সহ্য করছি, এই তরিকুল লোকটা কে, এত বদ চরিত্রের মানুষ এই বাড়িতে থাকতে পারবে না, আর শোনো এই বাড়িটাও আমার, আমার বাবা আমার নামে লিখেদিছে, তরিকুল আর তোমার ব্যাপারে বাবাকে কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছু বলিনি।
--আইজ আহুক তর আব্বা ছোট মুখে বড় কথা...
ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মত গরগর করতে করতে আনুশার মা ভতরে চলে গেল।
--স্যার, আপনি কি জানেন, কেন ম্যাডাম ঠিক করতে চাচ্ছে? সেটাও ওই তরিকুলের বুদ্ধিতে। কোথাকার এক ম্যাডামকে নাকি পনেরশ টাকায় ঠিক করে দেবে। স্যার, আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।
--না, আমি কিছু মনে করিনি।
--আমি একটু হাসি?
--কেন?
--আমার কেন জানি মনে হয়, আমার হাসির জন্য আপনি পৃথিবীর যে কোন অপমানই হাসিমুখে সহ্য করতে পারবেন।
--কে বললো তোমাকে?
--কেউ বলেনি, আমার মনে হয়।
আমি আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকালাম। হঠাৎ কি একটা পড়ার দিকে ওর দৃষ্টি নিবন্ধ হলো, মাথা নুইয়ে রইল ডালিমের মত লাল হয়ে।
-- আনুশা!
--হু।
--তোমার অনুমান ঠিক আছে। আজ তাহলে উঠি কেমন। কাল আবার দেখা হবে।