মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে রুচিরার। সেইসাথে কেমন যেন একটা তীব্র ভয়ও কাজ করছে। অফিসে কোন কাজে সে মন দিতে পারছেনা। এমন কিছু একটা হতে যাচ্ছে যা সে একেবারেই চাচ্ছে না কিন্তু হাসিমুখে সায় দিতে হচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে, মনের ভেতরকার ‘না’ কে প্রশ্রয় দিতে সে খুব ভয় পাচ্ছে। সকালে খাবার টেবিলে কথাটা তোলে জাফর, তার হাজব্যান্ড। হাসান রাজধানীর প্রখ্যাত এক স্কুলে চান্স পেয়েছে। সেখানে তাকে ভর্তি করানো সম্ভব কিনা। এখানকার ভর্তি ফি এবং বেতন অনেক বেশি। তাই অন্য কোথাও হয়ত ভর্তি করাতে হবে। জাফরটা একটা বেকুব। কোন বিষয়বুদ্ধি যদি থাকে! এমন ভাবনা সে কিভাবে ভাবতে পারে! কিন্তু সমস্যা হল, রুচিরাও হাসিমুখে সায় দিয়ে ফেলেছে। এমন কি সে নিজেই হিসেবকিতেব করে ফাইনাল করেছে, কোথায় কিভাবে কত টাকা খরচ হবে, কিভাবে সেটা ম্যানেজ হবে, এবং কবে তাকে ভর্তি করানো হবে। সে মোটেই চাচ্ছিল না, কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছিল।
হাসান তার ভাসুরের ছেলে। জাফরের বড় ভাই জালাল মাস ছয়েক আগে গত হয়েছে হঠাত অসুখে মারা যায়। রেখে যায় স্ত্রী আর দুই ছেলে মেয়ে হাসান আর হেনা কে। গ্রামে থাকা ভাই-ভাবির সাথে জাফরের নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও রুচিরার তা পছন্দ ছিলনা। এরা অনেকটাই গ্রাম্য এবং আনকালচার্ড। এদের সাথে রুচিরার তেমন যায়না। বিয়ের পরে গত দশ বছরে রুচিরা মাত্র দু’বার গ্রামে গিয়েছে। এরা অবশ্য আগে আসত ঢাকায় মাঝেমাঝে, কিন্তু রুচিরার তাচ্ছিল্যের কারনে বছর তিনেক হল তেমন একটা আসেনা। কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যুর পরে জাফর গ্রামে গিয়ে দু’দিন থেকে আসার সময়ে ভ্রাতষ্পুত্র হাসানকে নিয়ে এসেছে সাথে করে। মেয়েটাকে নিজের কাছে রেখে বারো বছরের হাসানকে তার মা দেবরের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে ছেলে লেখাপড়া শিখে বড় হবে এই আশায়। তার দরিদ্র সংসারে দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া কষ্টকরই হত। যদিও প্রথমে সে ছেলেকে চাচার সাথে যেতে দিতে চায়নি, কারন সে রুচিরাকে জানে। নিজের সংসারে রুচিরা এই উটকো ঝামেলাকে ঠিকমত মেনে নিতে পারবেনা এই শংকা তার ছিল, কিন্তু জাফরের অনুরোধে আর নিজের বিবর্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে সায় দেয়।
হাসানের আগমনে রুচিরা যথার্থ বিরক্তই হয়েছে। কিন্তু শত হলেও সে শিক্ষিতা এবং কালচার্ড মহিলা। সে তো আর সবার সামনে এ নিয়ে চেঁচামেচি করতে পারেনা। সে দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু হাসানকে নিয়ে জাফরের আদিখ্যেতার কমতি নেই। সেইসাথে যুক্ত হয়েছে তাদের সাত বছর বয়সী মেয়ে রুনি। সে হাসান ভাইয়া বলতে পাগল। বিরক্ত হলেও রুচিরা একপ্রকার মেনেই নিচ্ছিল। কিন্তু মাসখানেক আগে তার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। জাফর একদিন তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা আলোচনা করতে গিয়ে জানায়, হাসানকে তার নিজের ছেলের মতই বড় করবে, এবং বড় হলে তার সবকিছু নাকি নিজের মেয়ে এবং হাসানের মধ্যে সমান ভাগ করে দেবে! সে এটা করবে কারন তার ভাই জালাল নাকি তার জন্য অনেক করেছে কিন্তু সে প্রতিদান দিতে পারেনি। জাফরের এই মুর্খের মত আচরন এবং অপরিনামদর্শী পরিকল্পনা রুচিরাকে ক্ষুদ্ধ করে। কিন্তু সে ভেবে পায়না, কিভাবে এর থেকে পরিত্রান সে পাবে। ধীরেধীরে হাসান তার সংসারের বিশেষ অংশ হয়ে উঠছে। জাফরের মত বেকুব কিছুই বুঝতে চায়না এবং তাকে বোঝানোও দুঃসাধ্য।
রুচিরা মরিয়া হয়ে ওঠে। যে করেই হোক এই আপদ বিদায় করতে হবে। শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। রুচিরাও পায়না। অন্য কোন উপায়ের কথা মাথায় না এসে সে হাসান কে একেবারেই বিদায় করার পরিকল্পনা করে। রুচিরা এক কুখ্যাত ড্রাগ ডিলারের সাথে যোগাযোগ করে কিছু বিষাক্ত সাপের বিষ জোগার করে। রুচিরা জানত, অনেক নেশাখোরেরা অতি স্বল্পমাত্রার বিষ নেশার কাজে ব্যাবহার করে। এই বিষ নাকি খুব ধীরেধীরে শরীর নিস্তেজ করে নেশা ধরায়, তবে ডোজ বেশি হলে দু-তিন দিনে মৃত্যু হতে পারে। তাকে বিষের ক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য সেই ডিলার তার সামনেই একটা কুকুরকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে।
নিজের মধ্যকার সাধু আর শয়তানের মধ্যে অনেক টক্কর চলে, সে কি আসলেই হাসানকে মেরে ফেলবে? শয়তান জয়ী হয়। রুচিরা মনস্থির করেই ফেলে। ক’দিন সে হাসানের সাথে খুব ভালো আচরন করে যাতে কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক না হয়। কোন এক বিশেষ দিনে, রাতের বেলা রুচিরা হাসানের প্রিয় খাবার পোলাও রান্না করে তার প্লেটে বিষটুকু মিশিয়ে খেতে দেয়। রুচিরা দেখে হাসান প্লেট থেকে কিছু খাবার জানালা দিয়ে কোথা থেকে আসা এক বিড়ালকেও খেতে দেয়। রুচিরা মনে এক পৈশাচিক উত্তেজনা অনুভব করে, আজ রাত থেকেই ধীরেধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করবে হাসানের শরীর এবং খুব সম্ভবত আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটবে।
পরদিন সকালে তাদের ব্যালকনিতে বিড়ালটার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু হাসান দিব্যি সুস্থ। দিন গেল। রাত এল। আরো দুই-তিন দিন গেল। হাসানের শরীর খারাপের কোন লক্ষন দেখা গেলনা। রুচিরা ভয় পেয়ে গেল। এই ছেলে কি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী কিংবা কোন ভৌতিক ব্যাপার? সামান্য একমুঠো খাবারের মধ্যকার বিষ বিড়ালটাকে মেরে ফেলল অথচ পুরো এক প্লেট খাবারের মধ্যে থাকা বিষ এই ছেলেটার কোন ক্ষতি করতে পারলনা! সেইদিন থেকে রুচিরা হাসানকে ভয় পাওয়া শুরু করেছে। তীব্র ভয়। হাসানের সম্বন্ধে জাফরের কোন কথায় আর ‘না’ করার দুঃসাহস এখন আর তার নাই। হাসানের সাথে সে কি করতে গিয়েছিল আর কি হয়েছিল সে কাউকে শেয়ার করতে পারেনা, কিন্তু সে জানে এই ছেলে কি।
কিন্তু রুচিরা যেটা জানেনা সেটা হল, হাসানের মাঝে আসলেই অলৌকিক কিছু নেই কিংবা এর মাঝে কোন ভৌতিক ব্যাপারও নেই। সাপের বিষ প্রোটিনজাতীয়। খাবারের মাধ্যমে গ্রহন করলে তা পাকস্থলীর মধ্যেই পরিপাক হয়ে ভেঙ্গে অ্যামিনো এসিড হয়ে যায়। রক্তে যখন পৌছায় তখন তা আর ‘বিষ’ থাকেনা। সাধারনত যদি মুখে কিংবা পরিপাকতন্ত্রে কোন কাটা বা ঘা না থাকে সাপের বিষের ‘বিষ’টুকু রক্তে পৌছায়না। তাহলে বিড়ালটা কেন মারা গেল? কারন দীর্ঘদিন ঠিকমত খাবারদাবার না পেয়ে আর কাটাকুটা খেয়ে বিড়ালটার পরিপাকযন্ত্রে ঘা (আলসার) হয়ে গিয়েছিল। তাই কিছু প্রোটিন বিষ পাকস্থলী থেকে সরাসরি তার রক্তে পৌছায় আর আর তীব্র বিষক্রিয়া ঘটায়। কথায় আছেনা, রাখে আল্লাহ মারে কে!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই। ঠিক 'নারী' নয়, নারী-পুরুষভেদেই আমাদের মানুষদের মধ্যে 'সাধু' আর 'শয়তান' বসবাস করে। কারো মধ্যকার সাধু জয়ী হয়, কারো মধ্যকার শয়তান।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
রুচিরা একজন মধ্যবয়সী শহুরে রমনী। সে অহংকারী এবং দাম্ভিক। তার সংসারে এক কিশোর আসে 'উটকো ঝামেলা' হয়ে। রুচিরা না চাইতেও সে তার সংসারে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে পড়ে। রুচিরা পরিকল্পনা করে কিশোরটিকে বিদায় করে দিতে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ছেলেটি বেঁচে যায়, যা কিনা রুচিরার মনে তীব্র ভয় ধরিয়ে দেয়। তার মনে হয় এখানে কোন ভৌতিক ব্যাপার আছে কিংবা ছেলেটি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।
০১ জানুয়ারী - ২০১৮
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।