একটা হিন্দু মেয়ে নাম তার মায়া। সেও যেমন খুব মোটা ছিল তেমনি আমিও ছিলাম তার থেকে বেশি মোটা। ফলে তখন অন্যান্য ছেলে মেয়েরা আমাদের দুজনকেই বেশি ক্ষ্যাপাত। ওরা চালাকী করে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করত কেমন আছিস রে? তখন আরেকজন বলত মোটামুটি। এ কথা বলার মাধ্যমে তারা আসলে আমাদের দুজনের একজনকে মোটা আর আরেকজনকে মুটি বলে ক্ষেপাত। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার আমার প্রতি কেমন একটা টান বা মায়া লক্ষ্য করতাম। দেখতাম তাদের বাড়ির কান্ঠায় থাকা কুল বা পেয়ারা গাছের কাছে স্কুলে অন্য ছেলেদের যাওয়ার জো ছিল না। খ্যাও খ্যাও করে উঠত। কিন্তু সে আমাকে গাছের পাকা আর মোটা মোটা কুল বা পেয়ারা গুলি চুপ করে দিত। মায়া আমার থেকে বয়সে দু-চার বছরের বড় ছিল। সে সময় আমার তাকে নিয়ে বিশেষ কোনো অনুভুতি ছিল না। কেননা আমি তখন বড় জোর আট-দশ বছরের ছেলে। আমার কুল পাওয়াই ছিল লক্ষ্য। এর মধ্যে তাকে ভালো লাগা বা না লাগার কোনো বিষয় তখন আমি মাথাতেই আনিনি। তারপর একদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম মেয়েটি বিষ খেয়ে মারা গেছে। দেখলাম তুলশী তলার গোড়ায় তাকে একটা তক্তার উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে।এক অদ্ভুত সরলতা ও অমায়িকতার ছাপ ছিল তার মুখের আদলে। এখন মনে পড়ে সেদিন দেখেছিলাম তার কানে দেওয়া বাবলার কাঁটার কথা। গলার কাছে অনেক বেশি ময়লা ধরে যাওয়া সেই পুরানো ফ্রক। অভাব ও গরীবীর সব চিহ্নগুলিই ছিল তাদের। সেদিন আমাদের প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দেখেছিলাম চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরাতে। সেদিন আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে বেশিক্ষণ ওখানে দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। আবার সবাই যখন দেখছে তখন আমি ওর কাছ থেকে দূরেও বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। তাই বার বার তার কাছে গেছি আর অবলার মত করে তাকে দেখে আবার চলে এসেছি। ভয় করেছি যে আবার কোনো বদ মাইশ ছেলে আমাকে নিয়ে মজা না করে বসে এই দুঃসময়েও। এর পর কিছু দিন পরের কথা। একদিন স্কুলে গেছি। দেখছি তাদের সেই কুল গাছটিতে বেশ বড় বড় কুল পেকে আছে প্রচুর। অমনি আমার মায়ার কথা মনে পড়ে গেল। বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা মুচড়ে মুচড়ে উঠল। শিশুকালের ব্যাপার তখন ভালোবাসা লোভ হিংসা এ সবের অত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বুঝতাম না ঠিকই- কিন্তু কেন জানিনা তার জন্য মনটা আমার খা খা করে উঠত! যেমন তাদের বাঁশ তলার গোড়া দিয়ে বাড়ি আসা-যাওয়া সময় , তাদের বাড়ির একটা সাদা রঙের খেকী কুকুরটাকে দেখলে তাকে মনে পড়ত। তার মা তো আমাকে দেখে ক’দিন কেঁদেই দিয়েছিল!হতে পারে তার মাও জানত যে, মায়া মোটা মোটা পেয়ারা বা কুল গুলো আমার জন্যই গুছিয়ে রাখত। “আয় বাপ পেয়ারা নিয়ে যা !” একথা বলে সে এমন ডুকরে কেঁদে উঠত যে আস পাশের বাড়ির দু-চারটে বৌ-ঝি চলে আসত। স্কুলের মাষ্টাররা সহ আরো সবাই তখন যে জিনিসটা নিয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল তা হল ,এই মায়া এই ভাবে হঠাৎ মারা গেল কেন? কেন মারা গেল সেটা ঠিক করে কেউ বুঝতে পারেনি । এমনি লোকমুখে যেটা শোনা গিয়েছিল সেটা হল: ওরা খুব গরীব ছিল। সংসারে টান লেগেই থাকত। খাওয়া -দাওয়ার কষ্ট ছিল তা তো আপনাদের আমি আগেই বলেছি। একদিন নাকি ওর মা’এর কোমর ব্যথা করত বলে ধতুরার বীজ - পাতা বেটে রেখেছিল কোমরে দেওয়ার জন্যে । তারপর মায়া ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুল থেকে গিয়ে পাটের শাক বলে সেই ধতুরা পাতাই রুটি দিয়ে খেয়ে নেয়। আর তাতেই নাকি সে মাথা খারাপ হয়ে মারা যায়। কেউ কেউ আবার এটাও বলে যে সে স্কুল থেকে গিয়ে রুটি খাওয়ার সময় আধখানা রুটি বেশি খেয়ে নেওয়াতে তার মা তাকে একটু বকেছিল-কেননা তার ছোট ভাই মাঠ থেকে ঘাস কেটে এসে রুটি না পেলে ঝামেলা করবে মায়ের সাথেই - এই রাগেই নাকি ও জেনে বুঝেই সেই ধতুরার পাতা বাটা খেয়ে মারা গিয়েছিল-অর্থাৎ আত্মহত্যা! ঘটনা যাই হোক ----আমার তার কেমন সরল আর মায়া মাখানো মুখটির কথা, আর অত্যন্ত অযত্নে বড় হয়ে ওঠা সেই রুক্ষ বাবরী চুল, আর সেই সদ্য ফোঁড়ানো কানে দেওয়া বাবলার কাঁটার কথা মনে পড়ে এখনও -তারপর আমার মনের ভিতরটা কেমন যেন কেটে কেটে যায়। জেনে রাখবেন সব কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী
আশে পাসের বাড়ি না বলে ঘর বললে বড্ড মিল খায়। কারণ বাড়ি আর ঘর সমান নয়। আর ধুতরা ফুল খেলে মানুষ মারা যায় না, পাগল হয়ে যায়। তবুও বলবো সুন্দর কাহিনী :)মোটা(: যদিও একটু হাসি পাওয়া যায়, কিন্তু গল্পটি খুব মর্মান্তিক।
সালসাবিলা নকি
অল্প কথায় কতো কিছু বলে ফেললেন! বড়সর লেখাও অনেক সময় ভালো লাগে না। কিন্তু আপনার সাবলীল বর্ণনার ছোট এই স্মৃতিকথার গল্প মনে ভীষণ দাগ কেটেছে...
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।