শীত ও শূন্যতা

শীত (জানুয়ারী ২০২০)

অনিক আহমেদ
  • ৩২
কনকনে ঠান্ডা বাতাসে যেন আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। জ্যাকেটের চেইন গলা পর্যন্ত টেনে। আবার হাঁটতে লাগলাম। সূর্য হয়ত আর কিছুক্ষন পরই ডুব দিবে, শীত আরো তীব্রভাবে চেপে বসবে এই নিথর-নিঃসঙ্গ করবস্থানে।
লালচে ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে তার দিকে আমি হেঁটে চলেছি একটু একটু করে। এখানে আসাটা বোকামি হল কি না ভাবছিলাম। দুই পাশে নাম না জানা দেহগুলো শুয়ে আছে, হয়ত তাদের মালিকরা অদৃশ্য দেয়ালের আড়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
আরো একবার কেঁপে উঠলাম। শেষ বিকেলের কনকনে ঠান্ডা বাতাস বা অদৃশ্য দেয়ালের আড়ালে থাকা হাসিগুলো এর জন্য দায়ী নয়।
"শীত তোমার কেমন লাগে?" আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে রাফিয়া আমার কাছে জানতে চেয়েছিল। তখন আমরা কলেজে পড়তাম। সেদিন বিকেলে দুইজন কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম।
"ভালো লাগে, তবে সেই ভালো লাগার মধ্যে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই।" "তুমি সহজ ভাষায় কথা বলতে পারো না?" সে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেছিল। তার কথায় আমি হেসে ফেলেছিলাম। "তোমার কেমন লাগে?" আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে জবাব দিয়েছিল, "শীতকাল দারুণ একটা সময়। তুমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দেখো, এক প্রকার সজীবতার ঘ্রাণ পাবে। এটা আমার খুব ভালো লাগে।"
সেদিন রাফিয়ার জন্মদিন ছিলো। কয়েকদিন পর ফাইনাল পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও ক্লাসের বেশ কয়েকজন মিলে দুপুরের দিকে একটি হালকা পার্টির আয়োজন করেছিল। আমি সেখানে থাকতে পারি নি। ভেবেছিলাম এজন্য হয়ত মেয়েটা সপ্তাহখানিক আমার সাথে কথা বলবে না। একবার তার সাথে ল্যাব করতে যাই নি বলে আমার সাথে তিনদিন কথা বলে নি। এতটা অভিমান আমার খুব বিরক্ত লাগত।
তবে আমার ধারনা ভুল প্রমান করে সে কলটা রিসিভ করে। আমি তাকে কলেজের মাঠে। আসতে বলি। সে প্রশ্ন করল না কেন আসতে হবে। আমার কাছে কখনই সে এমন প্রশ্ন করত না। কেন যেন আমাদের দুইজনের মাঝে দুইজনের জন্য এক অজানা শব্দ ছিলো। "রাফি...." রাফিয়াকে আমি রাফি বলে ডাকতাম।
"হুমম?" সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল। "আমি তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি।" 
তার মুখে হালকা একটা হাসি দেখা গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "সেটা তো আমি আগেই বুঝেছি। এখন দিয়ে দিলেই পারো।"
আমি পকেট থেকে ছোট্ট বক্সটা বের করে তাকে দিলাম। নীল র্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফটটা বিশেষ কিছু ছিলো না। তবে আমি জানতাম আমার কাছ থেকে পাওয়া যে কোনো উপহারই তার কাছে অনেক বেশি দামি।
"হ্যাপি বার্থডে রাফি," আমি বললাম।
"থ্যাংক য়ু, " সে হেসে বলল।
মাঠের পাশে থাকা একটি বেঞ্চে আমরা দুইজন বসলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। তবে তার মেঘের মতো নরম চোখ দুটো সেদিন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অনেক কিছু বলে দিয়েছিলো। এমন কিছু কথা যা আমি কখনই তার মুখ থেকে শুনতে চাই নি।
দুই
রাফিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয় বই পড়ার মাধ্যমে। আমি ছোটবেলা থেকে বইপোকা ছিলাম। সবসময়ই ক্লাসে সবচেয়ে বেশি বই পড়া ছাত্র ছিলাম আমি। ক্লাসের সবাই আমাকে বইখোর বলে চিনত। প্রায়ই বলত "বইখোর ইমতু।" ইমতিয়াজকে ইমতু বললে সাধারনত আমি রেগে যেতাম। তবে তার আগে "বইখোর" লাগানোতে কিছু মনে করতাম না।
কলেজে ওঠার পর আমি বই পড়ায় আমার একজন প্রতিদ্বন্দি পেয়ে গেলাম। মেয়েটির নাম ছিলো রাফিয়া। তার হাতে সারাক্ষণ একটা না একটা বই থাকতোই। আর সে আমার মত শুধু উপন্যাস পড়ত না। বরং দর্শন, ভ্রমন, বিজ্ঞান সবরকম বইয়ের প্রতি তার ছিলো সমান । আগ্রহ। সে শুধু বই পড়তোই না বরং বই নিয়ে রীতিমত গবেষণা চালাতো। অনলাইনে তার একটি বুক-রিভিউ ব্লগ ছিলো, জনপ্রিয় একটি সোস্যাল সাইটে ছিলো বিরাট এক গ্রুপ। প্রায়ই তার লেখা ছোট গল্প বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছাপা হত। তার কথায় আমাদের ক্লাসের অনেকেই বই পড়া শুরু করে।
একদিন ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ করছি এমন সময় রাফিয়া আমার সামনে এসে হাজির হল। এর আগে আমি তার সাথে তেমন একটা কথা বলি নি। এক ক্লাসে পড়ি বলেই একটু চিনতাম। জানতে চাইল হারুকি মুরাকামির কোনো বই আমার কাছে আছে কিনা।
"হ্যা, আছে তো। তিনি আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন , " আমি জবাব দিলাম।
"আমি জানি তিনি তোমার প্রিয় লেখক। রাইসুল বলেছিল তুমি নাকি তার ভক্ত, " চেয়ার টেনে আমার সামনে বসে সে বলল। রাইসুল হল ক্লাসে আমার অল্প কিছু বন্ধুদের মধ্যে একজন।
"ভক্ত বলতে পারো, " আমি বললাম।
"আমারও তার লেখা পড়ার ইচ্ছে আছে। আমাকে কি তার একটা বই ধার দিতে পারবে?"

"অবশ্যই। বলো কোন বইটা তুমি পড়তে চাও?" "তোমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।"
আমি তাকে নারওজিয়ান উড পড়তে দিই। সেটা ছিল ইংলিশ ট্রান্সলেশন। মাত্র তিনদিনে সে। বইটা শেষ করে আমাকে ফেরত দেয়। ফেরত দেওয়ার সময় বলল, "আসলেই অনেক সুন্দর লিখেন তিনি। আমি আমার ব্লগে অবশ্যই এই বইটি সম্পর্কে একটা আর্টিকেল লিখব।"
আমি বলেছিলাম, "আর্টিকেলে আমাকে মেনশন করতে পারো। হাজার হোক আমার কাছ । থেকেই বইটা ধার নিয়েছিলে।"
সে হেসে জবাব দেয়, "অবশ্যই।" তখন ফিজিক্স ল্যাব শুরু হচ্ছিলো। আমার পাশে একটা। চেয়ার টেনে বসে সে জানতে চাইল, "আচ্ছা তোমার কি সত্যিই মনে হয় একটা মানুষ একই সময়ে দুইজনকে ভালোবাসতে পারে?"
"হ্যা পারে," আমি জবাব দিই।
"কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?"
"একটা মানুষ একই সময়ে দুইভাবে দুইজনকে ভালোবাসতে পারে। ভালোবাসার জন্য একটা মাধ্যম লাগে। শব্দ যেমন কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় যেকোনো মাধ্যম দিয়ে চলতে পারে, ভালোবাসাও ঠিক তেমনই যেকোনো মাধ্যমে জন্মাতে পারে।"
সে হয়ত কিছু বলতে চেয়েছিলো। তবে ল্যাবে টিচার চলে আসায় আর বলতে পারলো না।
রাফিয়ার সাথে আমার বন্ধুত্ব তৈরী হতে বেশি সময় লাগে না। তার সাথে আমার যতটা গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল সত্যি বলতে আর কারো সাথে ততটা কখনও হয় নি। আমরা এক সাথে প্রচুর সময় কাটাতাম। এক সাথে ক্লাস করতাম, ক্যান্টিনে বসে গল্প করতাম, বাসে পাশাপাশি বসে বাসায় যেতাম।
রাফিয়া এক কথায় অসাধারন একটি মেয়ে ছিল। সে নিঃসন্দেহে সুন্দরী ছিলো, তবে তার আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলার ভঙ্গি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করতো। তার কণ্ঠে। আত্মবিশ্বাস থাকলেও সেখানে কোনো অহংকার থাকত না। সে যখন কথা বলত তা যেন মন থেকেই বলত।
"ইন্টারের পর তোমার প্লান কি?" একদিন বাসে সে আমাকে প্রশ্ন করেছিলো। "ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিগুলোর জন্য প্রিপারেশন নিবো ভেবেছি। আমার ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আগ্রহ আছে। তোমার?"
"আমি তো ভেবেছি মেডিক্যালে এপ্লাই করব।"
"হুমম, ডাক্তার হয়ে দেশের সেবা করবে।"

"আরে রাখো তোমার সেবা। আমি বায়োলজি যা একটু পারি, ম্যাথ তো কিছুই বুঝি না। মেডিক্যাল ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।"
সে এমনভাবে কথাটা বলেছিল যে আমি না হেসে পারলাম না। আমার হাসি থামার অপেক্ষা করে সে বলল, "বায়োলজি ভালো লাগে বলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর এদিক দিয়ে যদি দেশের সেবা করাও হয়ে যায় তাহলে তো খুবই ভালো।" টেস্টের আগে আমরা এক সাথে স্টাডি করতাম। ক্লাস শেষ হলে দুইজন লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসতাম। রাফিয়া বায়োলজিতে দারুন ছিল। আর তার স্মৃতিশক্তি ছিল খুব তীক্ষ্ম। জটিল সব বৈজ্ঞানিক নাম সে কয়েক মিনিটেই মুখস্থ করে ফেলতে পারত। আমি প্রায়ই ওর কাছ থেকে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আঁকতে শিখতাম। অবশ্য আমার প্রেক্টিক্যাল খাতার বেশিরভাগ চিত্র ও নিজেই একে দিতো।
ম্যাথে দুর্বল বলে রাফিয়া মাঝেমধ্যে হতাশা প্রকাশ করত। আমি তাকে ইন্ট্রিগ্রেশন আর ডিফারেন্সিয়েশনের অংক বুঝিয়ে দিতাম। গনিত সত্যি মেয়েটাকে ক্লান্ত করে ফেলত। বলতো, "এই গনিতের কারনেই আমার এ প্লাসটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে।"
আমি তাকে বলতাম, "এত হতাশ হচ্ছে কেন? কয়েকদিন প্রেক্টিস করলেই আয়ত্তে এসে যাবে।"
শেষের দিকে সত্যিই রাফিয়া গনিতে পটু হয়ে যায়। কিছু কিছু সমস্যা তো আমার আগেই সমাধান করে ফেলতে পারত। সত্যিই মেয়েটি অসম্ভব মেধাবী ছিলো।
আমাদের বন্ধুত্ব ক্লাসের তো বটেই ক্লাসের বাইরেও অনেকের চোখে পড়েছিল। একদিন রাইসুল আমাকে বলল, "দেখিস, রাফিয়ার আবার প্রেমে পড়ে যাস না যেন।"
আমি হেসে জবাব দিয়েছিলাম, "সে রকম কোনো সম্ভবনাই নেই।"
তিন
তবে রাফিয়ার মুখ থেকে আমাকে সেই কথাটাই শুনতে হয়েছিল যা আমি কখনই শুনতে চাই নি। এমন সব শব্দ যা আমাকে শূন্যতার চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলো। আর তার আকূলতা যেন। আমাকে ঠেলে দিচ্ছিলো সেই চূড়া থেকে, অসীম গহ্বরের দিকে।
"জানো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, " সেদিন মাঠের পাশে থাকা বেঞ্চটিতে বসে সে আমাকে বলেছিলো। তার কণ্ঠে একটুও কৃত্রিমতা ছিলো না। সেখানে কোনো মিথ্যা ছিলো না। ছিলো না কোনো ভুল-ভ্রান্তির অবকাশ। আমার দেয়া নীল র্যাপিং পেপারে মোড়ানো বক্সটা তার হাতে ছিল। সে এমনভাবে আকড়ে ধরেছিলো যেন বক্সটা অমূল্য কোনো সম্পদ।
"এই কথাটা আমি কবে জানতে পারি শুনবে? সেদিন আমরা দুইজন বাসে ছিলাম। তুমি বাসের হেল্পারের সাথে ঝগড়া করছিলে ভাড়া নিয়ে। লোকটা পাঁচ টাকা বেশি ভাড়া চাচ্ছিলো। তুমি ভীষন রেগে গিয়েছিলে। বলতো কি অদ্ভুত ব্যাপার, এইরকম সময়ে কারো এমনটা হয়? অথচ তখন আমার কেন যেন মনে হলো তুমি আমার কাছে অনেককিছু।

"সেদিনের পর থেকে আমি আমার ডাইরিতে তোমাকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছি। একদিন তোমাকে ডাইরিটা দিবো, পড়ে দেখো। জানো, মাঝেমধ্যে আমি রাতে ঘুম থেকে ভেজা চোখ নিয়ে জেগে উঠি। স্বপ্নে কি দেখেছি তা মনে করতে পারি না, শুধু এটুকু বুঝতে পারি স্বপ্নে । তুমি ছিলে। আমি কেন কাঁদতাম কে জানে? বলতো আমাদের মাঝে কান্না কি কখনও আসতে পারবে?"
আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। তবে সে বলে চলল, "আজ কথাটা বললাম বলে যে আমাদের মধ্যকার ফ্রেন্ডশিপ অন্যরকম কিছুতে পরিনত হবে সেটা কিন্তু আমি মোটেই এক্সপেক্ট করছি না। আমরা আগের মতোই ফ্রেন্ড থাকব। তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং কোনো ভার্সিটিতে পড়বে, আমি মেডিক্যালে। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দুইজন বিয়ে করে ফেলব। বিয়ের আগে তুমি যত ইচ্ছে, যার সাথে ইচ্ছে প্রেম করতে পারো। আমি তোমাকে কিছু বলব না। তবে বিয়ে আমাকেই করতে হবে। ঠিক আছে মিস্টার?"
আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হল না। রফিয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়েই আমার মনের অবস্থা বুঝে ফেলতে পারত। তবে সেদিন কেন বুঝতে পারে নি? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছিলো? হয়ত চরম সত্যটাকে সে মেনে নিতে চায় নি।
"রাফি, আমি... আমি....," কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিভাবে বলব জানতাম না। আমি কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না এই কথাটা একটি মেয়েকে কিভাবে বলা যায়? বিশেষ করে এমন একজনকে যে আমাকে এতটা ভালোবাসে? আদ্যো কি বলা সম্ভব?
কিভাবে আমি তাকে কথাগুলো বলতাম? কিভাবে আমি আমার অসম্পূর্ণতার কথা বলতাম? বলতাম আমার চাহিদার কথা যা সমাজের চোখে তীব্রভাবে অস্বাভাবিক?
তবে হ্যা, একথাটি সত্য ছিল যে আমি তাকে ভালোবাসতাম। শারীরিক চাহিদা কখনও ভালোবাসার একমাত্র কারন হতে পারে না। এটি একটি মাধ্যম মাত্র। যেমন আরো অসংখ্য। মাধ্যম আছে। আমি তার প্রতি কোনো জৈবিক আকর্ষণ অনুভব করতাম না ঠিকই, তবে তার কন্ঠ, তার সাথে গল্প করা, এক সাথে হাসিতে ফেটে পড়া, তর্ক করা, তার হঠাৎ রেগে ওঠা - এই সবকিছুকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম।
তবে সেদিন আমি কিছু বলতে পারি নি। একটা শব্দও না। সে আমার নীরবতায় যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলো। তার দুইচোখ ভিজে উঠেছিল। আর ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে আমি আগে কখনও তাকে কাঁদতে দেখি নি। তার চোখ থেকে পড়া ফোঁটাগুলোর পবিত্রতা যেন আমাকে স্তব্ধ করে রেখেছিলো।
চার
সেদিনের পর রাফিয়ার সাথে আমার দীর্ঘ কয়েকটা মাস কোনো যোগাযোগ হয় নি। আমি দেশের সেরা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। আমার জীবনে বিরাট একটি পরিবর্তন আসে, মানিয়ে নিয়ে রীতিমত লড়াই করতে হয়। তবে এক প্রকার শূন্যতা আমাকে সব সময়ই ঘিরে রাখত।

প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি একটা বিয়ের কার্ড হাতে পাই। রাইসুল আর রাফিয়ার বিয়ে হচ্ছে। প্রথমে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারি নি। রাইসুল অন্য একটি ভার্সিটিতে ভর্তি হলেও ওর সাথে আমার অল্প-স্বল্প যোগাযোগ ছিল। এত কম বয়সে, তাও আবার রাফিয়াকে বিয়ে করতে যাচ্ছে - এমন কিছু সে আমাকে কখনই বলে নি।
আমি তাকে কল করি। রিসিভ করার পর প্রশ্ন করি, "মজা করছিস নাকি?"
সে আমাকে জানায় এটা কোনো মজা না। রাফিয়াকে সে প্রায় মাস খানিক আগেই বিয়ে করে ফেলেছে। দুই পক্ষের মা-বাবা রাজি হবে না বলেই তারা কাউকে না জানিয়ে, সাক্ষী হিসেবে দুইজন ক্লাসমেটকে নিয়েই কাজি অফিসে চলে যায়। রাফিয়া কেন যেন বিয়ের জন্য প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলো। রাইসুলকে নাকি রীতিমত বাধ্য করেছিলো তাকে বিয়ে করার জন্য। রাইসুল অনেক আগে থেকেই মেয়েটিকে পছন্দ করত৷ রাফিয়া এমন একটি মেয়ে যাকে। যেকোনো ছেলে পছন্দ করতে বাধ্য।
আমি ফোন রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কেন যেন এতদিন জমিয়ে রাখা কষ্ট বুক চিড়ে অশ্রু হয়ে আমার চিবুক বেয়ে ঝড়ে পড়ে। কেন আমি কাঁদছি? নিজেকে প্রশ্ন করি। আমার তো খুশি হওয়ার কথা।
আমি বিয়েতে যাই নি। যাওয়ার সাহস আমার ছিলো না। তবে রাফিয়াকে কল করেছিলাম। তার সাথে অনেক কষ্টে কষ্ঠ স্বাভাবিক রেখে পয়ত্রিশ সেকেন্ড কথা বলি। তাকে বিয়ের জন্য কনগ্রেচুলেশন জানাই। "হ্যালো, রাফি...রাফিয়া?" "হ্যা, বলছি।"
"আমি ইমতিয়াজ বলছিলাম।" "ওহ, ইমতিয়াজ। ভালো আছো?" "হ্যা। তুমি ভালো আছো?"
"আমিও ভালো।"
"বিয়ে করে ফেলেছো শুনলাম।"
"হ্যা.....।"
"ওয়েল, কংগ্রেচুলেশন।"
"থ্যাংক য়ু। তুমি তো আসলে না?" "আসলে ক্লাস পরীক্ষা ছিলো তো তাই আসতে পারি নি।"
"ইটস ওকে। ফ্রি হলে বাসায় এসো। গল্প করা যাবে।"

"আচ্ছা আসব। ভালো থেকে।"
সেটাই ছিল তার সাথে আমার সর্বশেষ কথোপকথন। সেখানে কোনো হাসি ছিল না, কান্না ছিল
। আমরা দুইজন যেন দুইটি যন্ত্র, সমস্ত আবেগ যেন আমাদের ছেড়ে বহুদিন আগে চলে গিয়েছে দূরের বসন্তের উদ্দেশ্যে।
কলটা কেটে দেওয়ার পর আমি বেশ কয়েকবার ভেবেছি আমি যদি সেদিন বিকেলে আমার অবস্থাটা খুলে বলতাম তাহলে রাফিয়া কি আমাকে মেনে নিতো? সে কি আমাকে মেডিক্যাল। পাশ করার পর সত্যিই বিয়ে করতো? আমি সেদিন কেন তাকে সবকিছু খুলে বলতে পারলাম ?
হয়ত সবকিছু বলতে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগছিলো। তাই বলতে পারি নি। হয়ত আমি ভয় পেয়েছিলাম সব কিছু শোনার পর সে আমাকে ঘৃণা করবে বলে। অথবা হয়ত অন্য কোনো কারন ছিলো। তবে কারন যেটাই হোক না কেন তা এখন কোনো কিছু বদলাতে পারবে না। আমি সব সময়ই শূন্যতায় থেকে যাবো। এক অন্ধকার রাতের আধারে যেখানে রাফিয়া আমাকে কখনই ডাকবে না।
পাঁচ
কষ্ট ভুলে থাকতে আমি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করি। সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করতে থাকি। আর আমি ব্যস্ত ছিলামও বটে। ক্লাস, ল্যাব, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট, সেমিনার, পরীক্ষা - সব মিলিয়ে দিনগুলো দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই কেটে যেতে থাকে।
সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পর আমি রাইসুলের কল পাই। স্ক্রিনে তার নাম দেখে একটু অপরাধবোধ হচ্ছিলো। কেননা প্রায় দেড় বছর আমি তার কোনো খোঁজ রাখি নি। এমনকি রাফিয়াকেও কোনো কল করি নি।
কল রিসিভ করার সাথে সাথেই রাইসুল ওপাশ থেকে বলল, "দোস্ত, তোর একটু সময় হবে?"
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যা আমার ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল। বললাম, "অবশ্যই হবে দোস্ত। বল কোথায় দেখা করতে হবে?"
"আসলে রাফিয়া তোর সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলো। ওকে কিছুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। অবস্থা খুব খারাপ দোস্ত। আমার ভীষণ ভয় করছে।"
আঘাত মানুষকে এক ধাক্কায় শেষ করে দেয়। তবে ভয় কুড়েকুড়ে খায়। ঠিক আমাকে সেদিন যেভাবে খাচ্ছিলো। একটু একটু করে, ধীরে ধীরে।
রাইসুল জানায় বিয়ের পর রাফিয়া পড়াশােনা ছেড়ে দেয়। সে তার সমস্ত মনোযোগ সংসারের দিকেই দিয়েছিলো। প্রথমে মেনে না নিলেও রাইসুলের মা-বাবা ধীরে ধীরে রাফিয়াকে আপন করে নেয়। তার মত একটা মেয়ের ওপর বেশিদিন রাগ করে থাকা কারো পক্ষেই সম্ভব না। রাফিয়া সারাক্ষন ব্যস্ত থাকতো পরিবারের যত্ন নিতে।

মাত্র এক বছরের মাথায় রাফিয়া গর্ভবতী হয়। তবে বাচ্চা আসার পর পরই তার স্বাস্থ্য অস্বাভাবিকরকম ভেঙে পড়ে। যদিও সে ভীষন খুশি ছিলো। তবে প্রায় দিনই অসুস্থ থাকত।
মাত্র সাত মাসের মাথায় রাফিয়ার ওজন অর্ধেক কমে যায়। রাইসুলের পরিবার বাধ্য হয় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে। যদিও এই সিদ্ধান্তে রাফিয়া মোটেই খুশি ছিলো না।
আমি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মা-মেয়ের মৃত্যু ঘটে। রাফিয়া তার মেয়ের নাম রেখেছিলো মিতু। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মিতু তার মায়ের হাত ধরে পাড়ি জমায় অজানা এক উদ্দেশ্যে।
হাসপাতালে রাফিয়ার নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম সে আমাকে কি বলতে চেয়েছিলো। তার রক্তশূন্য মুখটা যেন আমাকে এক শীতের বিকেলের স্মৃতি দিয়ে বিদ্ধ করে। যেদিন আমার পাশে বসে তার দুই গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ছিল, যার পবিত্রতা আমাকে স্তব্ধ করে রেখেছিলো।
ভয়
কনকনে বাতাস আমাকে আরেকবার কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। আমি রাফিয়া আর মিতুর করবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে মা-মেয়ে শুয়ে আছে পরম শান্তিতে। সেখান থেকে রাফিয়া কি আমাকে দেখছে? সে কি বুঝতে পারছে আমার ভেতরের হাহাকার? এই শীতের বাতাস যে হাহাকার মুছতে হাজারবার ব্যর্থ হয়েছে।
এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমার জানা নেই। আমার ভেতরের শূন্যতা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি তার করবের সামনে। আজ তার জন্মদিন। সে যেন দেয়াল ভেদ করে আধার থেকে আমাকে বলছে, "জানো, এই আধারেরও কোনো বিশেষত্ব নেই।"
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আব্দুর কাদির এককথায় অসাধারণ। ভোট রইল প্রিয়। আরও লেখার প্রতিক্ষায় রইলাম। আমার পাতায় আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০২০
অসংখ্য ধন্যবাদ অনুপ্রেরনার জন্য। আপনার লেখা অবশ্যই পড়বো।
ভালো লাগেনি ১৩ জানুয়ারী, ২০২০
ফয়জুল মহী অনবদ্য পরিপাটি লেখা I
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০২০
ধন্যবাদ মতামতের জন্য।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০২০
Ms Ahmad সুন্দর গল্প। শুভ কামনা লেখকের জন্য।
ভালো লাগেনি ৪ জানুয়ারী, ২০২০
ধন্যবাদ। আপনার যাত্রা-ও শুভ হোক।
ভালো লাগেনি ১১ জানুয়ারী, ২০২০

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

আমার গল্পের প্রধান চরিত্র ইমতিয়াজের কাছে শীত নিয়ে আসে এক গুচ্ছ স্মৃতি যা তাকে কাঁদিয়ে চলেছে দীর্ঘ চারটি বছর যাবৎ। তার কলেজ জীবনের বান্ধবী রাফিয়াকে হারানোর অনুভূতি তাকে আচ্ছান্ন করে রাখে কূয়াশার মত। এক শীতের বিকেলে রাফিয়া জানিয়েছিলো সে তাকে ভালোবাসে। তবে ইমতয়াজ নিজেকে ভালোবাসার যোগ্য মনে করে নি। আর তাই রাফিয়া নিজের জন্য ভিন্ন একটি পথ বেছে নেয়। তবে রাফিয়া তার পথে বেশিদিন হাঁটতে পারে নি। দুই বছরের মাথায় পাড়ি জমায় মৃতদের রাজ্যে। আর কোনো যুক্তি ছাড়াই ইমতিয়াজ নিজেকে রাফিয়ার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করে। ইমতিয়াজের জীবন তাই সেই শীতের বিকেলটিতেই আটকে আছে যেদিন রাফিয়া তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো। বিকেলটি তার সমস্ত স্নায়ু যেন ভোতা করে দিয়েছে। ফলে শীতের তীব্রতা তাকে আর কষ্ট দেয় না। তার চেয়ে বেশি কষ্ট বুকে নিয়ে সে হেঁটে চলে জীবিতদের মাঝে। বুকের কষ্ট অনুভব করার জন্য স্নায়ুর প্রয়োজন হয় না।

২৫ ডিসেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪