“আচ্ছা দৃষ্টিহীনদের সবাই কি জন্মান্ধ নাকি কারো কারো সময়ের সাথে দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে পড়ে?” টিভির ভলিউম কমিয়ে দিয়ে সোলাইমান সাহেব বললেনঃ “একজন অন্ধ দিসেবে উত্তরটা ত তোমারই জানার কথা। দুরকমই হতে পারে। যেমন তুমি কখনই পৃথিবীর সৌন্দর্য চোখে দেখনি আবার তোমার অনুজ অবনীর ছোটবেলার প্রখর দৃষ্টিশক্তি আজ ম্লান হয়ে গিয়েছে”। রুপাঃ না না ঠিক সেটা বলিনি। আমার জগৎ সম্পর্কে আমি সজাগ। তবে বলছিলাম যারা চক্ষুষ্মান তাদের কথা। অর্থাৎ লাইফে বিভিন্ন ডিসিশন মেকিং এর সময় আমরা কেমন অন্ধ হয়ে যাই কিনা তো সৃষ্টিকর্তা কি আমাদের এহেন মনোভাব গড়ে দিয়ে তবেই প্রেরণ করেছেন? নাকি আমরা সমাজের নানান কাজেকর্মে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে আঁধারে ডুব দেই? সোলাইমান সাহেবঃ হুম বুঝলাম। অন্ধত্তের গ্লানিতে তুমি ডিপ্রেশনে পড়ে গেছ। এরকমটা হওয়াই স্বাভাবিক। সমাজে ভুলভাল থাকবেই। এটা নিয়ে যত ভাববে মাথাটা ততই গুলিয়ে যাবে। রুপাঃ তাহলে আমি শারিরিকভাবে অন্ধ আর আপনি মানসিক। সুলাইমানঃ কেন? রুপাঃ এই যে আপনি জোর করে মন কে বোধ দেবার চেষ্টা করছেন আশেপাশে সব কিছু খুব স্বাভাবিক ভাবে চলছে, এটাই আপনার অন্ধত্ব। আচ্ছা চাচা আপনি কি সূর্য দেখতে পান? সোলাইমান সাহেবঃ আমি তো সবই দেখতে পাই। সূর্য প্রতিদিনই দেখি। রুপাঃ উপভোগ করেন? সলাইমান সাহেবঃ সূর্য খুব প্রখর। এটা উপভোগ করা যায় না। অবশ্য সূর্যের আভা যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটা দেখায় অপূর্ব সুন্দর। বিশেষ করে শেষ বিকেলের আলোটা আমার খুব প্রিয়। রুপাঃ আমার বয়সী অসংখ্য মেয়ে রয়েছে যাদের স্কুলে যাওয়ার কোন বেবস্থা নেই। বিকেল বেলা খেলতে যাওয়ার সুযোগ হয়না ওদের। আপনার বাসায় যে মেয়েটি তিন বছর ধরে কাজ করছে শুধু ডিম শেষ হয়ে গেলে দোকানে পাঠানো ছাড়া কখনো কি ওকে পাঠিয়েছেন পাশের মাঠটিতে? শেষ বিকেলের লাল আভা দেখে মনটাকে হারিয়ে দিতে? অথবা ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনকে শান্ত করতে? সোলাইমান সাহেবঃ তুমি জানো যে তোমার চাচি ভীষণ অসুস্থ। আমি ফিরি সন্ধ্যায়। মেয়েটা কাছে কাছে না থাকলে অনেক সমস্যা। সুমনার একটু কিছু হলে আমি আর স্বাভাবিক থাকতে পারব না। রুপাঃ আপনি চাচিকে অনেক ভালবাসেন। সোলাইমান সাহেবঃ নিশ্চয়ই। রুপাঃ তাহলে অফিস থেকে ছুটি নিচ্ছেন না কেন? বিপদের সময় স্ত্রীর পাশে থাকবেন না? চাচাঃ আচ্ছা তুমি এসব কি উল্টাপাল্টা প্রশ্ন কর? চাইলেই কি বস আমাকে ছুটি দিবে নাকি! রুপাঃ আমার ধারনা আপনার বস আপনাকে ছুটি দিতে পারেন। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে আসন্ন প্রমশনের ব্যাপারটা নড়বরে হয়ে যাবে বলে আপনি মনে করেন। তাই চাচির সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাঁচি মরি অফিসে রেগুলার হতে হবে। আর এভাবেই প্রতিনিয়ত সবাই সবার চোখ বেঁধে চলেছে। বস বাধছে আপনারটা আর আপনি নিজের স্ত্রীরটা। চাচা আমরা যখন একবার আঁধারে প্রবেশ করি তখন আশেপাশের সকল সুন্দর সম্ভাবনাকে একে একে বিদায় জানিয়ে দেই। প্রকৃতি কে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে যেমন তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য কমে যায় তেমনি সমাজে যেসব কর্মকাণ্ড ঘটা উচিত নয় সেগুলোকে নিয়ম বলে ঘোষণা দিলে তার গুরুত্ব কমে যায়। আর তাই তো বন্ধুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব, রাস্তাঘাটে দুব্যবহার অথবা অন্যকে ঠকানোর ব্যাপারগুলা এখন বেশ স্বাভাবিক। এগুলা তবুও সহজে হজম হয়ে যায় কিন্তু খুন, ধর্ষণ আর বড় বড় দুর্নীতির বিষয়গুলা যখন চোখের সামনে এসে পড়ে তখন কি করব বুঝতে না পেরে আমরা নিজেরা নিজেদের দুটি হাত দিয়ে চোখ জোড়া শক্ত করে চেপে ধরি। সোলাইমান সাহেবঃ রুপা, আমাকে একটু বলতো তোমার কথার পয়েন্ট টা কি? কেন হঠাৎ এই প্রসঙ্গে নেমেছ? রুপাঃ আপনি প্রায়ই আমাকে লক্ষ করে একটা কথা বলেন। আমি নাকি পৃথিবীটাকে ‘উপভোগ’ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হই অন্ধত্তের কারনে। মন ভরে দেখার মতন জিনিসগুলো সব মিস করে যাই। আমাদের চারিদিকের কাব্যময় পরিবেশটা বহুরূপী মানুষের ছড়াছড়িতে পরিপূর্ণ। অথচ আমার কাছে সবই সাদাকালো। রহস্যময় পৃথিবীটাকে আঁধার মাঝে আরও বেশি অবিশ্বাস্য মনে হয়। জানি ফুলের রঙ পাতার নির্যাস আর ফলের পুষ্টিকে হার মানায় সবসময়। তাই আপনার কথাগুলো নিয়ে অনেক ভাবলাম। পৃথিবীতে করার আছে অনেক কিছু যার কোনটাই আমি করতে সক্ষম নই। তবে যাদের করার ক্ষমতা রয়েছে তারা কি যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে? নাকি স্বার্থপরের মত ঠিক ততটুকুই করছে যতটুক তার পথের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সোলাইমান সাহেবঃ দেখো রুপা আমি স্বীকার করছি তোমার কথার অবতারণার একটা যুক্তি রয়েছে। তবে তুমি কি জানো যে স্বার্থের মূল্য দিতেই সমাজ গড়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ কি বলেছেন জানো? –“It is not from the benevolence of the butcher or the baker that we expect our dinner, but from regard of their own interest. We address ourselves not to their humanity but to their self-love and never talk to them of our necessities but of their advantage.” অর্থাৎ, আমরা কসাই বা রুটিওয়ালার দয়া থেকে আমাদের খাবার আশা করিনা, বরং তারা নিজেদের স্বার্থেই খাবার সরবারহ করে। আমরা তাদের মানবতার কাছে আবদার করি না উল্টো তাদের এই স্বার্থপরতার উপর নির্ভর করি। নিজেদের প্রয়োজনের কথা না বলে তাদের লাভের কথা বলি। সুতরাং, যেই স্বার্থে উভয়পক্ষ লাভবান হতে পারে সেরকম ক্ষেত্রে স্বার্থপর হত দোষ কি? রুপাঃ তাহলে ত চাচা ঘুষ এর দ্বারাও উভয়পক্ষ লাভবান হচ্ছে। সে ব্যাপারে কি বলবেন? একজন অর্থনীতিবিদের সমাজে যা যা ঘটছে সেটাই খুব স্পষ্ট সুন্দর এবং স্বাভাবিকভাবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। তার মানে কি এই যে সমাজের বাকি দশ জনকে মুখ বুজে বসে থাকতে হবে? আমাদের জন্ম হয়েছে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে। আরেকজনের দৃষ্টিভঙ্গিকে সবসময় মেনে নেয়া ঠিক না। এটা আমাদেরকে ধীরে ধীরে অন্ধ করে দেয়। সোলাইমান সাহেবঃ কিন্তু কি করব মা। সবাই যে পথে চলেছে সে পথ না ধরলে মাটি হয়ত আমার পা দুটো আকড়ে ধরবে। ধর আজকে থেকে আমি দরিদ্র মানুষের জন্য বিনা মূল্যে খাবার বিক্রয় শুরু করলাম। এবার একটু বাস্তবতায় চিন্তা করে বল তো খাবারদাবার বানাতে আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে যে পরিমাণ টাকা পয়সার প্রয়োজন হবে তার যোগান আসবে কোথা থেকে? সুতরাং বুঝতেই পারছিস এই মহতী উদ্যোগের সাথে সাথে আমার সংসারে প্রয়োজনীয় অর্থের বড় রকমের টান পড়ে যাবে। রুপাঃ বিনামূল্যে করা লাগবেনা। কিন্তু কিছু অর্থ সঞ্চয় করে তো কাজটা করা যেতে পারে। আমিও আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আচ্ছা চাচা বলুন তো আমরা কেন সুন্দর চিন্তা ভাবনাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখি? আমিই বলে দেই। আসলে ভাল থাকার ভান করার মধ্যে একধরনের সুখ রয়েছে। ঠিক ক্লান্তিকর দিনের আরামদায়ক ঘুমের মতন। আমাদের নিজেদের জীবনেই এত রকম সমস্যা যে তার উপর অন্য কারো দুশ্চিন্তার বোঝা নিজের ঘাড়ে চাপাতে আমরা নারাজ। তাই আপন সত্তাকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলেই সে খুশি। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে আমার মনে হয়। সোলাইমান সাহেবঃ তুমি ঘুরেফিরে শুধু আমাকেই দোষ দিচ্ছ। আমাদের আশেপাশে রয়েছে যারা তাদের মাঝেও অনেকে হাত-পা বাধা অবস্থায় অন্ধত্তের কালিমা বহন করে হেটে বেড়াচ্ছে শহরজুড়ে। রুপাঃ আবছা ছায়ায় অন্ধকার মাঝে ডুবছি আমরা সবাই, শুধু আমি আপনি না। সোলাইমান সাহেবঃ আসলে মা, যার চোখ নেই সে রঙিন পৃথিবীটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমার মত যাদের অন্তরের চক্ষু নেই তারা জীবনকে অনুভব করা থেকে বিরত রাখছে নিজেদের। নির্বোধের মত বলে ফেলা কথাগুলো শুনে কষ্ট পেয়েছিস দেখে খুব খারাপ লাগছে এখন। রুপাঃ দুঃখ পেয়ো না। যদি আমার কিছু কথা শুনে তোমার দৃষ্টি প্রসারিত হয় তাহলে বলব সত্যিই ভাল লাগছে। তবে এখন চলে যেতে হবে। চাচি বারান্দায় বসে আছেন আমার অপেক্ষায়। কথা দিয়েছিলাম আজ বিকেলে একটা সুন্দর গান শুনাব। আমি এখন আসি চাচা। সোলাইমান সাহেবঃ যাবার আগে নিলুকে আমার কাছে আসতে বলিস। কিছুক্ষণ পর। নিলুঃ খালুজান আমাকে ডাকসেন? সোলাইমান সাহেবঃ ফ্রিজ থেকে রসের পিঠা বের করে একটা বাটিতে বেড়ে দাও তো। ঝোল দিবা বেশি করে। নিলুঃ আচ্ছা। সোলাইমান সাহেবঃ আর দাড়াও, বিকেল বেলা বেলা কাজ না থাকলে মাঠ থেকে ঘুরে এসো। নিলুঃ সত্যি যাব? আমি গেলে খালাম্মাকে কে দেখবে? সোলাইমান সাহেবঃ কে দেখবে মানে? আমি দেখব রুপা দেখবে! নিলু আস্তে করে মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। খালুজানের কোথায় বেশ অবাক হয়েছে ও। চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গলেন তিনি। মনটা বেশ হালকা লাগছে। ভাগ্নের গলা থেকে ভেসে আসা সুমধুর গানের দিকে মন দিলেন সোলাইমান সাহেব। “ঝড়ের পাখি হয়ে উড়ে যেতে হবে কত দূরে, জানিনা কোন সীমানা, হারিয়েছি ঠিকানা”। খুব পছন্দের একটা গান। ছোটো বেলায় অনেক যত্ন করে রুপা কে শিখিয়েছিলেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মৌরি হক দোলা
বাহ্! দুটি চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে সুন্দর একটি বিষয় তুলে এনেছেন। অনেক ভালোলাগা ও শুভকামনা রইল....
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া
প্রথম গল্প হিসেবে বেশ ভালো লিখেছেন। বুঝা যাচ্ছে লেখালেখির অভ্যাস এবং ভাব দুটোই আছে। ভালো করবেন লেখালেখিতে। ভোট উপহার থাকল। সময় পেলে আসবেন আমার পাতায়।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।