রতনগঞ্জ, একাত্তর

মুক্তিযুদ্ধ (ডিসেম্বর ২০২৫)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ৩২
ফয়সল কয়েক প্যাকেট চারমিনার সিগারেট নিয়ে এসেছিল সাথে করে। মেহবুব ও নুরু ফয়সলের মতোই ধূমপায়ী, কিন্তু বাড়তি প্যাকেট আনেনি। তাই ফয়সল একটি সিগারেট ধরালে তারা তিনজন মিলেই পালা করে টানে। অবশ্য ফয়সল মালিক হিসেবে তার সাথিদের ওপর খিস্তি ঝাড়ার অধিকার চর্চা করে মাঝে মাঝে। এতে মেহবুব ও নুরুর যায় আসে না। ছয়মাস ধরে মাঠেঘাটে জীবন হাতে নিয়ে তারা একসাথে আছে। সি আর দত্তের চার নম্বর সেক্টরের অনেক গেরিলা অভিযানে তারা যুদ্ধ করেছে। গ্রেনেড আর স্টেনগান বহন করেছে অধিকাংশ অভিযানে। তবে সেতু উড়িয়ে দেবার জন্য ডাইনামাইটও ফাটাতে হয়েছে অন্তত দুইটি মিশনে। কালীগঞ্জের ব্রিজ ভাঙ্গার অ্যাকশনে গিয়ে প্রাণটাই প্রায় চলে গিয়েছিল নুরুর। কপাল ভাল, পুল পাহারাদার রাজাকারের থ্রি-নট-থ্রি থেকে ছোড়া গুলি নুরুর নিতম্বের এক খাবলা মাংসই তুলে নিয়েছিল শুধু; সেলিমের মতো চোখ নিয়ে যায়নি। এরপর প্রাণপণে পশ্চাদপসরণ করে ক্ষতস্থান গামছা দিয়ে বেঁধে খালের জলে ভেসে ভেসে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল।

ফয়সল কয়েক টান মেরে সিগারেটটি নুরুর দিকে বাড়িয়ে দেয়। নুরুও গাঁজার মতো উপর্যুপরি কয়েকটি টান মেরে এক জাহাজ ধোঁয়া বুকে টেনে নেয়। সিগারেটের শেষাংশ পড়ে মেহবুবের ভাগে। মেহবুব বিরক্ত মুখে সিগারেটের টার ও নিকোটিনসিক্ত পুচ্ছ দুই আঙুলে চেপে ধরে টেনে টেনে কালচে-সাদা ধোঁয়া বের করে বৈশাখী মেঘের আদল তৈরি করে। আপাতত এছাড়া আর কোনো কাজ নেই তাদের।

ফয়সলরা গত দুদিন ধরে রতনগঞ্জের হালিম চৌধুরির মেহমান হয়েছে। তাদের থাকার যায়গা সঙ্গতভাবে কাচারিঘরেই হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু অধিক নিরাপত্তার জন্য তাদের থাকতে হচ্ছে গোয়ালঘর সংলগ্ন ঘরে যা সাধারণত রাখাল বা কামলার জন্য নির্ধারিত। থাকা নিয়ে গেরিলা-যোদ্ধাদের কী আপত্তি থাকতে পারে? তারা তো আর শ্বশুরবাড়ি আসেনি। অন্ধকার রাতে কুশিয়ারা নদী সাঁতরে পার হয়ে খলাছড়া, মাদারখাল, লামারগাম, মনসুরপুর গ্রাম ছাড়িয়ে ধু-ধু প্রান্তরের পাকা আমনের খেতে বিলি কেটে কেটে হালিম চৌধুরির গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে একটি মসজিদে ঢুকে ফজরের নামাজ আদায় করে তারপর এ বাড়িতে এসেছে।

সেদিন মসজিদে ইমামসহ মাত্র তিনজন নামাজি ছিল। প্রথানুযায়ী অপরিচিত লোক দেখে তারা তাদের পরিচয়, গন্তব্য, ইত্যাদি জানতে চায়। এসব প্রশ্নের উত্তর অনুশীলন করেই যেহেতু তারা সফরে বেরিয়েছে তাই ফয়সলদের গুছিয়ে উত্তর দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে তাদের কথার মধ্যে যে হবিগঞ্জ অঞ্চলের টান আছে তা কোনো সন্দেহের জন্ম দেয়নি। কেননা তারা বলেছে, এওলাসার গ্রামের নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদের জন্য একদিন আগে তারা সাক্ষাৎকার দিতে এসেছিল। আজ তারা জেলা শিক্ষা অফিসে যাবে বলে রাত ভোর হবার আগেই রওয়ানা দিয়েছে। ফয়সল নামাজিদের সাথে কথা বলার ফাঁকে রতনগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হালিম চৌধুরির বাড়ির ঠিকানাটাও জেনে নিয়েছে। ফয়সল বলেছে, ‘স্যারের সাথে একটু দেখা করে যাব; ওনার একটা চিঠি আছে।’

শিক্ষা ও শিক্ষকতা সংক্রান্ত ব্যাপার বলেই নামাজিরা কথা বাড়িয়ে বেয়াদবি করতে সাহস করেনি, তবে সন্দেহ করেছে কি না বোঝা যায়নি। গেরিলাদের বেশভূষা? না, এ অভিযানে তারা উশকোখুশকো হয়ে আসেনি। একদম ফুলবাবুর বেশ ধরেই এসেছে। গাঁটরি-বোঁচকা সামান্য দূরে একটি ঝোপের ভেতর লুকিয়ে রেখে পাজামা-কোর্তা পরে সুবোধ-সজ্জন হয়েই তারা মসজিদে প্রবেশ করেছে। নামাজিদের সাথে কথা শেষ করেই তারা হালিম চৌধুরির বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।

হালিম চৌধুরি দাওয়ায় বসে ক্বুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। অচেনা আগন্তুকের সাড়া পেয়ে তিনি কাচারিঘরের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে তিনজন তরুণ ছেলেকে দেখতে পান। তিনি কোনো প্রশ্ন করার আগেই ফয়সল সালাম দিয়েই নিচুকণ্ঠে বলে, ‘চাচা, আমরারে বাড়ির ভিত্রে ঢুকতে দেইন। আমরা সেলিম’র বন্ধু।’

ফয়সলের কথা শুনে হালিম চৌধুরির বুকটা ধক করে ওঠে। তিনি মুখে কিছু না বলে ডানে-বায়ে তাকিয়ে ওদের হাতের ইশারায় বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে বলেন। বসার ঘরে ফয়সলদের ঢুকিয়ে তিনি দ্রুত অন্দরমহলে গিয়ে আবার ফিরে আসেন এবং সংক্ষেপে ওদের ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ-বৃত্তান্ত শোনেন। সেলিম ফয়সলের সাথে একটি চিঠি দিলেও হালিম চৌধুরি শঙ্কিতভাবে ছেলের কুশলসমাচার জানতে চান। ফয়সলরা আশাব্যঞ্জক কথাবার্তা শুনিয়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করে। তাদের এই মৌখিক বিবরণের ছিটেফোঁটাও আসলে সেলিমের লিখিত চিঠিতে নেই। সেলিম চিঠিতে যা লিখেছে তার সারমর্ম হলো – তার বন্ধু ফয়সল, মেহবুব ও নুরু এম.সি. কলেজের বিএসসি-পড়ুয়া ছাত্র। তারা এওলাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। এ কাজের জন্য দু’চারদিন হয়তো তাদের থাকতে হতে পারে। হালিম চৌধুরি যেন তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। অনাহূত কোনো ঝুটঝামেলায় পড়ে গেলে এই চিঠিটাই যেন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে সেজন্য তার বক্তব্য এমন করে লেখা হয়েছে।

হালিম চৌধুরি তড়িঘড়ি করে ফয়সলদের জন্য হালকা খাবারের ব্যবস্থা করেন। ঘুমানোর জন্য তাদের নির্ধারিত ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসার সময় তিনি শঙ্কিতভাবে ফয়সলকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমরার প্ল্যান কিতারে বাবা? আমার তো খুব ডর লাগের।’

ফয়সল বলে, ‘আল্লাহ ভরসা, চাচা। আফনে ডরাইবা না। আমরা দুইজন মানষের লগে দেখা করতাম আইছি। তারাও আপনার বাড়িত আইব।’

হালিম চৌধুরি যেন ভয়ে কেঁপে ওঠেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কে আইব? কুনদিন আইব?’

নুরু বলে, ‘চাচা, এরা খুব সাবধানে আইব; যেকুনো সময় আইব। আফনে চিন্তা করবা না; তারা সেলিম’র পরিচিত।’

হালিম চৌধুরি ভয়ে জড়সড়ো হয়ে বলেন, ‘ই তো খুব রিস্ক’র কথা রে বাবা। অতদিন তো চুপচাপ পড়ি রইছি; এখন যদি খুদানাখাস্তা যদি কুনো বিফদ অয়…’

ফয়সল বলে, ‘আমরাও চুপচাপ পড়ি রইমু। বাইরর কুনো মানষে না জানলেউ অয়। আফনে সাভাবিক থাকোউক্কা।’

এবার মেহবুব নিচুস্বরে বলে, ‘চাচা, আরেকটা কথা। আইজ রাইত আমরারে থুড়া সাহায্য করবা। আমরার কিছু জিনিস মসজিদর কান্দাত এক বন’র চিফাত থইয়া আইছি – ওগুন আনা লাগবো।’

হালিম চৌধুরির হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়ায় তিনি কথা না বাড়িয়ে বলেন, ‘ঠিক আছে। এখন তুমরা গুমাও। রাইত আইলে দেখমুনে।’ তবে ওদের রেখে বের হয়ে যেতে গিয়ে তিনি একটু থামেন; প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা তুমরা অপরিচিত জাগাত আইলায়, আমার সেলিম আইলো না কেনে?’

হালিম চৌধুরির এ প্রশ্নে ওরা থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণে ফয়সল স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করে, ‘চাচা, সেলিম’র ইচ্ছা আছিল, অইলে আমরার কমান্ডার তারে না পাঠাইয়া আমরারে পাঠাইছে।’

হালিম চৌধুরি আর কোনো প্রশ্ন না করে বেরিয়ে আসেন।

সেলিম যে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই ঢাকায় রেলওয়ে-চাকুরে তার মামার কাছে চলে গিয়েছে একথা গ্রামের সবাই মোটামুটি জানে। মামার বাসায় থেকে সে ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পড়ছিল এবং যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই সে বাড়িতে এসে কাউকে না বলেই জকিগঞ্জ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যায়। মাসখানেক পর এ খবর জানতে পেরে হালিম চৌধুরি পরিবারের সবার মুখে কুলুপ এঁটে দেন। সবার মুখ বলতে সেলিমের মা এবং ছোটবোন মীনা। যেহেতু সেলিমের বড়ভাই আলীম লন্ডনপ্রবাসী এবং বড়বোন স্বামীর ঘরে, অতএব তারা এই রাখঢাকের আওতাভুক্ত নয়।

হানাদার বাহিনী দেশের আনাচেকানাচে পৌঁছার পর তাদের মিত্ররা স্বউদ্যোগে নিজ নিজ এলাকার নওজোয়ানদের খোঁজ নিতে আরম্ভ করলে হালিম চৌধুরি ভড়কে যান। অবশ্য তিনি অবলীলায় সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেন যে তাঁর ছেলে ঢাকায় তার মামার কাছে আছে। তারপরও ইউপি চেয়ারম্যানসহ অন্যরা আড়ালে-আবডালে কানাঘুষা করতে থাকলে হালিম চৌধুরি অনেক কোশেশ করে সেলিমের কাছে এ বার্তা পাঠাতে সমর্থ হোন যে সে যেন একবার বাড়িতে এসে প্রমাণ করে যে সে ঢাকাতেই তার মামার কাছে আছে, যুদ্ধেটুদ্ধে যায়নি। তাই ঝুঁকি নিয়েই আগস্ট মাসে কালীগঞ্জ ব্রিজ অপারেশনের আগে সে রতনগঞ্জে ফিরে আসে এবং শার্টের পকেটে ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের পরিচয়-পত্র ঢুকিয়ে হাট-বাজারে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে এক সুযোগে তার ক্যাম্পে ফিরে যায়।

অমাবস্যা ছিল বলে সেদিন রাতের আঁধারে ফয়সল, নুরু ও মেহবুব খুবই সতর্কতার সাথে থলেতে করে তাদের ফেলে আসা জিনিস হালিম চৌধুরির বাড়িতে নিয়ে আসে। বিদ্যুৎহীন প্রত্যন্ত এলাকা, তাছাড়া গাড়ি চলাচলের রাস্তাও সে গ্রামে নেই – তাই রাতের বেলা শত্রুসেনা কিংবা রাজাকারদের চলাচল সাধারণত অনুপস্থিত। তবুও ভয় ছিল যদি গ্রামের কেউ দেখে ফেলে। হালিম চৌধুরি সেই ভয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে বাড়ির উঠানে পায়চারি করছিলেন। সেলিমের বোন মীনা ও তার মা ঘরের বারান্দায় রাখা বড় বেঞ্চিতে বসে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে হাঁসফাঁস করছিলেন। ভাগ্যিস, কোনো অঘটন ঘটেনি।

খড়ের গাদার ভেতরে ব্যাগগুলি লুকিয়ে রাখার সময় হালিম চৌধুরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ইতা মালামাল কিতারে বাবা?’

ফয়সল বলে, ‘চাচা, ডরাইবা না, সামান্য জিনিস আছে। সেলিম’র দুইজন বন্ধু আইয়া লইয়া যাইবো গি। তারার নাম বকুল আর মানিক।’

হালিম চৌধুরি বুঝতে পারেন জিনিস মানেই যুদ্ধের কোনো সরঞ্জাম। তাঁর ভয় আরও বেড়ে যায়। তবে বকুল ও মানিকের নাম শুনে তাঁর মনোযোগ ওদিকে যায়। এদের নাম তো তিনি কখনও সেলিমের কাছে শোনেননি। হতে পারে তারা অন্য কোনো এলাকার। মনে মনে তিনি কামনা করেন, ওরা যেন তাড়াতাড়ি এসে এ আপদ সরিয়ে নেয়।

মীনা ও তার মায়ের সাথে ওইদিন রাতের বেলা খাবার টেবিলে ফয়সলদের দেখা হয়েছিল। আর দেখা হয়েছিল মনার সাথে, বিকালে। মনা বাঁধা কামলা। সকালে আসে, সারাদিন ফুটফরমাশ খাটে, রাতে খেয়েদেয়ে চলে যায়। মনাকে বলা হয়েছে ওই মেহমানরা সেলিমের বন্ধু; ঢাকায় থাকে; মাস্টারি চাকরির পরীক্ষা দিতে এসেছে – এই পর্যন্ত। মনার মনে এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে মেহমানরা কাচারিঘরে না থেকে ওই সাধারণ ঘরে থাকছে কেন, তাই হালিম চৌধুরি তাকে চোখ টিপ মেরে বলেছেন, ‘ইতা চেংড়া ফুয়াইন, বিড়ি-সিগারেট খাইন। এর লাগিয়া লুকাইয়া থাকতা চাইন।’ সাথে সাথে তিনি মনাকে সাবধান করে বলে দিয়েছেন মেহমানদের কথা যেন সে বাইরের কারুর সাথে আলাপ না করে। কেননা দিনকাল খারাপ। বাইরের লোকজনের কথা শুনলে মানুষজন হাজারটা প্রশ্ন করবে।

গ্রামের নারীরা পর্দানশিন হলেও হালিম চৌধুরির মতো অভিজাত পরিবারগুলো কট্টর রক্ষণশীল নয়। সঙ্গত কারণে তাদের অনেক অধীনস্থ লোক থাকে; তাদের সাথে মহিলাদেরও কথাবার্তা বলতে হয়। আত্মীয়স্বজনদের সাথে মেয়েরা সরাসরি দেখা করতে পারে, কথা বলতে পারে। ফয়সলদের সাথেও সেলিমের মা আন্তরিকতার সাথে কথা বলেছেন, ছেলের খোঁজ নিয়েছেন, তাদের জন্য দোয়া করেছেন। মীনাও ভাইয়ের জন্য ব্যাকুলতা দেখিয়েছে।

সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক ও প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে হালিম চৌধুরিকে ইউপি চেয়ারম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্যরা যথেষ্ট সমীহ করে। তবুও তাঁর মনের ভেতর একটা ইঁদুর বাস করে। ছেলেটা যদি যুদ্ধে না যেত এবং ঘরে একটি উঠতি বয়সের মেয়ে না থাকতো তাহলে তিনি বুক ফুলিয়েই চলতে পারতেন। যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় মীনা এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। এজন্য তার খুব কষ্ট হয়। চৌধুরি পরিবারের মেয়ে হলেও হানাদার-কবলিত দেশের অন্য মেয়েদের মতো তার ভেতরেও একধরণের ভীতি কাজ করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সে আর কোথাও বেড়াতেও যায়নি।

ফয়সলরা যখন শুয়ে বসে সিগারেট খেয়ে সময় পার করছে তখন মীনা গোয়ালঘরের দিকে কোনো কাজের জন্য যাওয়ার সময় তার নাকে ধোঁয়ার গন্ধ লাগে। সে তখন মেহমানদের ঘরের দিকে এগিয়ে এসে জানালার ওপাশ থেকে পরিচিতজনের জনের মতো মিষ্টি করে একটা ধমক দেয়, ‘ও ভাই, আফনারা ই বাজে জিনিস খাইন কেনে? ধূমপান ক্ষতিকর জানইন না নি?’

মীনার কথা শুনে ফয়সলরা হকচকিয়ে যায়। তারা ধারণাও করতে পারেনি একটি অনূঢ়া মেয়ে দুদিনের পরিচিত ছেলেদের সাথে অমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। ওরা লজ্জায় কিছু বলতে পারে না, শুধু পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

মীনা আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমার ভাইয়ে ও কিতা সিগারেট খাইন নি?’

মেহবুব তখন কালক্ষেপণ না করে উত্তর দেয়, ‘না না। সেলিম খুব ভালা মানুষ; হে বিড়ি-সিগারেট খায় না।’

মেহবুবের কথা শুনে নুরু ফিক করে হেসে দেয়। তখন মীনা বলে, ‘আমি বুঝছি, আপনারা সব একরকম।’ সে ধূমপানের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে একটু মন খারাপ করে বলে, ‘আমার ভাইরে লইয়া আইলা না কেনে?’ কথাটি বলতে গিয়ে তার দু’চোখ ছলছল করে ওঠে।

সেলিমের বাড়িতে সেলিম কেন আসতে পারেনি সেকথা তো ফয়সলরা বলতে পারবে না। সত্য কথা বললে বাড়িতে হুলস্থুল, কান্নাকাটি পড়ে যাবে। কালীগঞ্জের সেতু ওড়াতে গিয়ে নুরুর পশ্চাদ্দেশের এক খাবলা মাংসই যায়নি, সেলিমের বাঁ চোখটিও চলে গেছে। এই মারাত্মক দুঃসংবাদ কি মীনাকে কিংবা হালিম চৌধুরিকে দেওয়া যায়? সেলিম এখনও হাসপাতালে শুয়ে আছে। চোখ তো গেছেই; চিকিৎসকরা বলেছে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দিল্লিতে পাঠাতে হবে।

ফয়সলরা রতনগঞ্জে আসার দুদিন পার হয়ে গেলেও বকুল আর মানিকের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই। দেখাও হয়নি কোনোদিন ওদের সাথে। হালিম চৌধুরি ভজকট অবস্থায় পড়েছেন। ফয়সলরাও মাথার ভেতর একটু চাপ অনুভব করে। এমন সময়ে সিগারেটের স্টকও শেষ হয়েছে। সিগারেট কিনতে হলে বাইরে যেতে হবে। তা তো অসম্ভব ব্যাপার।

তৃতীয় দিন বিকেলে হালিম চৌধুরি হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এসে সোজা ফয়সলদের ঘরে গিয়ে হাজির হন। ওরা হালিম চৌধুরিকে দেখে চমকে ওঠে। এ ঘরে তিনি আরও কয়েকবার এসেছেন, তবে এভাবে সরাসরি নয়, গলাখাঁকারি দিয়ে। তাঁর মুখটা ভীতিবিহ্বল দেখাচ্ছে। তিনি অবতারণী বাদ দিয়ে শঙ্কিত উচ্চারণে জিজ্ঞেস করেন, ‘এরার কুনো খবর পাইলায়নি?’

নুরু বলে, ‘এখনও তো আইল না, চাচা।’

হালিম চৌধুরি উদ্‌বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, ‘আমার কাছে ভাব ভালা মনে অর না। তুমরার লাগি আমার ডর করের।’

ফয়সল বলে, ‘কিতা অইছে চাচা, খুলিয়া কইন।’

হালিম চৌধুরিকে বলতেই হবে। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানর কথাবার্তা আমার কাছে ভালা লাগলো না।’ হালিম চৌধুরি ভেঙ্গেচুরে যা বললেন তার সারকথা হলো – ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে তাঁর দেখা হয়েছিল। চেয়ারম্যান কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে একথাও জানিয়েছেন যে দক্ষিণ গ্রাম মসজিদের ইমাম নাকি গল্পচ্ছলে সেদিনকার তিনজন আগন্তুকের কথা তাঁকে বলেছেন। তাদের যে হেড-মাস্টার হালিম চৌধুরির সাথে দেখা করে যাবার কথা সেকথাও ইমাম সাহেব তাঁকে জানিয়েছেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে হালিম চৌধুরিও স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন যে ওই লোকগুলো এওলাসার প্রাইমারী স্কুলের একটা চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। এরপর চেয়ারম্যান সাহেব দেশের পরিস্থিতি, বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলা, ইত্যাদি নিয়ে বেশ উদ্‌বেগ প্রকাশ করেছেন।

মেহবুব সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তাইলে আফনার পরামর্শ কিতা, চাচা?’

হালিম চৌধুরি বলেন, ‘আমার মাথায় ঠিক কাম করের না। তুমরার আর রিস্ক লওয়া বোধয় ঠিক অইতো নায়। চেয়ারম্যান সুবিদার মানুষ নায়। আর আমরার ইউনিয়ন’র রাজাকার কমান্ডার আজমলও বদ মানুষ। পারলে আইজ রাইতউ যাও গিয়া। হি ফুয়াইন আইলে দেখমুনে আমি কিতা করা যায়।’

ফয়সলরা কিছুক্ষণ একে অপরের মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তারপর ফয়সল বলে, ‘আল্লাহ্‌ ভরসা। আফনে চিন্তা করবা না, চাচা। আমরা আইজ রাইতউ রওয়ানা করি লাইমু। কিন্তু আরেকটা কথা, পরিস্থিতি যা-ই অউক আমরার ব্যাগগুলার কথা যেন শত্রুরা না জানে।’

হালিম চৌধুরি বলেন, ‘আচ্ছা, আমারে ঠিক করি কও চাইন, তুমরার ব্যাগ’র ভিত্রে কিতা আছে।’

ফয়সল একটু চিন্তা করে বলেই ফেলে, ‘চাচা, ব্যাগ’র ভিত্রে পঞ্চাশটা গ্রেনেড আছে। খুব সাবধানে রাখবা, মনা-টনায় টের পাইলে ঝামেলা বাড়বো।’

হালিম চৌধুরি এবারও একটা ঝাঁকি খান। তাঁর চোখ দেখলে মনে হয় তিনি যেন ভূত দেখছেন। তিনি আর কিছু না বলে দ্রুত পা চালিয়ে অন্দরমহলে চলে যান।

ফয়সলদের ফিরে যাওয়া তত ঝুঁকিপূর্ণ হবার কথা নয়। কারণ ফেরার পথে তাদের হাতে একটা হাতব্যাগে কাপড়চোপড় ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। কলেজের যে পরিচয়পত্র আছে সেগুলো তো তাদের সাহায্যেই আসার কথা। তারা মোটমাট তৈরি হয়েই রাতের খাবারের অপেক্ষায় বসে আছে। খাওয়াদাওয়া করে রাত একটু নিঝুম হলেই বেরিয়ে পড়বে।

হালিম চৌধুরি তাঁদের এলাকার মসজিদে গিয়ে এশা’র নামাজ পড়ে ডানে-বায়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বাড়িতে ফিরে এসে স্ত্রীকে ভাত বাড়তে বলেন।

ফয়সলদের নিয়ে খেতে বসে হালিম চৌধুরি বিষণ্ণবদনে কথা বলছেন এবং তাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন। এসময় হঠাৎ বাড়ির বাইরে কার গলার আওয়াজ শোনা যায়, ‘চৌধুরি সাব, বাড়িত আছইন নি?’

মুহূর্তের মধ্যে ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। ভাতমাখানো হাতগুলি আর মুখে ওঠে না। হালিম চৌধুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থবির হয়ে যান। গলার স্বরটি তাঁর পরিচিত মনে হচ্ছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি দ্বিতীয় হাঁকের জন্য তিনি অপেক্ষা করেন।

দ্বিতীয়বার লোকটি বললো, ‘আমি আজমল, চৌধুরি সাব, আপনারে থুড়া কষ্ট দিতাম আইলাম।’

হালিম চৌধুরির আর বুঝতে বাকি রইল না, সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। তিনি অগত্যা বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলেন, ‘থুড়া দম লউক্কা, আমি খাওয়াত; আত্‌টা ধইয়া আই।’ তারপর তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে ওদের টর্চলাইটের আলোয় আন্দাজ করতে পারেন আজমল একা নয়, সাথে তার দলবল আছে।

ইতিমধ্যে মীনা ও তার মা কাঁদতে শুরু করেছেন। ফয়সল বলে, ‘চাচি, আফনারা কানবা না; ইনশাল্লা কুনো সমস্যা অইতো নায়। আফনারা কইবা, আমরা মাগরিব’র বাদে আইজ আবার আইছি। বাকি মাত আমরা মাতিমু।’

হালিম চৌধুরি যন্ত্রের মতো হাত ধোন। তিনি ফয়সলের কথায় ভরসা পান না। আজমল যদি কথা বাড়াতে থাকে? যদি সে পুরো বাড়িতে তল্লাশি চালায়? যদি সে পাক-সেনাদের নিয়ে আসে? যদি সে ফয়সলদের বন্দি করে নিয়ে যায়? যদি তারা মীনাকে…? হালিম চৌধুরি আর ভাবতে পারেন না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অনুপম শব্দ চয়নে গভীর চেতনা ও হৃদয় অনুভূতির নান্দনিক সৃজন গাঁথা..!!অপার মুগ্ধতা সহ একরাশ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা..????????
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মাহাবুব হাসান গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। গল্প কোথাও গতি হারায় নি। সাসপেন্স ছিল। আর শেষটায় তখন 'অসমাপিত'!
আপনি গল্পটি পড়েছেন তাই খুব ভাল লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ফয়সল কয়েক প্যাকেট চারমিনার সিগারেট নিয়ে এসেছিল সাথে করে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৮১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ভূমিকম্প”
কবিতার বিষয় "ভূমিকম্প”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৫