রমণীর রমণীয়তা

রমণী (ফেব্রুয়ারী ২০১৮)

মোহন মিত্র
বাংলার গ্রাম। ভোর হতে বাকী আছে। বরুণের ঘুম ভেঙে গেছে। প্রায় কুড়ি বছর বাদে বরুণ এসেছে তাঁর গ্রামের বাড়িতে। তাঁর ঘরটাতেই তাঁকে শুতে দেয়া হয়েছে। ঘরটা এখন এক ভাই ব্যাবহার করে। বরুণ দেখছে টালির চালের ফুটো দিয়ে অন্ধকার আকাশ - একটা দুটো তারা। বাড়িটা এখন কত নিঃস্তব্দ। অথচ এই বাড়িতে এক সময় কাক ডাকার আগে হৈ চৈ শুরু হয়ে যেত। বরুণের বাবা কালিনাথ নিজে চারটের সময় উঠতেন আর সবাইকে ডাকতেন। সূর্য ওঠার আগে সবাইকে বিছানা ছাড়তে হবে। আজ ডাকার সেই লোক নেই। বরুণের মাও নেই যিনি ভোর থাকতেই উঠে তাঁর কাজ কর্ম শুরু করে দিতেন। বরুণের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

বরুণ ভাবছে এই বাড়িতে একদিন কত লোক থাকত। বাবা কাকার যৌথ পরিবার। কাকা কাকীমা, খুড়তুতো ভাই বোনেরা তিন জন, বরুণরা পাঁচ ভাই বোন। কত আত্মীয় স্বজনদের আসা যাওয়া। কৃষি নির্ভর সংসার। খাবার কোন অভাব ছিল না। অভাব যদি কিছুরও ছিল তা কাঁচা টাকার। যদিও কালিনাথ একটা আধা সরকারী অফিসে কাজ করতেন এবং কাকাও এক প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টার ছিলেন। কিন্তু কৃষির উপর নির্ভর করতে হত বেশী। বাড়িতে সারা বছর প্রায় চাষবাস করার লোক, গরুবাছুর দেখার লোক, বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা ও ঘেড়াবেড়া দেবার লোক, কাজের মাসী, রান্নার মাসী - সব মিলিয়ে যেন একটা ধর্মশালা। তখন মাকে অনেক বেশী খাটতে হত, মা ছিলেন বাড়ির বড় বৌ। যদিও রান্নায় সাহায্য করার জন্য রানী মাসী আসত। কিন্তু তাঁর আসার আগে ও যাবার পরে মাকে অনেক কিছু করে রাখতে হত। বরুণ দেখেছে যে সময় বাড়িসুদ্ধ লোক ঘুমোত ঘরে ঘরে, সে সময় ঘরের বাইরে থেকে নানা রকম কাজের আওয়াজ আসত। বোঝা যেত তাঁর মা কাজ করছেন। বাসনপত্র নাড়াচাড়ার আওয়াজ। বারান্দা ঝাঁট দেবার আওয়াজ। যেখানে যেখানে কাজের লোক উঠতে পারবে না, সেখানে তো বাড়ির লোককেই কাজ করতে হবে। কুয়ো থেকে জল তোলার আওয়াজ। বাড়ির চারিদিকে গবরজল ছড়া দেবার আওয়াজ। বাসি বাড়ি থেকে হেউ যেন কোথাও বাইরে কোন কাজে না যায়। সেইজন্য তিনি কতগুলি সংসার মেনে চলতেন। আজ আর সে আওয়াজ আসছে না। সে নিয়মও চলে না।

বরুন যখন প্রথম বাইরে চাকরী করতে গেল কমলাদেবী বলেছিলেন, “অত দূরে না গেলে হয় না”?
বরুণ বলেছিল, “বাড়ির পাশে আর চাকরী কোথায় মা। যা দিনকাল, দেখছ তো। কাকারা আলাদা হয়ে গেল। দিদিদের বিয়ে দিতে কিছু জমি বিক্রি করতে হোল। দাদা চাকরী করে বটে, কিন্তু ও যা পায় তাতে ওর নিজের সংসার চলে কি না ঐ জানে। আমাকে যে যেতেই হবে মা”।
কমলাদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “আমার ভয় করে বাবা, জানি না কপালে কী আছে”। বৃদ্ধ বয়সে একলা হয়ে যাওয়ার ভয়টা যেন চেপে বসেছে আজকের সমাজে। যৌথ পরিবার ধরে রাখার কোন পথ দেখা যায় না। অর্থনৈতিক অবস্থা সামাজিক ব্যাবস্থাকেও বিধ্বস্ত করেছে।

বরুণ জানে তাঁর মা, কমলাদেবী, মাত্র তের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন এই সংসারে। ছোট্ট সংসার ছিল। বাবারা দুই ভাই, দাদু ও ঠাকুমা। তখন থেকে তিনি তিল তিল করে সংসারটা গড়েছেন। সমস্ত কাজ একা হাতে সামলেছেন। কাকার বিয়ে দিয়েছেন। নিজের পাঁচ ছেলে মেয়ে হয়েছে। কাকার দুই মেয়ে এক ছেলে হয়েছে। তাদের সবাইকে সমান ভাবে মানুষ করেছেন। বরুণ সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছে। বাড়ির লোকেরা যখন ঘুম থেকে উঠবে তখন তাঁর মায়ের সব কাজ সারা হয়ে যাবে। কাকীমাও অনেক দেরীতে ঘুম থেকে উঠতেন। সে নিয়ে মাকে কখনও রাগারাগি করতে দেখেনি বরুণ। তবে কাকীমাও হাতে হাত লাগিয়ে মা’র সাথে সংসারের কাজ করেছেন। সবার আগে কমলাদেবী বাসি কাপড় ছেড়ে রান্না ঘরে উনুন জ্বালিয়ে রান্না চাপিয়ে দিতেন। রানী মাসী অবশ্য এসে যেত সময়মত। কমপক্ষে ডাল, ভাত, আলুসেদ্ধ তো করে দিতে হবে। মাছের ঝোল অথবা এক আধটা তরকারি যদি হয়ে যায় ভালো। আগের সন্ধেবেলা তরকারিটা কেটে রাখলে বা মাছ ভেজে রাখলে সুবিধা হয়, তাই তিনি আগের রাতেই সবাই শুয়ে পড়লে একটু কাজ এগিয়ে রাখতেন। কাকিমা আসার পর তরকারি কাটার কাজটা তিনিই করতেন। দিদিরা একটু বড় হলে তারাই সকালে উঠে চায়ের পাট সামলাত। মোটামুটি সকাল থেকে সংসারে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যেত। মনে হত এটা একটা যৌথ পরিবার। সব কিছুতে একটা আনন্দ ছিল।

এই করুণাময়ী মহিলার নজর সব দিকে থাকত। কালীনাথ যাবেন কাজে, ফিরবেন সন্ধ্যা পেরিয়ে কিংবা অনেক রাত্রে। তাঁকে তো সেই রকম খাবার খাইয়ে পাঠাতে হয়। কাকা যাবে স্কুলে ছ-সাত মাইল দূরে। তখন গ্রামে গঞ্জে হোটেল রেস্তোরা ছিল না। সারাদিন তাঁরা ভাত না খেয়ে থাকবে? তাই তাদের জন্য ভাত ডাল একটু করে দিতেই হয়। ছেলে মেয়েরাও যাবে স্কুলে, টিফিনের সময় বাড়ীতে আসতে পারে না। তাদের ঘি আলু সেদ্ধ হলেই ভাত খাওয়া হয়ে যায়। স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসে অনেকেই ভাত খোঁজে। বাড়িতে কাজের মাসী, জন চাকর তাঁরাও তো সবাই দুপুরে খাবে। তাদের খাবার পরিমাণও বেশী। বাড়ীতে আত্মীয় কুটুম্ব থাকলে তাদের জন্য একটু ভাজা ভুজি, ভালো মন্দ বানাতেই হয়। এই ভাবে সবার কথা ভেবে সবার মত করে খাবার যোগান দেয়া তাঁর নিত্যদিনের কাজ।

সকাল বেলায় সবার এক রকম জলখাবার নয়। মুড়ি চিড়ে ছাতু পান্তাভাত এইসব ছিল পাড়াগাঁয়ে সকালের ব্রেকফাস্ট। তাঁর সাথে চিনি, গুড়, ঘুঘনি বা তরকারি লাগত। ছোটরা চাইত দুধ মুড়ি। সবার জন্য তিনি তৈরি। বিশাল বড় হাড়ি কড়াইএ রান্না হত। পদ ও পরিমান অনেক। একা হাতে তাঁকে বেশীর ভাগটাই সামলাতে হত। মেয়েরা একটু বড় হয়ে যদিও একটু সাহায্য করত, কিন্তু তাদের লেখা পড়া করার পর সে আর কত টুকু। বাঙ্গালী ঘরে মায়েরা চাইত না আইবুড়ো মেয়ে রান্নার কাজ করে গায়ের রং কালো করুক। বিয়ে দিতে হবে তো।

বাড়ির সবাই এক সাথে খেতেও আসে না। আসে এক জন দু জন করে। যার যখন সময় হয়, সে তখন আসে। কেউ বসে রান্না ঘরে, কেউ বসে বারান্দায়। কাজের লোকেরা বসে উঠোনে। তিনি চরকির মত ঘুরতে থাকেন। কেউ বলছে ভাত দাও, কেউ বলছে মাছ দাও। কেউ বলছে এত ঝাল আমি খাব না। কেউ বলছে ডালে নুন কম হয়েছে। এত সব করেও তিনি কারও মন কি পেয়েছেন কোনদিন? সবাই তো খুঁতটাই খুঁজে বের করেছে বেশী।

সব শেষে যখন তিনি স্নান ও নিত্যপুজো সেরে খাবার খেতেন তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। যাদের সু্যোগ ছিল তাদের কারও কারও দিবা নিদ্রা সমাপ্তির মুখে, আর তিনি? বসবার সময় নেই তাঁর। এখনি আবার স্কুল ফেরত ছেলে মেয়েরা আসবে। “মা খেতে দাও, জেঠিমা খেতে দাও” বলতে বলতে। সবাই টিফিন করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে উঠত। তাদের খেলা্র সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের সামলানো সোজা কাজ নয়। কেউ ভাত খাবে অথচ ঝাল ঝোল খাবে না, কেউ দুধ চিনি দিয়ে মুড়ি চিড়ে খাবে। তাদের সবাইকে খেতে দেয়ার কাজ বেশ স্নেহের সাথে করতেন তিনি।

তারপরই রাত্রের খাবার যোগাড়ে লাগতে হবে। যদিও দিনের অনেক রান্নাই রাত্রের জন্য থাকে, তবু ভাত বা রুটি তো বানাতেই হবে। তাছাড়া কোন কিছু কম মনে হলে সেটাও পূরণ করতে হবে। ছোটরা সন্ধে লাগতে লাগতে ঘুমোতে শুরু করবে। তাই তাদের জন্য ঝটপট ব্যাবস্থা করতেই হবে। আবার কেউ আসবে রাত দশটায় তাঁর জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকতে হবে। সবার খাওয়া হলে তবেই তিনি খেতে পারবেন। সব শেষে তিনি রান্না ঘরের সব গুছিয়ে, কাল সকালের কিছু কাজ এগিয়ে রেখে শুতে যাবেন। সেখানেই তাঁর শেষ না আরও কিছু বাকী থাকে? সেটা তিনিই জানেন।

এত সব করেও কি তিনি সবার মন পেয়েছেন? বরুণ জানে তিনি তা পান নি। পান থেকে চুন খসলেই সবার হম্বিতম্বি। এটা কেন হয়নি, ওটা কেন হয়নি। তরকারি কেন এত ঝাল, ডালে কেন নুন হয়নি। ভাত কত বেশী সেদ্ধ হয়েছে। সময়ে এটা হয়নি, সময়ে ওটা হয়নি। কমলাদেবী কিন্তু নিঃশব্দে কাজ করে যেতেন। সব যাতনা সহ্য করে চলতেন। এতবড় বাড়ি। চার ভিটেয় চারটে ঘর বিশাল বিশাল বারান্দা। রান্না ঘর, উঠোন, সামনে পেছনে বাগান। এইগুলি পরিষ্কার রাখা, গাছ পালা কেউ ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে কি না তা দেখা, জমি থেকে যে ফসল কেটে বাড়িতে বা খামার বাড়িতে রাখা আছে সেগুলি কেউ নষ্ট করছে কিনা, গরু ছাগল বাগানে গাছ পালা খেয়ে যাচ্ছে কিনা, এই বিশাল কাজের তদরকি তাঁকেই করতে হত।

সন্ধের আগে ছেলে মেয়েরা বাড়িতে ঢুকছে কিন সেটাও খেয়াল করতে হবে তাঁকেই। রাখালেরা গরু বাছুর ঠিক ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে কিনা, তাদের ঠিক ঠিক জায়গায় বাঁধা হোল কিনা এবং তাদের সবার ঘাস জল দেখানো হয়েছে কিনা তার সব খবর তাঁকেই রাখতে হবে। যত রাতই হোক কালিনাথ এসে সে সব জিজ্ঞেস করবেন এবং বাকী কিছু করার থাকলে তিনি নিজেই করবেন। তাই কমলাদেবী এই তদারকি টুকু করে রাখতেন যাতে কালিনাথকে কিছু না করতে হয়।

এতসবের মাঝে সারাদিনে কোন লোক বাবা কাকার খোঁজে এসেছিল কিনা সেটাও মনে রাখতে হবে। না’হলে আগেই বলেছি ‘পান থেকে চুন’ খসলে সব দোষ পড়বে কমলাদেবীর ঘাড়ে। কমলাদেবী কিন্তু অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে সব কিছু করে গেছেন।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়, তাই দেখার চেষ্টা করছে বরুণ। কিন্তু তখনও যথেষ্ট অন্ধকার। বরুণ জানে আজ ডাকবার জন্য তাঁর বাবা নেই, চায়ের কাপ নিয়ে এসে “বরুণ, চা এনেছি” বলার জন্য মাও নেই। ছোট ভাইএর বৌ অবশ্য খাতির যত্ন ভালোই করে। তাঁর পেছনে স্বার্থ আছে। তা থাক, একটু দাদা বলে ডাকা, সময়ে চা জল খাবার দেয়াটাই বা কম কিসে? বরুণ ভাবে। সে এসেছে এখানকার স্কুলে কথা বলতে যে সে তাঁর প্রয়াত মা-বাবার নামে একটা স্কলারশিপ চালু করতে চায়। যাতে গরীব ঘরের মেধাবী একটি ছেলে ও একটি মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের পর তিন বছরের আন্ডার গ্র্যাজুয়শন কোর্স কমপ্লিট করতে পারে।

***

বরুণ এখন অবসর গ্রহন করেছে। তাঁর একমাত্র মেয়ে মিলি বিয়ের পর আমেরিকা চলে গেছে। উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে। এখানে পিএসইউতে এক্সিকিউটিভ পোষ্টে চাকরী করত। বিয়ের পর সেই চাকরী ছেড়ে তার স্বামী জয়ের সাথে যেতেই হোল। জয়ও উচ্চ শিক্ষিত। সে ভাল কোম্পানিতেই চাকরী নিয়ে গেছে। মিলিও তাঁর যোগ্যতায় সেখানে চাকরী পেয়ে গেছিল। সব ঠিক চলছিল। বরুণ আর বিশাখা দু’বার আমেরিকা ঘুরেও এসেছে। ওরা খুশীতেই ছিল বলে মনে হয়েছে তাদের। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়েছিল তাদের প্রথম বাচ্চা আসার পর। বরুণ ভেবেছিল এই সঙ্কট সাময়িক...সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।

চাকরী আগে না বাচ্চা আগে? এই দোটানায় মিলি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। প্রায় পাঁচ ছ মাস ম্যাটারনিটি লিভ ছিল। বরুণ ও বিশাখা চলে আসার পর মিলি প্রথম বাচ্চা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল। জয় এক্কেবারে সময় দিত না। বিশ্রাম পেতনা একেবারে। বাচ্চাকে খাওয়ান, চান করানো, ঘুম পাড়ান মায়ের ফুলটাইম জব। তারপর রান্না করা, বাজার করা, ঘরের যাবতীয় কাজ করা সব মিলির। সে পেরে উঠছিল না। বাচ্চাকে ডে-কেয়ারে রেখে, কিছুদিন কাজে যাচ্ছিল। কিন্তু বাচ্চা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। তাতে আরও কাজ বেড়ে যেত। মিলি খুব আবেগপ্রবন ও দরদী হৃদয়ের মেয়ে। ডে-কেয়ারে বাচ্চাদের অবস্থা দেখে সে নিজের চাকরী ছেড়ে দিয়েছিল। অবশ্য তাতে জয়ের প্ররোচনা ছিল বেশী এবং সঙ্গে স্বার্থও। তাঁর নিজের কেরিয়ারে যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিল। বাচ্চার অসুখ করলে জয়কে এক দু’বার ছুটি নিয়ে হসপিটালে যেতে হয়েছে। তাই মিলিকে পুরোটাই সেক্রিফাইস করতে এক প্রকার বাধ্য করেছিল নানারকম আবেগের কথা বলে।

বরুন-বিশাখা অনেক বার মিলিকে বলেছে, “তুমি নিজের কেরিয়ার নষ্ট কর না, বাচ্চা ঠিক মানুষ হয়ে যাবে। আর পাঁচ জনের তো হচ্ছে”। মিলিও তখন বাবা-মার কথায় কোন গুরুত্ব দেয়নি। বরং বলতো, “কেরিয়ারটাই কি সব? বাচ্চাদের কোন প্রায়োরিটি নাই? এরা ডে-কেয়ারে থাকলে রোজ অসুস্থ হবে। তখন আমার চাকরী থাকবে? তাছাড়া মা, তুমিও তো চাকরী করনি”।

বরুণ-বিশাখা বেশী জোর করে নি। কোনদিনই করতো না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারছিল জয় আর মিলির মধ্যে সব কিছু ঠিক চলছে না। জয়কে তখন কেরিয়ারের নেশায় পেয়েছে। সে একটার পর একটা চাকরী চেঞ্জ করছে। আরও টাকা চাই, আরও উঁচু পদ চাই। এক শহর থেকে আর এক শহর, এক কোম্পানি থেকে আর এক কোম্পানি। চার বছরের মধ্যে কত গুলো চেঞ্জ হোল ঐ জানে। মিলির ফ্রাস্ট্রেসন বাড়ছিল। সে কি করে ঐ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে তাই ভাবছে। নিজেকে দাঁড় করানোর কথা ভাবছে। ঠিক সেই সময় জয় চালাকি করে দ্বিতীয় বাচ্চা চাপিয়ে দিয়েছে ওর ঘাড়ে। যাতে করে মিলি আর কোনদিন চাকরী না করতে পারে। মিলির এটা দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল। মিলি দ্বিতিয়বার কনসিভ করে বসলো। বরুণ বিশাখা সে খবর পেল জাস্ট ডেলিভারীর আগে।

প্রথমে যেটা ছিল আবেগ সেটা এখন হয়েছে বাধ্যতামুলক। মিলির এখন আর ফেরার পথ নেই। দ্বিতীয় বাচ্চা হওয়ার সময় মিলি বাবা মাকে ডাকতে চায়নি। কিন্তু জয় চিঠি লিখেছিল। বরুণ-বিশাখা সেটা উপেক্ষা করতে পারেনি। সেবারেও মিলিকে বোঝানো হয়েছিল সে যেন যত শিঘ্রী সম্ভব নিজে একটা কিছু করে। তাঁর নিজের পরিচয় তৈরি করে। স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। মানুষের মন ও দিন সবসময় একরকম থাকে না। জয় তখন লোক দেখানো হলেও খানিকটা সহায়তা করতো। উইকএন্ডএ বাচ্চাদের সামলাতো। মিলি তখন নিজের জন্য একটু হলেও খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারতো। কিন্তু দু বছর পেরোতে না পেরোতেই জয় অন্য শহরে চাকরী নিল। শুধু তাই নয়, সেই শহরে নতুন করে সংসার পাতার যত নেগেটিভ দিক আছে সেগুলো দেখিয়ে মিলির ব্রেন ওয়াস করে দিয়েছিল। এখানে বাড়ী বিক্রি করা, আবার ওখানে বাড়ি কেনা, নতুন করে সাজানো, নতুন স্কুল খোঁজা, নতুন বন্ধু বান্ধব খোঁজা ইত্যাদি ঝামেলার কথা। মিলি এতদিনে বুঝে গেছে জয় কী ধরণের খেলা খেলছে। ছোট ছোট দুটো ছেলে নিয়ে মিলি নাজেহাল হচ্ছে। আর ওদিকে জয় নিজের কেরিয়ার ছাড়া আর কিছু ভাবছে না। জয় মিলিকে শুধু নিজের জন্য ব্যাবহার করছে। মিলির কাছে এটা এখন পরিষ্কার।

শুরু হোল অশান্তি। ব্যাক্তিত্বের সংঘাত ছিল আগে থেকেই। যেটা বরুণ অনেকদিন আগে আঁচ করেছিল। যে মিলিকে বাড়িতে তাঁর মা কোন কাজ করতে দিত না, সেই মিলিকে আজ জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব করতে হয়। । ভোর সাড়ে তিনটায় ওঠে। রাতে লাগানো সমস্ত বাসন ডিশ ওয়াসার থেকে বের করে ঠিক ঠিক জায়গায় রাখে। নিজের ফিটনেস এক্সারসাইজ এবং ফিজিওথেরাপি করে। (ওর লাম্বার স্পন্ডিলিসিস আছে। কার এ্যক্সিডেন্টে স্পাইনাল কর্ডএ কম্প্রেসন ফ্র্যাকচার হয়েছিল। তিন মাস বেড রিডেন ছিল।) বাচ্চাদের ব্রেকফাস্ট বানায়, জয়ের ব্রেকফাস্ট বানায়। তারপর ছেলেদের ঘুম থেকে তোলে। তাদেরকে স্কুলের জন্য তৈরি করে। নিজে নিজেরটা করে নেবার মত বড় ওরা হয়নি। সব করে দিতে হয়। ব্রাশ করানো, চান করানো, জামা কাপড় পরান, ব্রেক ফাস্ট করান, জুতো পরান, স্কুল ব্যাগ ঠিক করে হাতে দেয়া এবং বড়জনকে স্কুল বাসে তুলে দেয়া আর ছোটজনকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া সব মিলির কাজ। ছোট জনকে স্কুল থেকে নিয়েও আসতে হয় এবং বড় জনকে স্কুল বাস থেকে নামিয়ে নেবার জন্য বাড়ী ফিরেও আসতে হয় সময়ে।

আর জয়? সে ঘুম থেকে উঠে নিজে অফিসের জন্য তৈরি হবে। ব্রেক ফাস্ট খাবার সময় থাকলে খাবে নয়ত টিফিন বক্স নিয়ে অফিস চলে যাবে। তাঁকে আর সারাদিন পাওয়া যাবেনা। সে ফিরবে রাত আটটা বা দশটা কোন ঠিক নেই। কদাচিৎ সে সন্ধ্যা সাতটায় বাড়ি এসেছে অফিস থেকে। রাতের খাবার ঢাকা দেয়া থাকে। সে খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। তাঁর সাথে ছেলেদের দেখা শুধু উইকএন্ডেই হয়। মিলির সাথেও কথা ফোনে ফোনে হত। পরে সেটা ই-মেল বা এসএমএস এর মাধ্যমে হতে শুরু করে। ওদের সম্পর্কের দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে।

ছোট ছেলেকে স্কুলে ছেড়ে মিলির অনেক কাজ থাকে। শপিং করে, বাড়িতে ফিরে লাঞ্চ বানায়, এবং নিজের জন্য কিছু করা। এক্সট্রা কারিকুলাম এ্যক্টিভিটির জন্য ছেলেদের লাঞ্চ অনেকদিন গাড়ীতেই করতে হয়। বাড়ি আসার সময় থাকেনা। নানা রকম প্রোগ্রাম থাকে, ক্যারাটে, সুইমিং, মিউজিক, বেসবল, সক্কার, অথবা কোচিং। এর মাঝে ড্রেস চেঞ্জ, রিক্রিএশন, হোম ওয়ার্ক সব গাড়ীতেই হয়। মিলি নিজে খেয়েছে কিনা বা খেলেও কী খেয়েছে একমাত্র সেই জানে।

সন্ধ্যার আগে ফিরে আবার ডিনার বানাতে হয়। কোনদিন বানায়, কোনদিন বাইরের খাবার পিৎজা, বার্গা্‌র চাউমিন খেয়েই রাত কেটে যায়। ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে ডিনার শেষ করে, আটটার মধ্যে ঘুমোতে না গেলে পরদিন পাঁচটায় ওরা আর উঠতে পারবে না। ওরা শুতে গেলে মিলি সারাদিনের বাসন পত্র ডিশ ওয়াশারে ঢোকায়। শুতে যাবার আগে সেটা চালিয়ে শুয়ে পড়ে। উইকেন্ড এ থাকে লন্ড্রীর কাজ। ওয়াশিং মেসিন থাকলেও তাতে সব জামা কাপড় ঢোকান আবার ধোয়া হয়ে গেলে সেখান থেকে বের করে গুছিয়ে রাখাটাও অনেক কাজ। সময় তো চায় তাঁর জন্য। এছাড়া চারখানা বেডরুম, চারটে টয়লেট, বড় হলঘর দুটো, একটা বেসমেন্ট, বাড়ির ব্যাক-ইয়ার্ড পরটিকো - এইসব মেইন্টেইন করতে হয়।

উইক এন্ড পার্টি তো আছেই। হয় কারও বাড়ি যেতে হবে নয়ত নিজেদের বাড়িতে পার্টি হবে। চলবে সারা বছর। তার আলাদা প্রস্তুতি।

বরুণ ভাবে এ তো সারাদিনে অবিশ্যাস্য কাজের ধারা। নিজে একজন কি করে করতে পারে? মিলি কিন্তু করে চলেছে বারো বছর ধরে। ছেলে দুটোর কথা মাথায় রেখে এবোং বাবা মায়ের সামাজিক সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে বিবাহিত সম্পর্ক বজায় রাখছিল শত লাঞ্ছনার মাঝে।

সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেলে এবারে সে চায় মুক্তি। যে আশঙ্কা বরুণের ছিল।

একদিন সন্ধ্যাবেলা ফোন এলো। এমন সময়ে ওর ফোন আসার কথা না। বড় নাতি কখনও ফোন করে। বলে, “দাদু। ক্যান ইউ কাম অন স্কাইপ?” দাদু হয়তো তখন ঘুম থেকেই ওঠেনি। ওদের ফোন এলে দাদু সব কাজ ফেলে বলে, “হোয়াই নট? লেট মি ওপেন মাই ল্যাপটপ”। দাদু নাতির কথা চলতে থাকে, তারমাঝে স্কাইপ অন হয়ে যায়। কোনদিন এক ঝলক দর্শন দিয়ে যায় মিলি। মা কোথায় জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে “মাম্মা ইজ বিজি এন্ড ডুইং সাম ওয়ার্ক”।

সেদিন ফোন তুলে বললাম, “কেমন আছো তোমরা”?
মিলি সে কথার ধার দিয়ে গেল না। বলল, “বাবা, আমরা সেপারেট হচ্ছি।
-“মানে”? বুঝতে না পেরে বরুণ জিজ্ঞেস করলো।
-“আমি আর জয় সেপারেট হচ্ছি”।
বরুণ শকড। “হঠাত কী হোল”?
-“বাবা, হঠাৎ নয়। আর একসাথে থাকা যায় না। কোন সমাধান পাওয়া গেল না। কোন কাউন্সিলিংএ কাজ হোল না। অনেক চেষ্টা করেছি। আমি আর পারছি না”।

যদিও তাঁদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত সংবাদ। তবু মনের দুর্বলতা চেপে রেখে বরুণ বলল, “ডিসাইড করলে কিন্তু অনেক দেরীতে।”
-“তোমাদের সামাজিক সম্মান ভেবে আমি চেষ্টা করলাম অনেক সম্পর্কটা যদি টিকে থাকে। কিন্তু কেউ যদি নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু না বোঝে তাঁর সাথে থাকা যায় না”।
-“কিন্তু, ছেলে দু’টোর কথা ভেবেছ? ওদের মনের উপর কতটা এবং কী প্রতিক্রিয়া হবে”?
-“জানি, বাবা......”

বরুণ বুঝতে পারে মিলির গলা ধরে এসেছে। চোখ দেখতে পাচ্ছেনা বটে কিন্তু সেদুটো যে শুকনো নয় তাও জানে বরুণ। খুব অভিমানী তাঁর মেয়ে। একটুতেই চোখে জল বের হত। সে আজ একা ঐ বিদেশে এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এটা সত্যি মর্মান্তিক।

বরুণ ভাবে সে কি হেরে গেল? ছেলে মেয়েকে নৈতিক আদর্শে মানুষ করেছে সে। সমাজের এই ব্যাবস্থার কাছে নিজেকে বড় অসহায় মনে হোল। তাঁর মা’র জন্য সে কিছু করতে পারেনি। মা লেখা পড়া জানতেন না। সে সময় গ্রামে মেয়েদের স্কুলে পাঠানই হত না। তবু তো তার মা দ্বিতীয় শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছিলেন। পুজো আচ্চা করার সময় লক্ষ্মীর পাঁচালী, ব্রতকথার বই পড়তেন। তাঁর সমবয়সী মহিলারা একসাথে ব্রত রাখতেন এবং মার কাছে এসে সেই কথা শুনতেন। বরুণের দিদিমাও পড়তে পারতেন। তিনি তাঁর বাড়িতে রোজ মহাভারত পাঠ করতেন আর পাড়ার সব বৃদ্ধারাও সেখানে সেই পাঠ শুনতেন।

মাকে দেখে মর্মাহত বরুণ নিজের সংসারে যথেস্ট সচেতন ছিল। বিশাখা ঘর সামলাত আর বরুণ বাইরের কাজ। কাজের লোক রাখতে পেছপা হয়নি। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার পর বিশাখাকে বহির্মুখী হতে উৎসাহিত করেছে। বিশাখা কিছুদিন স্কুলেও পড়িয়েছে। তাঁর জন্য কোন বাঁধন ছিল না। যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। যেটা তাঁর মায়ের ছিল না।

স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য মেয়েকে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু শুধু ভাবপ্রবণতার জন্য মেয়েটা মার খেয়ে গেল সমাজের এই ঘৃণ্য ব্যাবস্থার কাছে।

বরুণ ভাবে নারীজাতির উত্থান নারীজাতিকেই শক্ত হাতে করতে হবে। যে সন্তানের জন্য মা তাঁর প্রাণ নিছাবর করে দেন, সেই সন্তান যখন পুরুষ হয়ে আর একজন নারীকে দাসী ভাবে, ভোগ্যা বস্তু ভাবে, সে সন্তানের জন্য মায়েদের করুণার সংজ্ঞা বদলানোর প্রয়োজন আছে।

বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে এক অশিক্ষিতা রমনী আর একবিংশ শতাব্দীর যুগোপযোগী শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিতা আর এক রমনীর সংসারে স্থান এক। সম্মান, মর্যাদা, স্বাধীনতা কোনটাই উপযুক্ত নয়। তাঁরা ঘরের কাজ করার দাসী, সন্তান পালনের আয়া, আর ভোগ্যাবস্তু পুরুষের সজ্জা সঙ্গিনী। লজ্জাহীনভাবে পুরুষরা এখনও প্রাচীন কালের ধারাবাহিকতা নিয়ে চলছে যার অবসান হওয়া আসু প্রয়োজন। নারী না চাইলে পুরুষের জন্ম সম্ভব নয়, এই সত্যটা যত শীঘ্র তাদের বোধগম্য হয় তত মঙ্গল। সেদিন আর দূরে নেই যেদিন সমস্ত নারী আর সন্তান ধারণ করতে চাইবে না। বৃক্ষ তাঁর ফল ও বীজ নিয়ে সমস্ত অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়ালেও কোন বৃক্ষ জন্মাবে না, যদি ধরণী তাঁকে ধারণ না করে।

হে পুরুষ ভুলে যেও না - “রমণী জননী হয়, জননী রমণী” এবং সেখানেই রমণীর রমনীয়তা।



আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সালসাবিলা নকি বেশ ভালো লিখেছেন।
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
মোঃ মোখলেছুর রহমান দাদা আপনার গল্পটা পড়লাম,গল্প বর্নায় সরলতা ভাল লাগল,ভাল থাকবেন।
ভালো লাগেনি ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত দাদা , গল্পটা সময় নিয়ে পড়লাম । ভাল লেগেছে । শুভকামনা আর ভোট রইল । ভাল থাকবেন ।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
আপনাদের ভালো লাগাটা সত্যি আনন্দদায়ক এবং উৎসাহ পাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

২৪ জানুয়ারী - ২০১৮ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪