‘বুঝছেন ভাই, মায়া মানুষ হইলো তরল পদার্থ। আপনে যে পাত্রে রাখবেন সেই পাত্রেরই আকার ধারণ করবে। এই জন্য এদের সাথে খুব বুঝে শুনে চলতে হয়। বুঝেন নাই?' কথাগুলো শুনে আমি ফাইল থেকে চোখ তুলে বক্তার উদ্দ্যেশ্যে তাকালাম। এখন 'লাঞ্চ টাইম ব্রেক'। প্রায় সবাই ক্যাফেটেরিয়াতে বসে খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। আমিই নিজের ডেস্ক ছেড়ে কোথাও যাই না। যাওয়ার ইচ্ছেও হয় না। এ অফিসে আমি 'দ্বিতীয় মেয়ে' কর্মরত আছি। প্রথমজন হচ্ছে আয়া 'সালেহা বেগম।' আর আমি এমডি স্যারের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। অন্যসব কর্মকর্তা, কর্মচারি সবাই ছেলে। এরা প্রথম থেকেই আমাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই আমিও এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা, এমনকি নিজের কাজও করতে পারি না। সব সময়ই নানা কটুক্তির শিকার হতে হয়। এই যেমন একটু আগের বলা কথাগুলো। মেয়েদের সম্পর্কে কথাগুলো ইতিবাচকও হতে পারতো। কিন্তু বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যায় কতটা অবহেলা আর ব্যঙ্গাত্মকভাবে কথাগুলো বলা হয়েছে। বক্তা জুনায়েদ আলম। আমার ডেস্ক থেকে ক্যাফেটেরিয়া কয়েক ফুটের দূরত্ব। তাই প্রতিটি কথা স্পষ্ট শোনা যায়। আর সামনের দিকের কয়েকজনকে দেখাও যায়। একটা স্বনামধন্য ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির 'আমদানি বিভাগের' অফিস এটা। খুব বড় কোম্পানি হওয়ায় আমদানি, রপ্তানী বিভাগ গুলোর আলাদা আলাদা অফিস আছে। কাজগুলোও আলাদাভাবেই হয়। যেহেতু বৈদেশিক লেনদেন তাই এখানে কোন মেয়ে নেই, আমি ছাড়া। আর আমাদের দেশে এখনও মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে সরব হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া আমাদের এমডি স্যারের মেয়েদের ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতে স্বভাব আছে। 'মেয়ে মানুষ ব্যবসা বানিজ্যের কী বুঝবে! তাও আবার ইন্টারন্যাশনাল ইস্যু।' এটাই তার অভিমত। সেই তিনিই আমাকে তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এর পেছনেও একটা গল্প আছে। আমার বড় মামা তার বাল্য কালের ঘনিষ্ট বন্ধু। বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট তিন ভাইবোন ও মায়ের দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ে। যদিও পাড়া প্রতিবেশিরা বলেছিল ভালো সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু আমাকে বিয়ে দেয়া মানেই তো সব সমস্যার সমাধান নয়। আমাকে গ্রাজুয়েশন করতে হবে, ভাই বোনগুলোকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। মামার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করতেই মামা তার বন্ধু এবং আমার বর্তমান এমডি স্যার শেখ তাজ উদ্দিনের অফিসে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে শেখ সাহেবের মায়া হয়েছিল নাকি বন্ধুর অনুরোধ রেখেছেন জানি না সাথে সাথেই পার্সোনাল এসিট্যান্ট ঘোষনা করলেন। অন্য কোন পদ খালি ছিল না তখন। অফিসের অন্যসব কর্মচারীরা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল। এরপর থেকেই আমাকে নিয়ে কানাঘুষা চলছে।
.
বাসায় ঢুকেই খুব সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম। মুরগীর মাংস রান্না হচ্ছে আজ! আমাদের বাসায় মাসে দু'বার মুরগী রান্না হয়। এর বেশি আসলে সম্ভব হয়ে উঠে না। আমি সোজা রান্নাঘরে গেলাম। মা চুলার কাছেই ছিলেন। হেসে বললেন, 'মুখ হাত ধুয়ে টেবিলে আয়। আলুর চপ করেছি।' অফিস থেকে আসার পর ক্লান্ত থাকলেও সময়টা আমার খুব ভালো কাটে। কলেজে পড়ুয়া ভাই, ক্লাস নাইনের ছাত্রী বোন, আর এগারো বছরের পিচ্চি ভাই তিনজনে মিলে আমার চারপাশে কিচির-মিচির করে। সন্ধ্যার চা'টা একসাথে খেতে খেতে সবার কথা শুনি। তারপর নিজের রুমে গিয়ে নিজের মতো একান্তে কিছু সময় কাটাই। আজকে ওরা তিনজন চা খেয়ে যার যার মতো উঠে চলে গেল। কিন্তু আমি বসে রইলাম। জুনায়েদের কথাগুলো মনে পড়ছে। 'মেয়েরা তরল পদার্থ। যে পাত্রে রাখে তার আকার ধারণ করে।' কথাটা তো খুবই সুন্দর, যৌক্তিক। প্রয়োজনে মেয়েদের বারবার নিজেকে বদলাতে হয়, ভাঙতে হয়, গড়তে হয়। যেকোন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। এটা তো ভালো গুণ। কিন্তু জুনায়েদ কি বিশ্রি ভাবেই না বলল কথাগুলো।
অফিসের প্রত্যেকটা লোক আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। যেন ওদের মধ্যে আমি একটা কীট ঢুকে পড়েছি। কেউ কেউ তো ছড়িয়েছে এমডি স্যারের সাথে আমার অনৈতিক সম্পর্ক আছে। ছিঃ তিনি আমার বাবার বয়সী। আমি আর এসব নিতে পারছি না। চাকরিটা ছেড়ে দেয়াও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। অন্য একটা চাকরি খুঁজতে হবে। মা আমার অন্যমনষ্ক ভাবটা লক্ষ্য করলেন। জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে। মার কাছে আমি কিছুই লুকাতে পারি না। সব খুলে বললাম। মা বললেন, 'তুই নিজেই বললি, মেয়েরা যেকোন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তাহলে তুই এই পরিস্থিতির সাথে পারছিস না কেন?' আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। মা কী বলছেন এসব! মা আমাকে বুঝিয়ে বললেন এবারে, 'তুই জানিস চাকরি পাওয়া কতো কষ্টের। এখনও পড়ালেখাটাই শেষ করতে পারিসনি। তোর মামা ছিল বলে চাকরিটা পেয়েছিস। এটা ছেড়ে দিলে আবার চাকরি কে দেবে? মাত্র তো কয়টা মাস গেল। মেয়েরা সব পারে। তুই তোর ভালোটা দিয়ে সবার মন জয় করে নে। তোর সম্পর্কে, মেয়ে জাতি সম্পর্কে ওদের যে ভ্রান্ত ধারণা সেগুলো ভেঙে দে। আর চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বেঁচে যাবি সেটা ভাবার কোন দরকার নেই। মেয়েদের জন্য বাইরের জগৎ সবখানে একই রকম, কঠিন, খুব কঠিন।' মা ঠিকই বলেছেন। এ পর্যন্ত আমি হার মানিনি। এখনও মানবো না।
.
আজকের সকালটাই অন্যরকম। মনে নতুন মনোবল নিয়ে অফিসে প্রবেশ করলাম। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই প্রথমে দেখা হয় সিকিউরিটি গার্ড আবু সালেহ মিঞার সাথে। সব সময় মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর আমার মনে হয় আমাকে দেখলে তার মুখ গোমড়াভাব আরও প্রকট হয়। অন্যদিন আমি মাথা নিচু করে দ্রুত পায়ে ঢুকে পড়ি। আজ সেটা করলাম না। তার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি চোখ মুখ কুঁচকে শক্ত হয়ে রইলেন। আমি মুখে হাসিভাব নিয়ে বললাম, 'আসসালামু আলাইকুম সালেহ ভাই। কেমন আছেন।' বেচারার অবস্থা তখন দেখার মতো। কেউ কখনও তাকে সালাম দেয়নি। কুশল বিনিময় করা তো দূরের কথা। আমাদের অফিসের আয়ার চেয়েও অবহেলিত তিনি। অথচ তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেন। আমাদের সিকিউরিটির জন্য ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমার প্রশ্নটা তাকে এতটাই অবাক করল যে তিনি কোন জবাবই দিতে পারলেন না। আমি আবারও বললাম, 'আজকে বাসায় গিয়ে ভাবিকে আমার সালাম দিবেন। আর বলবেন আমাদের অফিসে একটা মেয়ে আছে যে নিতান্তই বাধ্য হয়ে চাকরি করছে। সেই মেয়েটা তোমার জন্য দোয়া করে যেন তোমাকে বাধ্য হয়ে কখনও চাকরি করতে না হয়।' কথাগুলো বলেই ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
প্রতিটা ডেস্ক থেকে সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। প্রতিদিনই এমন হয়। আমি পুলসিরাত পার করার মতো মাথা নিচু করে আমার ডেস্কে চলে যাই। কিন্তু আজ আমি সবার চোখে সোজাসুজি তাকালাম। মুখে হাসি ধরে রাখলাম। যেন এরা সবাই আমার পরম বন্ধু। আমি আমার ডেস্কে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই চারপাশ থেকে গুঞ্জন ভেসে আসতে লাগলো। 'ব্যাপারটা কী! আজ এত খুশি কেন!' কেউ একজন বলল, 'মনে হয় প্রমোশন হয়েছে।'
'ওর আবার কী প্রমোশন হবে। এমডি স্যার নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কে জানে।'
'হতে পারে। এই বয়সে এমন কচি মাল কয় জনে পায়!' শেষ কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠলো। অন্যদিন হলে কথাগুলো শুনে আমার খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু আজ লাগছে না। কারণ আমি জানি আজকেই এসবের শেষ দিন। কাল থেকে এরা সবাই আমাকে সম্মান করবে। নিজের বোন, মেয়ের মতো ভালোবাসবে।
.
আমি বাসা থেকে লাঞ্চ নিয়ে আসি। আজকে লাঞ্চ টাইমে আমার খাবারের বক্সটা নিয়ে সোজা ক্যাফেটেরিয়াতে চলে গেলাম। আমাকে দেখে সব কোলাহল থেমে গেল। পিনপতন নীরবতা নেমে এল পুরো ক্যাফেটেরিয়ায়। আমি গিয়ে বসলাম অফিসের সবচেয়ে বয়স্ক কর্মচারী নিয়াজ উদ্দিন সাহেবের টেবিলে। তার সাথে বসেছে আরও দুজন। একজন জুনায়েদ আলম, আরেকজন গোলাম সরোয়ার। কে একজন যেন বলে উঠল, 'কলিকাল বুঝি চলে এলো। মেয়েছেলে আমাদের সাথে বসে খাবে। ছিঃ ছিঃ। লাজ-লজ্জা বলে কিছু নেই নাকি!' আমি আমার টেবিলে যারা আছে তাদের উদ্যেশ্যে বললাম, 'কী ব্যাপার! আপনারা খাচ্ছেন না কেন? শুরু করেন। আমি এখানে আসাতে আপনাদের অসুবিধা হচ্ছে? কী করব বলুন, প্রতিদিন একা একা দুপুরের খাবার খেতে খুব খারাপ লাগে। বাবা বেঁচে থাকতে সবাই একসাথে খেতাম। এখন রাতের খাবারটা ভাইবোন গুলো আর মাকে নিয়েই খাই। দুপুরে ওদের খুব মিস করি। তাই ভাবলাম আপনারাও তো আমার পরিবার। আপনারা থাকতে একা কেন খাবো? আমি কি ঠিক করিনি নিয়াজ চাচা?' নিয়াজ চাচার চোখে পানি চলে এসেছে। তিনি বললেন, 'হ্যা মা। ঠিক করেছো। প্রতিদিন তুমি আমার সাথেই খেয়ো। তোমার মতো একটা মেয়ে আছে আমার। ও শহরে মেসে থেকে পড়াশোনা করে। তুমি আমার সাথে বসে খেলে মনে হবে নিশিই আমার পাশে বসে খাচ্ছে।' নিয়াজ চাচা এক হাতে চোখ মুছছেন আর অন্য হাতে একটা প্লেটে আমার জন্য খাবার নিচ্ছেন। আমি অনেক কষ্টে চোখের জল লুকালাম। আজকে আমার কাঁদা চলবে না। আমরা সবাই খাওয়া শুরু করেছি।
অন্যদিন এই জুনায়েদ আলম অনেক বকবক করে। আজ দেখলাম চুপচাপ খেয়ে চলেছে। আমিই নিজ থেকে কথা শুরু করলাম,
'জুনায়েদ ভাই, খালাম্মা কেমন আছেন? শরীর ভালো তো উনার? দাদীকে নিয়ে তো অনেক কষ্ট করতে হয়। এজন্য উনার সুস্থ থাকাটা খুব বেশি জরুরী।' কথাগুলো শুনে জুনায়েদ বিষম খেল। গ্লাস থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়েছে। তারপর বলল, 'আপনি কীভাবে জানেন আমার মার কথা, দাদীর কথা?' আমি হাসলাম। 'আপনি যে প্রতিদিন মা আর দাদীর গল্প করেন আমি সব শুনি। আপনাদের অনেকের কথা আমার ডেস্কে স্পষ্ট শোনা যায়।' জুনায়েদ হাসিমুখে বলল, 'তাই নাকি!' জবাবে আমিও হাসি ধরে রেখে বললাম, 'হ্যা তাই তো। আপনি আপনার দাদীর ভক্ত আর আপনার দাদী আপনার মায়ের ভক্ত। আপনার মা আপনার দাদীর সেবাযত্ন করেন। ঠিক ছোট বাচ্চার মতো গোসল করিয়ে দেন, মুখে তুলে খাইয়ে দেন।' জুনায়েদ চুপ করে রইল। আমি বলে যেতে থাকলাম। 'আপনি কাল ঠিকই বলছিলেন। মেয়েরা তরল পদার্থ। যে পাত্রে তাদের রাখবে সেই পাত্রেরই রূপ ধারণ করবে। এই যে আপনার মা তাকে জিজ্ঞেস করে দেখলেই বুঝবেন, বিয়ের আগে তিনি কেমন ছিলেন। বিয়ের পরে কেমন হয়েছেন। তিনি একসময় ছিলেন কারো আদরের মেয়ে, তারপর কারও স্ত্রী, কারও বউমা। তারপর তিনি মা হয়েছেন। আপনি বিয়ে করলে তিনি শাশুড়ি হবেন। তারপর দাদী। এই যে বারবার তার পরিবর্তন, এটা শুধু নামের বা সম্বোধনের পরিবর্তন নয় সাথে সাথে তার দায়িত্ব-কর্তব্যেরও পরিবর্তন হয়। সম্বোধন গুলো শুধু নিজের সাথে জড়িয়ে নেন না, নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হয়, প্রকাশ করতে হয়। আমার কথাই বলি। বাবা বেঁচে থাকতে আমি ছিলাম আদরের দুলালী। প্রথম সন্তান বলে বাবার চোখের মনি ছিলাম। বাবা কোনদিন আমাকে কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। বাবা যখন চলে গেলেন প্রথমে অভাবের সাথে পরিচিত হলাম। তারপর একে একে দায়িত্ব কর্তব্যের চাপে ভুলেই গেলাম আমি এক সময় ননীর পুতুল ছিলাম। এখন আমি যে মেয়ে তাও ভুলে যাই। আপনাদের মতোই অফিসে আমারও অনেক কাজ। আপনাদের সব ফাইল আমার কাছে আসে, আমাকে সব ঠিক আছে কিনা দেখে স্যারের কাছে নিতে হয় সাইন করার জন্য। মেয়ে বলে এখানে আমার কোন ছাড় নেই। কোন ফাইল সাবমিট করতে দেরি হলে আপনাদেরসহ এমডি স্যারের কাছে আমার কৈফিয়ত দিতে হয়। আপনারা তো যার যার কাজ করে আমাকে ফাইল জমা দিয়েই মুক্ত হয়ে যান। আমাকে আপনাদের সব রকমের সবগুলো ফাইল দেখে নিতে হয়। তারপর বাসায় গিয়ে ভাইবোনদের এটা সেটা শোনা, চাহিদা মেটানো। মেয়ে বলে আমার দায়িত্ব আপনাদের কারো থেকে কোন অংশে কম নয়। এরপরও আমাকে পথে ঘাটে, এমনকি অফিসেও কতো কটু কথা শুনতে হয়, সহ্য করতে হয়। আমি পারি এসব। কারণ আমি মেয়ে।'
কথাগুলো আমি এতো দৃপ্তভাবে উচ্চারণ করে বলছিলাম কখন যে সবাই চুপ হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে খেয়ালই করিনি। এটাই ভালো হয়েছে। একজন জুনায়েদকে 'মেয়ে মানুষ' সম্পর্কে ধারণা দিয়ে গিয়ে সবার কাছেই আমার কথাগুলো পৌঁছতে পেরেছি। ভালো লাগছে খুব। অন্য রকম ভালো লাগা। বিজয় লাভের আনন্দ এটা।
.
অফিস ছুটির ঘণ্টা খানেক আগে আমি এমডি স্যারের রুমে গেলাম। ভীষণ ব্যস্ত থাকেন তিনি। সারাক্ষণ ফাইল-পত্রের মধ্যে ডুবে থাকেন। চোখ তুলে আমাকে দেখে আবার চোখ নামালেন কোন একটা ফাইলের মধ্যে। দরাজ কণ্ঠে বললেন,
'কিছু বলবে নাকি?'
আমি বললাম, 'জি স্যার। কথাগুলো খুব জরুরী। আপনি যদি কয়েক মিনিটের জন্য ফাইল ছেড়ে আমার দিকে তাকাতেন আমার বলতে সুবিধা হতো।'
স্যার ফাইল বন্ধ করে আমার দিকে তাকালেন। 'কী ব্যাপার? কোন সমস্যা? কেউ তোমাকে বিরক্ত করছে?'
আমি বললাম, 'নাহ্ স্যার। আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আপনি তো আমাকে এখানে চাকরি দিয়ে অনেক বড় উপকার করেছেন। এজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখানে আমি ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। ব্যাপারটা খানিকটা অস্বাভাবিক। আর অন্যরা যেমন আমাকে এখনও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না আমিও স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ চালিয়ে যেতে পারছি না। এজন্য স্যার আপনার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে নতুন কোন এম্প্লয়ি নিলে মেয়েদের নেয়ার ব্যাপারে একটু ভেবে দেখবেন।'
স্যার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, 'তুমি কি বলতে চাইছো আমি আরও মেয়ে নিয়ে আমার অফিস ভর্তি করে ফেলি? এটা অফিস, কারও রান্নাঘর না। একমাত্র তোমাকে নিয়েছি শুধুমাত্র তোমার মামার রেফারেন্সে।'দে
আমি বললাম, 'স্যার আপনিই বলুন, আমি কি আমার কাজে গাফিলতি করেছি কখনো? আর মেয়েদের শুধু ঘরের কাজেই পারদর্শী হতে হবে কেন? আমার মতো যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য তো বাইরে চাকরির ক্ষেত্র থাকা উচিত। আর অনেক মেয়েই চায় স্বাবলম্বী হতে।'
স্যার প্রচণ্ড রেগে গেলেন। 'মেয়েদের চাকরি দেয়ার দায়িত্ব আমি কেন নেব?'
আমি সাথে সাথেই বললাম, 'স্যার প্রথমে আপনি উদ্যোগ নিলে আপনার দেখাদেখি অন্য কোম্পানি গুলোও নেবে। এভাবে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে আসতে থাকলে সরকারও মেয়েদের জন্য চাকরির নানা ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে। স্যার আমার মতো অসহায় অনেক অনেক মেয়ে আছে যাদের চাকরির খুব প্রয়োজন।'
স্যার চুপ করে রইলেন। আমি বলতে লাগলাম, 'স্যার কিছু মনে করবেন না, আপনার কিছু হয়ে গেলে আপনার ছেলে বা মেয়েকে সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু যাদের বড় ছেলে নেই তাদের কী হবে? ওদের নিরুপায় অবস্থাটা একটু ভেবে দেখুন।' মনে হলো শেষের কথাগুলোতে কাজ হয়েছে। স্যার বললেন, 'ঠিক আছে তুমি এখন আসতে পারো।'
স্যারের রুম থেকে বের হতেই পিয়ন রাজু হেসে বলল, 'আপা, খুব ভালো বলছেন।' আমি হেসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার ছোট ভাইটার বয়সী হবে। জিজ্ঞেস করলাম, 'রাজু তুমি পড়ালেখা করো না?'
ও মলিন হেসে বলল, 'ক্যামনে আপা। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আর কলেজে ভর্তি হই নাই। সারাদিন তো এখানেই চলে যায়। কলেজে যাব ক্যামনে?'
আমি নীরবে ওর সামনে থেকে চলে এলাম। এমনিতে তিন ভাইবোনের দায়িত্ব আমার ওপর। রাজুর জন্য কি কিছু করা সম্ভব হবে!
.
ডায়রিটা বন্ধ করলাম। এর পরের ঘটনাগুলো আমি জানি। বাবা অনেকবার বলেছেন। রাবিয়া সুলতানার একান্ত প্রচেষ্ঠাতেই অফিসের সবাই মিলে তাদের এমডি স্যার শেখ সাহেবকে বারংবার অনুরোধ করতে থাকে মেয়েদের অফিসে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে। এতে কাজ হয়। পরবর্তীতে কয়েকটা পদবী বাড়াতে হয় মেয়েদের নিয়োগ দেয়ার জন্য। রাবিয়া সুলতানা পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট থেকে ক্লিয়ারিং ইনচার্জ পদে উন্নীত হন। তার বেতন ছিল তখনকার সময়ের ত্রিশ হাজার টাকা। আজ থেকে সাইত্রিশ বছর আগের কথা এগুলো। এরপর তিনি আমার বাবা সেই কিশোর পিয়ন রাজুকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। রাবিয়া সুলতানার সহযোগিতায় তিনি কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হন। এখন আমার বাবা রাজু আহমেদ একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক। এই রাবিয়া সুলতানাকে আমি ফুফু ডাকি। তিনি এখন ষাট বছরের গর্বিত পৌঢ়া। তার ভাইবোন সকলে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আমাকে তিনি খুব স্নেহ করেন। আজ তাঁর ডায়রিটা হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, 'আমার জীবনের গল্প আছে এতে। আমি চাই তোর মতো মেয়েরা আমার গল্পটা জানুক। এক সময় মেয়েদের জন্য সব কিছুই অনেক কঠিন ছিল। এখন যে সব সহজ তাও নয়। তবে সময় অনেক পাল্টে গেছে। অনেক কিছুই আগের মতো নেই। আমার এখন খুব ভালো লাগে। মেয়েরা এখন শুধু ঘরের কাজেই নয় বাইরেও সমান পারদর্শী। একটা কথা সব সময়ই মনে রাখবি, 'মেয়ে বলে নিজেকে কখনো ছোট মনে করবি না। যখন যেখানে যেমন রূপ ধারণ করতে হয় তেমনি রূপ ধারণ করবি। ঠিক তরল পদার্থের মতো। তাহলে বাইরের প্রতিকূল পরিস্থিতি তোকে কখনো বিপদে ফেলতে পারবে না।'
আমি সেই গর্বিত রমণীর জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে শপথ করলাম, 'আমিও তোমার মতোই হবো ফুফু।'