শাহীন তার টুনটুনি মা টাকে ভীষণ ভালোবাসে। ঘরে এসেই এক মুহূর্ত না দেখলে সে অস্থির হয়ে যায়।
টুনটুনি'র ভালো নাম জান্নাত, কিন্তু শাহীন আর মমতা তাকে টুনটুনি বলেই ডাকে। তাদের একমাত্র এই মেয়েটির বয়স চৌদ্দ মাস, এখনই সে ঘরময় দৌড়ান দেয়। দশ মাস বয়স থেকে হাঁটা শুরু, তাই এখন খুব চালু হয়ে গেছে। হাঁটা'র চেয়ে দৌড়াতেই তার বেশি পছন্দ। সারাক্ষণ পা পা, পা পা করে চিল্লাবে, বাবা অন্তপ্রাণ মেয়ে।
মা বকে:
সারাদিন আমি তোর পেছনে লেগে থাকি আর তুই কিনা বাপ আসলে আমাকে চিনিসই না। পা পা পা পা... যা তোকে আমি কোলে নিবনা...
শাহীন খুব খুশি। তার মেয়ে তাকে এত্তো ভালবাসে।
আর কিছুদিন অপেক্ষা করো টুনটুনি মা। তোমাকে সারাদিন মা মা মা ডাকার জন্য আরেকজন নিয়ে আসব...
দরকার নেই, একজনের জ্বালায় বাঁচিনা, তিনি আরেকজন নিয়ে আসতে চান।
কি করে আমার মা, দাও হিসাব দাও, বিচার করি।
কি করেনা সেটা বল, সারাদিন দরজা দেখিয়ে দিবে আর বু পিপ যাবে বলবে, পা পা বলবে...
পা পা বলার অপরাধে আমার মেয়ের শাসন করতাম!
বলে মেয়েকে কোলে নিয়ে গুনে গুনে দশটা চুমু খায় শাহীন।
দিলাম বিচার করে, আর কিছু থাকলে বল, তৎক্ষণাৎ বিচার হইবে...
হুম, বুঝা গেছে...মেয়েকে আদর দিয়ে মাথায় তুলে অহংকারী করে তুলবে...আমার আর কথাই শুনবেনা।
শুভ শুভ বলো, আমার মেয়ে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লক্ষী মেয়ে।
ইনশাল্লাহ, তাই যেন হয়।
আর কি করে বললে না তো?
কি করবে আর, সারাদিন তোমার জুতার স্ট্যান্ড থেকে জুতা নিয়ে সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে। তোমার জুতো পরে হাঁটতে গিয়ে ক'বার ব্যথা পেয়েছে হিসাব আছে?
এতক্ষণ পর বলছো, আমার মা ব্যাথা পেল তা!
মা দেখি দেখি..
সোহাগী কন্যা বুঝতে পেরে উফ উফ করে পা দেখায়। বাপ আবার মেয়ের পায়ে চুমু খায়। মেয়ে খুশি হয়ে হাত তালি দেয়, হাসে আবার পা বাড়িয়ে দেয়। বাপও ইচ্ছেমত আদর সোহাগে ভরিয়ে দেয় তার ছোট্ট মাকে। তার মা যে নেই। টুনটুনিই তার সবকিছু।
টুনটুনি'র খিদা লাগছে মনে হয়, মায়ের কাছে ঝাপ দিয়ে পড়ে এবার৷
দেখলে, তোমাকেও কত্তো ভালবাসে আমার মা!
দেখলাম, পেটের খিদায় ভালবাসা বাড়ছে৷
দু'জনই হাসে তারা, সাথে টুনটুনিও
আ আ করে হেসে উঠে, কি বুঝে হাসছে কে জানে৷
শাহীন মমতা'র বিয়ের চার বছর চলছে। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে। তবে তাদের সুখের অভাব নেই । মেয়ে'র জন্মের পর সুখ আরো কানায় কানায় ভর্তি । মমতা একটা স্কুলে পড়াতো। দেড় বছর হয় ছেড়ে দিয়েছে, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার পর ও আবার কাজ করার কথা ভাববে।
শোন শাহীন, অনেকদিন আমাদের বাড়ি যাইনি। মা বাবা বারবার যেতে বলছেন।
তো আমার কি হবে?
বাচ্চাদের মতো কথা বলছো কেনো? কখন যাবো বলো৷
বারে, আমি আমার মা ছেড়ে থাকতে পারবোনা।
তাহলে মায়ের সাথে চলো, ছুটি নাও৷
তা সম্ভব না।
অনুষ্ঠান ছাড়া শ্বশুরবাড়ি মজা নাই।
হুম সব কথাই তো তুমি বলছো৷
তাছাড়া গরমের দিনে গিয়ে কি করবো? ছুটি জমিয়ে পরে আমরা কোথাও বেড়াতে যেতে পারি, তাই না? আমার মেয়েটাও আরেকটু বড় হোক।
তা কখন যাবে?
কাল না, পরশু যাই, তোমার জন্য সব রান্না করে রাখব কালকে।
কোন রান্না লাগবেনা, যাবে তো দু'দিনের জন্য, আমি ম্যানেজ করবো।
এতদিন পর মাত্র দু'দিন!
তাহলে?
দশদিন
কখনোই না, পাঁচদিন।
না এক সপ্তাহ।
এক সপ্তাহ! কিভাবে আমার সময় কাটবে!?
আমাদের সাথে ভিডিও চ্যাটে।
হুম। আমার মাকে আদর করবো কেমনে? আর মায়ের মাকে?
নানার বাড়ি গিয়ে নানীকে আদর কইরা আইসো জনাব।
হ নানী, অহন তো নাতী'র পাশেই আছো। আসো নানী আদর কইরা দিই।
ওরা দু'জন মজা করতে থাকে।
পরেরদিন মমতা তিন চার পদের খাবার তৈরি করে ফ্রিজে নয় দশ বাটি করে সাজিয়ে রাখে। মমতাদের বাড়ি আসতে যেতে চার ঘন্টা সময়, তাই শাহীন সাথে গিয়ে রেখে আসতে চায়না। পরিচিত ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে তাতে তুলে দেয়। মেয়ে যখন পা পা করে কেঁদে উঠে, শাহীনের বুকটা কেউ কেঁটে দেয় যেন, হু হু করে উঠে ছোট্ট টুনটুনির জন্য।
আর না পেরে অফিসে ফোন করে জীবনে প্রথম বারের মতো নির্দ্ধিধায় মিথ্যা বলে। জানিয়ে দেয় আজ হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে। ভালো লাগলে আসবে নইলে রেস্ট নিবে।
ক্যাবে মেয়ে কোলে নিয়ে শাহীনও উঠে পড়ে। মা মেয়ে দু'জনই খুশি। ওদের সাথে শ্বশুর বাড়ি কয়েক ঘন্টা থেকে খেয়ে দেয়ে সন্ধ্যা রাতেই বেড়িয়ে পড়ে সে। পরদিন কাজে যেতে হবে। মেয়েও ঘুম, এরপরও ঘুমন্ত মেয়েকে ফেলে যেতে ওর মন কেমন করে। ওকে দুটো চুমু খেয়ে বের হয় সে। ইচ্ছে করছিলো বুকে করে তাকেও নিয়ে চলে আসে।
প্রতিদিন ঘরে এসেই মন খারাপ হয়ে যায় শাহীনের৷ পা পা করে মেয়ে দরজা পর্যন্ত এসে হাত ধরে ঘরে ঢুকাতো তাকে। ঘরে এসেই সে জামা কাপড় না বদলিয়ে মেয়েকে ফোন দেয়।
কই আমার মা কই?
শুধু মায়ের খোঁজ, নানী'র তো কোনো খবরই জানতে চাওনা, মিসও করোনা, হুম।
নানী কি লাগ কচ্ছে?
হ্যাঁ কচ্ছে...
রাগ করে চলে আসতে পারেনা নানা'র কাছে?
পাঁচদিন তো চলেই গেলো। পরশু তুমি আসো, একসাথে চলে আসবো।
ঠিক আছে। কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়বো, রেডি থেকো।
হুম, রাতে ভাত খেয়েই বেড়িয়ে পড়ব।
হুম রাক্ষস মেয়ে, ভাত ছাড়া চলেনা।
বলেছে..
আমার মা কই?
ওর ছোট মামার সাথে বাইরে গেছে। সারাক্ষণ বু বু পিপ পিপ...
ধ্যাৎ, দেখলাম না আমার মাকে। আসলে কল দিও, রাখছি।
মেয়ে ঘুম ছিলো তাই আর শাহীনকে ফোন করেনা মমতা। শাহীন ফোনের মধ্যেই চিল্লা দিয়ে মেয়ের ঘুম ভেঙে দেবে। বাপ মেয়ের আদরের ছোটে মেয়ের ঘুম আবার বেশি রাতে আসবে, ততক্ষণ ওকে অনেক জ্বালাবে। এই ভেবে আর কল করেনা শাহীনকে। শাহীনও মেয়ে ঘুম ভেবে ডিস্টার্ব করেনা আর।
পরদিন শাহীন অফিসে। একটা কল বারবার আসে। ও বস এর সাথে মিটিং এ। প্রায় পনের মিনিট পর দেখে ওর শ্বশুর ইতিমধ্যেই দশবার কল দিয়েছেন। ও তাড়াতাড়ি ফোন করে। দ্বিতীয়বারে তিনি রিসিভ করেন। কান্নার জন্য তার কথা বুঝা যায়না ভালো।
শাহীন জামাই বাবা..
জ্বি বলেন..
জান্নাত আমাদের জান্নাত পুকুরে পড়ে গেছে..
কি বলছেন! এখন কই আমার মেয়ে? কেমন আছে?
নাই বাবা নাই, জান্নাত নাই। তুমি আসো, তাড়াতাড়ি আসো। মমতাও হাসপাতালে। আমরা সবাই হাসপাতালে বাবা। মমতা'র জ্ঞান নাই। আমার মেয়েও কথা বলেনা বাবা...
উনি কাঁদতেই আছেন।
শাহীনের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয়না। ও যেন বোবা হয়ে গেছে।
টুনটুনি নাই, মানে কি! ও আছে কিভাবে তাহলে? এ শুনার আগে শাহীন মরে গেলনা কেন!
পুরো পৃথিবীটা শাহীনের কাছে অর্থহীন মনে হয়। ও কিছুতেই যাবেনা। ও কখনোই যাবেনা সেখানে৷ ওর মৃত মুখটা কিভাবে দেখবে সে!?
টুনটুনি পা পা করে আর ডাকবেনা তাকে! টেলিফোনে এলো এলো করে অস্থির হবেনা?মেয়ের সাথে শেষ দেখা, শেষ কথাও হলোনা!
আমার মা আমাকে আর ডাকবেনা...
চিৎকার করে কেঁদে উঠে শাহীন।
কলিগ'রা সবাই দৌড়ে আসে। বুঝতে পেরে তারাও হতভম্ব হয়ে পড়েন। কি সান্ত্বনা দিবে, কেউ বুঝে উঠতে পারেনা, তাদের ভাষাও হারিয়ে গেছে যেন। তারা সদ্য মেয়েহারা বাপটার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকেন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
অতি আদরের ছোট্ট টুনটুনিকে নানু'র বাড়ি পর্যন্ত পাঠাতে মন চায়না বাপের, মেয়েকে না দেখে থাকতে হবে বলে। আর সেই টুনটুনিকেই আল্লাহ পছন্দ করলো তাঁর কাছে নিয়ে যাবার জন্য! কন্যা হারা সে বাপের কেমন অনুভূতি হয়? এই হলো পিতৃত্ব বিষয়ের জন্য আমার গল্প।
১৭ জানুয়ারী - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪