জীবনভর এদিকসেদিক কাটিয়ে বশির সাহেব গ্রামে ফিরলেন। নানা দেশ ঘুরেছেন, নানান কিছু করেছেন, তবে ব্যাবসাই ছিল তার আসল পেশা। আর নেশা ছিল ঘোরাঘুরি। ছোটবেলায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সায়েন্টিস্ট হতে চেয়েছিলেন সুন্দর আর বৈচিত্রময় পৃথিবী দেখার আশায়। তা আর হল কই! বিজ্ঞান নিয়ে পড়ারই সুযোগ হয়নি। তবে পৃথিবী দেখার সুযোগ তিনি ঠিকই বের করে নিয়েছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াতে হোটেল ব্যাবসা করেছেন অনেক বছর, গার্মেন্টস ব্যাবসায় জড়িত ছিলেন চীনাদের সাথে, তেলের পাম্পের শেয়ার ছিল কানাডাতে। এই ব্যাবসায়িক কাজেকর্মে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বনাগরিক।
বিয়ে থা করেন নি। সংসারের ঝামেলা মাথায় নিতে চান নি। আচরনেও শুদ্ধ জীবনযাপন করেছেন। নানান দেশ, বন্দর ঘোরাঘুরি করলেও মদ, মেয়েমানুষ, জুয়া ইত্যাদি তাকে ছুঁতে পারেনি। তার একটাই নেশা ছিল। বেড়ানো।
বছরখানেক আগে ইতালীর নেপলসে থাকা অবস্থায় তার একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়। তেমন কোন ক্ষতি হয়নি, তবে কথায় একটু জড়তা এসেছে। বশির সাহেব বুঝলেন, সময় হয়ত ঘনিয়ে আসছে। আর কত! বয়সও কম হলনা। পঞ্চান্ন পেড়িয়েছে। এভাবে আর দেশে-বিদেশে কতদিন! এবার কোথাও থিতু হওয়া যাক। কিন্তু নিজের দেশ ছাড়া কোথায় যাবেন? দেশেই বা যাবেন কোথায়? সেই যৌবনে মায়ের মৃত্যুর পরে দেশ ছেরেছিলেন। মাঝেমধ্যে গেলেও সেভাবে থাকা হয়নি। গ্রামে যাননি কতকাল! বাবা তো শৈশবেই হারিয়েছেন। ভাইবোনও ছিলনা। তাই সে অর্থে তিনি শেকড়বিহীন। তবুও বশির সাহেব মনস্থির করলেন, গ্রামেই ফিরবেন। এতবছর নিজের গ্রাম, নিজের শেকড় থেকে দূরে থাকার কারনে তিনি এক ধরনের অপরাধবোধ অনুভব করলেন।
নিজের ব্যাবসাপাত্তি গুটিয়ে তিনি প্রায় তিরিশ বছর পরে গ্রামে ফিরলেন। তার আগেই অবশ্য পুরনো বন্ধুদের খুজে নিয়ে তার ফেরার বন্দোবস্ত করলেন। ছোট এক টুকরো জমি কিনে সুন্দর একটা বাড়ি করালেন। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান করালেন। গ্রামে নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে ফুলের সৌরভ মাখা বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়ে তিনি ভাবলেন, “আহা শান্তি! এই তো আমার স্বর্গ।”
এইবারে আমাদের বশির সাহেব মনযোগ দিলেন গ্রামের সংস্কারে আর মানুষের কল্যানে। চারপাশে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে তিনি যথার্থই ব্যাথিত হলেন। এত অল্প কিছু টাকার অভাবে মানুষের এত দৈন্যদশা! অথচ তার বিশাল পরিমান অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত। বশির সাহেব দুহাতে মানুষকে দান সদকাহ করা শুরু করলেন। কারো ঘর নেই, ঘর করে দিলেন। কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা টাকার অভাবে, তিনি ব্যাবস্থা করে দিলেন। গ্রামের অনেকগুলো ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যাবস্থা করে দিলেন। একটা স্কুল আর ছোট একটা হাসপাতালও তৈরি করলেন। চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ তাকে ‘মহান’ আখ্যা দিল। বিনয়ী বশির সাহেব লজ্জিত হন, কিন্তু তার ভালোও লাগে।
কিছুদিন বাদে তিনি বুঝতে পারলেন, এভাবে শুধু দান সদকাহ করে একটা সমাজ পরিবর্তন করা যাবেনা। ইতিমধ্যে গ্রামের অনেক মানুষ কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে। চাইলেই যেহেতু বশির সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া যায়, কি দরকার শুধু শুধু খাটা-খাটনীর! তিনি গ্রামের মানুষদের স্বাবলম্বী করার জন্য কুটিরশিল্পের কথা ভাবলেন। গ্রামের মানুষদের এর প্রয়োজনীয়তা আর লাভ ব্যাখ্যা করলেন। মানুষজন শুনে হ্যা-হু করল, কিন্তু তেমন আগ্রহ দেখালো না। বশির সাহেব অনেকগুলো টাকা ঢাললেন। দিন গেল, মাস গেল, কিন্তু তেমন কিছুই হলনা। এখানে তার বেশ একটা অর্থনৈতিক লোকসান হল। তার চেয়েও বড় ক্ষতি হয়ে গেল তার মনে।
মানুষের এই কর্মত্যাগী লোভী মানসিকতা তাকে ভীষণ ব্যাথিত করল। বশির সাহেব দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করলেন। তার শরীরের একদিক অচল হয়ে গেল। রাজধানী শহরে চিকিৎসায় বেশ কিছু খরচও হল। বশির সাহেব আবার গ্রামে ফিরলেন। তবে সেই উদ্যম আর উৎসাহ আর ফিরে পেলেন না। একেতো শরীরের এই অবস্থা, তার উপর লোভী মানুষের ক্রমাগত চাওয়া। কিন্তু বশির সাহেব কাউকে ফেরান না। তিনি জানেন, বুঝতে পারেন, অনেকেই মিথ্যা বলে টাকা নিচ্ছে, তাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু তিনি কিছু বলেন না। ভেবে দেখলেন, জীবনের আর কটা দিনই বা বাকী আছে! কী হবে এইসব অর্থসম্পদ দিয়ে। মানুষ নিয়ে যাক। সুখে থাক তারা।
কথায় বলে, বসে খেলে রাজার ধনও ফুরায়। ক’বছরের মধ্যে তার ধনও ফুরিয়ে এল প্রায়। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করলনা। এখন মানুষকে আর আগের মত সাহায্য করা সম্ভব হয়না। মানুষও তাকে অপছন্দ করা শুরু করেছে। ‘কৃপণ’ বলে সম্বোধন করে। আগের মত সম্মানও কেউ তাকে দেয়না। খুব কাছের দু-একজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া তার কাছে কেউ আসেও না। কাছের-দুরের আত্মীয়-স্বজন যারা আগে আসত, তারাই সবার আগে ছেড়ে গেছে। নিজের বসতবাড়িটুকু বাদে বাকিটুকু অন্যের দখলে চলে গেছে। ঠিক পাঁচ বছর আগে ঘরের দাওয়ায় যেখানে বসে বশির সাহেব স্বর্গ দেখেছিলেন, সেখানে বসে আজ ভাবছেন, “ভুলটা কোথায় হল! মানুষকে ভালোবাসা কি পাপ!”
সন্ধ্যায় মাতব্বর শ্রেনীর একজন আসলো, অনেকদিন পরে। এই লোক তাকে কোনদিন পছন্দ করেনি মানুষ তাকে সম্মান করত বলে। অথচ সাহায্যপ্রার্থীদের তালিকায় সেও ছিল। উপহাসের ছলে বশির সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এমন হল, কেন তিনি রাজার অবস্থা থেকে পথের ভিখিরির মত অবস্থায় আজ! বশির সাহেব স্মিত হাসলেন! এ আমাকে এই প্রশ্ন করছে, অথচ এরাই আমার সর্বস্ব খুবলে খেয়েছে! মুখে বললেন, "কি আর করা ভাইসাহেব! নিশ্চয়ই জীবনে বড় পাপ করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে তো হবেই।” ব্যাস। গ্রামশুদ্ধ রটে গেল, বশির সাহেব মস্ত পাপী। জীবনে তিনি অনেক বড় বড় পাপ করেছেন, তাই এখন তার শাস্তি পাচ্ছেন। মানুষ তাকে এখন ঘৃণা করা শুরু করল। অসুস্থ শরীরে রাস্তায় কদাচিৎ বের হন। বের হলে মানুষ ঠাট্টা করে, কেউ কেউ থু থু’ও দেয়। কেউ দূর থেকে ঢিল মারে। সন্ধ্যার পর, তার ঘরে কিছু উশৃংখল ছেলেপান এসে গাঁজা নিয়ে বসে। কখনো কখনো মদের বোতলও থাকে। বশির সাহেবের প্রতিবাদে কাজ হয়না। তাকে ধমকে চুপ করিয়ে রাখা হয়। একদিন মাতাল অবস্থায় একজন বলে ফেলল, “শালা বুইড়া বেশি ফালাইতাছে। দে শালারে আগুনে পোড়াই দে।” যেই ভাবা সেই কাজ। হারিকেনের কেরোসিন ঢালা হল তার গায়ে, সেই সাথে বোতলের পানীয়। আগুন ধরিয়ে দেয়া হল তার গায়ে আর ঘরে। ইতিমধ্যে মানুষ জমে গেছে চারদিকে। তামাশা দেখতে। একজন পাপী তার শাস্তি পাচ্ছে। বশির সাহেবও নিজেকে দেখছেন। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। তিনি কোন জ্বালাপোড়া বা ব্যাথা অনুভব করছেন না। শুধু বুঝতে পারছেন, তার প্রাণবায়ু চলে যাচ্ছে কিংবা গেছে। তিনিও বুঝতে পারছেন তিনি প্রায়শ্চিত্ত করছেন। পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু হিসেব মেলাতে পারছেন না, কোন সে পাপ? মানুষ হয়ে জন্মানো পাপ, না মানুষকে ভালোবাসা পাপ? বশির সাহেব কয়লায় রূপান্তরিত হওয়ার আগে হিসেব মেলাতে পেরেছিলেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বর্তমান এই সমাজ খুব নিষ্ঠুর। অধিকাংশ মানুষই অন্যের ভালো দেখতে পারেনা, বরং সবসময় খুঁজে অন্যকে কিভাবে হেনস্থা করা যায়। একজন উপকারীর অপকার করতে কিংবা নিন্দা করতে যেন আরো আগ্রহী। এই দুঃসহ সময় কী ভয়ের নয়। আমার এই ছোটগল্পে এরকম একটা দুঃসহ এবং অমানবিক ঘটনাই আছে।
০১ জানুয়ারী - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী