‘মাছগুলা কি তাজা?’
‘না দাদা। সবগুলা একদম পঁচা।’-এক হাতে নাক চেপে ধরে জবাব দেয় চোখে কালো কাপড় বাঁধা মাছ বিক্রেতা।
‘তাইলে এক পাল্লা পঁচা মাছ দ্যাও আমারে।-এক লাখ টংকা দাম পাইবা কিন্তু, ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে দাদা।’-বলেই এক পাল্লা মাছ মেপে দেয় সে।
‘আবার আইসেন দাদা। কালকে আপনের লাইগ্যা বড় বড় পঁচা মাছ রাখুম।’-একশ’ টংকার কড়িটি নিতে নিতে বলে বিক্রেতা।
এখানে সবাইকে মিথ্যে বলতে হয়-তাই ‘সতেজ’ মাছকে এরা বলে ‘পঁচা’; যেমন ‘মিষ্টি’কে বলে ‘টক’। আর ১০০ টংকার কড়িকে বলে ১,০০,০০০ টংকা-টংকার অংকের সাথে ইচ্ছে করেই আরো তিনটি শূণ্য জুড়ে দেয় এরা-সবই মিছেমিছি এই আর কি! আবার শুনতেও ভালো লাগে...লাখ টংকা...নেহায়েত কম নয়।
বলছিলাম ছোট্ট দ্বীপ-অন্ধ প্রদেশের কথা। রাজার হুকুমে এখানে সবাই পাতলা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে চলাফেরা করে-নইলে নিশ্চিত মৃত্যুদন্ড। কেউ কেউ আবার অন্ধদের মতো ব্যবহার করে লাঠিও। অন্ধ সেজে থাকায় প্রজারা কখনো সত্যকে ‘সত্য’ বলতে পারে না-কেবলি মিথ্যে বলে। বড় অদ্ভূত এই দ্বীপ-অন্ধ প্রদেশ। দ্বীপের জাতীয় স্লোগান আরো অদ্ভূত-‘আমরা সব আন্ধা-করি শুধু ধান্ধা।’।
বিচিত্র এ দ্বীপের মানুষের প্রকাশভঙ্গি ও কথাবার্তা। এখানে ‘হ্যাঁ’কে এরা বলে ‘না’ আর ‘না’ কে বলে ‘হ্যাঁ’। শুধু তাই নয় ‘হ্যাঁ’ বলার সময় মাথা নাড়ে ডান থেকে বামে-বাম থেকে ডানে পরপর দু’বার; আর ‘না’ বলার সময় মাথা ঝাঁকায় উপর থেকে নীচে-নীচ থেকে উপরে পরপর দু’বার।
যেমন কেউ বড় সাইজের একটা কুমড়ো দেখিয়ে বলল, ‘কুমড়াডা কত্তো বড়, তাই না?’
উপর-নীচ দু’বার মাথা ঝাঁকিয়ে এরা বলে-‘না’।
আবার কেউ গোল আলু দেখিয়ে বলল-‘দ্যাখ, কি সুন্দর ডিম?’
যথারীতি ডানে-বামে দু’বার মাথা নাড়িয়ে এরা বলে-‘হ্যাঁ।
দ্বীপের শাসন ব্যবস্থা জনগনতন্ত্রের আড়ালে পুরোপুরি রাজতান্ত্রিক। বর্তমান মহারাজের নাম ‘মিথ্যারাজ’। মিথ্যারাজের আগে ছিল সত্যরাজের রাজত্ব। তারও আগে অসুররাজের রাজত্ব। অসুররাজের রাজত্বের নিয়ম ছিল-‘জোর যার মুল্লুক তার’। কিন্তু অসুরদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে জনগণ একসময় বিদ্রোহী হয়ে উঠে। সে বিদ্রোহে সত্যরাজের নেতৃত্বে পরাজিত হয় অসুররাজ। সত্যরাজের সময়ে দেখা গেল আরেক বিপত্তি। সত্য পালন করতে গিয়ে অনেকের স্বার্থই রক্ষা করা যাচ্ছিল না-বিশেষ করে রাজার দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীরাই পড়ল বেশী বেকায়দায়। ফলে শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। অবশেষে একদিন শুনা গেল বৃদ্ধ সত্যরাজ সমুদ্রে ডুবে মরেছে। সেই থেকে যুবরাজ মিথ্যারাজই আছেন বহাল তবিয়তে। এখন সময়টা মিথ্যার। বেশ ভালোই চলছে...
অন্ধপ্রদেশে আজ বসেছে বসন্ত মেলা। হরেক রকম আয়োজন মেলায়। তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন-‘মিথ্যে বলা’ প্রতিযোগীতা। প্রতিযোগীতা দেখতে নেমেছে জনতার ঢল-সবার চোখই কালো কাপড়ে বাঁধা। মিথ্যারাজ নিজে উপস্থিত থেকে সেরা মিথ্যুককে পুরস্কার দেবেন। চলছে প্রতিযোগীতা...
প্রত্যেক প্রতিযোগীকে একটি করে প্রশ্ন করা হচ্ছে। মিথ্যে বলতে না পারলে পুরস্কার তো দূরে থাক; সাথে সাথেই কেটে নেয়া হচ্ছে জিব। গতবারের মিথ্যুক চ্যাম্পিয়নসহ এবারের প্রতিযোগী পাঁচজন। এরি মধ্যে তিন প্রতিযোগীর জিব কাটা পড়েছে। বাকী আছে দু’জন।
তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞ্যেস করা হলো-‘মহারাজের নাম কি?’
এই প্রতিযোগী ভালভাবেই জানে মহারাজের নাম-‘মিথ্যারাজ’। যেহেতু সত্য বললে জিব কাটা যাবে তাই মিথ্যে উত্তর দেয় সে-‘মহারাজের নাম ‘সত্যরাজ’। মহারাজ সত্যরাজের জয় হোক।’
উত্তর শুনামাত্র মিথ্যারাজ প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ‘কি বললি-মহারাজ সত্যরাজের জয় হোক! তুই আমার প্রজা হয়ে আমার পিতার জয়গান করছিস? এ্যাঁই কে আছিস, ওর জিব কেটে নে’। ব্যাস, হুকুম তালিম হয়ে গেলো।
অতঃপর গতবারের চ্যাম্পিয়ন মিথ্যুকের পালা-নাম তাঁর মিঠালাল। মিঠা মিঠা কথা বলে মানুষের সাথে প্রতারণা করে বলে তার এই নাম। একই প্রশ্ন করা হলো তাকে-‘বল, মহারাজের নাম কি?’
পাতলা কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা থাকলেও আগের প্রতিযোগীর পরিণতি একটু আগেই দেখেছে সে। প্রশ্ন শুনে একটু ভড়কেও যায় গতবারের চ্যাম্পিয়ন। উপস্থিত জনতাও অপেক্ষায় আছে কখন মিঠালালের জিব কাটার হুকুম হয়। জনতাও চায় তার জিব কাটা পড়ুক-এ জিব দিয়েই সে অনেকের সাথে প্রতারণা করেছে।
আবার প্রশ্ন করে-‘বল, মহারাজের নাম কি?’ কি উত্তর দেবে ভাবে মিঠালাল। আমতা আমতা করে বারকয়েক ঢোক গিলে বলে-‘মহারাজের নাম..‘ম-হা-রা-জের নাম জরাথ্যামি। মহারাজ জরাথ্যামি’র জয় হোক।’
উত্তর শুনে স্তব্ধ জনতা। ময়দান জুড়ে পিনপতন নিরবতা। ধূর্ত মিথ্যুকের জিব কাটা পড়ছে ভেবে মনে মনে খুশী সবাই-আর রক্ষা নেই। প্রমাদ গুনতে থাকে মিঠালালও।
এদিকে মহারাজও মিঠালালের উত্তর শুনে ধন্ধে পড়ে যায়। একবার তাকায় রাজসভার পন্ডিতের দিকে আরেকবার মিঠালালের দিকে। সত্যি ধন্ধে পড়ে যায় রাজা-বুঝতে পারে না কে এই জরাথ্যামি?
মিঠালালের জিব কাটতে ছুরি হাতে এগোয় জল্লাদ। হঠাৎ রাজ পন্ডিত তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে-‘ইউরেকা, ইউরেকা...পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি, এবারের চ্যাম্পিয়ন মিথ্যুককে আমরা পেয়ে গেছি...।’-পন্ডিত সউল্লাসে মিঠালালের হাত উঁচু করে ধরে।
উপস্থিত জনতার মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। বিষয়টা বুঝতে পারে না কেউ।
‘জরাথ্যামিটা কে পন্ডিত?’-ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ধমকে উঠে রাজা।
‘জরাথ্যামিতো আপনি নিজেই মহারাজ, আপনি নিজে...। মিঠালাল মহারাজ মিথ্যারাজের নাম উল্টো করে বলেছে ‘জরাথ্যামি’, কী বুদ্ধি, কী বুদ্ধি!’
চ্যাম্পিয়ন মিথ্যুকের উপস্থিত বুদ্ধি দেখে মিথ্যারাজও বেজায় খুশী। পুরস্কার হিসেবে তাই অমন বুদ্ধিমান মিথ্যুকের সাথেই রাজকণ্যার বিয়ে ঠিক করে মিথ্যারাজ। নিজের মনেই বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে-‘মহারাজের নাম জরাথ্যামি...মহারাজ জরাথ্যামি...আমি জরাথ্যামি...’ যেনো মিথ্যারাজের উল্টো নামটিই বেশ পছন্দ তাঁর-কালো কাপড়ে বাঁধা মিথ্যারাজের চোখে আনন্দের দ্যুতি খেলে-প্রজারা দেখতে পায়না সে খুশী।
দুই
দুই সূর্যাস্ত পরের কথা। সন্ধ্যারাত থেকেই প্রচন্ড ঝড় বইছে। উঁচু উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ছে দ্বীপে; লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে সবকিছু।
দু’রাত পরে ঝড় থামে। অন্ধ সুবলের মেয়ে আঙুরবালা সাগরপাড়ে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে যায়। দেখে- সোয়া কুঁড়ি বয়সের এক যুবক পড়ে আছে; পোশাক-আশাক একেবারই অন্যরকম-নিশ্চিত দ্বীপের কেউ নয়। আহারে, ঝড়ে ভেসে এসেছে সাগরের কোথা থেকে কে জানে। বুকে কান লাগিয়ে শুনে-বেঁচে আছে যুবক। জীবনে এই প্রথম চোখ বাঁধাহীন অবস্থায় কোন যুবককে দেখল আঙুরবালা। পরদেশী যুবকের অপূর্ব সুন্দর চোখ দু’টির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কীসের যেনো টান অনুভব করে। বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে। অনেক কষ্টে পরদেশী যুবককে নিয়ে আসে সে ঝুপড়ি ঘরে।
সুস্থ হয়ে উঠলে পরদেশী যুবককে শেখাতে শুরু করে দ্বীপের ভাষা; সাথে দ্বীপের নিয়মকানুনও। রাজনিয়ম- তাই যুবকের চোখ বেঁধে দেয়া হয় পাতলা কালো কাপড়ে-চোখ বাঁধার আগে যুবকের অসম্ভব সুন্দর চোখ দু’টি শেষবারের মতো মুগ্ধ চোখে দেখে আঙুরবালা। যুবতী জানলও না-উর্বশী তরুণীকে চুরি করে কতোবার দেখে নিল পরদেশী যুবকের কালো কাপড়ে ঢাকা চোখ।
বসে বসে দিন কাটে না যুবকের-আঙুরবালার সাথে দোকানে বসতে চায়। কিন্তু দোকানদারী করতে গেলে যে মিথ্যে বলা শিখতে হবে। তাই মিথ্যে শিখানো হচ্ছে তাঁকে...
‘তিনটায় এক হালি, ‘না কিনলে ধরা খাইলি’-আঙুরবালা সুর করে যুবককে শেখাতে থাকে।
‘চারটায় এক হালি, কিনলেই জিতে গেলি’-যুবক উল্টো সুর করে বলে; কিছুতেই মিথ্যে বলতে রাজী নয় সে।
‘আঙুর ফল টক, না কিনলে ঠক’-আঙুরবালা আবার সুর করে শেখাতে চায়।
‘আঙুর ফল মিষ্টি, তুই আঙুর মিষ্টি-যুবক আঙুরবালাকে বলে। লজ্জায় কালো হয়ে উঠে আঙুরবালা-যুবকের সত্যি কথাগুলো বড়ই মিষ্টি লাগে তাঁর কাছে।
আজই প্রথম আঙুরবালার সাথে দোকানে বসেছে যুবক। আম, নারিকেল, ডুমুর, কলাসহ নানা রকম ফলের পসরা দোকানে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ফলের দোকান। কেউ একজন ক্রেতা আসছে। অমনি আঙুরবালা হাঁকতে লাগল-
‘তিনটায় এক হালি, ‘না কিনলে ধরা খাইলি’
‘আঙুর ফল টক, না কিনলে ঠক’....
আঙুরবালা হাঁকাহাঁকিতে পাশের দোকানদারও হাঁকতে লাগল-
‘আসেন দাদা আসেন-আন্ধা চোখে দ্যাখেন’
‘আমরা দাদা আন্ধা-করি সবাই ধান্ধা’....
দোকানী কালালালও শুরু করে-
‘পাঁচটায় এক হালি, না কিনলে ধরা খাইলি’
‘আঙুর ফল টক, না কিনলে ঠক’....
বাজারে হাঁকডাকের প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল বিক্রেতাদের মধ্যে। ক্রেতা বেচারাকে নিয়ে শুরু হলো টানাটানি।
‘তুই পাঁচটায় এক হালি দিলে আমি দিমু ছয়টা।’-ধলালাল ক্রেতাকে টানতে থাকে।
‘আমি দিমু হালিতে সাতটা।’-কালালালও কম যায় না।
‘তাইলে আমি দিমু মাগনা’-কিছুতেই হারতে রাজী না ধলালাল। ধলালাল আর কালালালের মধ্যে ক্রেতাকে নিয়ে শুরু হলো টানাটানি-তর্কাতর্কি-ধব্স্তাধ্বস্তি। অতঃপর মারামারি। মারামারির এক পর্যায়ে ধলালাল ডাব কাটার দা দিয়ে মারে কোপ কালালালের মাথায়। ধড়ফড় করতে করতে মরেই গেলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে হাজির ন্যায়পাল।
‘বাজারে এত্তোগুলা লোক, কেউ কিচ্ছু দেখলি না। সব ক’টাকে আজ বেঁধে নিয়ে যাব।’-ন্যায়পাল ধমকে উঠে।
‘আমি সব দেখছি ধর্মাবতা।’-কালালালের ভাতুষ্পূত্র ভোলালাল এগিয়ে আসে। তাঁর কখা শুনে বাজারের সবাই আতংকিত হয়ে পড়ে-সত্য কথা বললেই বেচারা কানালালের আজীবন সশ্রম কারাদন্ড।
‘বল কি দেখেছিস।’-ন্যায়পাল সাগ্রহে জানতে চায়।
‘ধর্মাবতা, মাত্র দোকানে ঢুকছি। কালো কাপড়ের ফাঁক দিয়া দেখলাম-কালা কাকা ভাং খাইয়া মাতলামি করতাছে। চাচীর লগে রাইতে ঝগড়াও অইছে। মাতলামি করতে করতে একসময় কাকা দা দিয়া নিজেই নিজের মাথায় মারল কোপ। লগে লগেই শেষ। ও..কাকা গো...ক্যান চইল্যা গেলা গো...’-বলেই বিলাপ করতে থাকে ভোলালাল।
‘ধর্মাবতা, বুড়া পাগল অইয়া গেছিলো। সবসময় নিজের কান নিজেই কামড়াইত, নিজের পিঠও কামড়াইত মাঝে মাঝে।’-আরেকজন সাক্ষ্য দেয়।
ন্যায়পাল তাই বিশ্বাস করল। বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধাল পরদেশী যুবক। স্বচ্ছ কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা থাকলেও সবই দেখেছে সে। সত্য সাক্ষ্যই দিল সে। প্রেমিককে বাঁচাতে সত্য-মিথ্যা কতো কথা বলল আঙুরবালা-কিছুতেই কিছু হলো না।
‘বিচার আন্ধা যুবক।’-কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা ন্যায়পাল বলে। অতঃপর সত্য সাক্ষ্য দেয়ার কারনে আজীবন সশ্রম কারাদন্ড যুবকের। নিয়ে যাওয়া হলো রাজ কারাগারে-আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ায় বেকসুর খালাস ভোলালাল-বাড়ী যেতে যেতে ভাবে সে-‘কাকার দোহান অহন আমার...।’
তিন
রাজপ্রাসাদে চলছে বড় রাজকুমারী চন্দ্রভানুর বিয়ের আয়োজন। সখীদল ঘিরে রেখেছে রাজকুমারীকে।
‘আহা কী ভাগ্য রাজকুমারী আপনার! দ্বীপের সেরা মিথ্যুকের সাথে শুভ বিবাহ।’-বলে এক সখী।
‘আরে, শুধু কী মিথ্যুক। তিন তিনবারের চ্যাম্পিয়ন মিথ্যুক। আহা, কী গুণী বর।’-আরেক সখী রাজকুমারীর হবু বরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
‘চ্যাম্পিয়ন মিথ্যুক না ছাই! পিতাজীর চেয়ে বড় মিথ্যুক আছে নাকি দুনিয়ায়? তিনি হলেন রাজ মহারাজ-মহারাজ মিথ্যারাজ। পিতাজীর তুলনায় মিঠালালতো কোন্ নস্যি ছার। পিতাজী হলেন দুনিয়ার সেরা মিথ্যারাজ-তিনি আমাগো গর্ব’-নিজের পিতাকে নিয়ে বড়াই করে রাজকুমারী।
আড়ালে দাঁড়িয়ে মহারাজ মিথ্যারাজ রাজকুমারীর সব কথাই শুনতে পায়। রাজকুমারীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খুশী হবারই কথা তাঁর। কিন্তু কেন জানি সেখান থেকে সঙ্গোপনে চলে আসে সে।
নিজ কক্ষে ফিরে এসে অঝোরে কাঁদতে থাকে মিথ্যারাজ। এ কান্না পিতার প্রতি কণ্যার ভালোবাসার কথা শুনে নয়; এ কান্না লজ্জার। সারা ঘরময় পায়চারি করতে থাকে মহারাজ। নিজের মনে বিড়বিড় করে-‘এ আমি কি শুনলাম! আমার মেয়ে আমাকে দুনিয়ার সেরা মিথ্যুক বলে গর্ব বোধ করে! এ লজ্জা রাখি কোথায়!’ আবারও কাঁদতে থাকে-চোখের জলে ভিজে যাওয়া কালো কাপড় খুলে ফেলে রাজা। চোখের জল আজ শুধু রাজার কালো কাপড় খুলে দেয়না; খুলে দেয় মহারাজের চোখও।
অশতীপর বৃদ্ধ রাজাকে কেন জানি আজ মৃত্যুভয় পেয়ে বসে। অতীতের কতো কথা মনে পড়ে তাঁর। প্রায় প্রতি রাতেই পিতাজী সত্যরাজ স্বপ্নে হানা দেয়। বলে-‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর মিথ্যারাজ। কতকাল এ আন্ধাশাসন! স্বাধীন করে দাও প্রজাদের। স্বপ্নঘোরে মিথ্যারাজ বিড়বিড় করে-‘তাই হবে পিতাজি। একসময় ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়। থরফড়িয়ে জেগে উঠে মিথ্যারাজ। সারারাত আর ঘুমাতে পারে না সে। সে জানে তাঁর অতীতের পাপ....
মিথ্যারাজের মনে এ যেন দুই মনের বসবাস। ঘুমঘোরে সত্যরাজের প্রতিচ্ছবি আর জাগরণে অন্য এক মিথ্যারাজ। কি করবে সে-এতকালের প্রচলিত অন্ধরীতি তুলে নিলেতো প্রজারা সব স্বাধীনচেতা হয়ে উঠবে। একবার স্বাধীনতার স্বাদ পেলে জনতা টলিয়ে দেবে রাজ সিংহাসন। সুতরাং যেভাবে চলছিল চলুক সেভাবে। চলেও তাই...বহুকাল ধরে অন্ধাভিনয়ে অভ্যস্ত প্রজাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই আর....
অতঃপর শুক্লা তিথিতে শুভক্ষণ দেখে মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে যায় মিঠালাল আর রাজকুমারী চন্দ্রভানুর। কিছুকাল ভালই কাটে তাদের।
কিন্তু মিঠালাল তো এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকার মানুষ নয়। ছিলও না কোনদিন। সে ছিল অতি ধূর্ত এক কথার কারিগর। মিঠা মিঠা কথা বলে ফাঁদে ফেলতো মেয়েদের। দ্বীপের অনেক কিশোরী-যুবতী নিঃস্ব হয়েছে তার কামনার ফাঁদে। মিঠালালের নষ্ট চোখ এখন ছোট রাজকুমারী চুমকিবানুর উপর।
খুব অল্পদিনেই চুমকিবানুকে পটিয়ে ফেলে মিঠালাল। সম্পর্ক গড়ায় দৈহিক সম্পর্কে-ঠোট-জিহবা, উর্বশী বুক চুমে তলপেট পর্যন্ত। হাতে-নাতে ধরাও পড়ে চন্দ্রভানুর কাছে। নিজেকে বাঁচাতে মিঠালাল হত্যা করে চন্দ্রভানুকে। চুমকিবানুও সাহায্য করে তাতে। রাজ বাগানেই ঘটে ঘটনাটি। মিথ্যা সাক্ষ্যের কারনে খুনীকে শনাক্ত করতে পারে না মিথ্যারাজ। মেয়ের শোকে পাগলের মতো হয়ে যায়। রাজা এখন সত্য জানতে চায়। কিন্তু মিথ্যারাজের রাজ্যে সত্য জানা অসম্ভব-নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছে সে।
কিন্তু কথায় বলে-‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। সশ্রম কারাদন্ডভোগী সেই পরদেশী যুবক ঘটনার দিন মালীর কাজ করছিল রাজবাগানে-দেখে ফেলে সবকিছু। তাঁর সত্য সাক্ষ্যে ফাঁস হয়ে যায় রাজকুমারীর অবৈধ প্রণয়ের কথা। অপমানে-লজ্জায় আত্মহননের পথ খুঁজে নেয় চুমকিভানু। পালিয়ে যায় মিঠালালও।
দুই মেয়েকে হারিয়ে মৃত্যুসজ্জা নেয় মিথ্যারাজ। মনে পড়ে তাঁর অতীত জীবনে কৃত পাপের কথা। পাপের কথা... পরপর দু’মেয়েকে হারানোর ব্যথায় বিলাপ করতে থাকে মিথ্যারাজ। রাজকুমার কংশরাজ ছুটে আসে পিতার শিয়রে।
‘আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে...। মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা পূরণ কর যুবরাজ। তুমিই পার আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে’-রাজা অসহায়ভাবে যুবরাজের হাত চেপে ধরে।
‘বলুন মহারাজ’-যুবরাজও রাজার হাত চেপে ধরে বুকে।
‘শুন যুবরাজ...পিতৃহত্যাকারী পাপী আমি...। তোমার পিতামহ সত্যরাজ ডুবে মরেনি। রাজ সিংহাসনের লোভে ধুতুরার বিষে অজ্ঞান করে...আমিই তাঁকে ফেলে দিয়েছি সমুদ্রজলে। আমি আমার পিতাকে ফেলে দিয়েছি সমুদ্র জলে...তুমিও আজ রাতে আমাকে ফেলে দাও সমুদ্রের গহীন তলে...এভাবেই প্রায়শ্চিত করার সুযোগ দাও পুত্র আমার।’-বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মিথ্যারাজ।
চার
এদিকে রাজ পরিবারের পাপাচার ফাঁস করে সাক্ষ্য দেয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা যুবরাজ কংশরাজ। সত্য সাক্ষ্য দেয়ার অপরাধে প্রত্যুষে পরদেশী যুবকের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘোষণা দেয় যুবরাজ।
মৃত্যুদন্ড দেখতে ময়দানে জড়ো হয় দ্বীপের সবাই। ছুটে আসে আঙুরবালাও। ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত। প্রস্তুত জল্লাদও। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে এখনো কিছুসময় বাকী।
‘যুবক, বলো তোমার শেষ ইচ্ছা!’-যুবরাজ জানতে চায়।
‘দ্বীপের সকলের চোখের কালো কাপড় খুলে দেয়া হোক। দ্বীপবাসী স্বচক্ষে দেখুক আজ সত্য বলার পরিণতি। শেষবারের মতো কিছু বলতে দাও আমায়’-যুবক তাঁর অন্তিম ইচ্ছা জানায়।
কংশরাজ ভাবে-ভালোই হলো। প্রজাদের চোখ খুলে দিলে-স্বচক্ষে মৃত্যুদন্ড দেখে ভবিষ্যতে আর কেউ সত্য বলার সাহস পাবে না।
‘তবে তাই হোক। খুলে দাও যুবকের চোখ। ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত প্রজারাও সরিয়ে ফেল চোখের কালো কাপড়। দেখ-সত্য বলার ভয়াবহ শাস্তি।’-যুবরাজ হুকুম দেয়।
‘সত্যরাজে’র রাজত্বকালে আজকের বৃদ্ধরা ছিল ছোট ছোট শিশু। তখন চোখ খোলাই ছিল তাঁদের। সেটি কতোকাল আগের কথা-এখনকার বৃদ্ধদের তা মনেও নেই। কালো কাপড়ে এতোকাল চোখ ঢেকে রাখায় প্রায় দৃষ্টিহীন এরা। তবুও আজ কালো কাপড় সরিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে। নবীন প্রজন্মও জন্মের পর এই প্রথম চোখের কালো কাপড় সরানোর সুযোগ পেল। ভোরের আলোয় চোখ খুলতে কষ্টই হচ্ছে দ্বীপবাসীর। দিনের আলোতে চোখগুলো মানিয়ে নিতেও সময় নেয়। চোখের আলো স্বাভাবিক হয়ে আসতেই দ্বীপবাসী দেখে সব অস্বাভাবিক দৃশ্যাবলী...
ছোট্ট শিশুরা ছুটাছুটি করছে এদিক-ওদিক। কিশোর-কিশোরী মেতে উঠেছে দূরন্তপনায়-পাহাড়ে উঠছে, আবার নামছে। উঠতি যুবক-যুবতীরা মেতে উঠেছে পুষ্পবনে। উম্মাতালভাবে তারা উপভোগ করছে কিছু সময়ের স্বাধীনতা-নেচে গেয়ে। মুগ্ধ খোলা চোখগুলো অবাক বিস্ময়ে দেখছে কেবল-সবুজ আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাস, নানান বরণ পুষ্পশোভা-কি অপরূপ স্নিগ্ধ সকাল-এতোদিন যা সবই ছিল কালো কালো...
পরদেশী যুবক চিৎকার করে বলতে শুরু করে....
‘শুন হে প্রবীণ দ্বীপবাসী-
তাকাও তোমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের দিকে-কত প্রাণচঞ্চল দূরন্তপনায় মেতেছে আজ ছোট্ট সোনামনি-কিশোর-কিশোরীদল। তোমরা কী চাও-থেমে যাক এ দূরন্তপনা ক্ষণিক বাদে; ঢেকে যাক শিশুদের চোখ আবার আন্ধা কাপড় তলে?
শুন হে পুষ্পবনের প্রেমিক যুগল-
ক্ষণিকের স্বাধীনতা-কতো ঢংয়ে নেচে গেয়ে উপভোগ করছ তোমরা আজ। চোখ মেলে দেখ-কতো স্নিগ্ধ এ সকাল, সুন্দর এ ধরণী! তোমাদের এ চোখ বিধাতার সৃষ্টি। তোমরা অন্ধ নও-ছিলেও না কোনদিন-তবে কার ভয়ে তোমাদের এ আন্ধাজীবন। তোমরা কী চাও-তোমাদের অনাগত সন্তানেরাও এমনিভাবে কাটাবে আন্ধা জীবন?
শুন হে ভরা য়ৌবণা যুবক-
যৌবণের ধর্ম শুধুই স্বাধীনতা। পরাধীনতা মানায় না তোমায়। মিথ্যা অন্ধত্ব তোমাদের করেছে পরাধীন। রক্ত টগবগে যুবক তুমি-হাঙরের মুখ থেকে মৎস্য কেড়ে আনো তুমি। কিসের ভয়ে তোমাদের পরাধীন জীবন। কী চাও তোমরা-আজকের ক্ষণিকের এ স্বাধীনতা? নাকি অনন্ত যৌবণা স্বাধীন জীবন-টগবগে তোমাদের মতো?
বিদায় দ্বীপবাসী-
তোমাদের প্রিয় সন্তান, ঐ মহাসমুদ্র, আমার সৃষ্টিকর্তার দোহাই-যে কালো কাপড় আজ খুলে ফেলেছো তোমরা-তা যেন আর কোনদিন তোমাদের আন্ধা না করে। মিথ্যা বলোনা-সত্য বলায় আজ আমার এ করুণ পরিণতি-হোক ফাঁসি; তবুও-আমার মৃত্যুর পরে হলেও-তোমরা জেগে ওঠো..ওঠো জেগে..ছুঁড়ে ফেল সব আন্ধা কাপড়...’
যুবকের কথায় দুলে ওঠে জনসমুদ্র-ঢেউ খেলে ফুঁসে ওঠা সমুদ্রের মতো।
চোখ খুলে দিলে এমনটা ঘটতে পারে কখনো ভাবেনি অনভিজ্ঞ যুবরাজ। যথেষ্ট রাজসিপাহীও আগে থেকে মোতায়েন করেনি ময়দানে। অল্পসংখ্যক রাজসিপাহীরা বাঁধা দিতে পারে না ধেয়ে আসা জনসমুদ্রের ঢল-ধেয়ে আসে ফাঁসি মঞ্চের দিকে। জল্লাদও এগিয়ে যায়। জনতা পৌঁছানোর আগেই সব শেষ। ফাঁসিতে ঝুলন্ত যুবক হয়ে উঠে মহাবিদ্রোহী কবিতা। গর্জে উঠে জনসমুদ্র; উত্তাল ঢেউ লন্ডভন্ড করে দেয় সবকিছু।
পিতা মিথ্যারাজকে যুবরাজ সমুদ্রে ফেলে এসেছিল কীনা জানা যায়নি। তবে যুবরাজকে জনতা সেদিন ছুঁড়ে ফেলেছিল সমুদ্রজলে-ছুঁড়ে ফেলেছিলো প্রজাদের চোখে এতোকাল ধরে বেঁধে রাখা আন্ধা কাপড়গুলো।
আর পরদেশী যুবকের করুণ পরিণতিতে কেঁদে কেঁদে সত্যিই অন্ধ হয়ে যায় আঙুরবালা-ভালোবাসাতো কেবল অন্ধই হয় না; অন্ধও করে দেয়।
০৬ ডিসেম্বর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪