সিঁথি হাঁটছে। একাকী ও নির্বিকার। মাঝে মাঝে একা হাঁটতে তার ভালই লাগে। ঢাকা শহরে পিঁপড়ের মতো গিজগিজ করছে মানব সন্তান। তবুও মেয়েমানুষের একা হেঁটে বেড়ানো এখনও সমাজবান্ধব নয়। একটু জনবিরল এলাকায় যেন তা আরও ঝুঁকিপূর্ণ। তবে মিরপুর বারো’তে ভাইয়ের বাসায় থাকাতে তার সুবিধা হয়েছে এই যে ইচ্ছে হলে হেঁটে হেঁটে সে মিরপুর সিরামিক, ক্যান্টনমেন্ট চেকপোস্ট, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল পেরিয়ে নিঃসংকোচে ডিওএইচএসে ঢুকে পড়তে পারে। ওখানে গিয়ে সিএসডিতে কিছুক্ষণ উইন্ডো শপিং করে অবলীলায় জলমুকুট, বৈকালি হ্রদে যতক্ষণ খুশি হাওয়া খেতে খেতে চক্কর দিতে পারে। ওখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কেননা এই আবাসিক এলাকায় যারা থাকে বা যায় তাদের সবাইকে কঠোর বিধি-নিষেধ মানতে হয়। মেয়েরা একাকী বা দলবদ্ধভাবে হাঁটাহাঁটি, ছুটোছুটি করলেও কোনো বখাটে নাগর গিয়ে নাক গলাবে তার উপায় নেই।
শুধু ভাল লাগলেই যে সিঁথি হাঁটতে বেরোয় এমন নয়। মনের আকাশে কখনও মেঘ জমলেও সে সম্ভব হলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। আজকে তার মন ভারী; তাই হাল্কা হবার জন্য বেরিয়ে এসেছে। ভাবী বাঁধা দেয়নি; কখনও দেয়ও না। তবে গুরুজনের মতো প্রতিবারই আপ্তবাক্যটি উচ্চারণ করে, ‘সাবধানে যাস; আর তাড়াতাড়ি চলে আসিস।’
সেনা অফিসারদের আবাসিক এলাকাটি কী ছিমছাম, পরিপাটি। জন-যান সবাই যেন নিয়ম মেনে চলে। সেনা পরিবারের বাইরেও অনেক বেসামরিক লোক ফ্ল্যাট কিনে কিংবা ভাড়া থাকে এখানে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারাও পরিবেশের সাথে একাত্ম হয়ে আছে। সিঁথি কখনও দেশের বাইরে যায়নি। তবুও তার কাছে এলাকাটিকে বিদেশ বিদেশ মনে হয়।মাঝে মাঝে যখন সে আবাসিক দালানগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে যায় তখন দেশি-বিদেশি গাছ-ফুল-লতা দেখে তার মনটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মন প্রসন্ন থাকলে গুনগুন করে তার গান গাইতে ইচ্ছে করে; আশেপাশে কেউ না থাকলে এক কলি, আধা কলি গায়ও। আজকের বিকেলে পরিষ্কার আকাশ, ঝিরঝিরে হাওয়া, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও তার গুনগুন করার মুড নেই।
আজকেও তাহসান তাকে জোরাজুরি করেছে। বলেছে, বেশি দূর নয়, ক্লাস শেষ করে তারা চিড়িয়াখানা বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে ঘুরে আসবে। তারপর কোনো রেস্তোরাঁয় বসে চা-কফি খেয়ে বাসায় চলে যাবে। সিঁথি এখনও চিড়িয়াখানা বা বোটানিক্যাল গার্ডেনে যায়নি। আগেও একদিন যখন তাহসান একই অনুরোধ করেছিল তখনও সিঁথি যেতে রাজি হয়নি। আজও সে ‘না’ বলে দিয়েছে। সে অবশ্য ভাবীর কাছ থেকে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের কথা ইতিমধ্যে জেনেছে। মাস ছয়েক আগে সিঁথি ভাইয়ের বাসায় আসার পর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ভাবী ঢাকার কোথায় কী আছে এসব তাকে বলেছে। ভাবী এটাও বলেছে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান শুধু বৃক্ষ-লতার বাগানই নয়, এটা একটা লীলাকাননও বটে। তবে বাবুটা একটু শক্ত হয়ে উঠলে একবার সিঁথিকে নিয়ে এসব জায়গা ঘুরে আসবে বলে ভাবী তাকে কথা দিয়েছে।
সিঁথি হাঁটতে হাঁটতে জ্যোৎস্না সরোবরের কাছে চলে যায়। বিকেলের মৃদু আঁচের সূর্যরশ্মি হ্রদের জলে নেমে সোনালি ঝালর নাচিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। পাড়ের পাম ট্রি-গুলোর চিরল পাতা যেন হাত নেড়ে নেড়ে অনুচ্চস্বরে ভাব বিনিময় করছে। নাম না-জানা নাতিদীর্ঘ গাছগুলোয় নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সিনিয়র নারী-পুরুষ ফিটফাট হয়ে কথা বলতে বলতে হ্রদের পাড় ধরে হেঁটে চলেছে। শুধু নারী-পুরুষ কেন, বেশ কয়েকটি কিশোরী-তরুণীও খিলখিল করে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সিঁথির মনে ইচ্ছে জাগে সে-ও যদি ওদের সাথে মিশে গিয়ে প্রাণ খুলে হাসতে পারতো। কিন্তু একজন আগন্তুকের পক্ষে এ কাজটি সহজ নয়। সিঁথি প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে একটি ঝাউগাছের পাশে বসে পড়ে।
মফস্বলের কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সিঁথি বিএ পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু জটিল এক পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় মেহবুব তার বোনকে ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসে। এতে তার উপকারই হয়েছে। বাচ্চা প্রসব করে তার স্ত্রী বেহাল অবস্থায় পড়েছিল; এ অবস্থায় সিঁথিকে সাথী হিসেবে পেয়ে তার হাড়ে বাতাস লেগেছে। তবে বাচ্চা না থাকলেও তার ভাই সিঁথিকে ঢাকায় নিয়ে আসতোই এবং এখন যেমন একটা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কোর্স করার জন্য তাকে ভর্তি করে দিয়েছে, তখনও তাই করতো। ওই আইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তাহসানের সাথে সিঁথির পরিচয়।
তাহসান সিঁথির প্রেমিক নয়। মর্নিং শিফটের আরও বেশ কিছু ছেলেমেয়ের মতো সে-ও একজন শিক্ষার্থী। এতদিনে সবাই একে অপরের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই বেসিক কম্পিউটার থেকে শুরু করে অফিস অ্যাপ্লিকেশন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডাটাবেস ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি নানা কোর্স করছে। তাদের মধ্যে তাহসানের মাথা বেশ পরিষ্কার; টেকনোলজির জটিল বিষয়গুলো সে দ্রুত রপ্ত করে ফেলতে পারে। বিশেষ করে গ্রাফিক্সের কাজে সে অনেক অগ্রসর। অন্যদের মতো সিঁথিও বিভিন্ন সময় তাহসানের সহযোগিতা নিয়েছে। সিঁথি তখন লক্ষ করেছে তার প্রতি তাহসানের দৃষ্টি একটু ন্যাতানো। সিঁথি সজ্ঞানেই তা আমলে নেয়নি। তবুও তাহসান অনেকবার তাকে চা-কফি খাওয়ার কথা অর্থাৎ একান্তে বসে কিছু সময় কাটানোর কথা বলেছে। কিন্তু সিঁথি কৌশলে এড়িয়ে গেছে। দৃশ্যত এড়িয়ে যাবার তার জোরালো কোনো যুক্তি নেই। তাহসান তরুণ ছেলে; তার নায়কের মতো অঙ্গসৌষ্ঠব না থাকলেও দীপ্তিময় চেহারা ফেলনা নয়। অপরদিকে উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গিনী সিঁথিরও সারল্যভরা মায়াময় মুখ সহজে এড়িয়ে যাবার নয়। এমতাবস্থায় তাহসানের চোখে-মুখে যদি কোনো আকুতি জেগে ওঠে সিঁথির তা নির্বিকারে অগ্রাহ্য করাও স্বাভাবিক নয়।
মেহবুবের ভাড়া করা দুই বেডরুমের বাসাটি তাদের জন্য যথেষ্ট। বাসায় থাকলে প্রায়ই সে তার ভাইপোকে নিজের বিছানায় নিয়ে আসে। ফুফুর সাথে খেলা করতে সে খুব মজা পায়। ভাবীর নিবিড় মন্ত্রণার পাশাপাশি এই ছোট শিশুর সংস্পর্শ সিঁথিকে খুব দ্রুতই বিষণ্ণতা থেকে ফিরিয়ে এনেছে। সে হয়তো এতদিনে তার হোঁচট খাওয়া পেছনের দিনকে মন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিতে পারতো, কিন্তু তাহসানের ক্রমবর্ধমান আসক্তি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সিঁথির অতীতকে রক্তাক্ত করে তুলছে।
সূর্য পশ্চিম দিগন্তের দিকে অনেকটা হেলে পড়েছে। আকাশের রং আস্তে আস্তে কমলা বরণ ধারণ করছে। পাখির কিচিরমিচির শুনে বোঝা যাচ্ছে ওরা ঘরে ফিরে আসছে। হ্রদের পারে ও রাস্তায় ভ্রমণকারীদের সংখ্যাও আগের চেয়ে বেড়েছে। সিঁথি হঠাৎ লক্ষ করে একজোড়া তরুণ দম্পতি একে অপরের কাঁধের ওপর হাত রেখে কী সব কথা বলে হাসতে হাসতে তার দিকেই হেঁটে আসছে। তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় সিঁথির মনে হলো ওরা দম্পতিই হবে। কোনো অবিবাহিত জুটি হলে অমন অবলীলায় গা জড়াজড়ি করে হাঁটতে পারতো না। সিঁথির বুকের ভেতর থেকে একদলা জমাটবদ্ধ শ্বাস দীর্ঘলয়ে বেরিয়ে আসে।
সিঁথিকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ভাবী আগেও বলেছেন, এখনও প্রয়োজনবোধে বলেন, ‘যুগ পাল্টেছে; এখন মানুষ দুঃখ-ব্যথা দুধকলা দিয়ে পোষে রাখে না। যে কথা কষ্ট দেয় তা মন থেকে মুছে ফেলতে হয়।’
সিঁথি বলে, ‘বলা যত সহজ, করাটা ততো সহজ নয়, ভাবী। মানুষ এত প্রতারক হতে পারে?’
ভাবী বলে, ‘শোন, তোর ভবিষ্যৎ এখনও পড়ে আছে। ওই লম্পট কলেজ-মাস্টারের চেয়েও ভাল কেউ তোর কপালে জুটে যেতে পারে। চিন্তা করিস না, নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা কর। দেখবি আমার কথাই ঠিক হবে।’
ভাবীর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিঁথিও পেছনকে পেছনে ফেলে দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। আইটি কোর্স ভালমতো শেষ করতে পারলে তার ভাই-ই তাকে একটা চাকরিতে লাগিয়ে দিতে পারবে একথা ভাবীই বার বার বলছে। কোর্স করতে গিয়ে সে অনেকটা স্থির হয়েই এসেছিল। কিন্তু তাহসান ছেলেটা আবার তাকে গুলিয়ে দিচ্ছে। তাহসানের অযাচিত আচরণ তার মনের জানালায় উঁকি দিলেই প্রশস্ত দরজা দিয়ে সে দুলাল স্যারের পৃষ্ঠদেশ দেখতে পায়। এই পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সিঁথির জন্য কষ্টকর। অথচ প্রশস্ত বুক নিয়েই দুলাল স্যার একপা, দুপা করে তার দিকে এগিয়ে এসেছিল। তারপর অল্পদিনেই সে সিঁথির নরম বুকের ভেতর তার নাম খোদাই করে ফেলেছিল। তাহসানও দুলাল স্যারের মতো একপা, দুপা করে এগিয়ে আসতে চাইছে বলে মনে হলে সিঁথির বুকটা দুরুদুরু করে। সিঁথি চায় না আবার কেউ এসে থিতু হওয়া জলাধারকে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ করে তুলুক।
পশ্চিমাকাশ আবিরবর্ণ ধারণ করলে সিঁথির বুকটা কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই হাহাকার করে ওঠে। ডিওএইচএসের সরোবর গোধূলিবেলায় কলকাকলিতে পূর্ণ হয়ে উঠলেও সে মহাশূন্যের নিস্তব্ধতা অনুভব করে। বাসায় ফিরতে হবে তাই সে দ্রুত গাত্রোত্থান করে।
ফিরতি পথে সিএসডি পার হয়ে সিঁথি যখন বড় রাস্তায় উঠতে যাবে তখনই পেছন থকে কেউ একজন তাকে ডাক দেয়। তার নাম শুনে সে চমকে উঠে থমকে দাঁড়ায়। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই সে যেন তড়িতাহত হয়; এ যে তাহসান! ও কোথা থেকে উদয় হলো এখানে? সে তো দারুস সালামে তার বাবা-মায়ের সাথে থাকে বলে জানিয়েছিল।
তাহসান ছুটে এসে বলে, ‘আমি আমার এক বন্ধুর কাছে এসেছিলাম। আপনি কি ডিওএইসএসে থাকেন?’
সিঁথির মনের ভেতর ততোক্ষণে ভীষণ তোলপাড় হচ্ছে। যার প্রচ্ছন্ন ছায়া ঘনঘন ইদানীং তার মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে সে-ই কিনা অসময়ে অকস্মাৎ সশরীরে প্রকটিত। সে থতমত খেয়ে বলে, ‘না, আমাদের বাসা বারো নম্বরের দিকে; এদিকে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।’
তাহসান বলে, ‘দেখা যখন হয়েই গেল, চলেন এক কাপ কফি খাই; প্লিজ ‘না’ বলবেন না।’
সিঁথি সকালে ‘না’ বলেছে। এখনও উচ্চকণ্ঠে ‘না’ বলতে গিয়েছিল প্রায়। পরে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যই হয়তো বা বিনম্র কণ্ঠে বলে, ‘দেখুন, আমার বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে। ভাবী চিন্তা করবে। আজ না, অন্য কোনোদিন নাহয়…।’
তাহসানের হাতে ছোট একটা শপিং ব্যাগ। হয়তো সিএসডি থেকে কোনোকিছু কিনেছে। সে অস্থিরতার সাথে ব্যাগটি এ-হাত ও-হাত করতে করতে বলে, ‘না, না। দেরি হবে না। আর অন্য কোনোদিন আপনার সময় হবে কি না জানি না। আচ্ছা ঠিক আছে, বসতে হবে না। আসেন, কফির কাপটা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনাকে এগিয়ে দেবো।’
এমন মহাফাঁপরে যে পড়বে তা সিঁথি কল্পনাও করতে পারেনি। সে আবার বেঁকে বসলে তাহসান যদি তার হাত ধরে টেনে নিতে চায় তবে তা হবে বড় কেলেঙ্কারি। তাই ভীষণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বলে, ‘আচ্ছা, যান, তাড়াতাড়ি নিয়ে আসেন।’
তাহসান বলে, ‘এই যে, সামনে; ডিসপেন্সার থেকে নিয়ে আসবো। আসেন আমার সাথে।’
সিঁথির চোখে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো টুকরো টুকরো ছবি ভেসে ওঠে। ক্ষিপ্র হরিণীর মতো উল্লম্ফনের সময়কালে দুলাল স্যার কলেজ ক্যাম্পাসে এক ফাঁকে যেদিন তাকে বলেছিল ‘তুমি খুব সুন্দর!’, সেদিন সে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। এর পরের কয়েকদিন দুলাল স্যারের ইংলিশ ক্লাসে সিঁথি মাথা তুলে স্যারের দিকে তাকাতে পারেনি। দুলাল স্যার হঠাৎ করে যেদিন তার ফোন নম্বর চেয়ে বসলো সেদিন সে প্রায় থরথর করে কাঁপছিল। এর পরের ইতিহাস অনেক লম্বা।
কফির কাপ হাতে নিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকলেও সিঁথি বা তাহসান প্রথম দু’তিন মিনিট কোনো কথাই বললো না। শেষপর্যন্ত তাহসানকেই নীরবতা ভাঙতে হলো। সে বললো, ‘সিঁথি, আপনি যতটুকু ভাবছেন আমি ততো খারাপ নই। অবশ্য আমি অনেকবার আপনার সাথে একান্তে কথা বলার চেষ্টা করেছি, আপনি আমাকে সুযোগ দেননি।’
তাহসানের কথা শুনে সিঁথির বুকটা ধুকপুক করে। সে যে ঘরপোড়া গরু। দুলাল স্যারও অনেক কৌশলে তার সাথে একান্তে শুধু কথাই বলেনি, তার চেয়ে অনেক বেশি দূরে নিয়ে গিয়েছিল। সে কথা ভাবলে তার নিজের ওপর ঘেন্না ধরে। তাই তাহসানের কথায় বা তার আকস্মিক আবির্ভাবে সিঁথির মন শিহরিত হয় না বরং ভয়ক্লিষ্ট হয়। তাহসানের কথা শুনে সে শুধু তার দিকে একবার আড়চোখে তাকায়।
সিঁথি কিছু বলছে না দেখে তাহসান বলে, ‘দেখুন, আমি বিবিএ করেছি; একটা পার্টটাইম জবও করি। বিভিন্ন আইটি টুল্সে হাত পাকা করে নিলে আমি একটা ভাল চাকরি পাবো। তখন এমবিএটাও করে নেবো।’
বিগত ছয় মাস ধরে অন্য সহপাঠীদের মতো তাহসানের সাথেও সিঁথির সখ্য হয়েছে। সে কখনও তাহসানকে ছ্যাবলামো করতে দেখেনি। কথাবার্তায় খুবই পরিশীলিত সে। কিন্তু হঠাৎ করে তার দিকে তাহসানের ঝুঁকে পড়া সিঁথিকে জড়তায় ফেলে দিয়েছে। একটা দুঃস্বপ্ন থেকে বেরোতে না বেরোতেই আরেকটি দুঃস্বপ্নের হাতছানি তাকে আড়ষ্ট করে দিয়েছে। এখন ভদ্রতার জন্য হলেও সিঁথিকে কিছু একটা বলতে হবে। সে বলে, ‘ভাল; তবে এসব জেনে আমার কী হবে?’
‘কী হবে না হবে তা জানি না।’ তাহসান বলে, ‘তবে কথা যখন বলছি তখন কোনো একটা প্রসঙ্গ নিয়ে তো বলতে হবে, তাই।’
সেনা চেকপোস্টের কাছাকাছি এসে সিঁথি হাতের খালি কাপটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে বুঝতে পারে না এরপর তার কী বলা উচিৎ। তাছাড়া সে না চাইলেও তার মনটা কেমন তরঙ্গবিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা মনের পর্দায় বার বার দুলাল স্যারের পলায়নপর ছায়াটাও ভেসে উঠছে। এই গোলমেলে অবস্থা থেকে সে বেরোতে পারছে না। কথা সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্যে সে বলে, ‘আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হোক।’
পশ্চিমাকাশে সূর্য আরও লাল হয়েছে। সিঁথির বাসাও আর বেশি দূরে নয়। চাইলেও আলাপচারিতা দীর্ঘ করা যাবে না। তবুও তাহসান বলে, ‘জানেন, আমার চাকরি না করলেও চলবে। বাবা চান তার সাথে আমি ব্যবসায় নামি। কিন্তু ব্যবসা আমার ভাল লাগে না।’
সিঁথি একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করে, ‘নিশ্চয়ই আপনাদের বড় ব্যবসা আছে, বড়লোক মানুষ, চাকরি করবেন কেন?’
তাহসান ত্রস্ত হয়ে বলে, ‘আপনার বাসার কাছাকাছি হয়তো এসে পড়েছি। কোনো কথাই বলতে পারলাম না। আরেকদিন যে বলার সুযোগ পাবো এমন নয়।’
সিঁথি বলে, ‘কেন? বললাম তো অনেক কথা। কফিও তো খাওয়া হয়ে গেল। কফির জন্য ধন্যবাদ।’
তাহসানের কাছে ধন্যবাদ এখন গৌণ। আবার কখনও সিঁথিকে একাকী না-ও পেতে পারে সেই শঙ্কা থেকে ত্বরা করে কিছু বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। সে বলে, ‘অযাচিতভাবে আপনাকে আমার অনেক ব্যক্তিগত কথা বলে ফেলেছি। আরেকটি ব্যক্তিগত কথা না বললেই নয়। আমি একজন দুঃখী মানুষ। একজন মানুষই আমাকে প্রচণ্ড দুঃখ দিয়েছে।’
তাহসানের অতি ব্যক্তিগত কথা শুনে বিব্রত হয়েই হয়তো সিঁথি থমকে দাঁড়ায়। এবং প্রথমবারের মতো এক মুহূর্ত স্থিরভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার পা চালায়।
তাহসান দ্রুততার সাথে বলে, ‘সিঁথি শোনেন, বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পেয়ে আমার সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক সে দিব্যি ভুলে গেল।’
তাহসানের শেষ কথায় সিঁথির দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তাহসান কী বলে! এ তো তার মতোই কাহিনী। বেশিদিন আগের কথা নয়। দুলাল স্যার বিসিএসে সফল হয়েই হুট করে কোন এক বড় অফিসারের মেয়েকে বিয়ে করে উধাও হয়ে যায়। মফস্বলের মেয়ে সিঁথি। সে মর্ম-যাতনায় মরো-মরো হয়ে পড়লেই তবে পরিবারের সবাই ব্যাপারটা টের পায়।
হঠাৎ সিঁথির ফোন বেজে ওঠে। ভাবীর ফোন। সিঁথি নিজেকে সামলে বলে, ‘এই তো চলে এসেছি ভাবী।’ সিঁথি দ্রুত বারো নম্বরের যানজট পেরোতে যায়। তাহসানও তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘সিঁথি, আপনার ফোন নম্বরটা দেবেন?’
সিঁথি বিষম বেকায়দায় পড়ে। তাহসানের সাথে কথা বলার পর যদিও তার মনের অবস্থা আগের মতো স্থাণু নয়। কিন্তু ফোন নম্বর দেয়া মানে অনাগত ঝক্কিকে আহ্বান করা। সিঁথি বলে, ‘ফোন নম্বর দিয়ে কী করবেন, রোজই তো আমাদের দেখা হয়।’
সিঁথির কথায় তাহসান মনঃক্ষুণ্ণ হয় বটে। তবে সে নাছোড় হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে; ফোন নম্বর না দিলে না দিন। আপনি আমাকে যা-ই ভাবুন আমি একটা কথা বলতে চাই। আপনার সম্বন্ধে আমি তেমন কিছু জানি না। আর জানার প্রয়োজনও নেই। আপনার যদি কোনো কঠিন দায় না থাকে তবে কী আমি আপনার দিকে হাত বাড়াতে পারি?’
তাহসানের কথা এবার সিঁথিকে কাঁপিয়ে দেয়। এখন আর মনের প্রকোষ্ঠে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকেই যেন কোথা থেকে দমকা হাওয়া ছুটে আসে। রাস্তার পাশের কাঠবাদাম আর সোনালু গাছের পাতা দুলতে থাকে। কয়েকটি শুকনো পাতাও তার গা বেয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। সিঁথি ফুলের সাথে অতো বেশি পরিচিত নয়। তবে তার মনে হয় কী একটা মধুর সৌরভ যেন ভেসে আসছে। পাশে কোথাও হয়তো বকুল ফুলের গাছ আছে। সে ভ্যাবাচ্যাকার মতো তাহসানের চোখে একবার চোখ রাখে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না।
সিঁথি রাস্তার বাম দিকে মোড় নিয়েছে। তাহসান তখন অস্থির হয়ে বলে, ‘কিছু বলবেন না?’
সিঁথি কী বলবে ভেবে না পেয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে, ‘যান। কালকে ক্লাসে দেখা হবে।’ তারপর দ্রুত পা চালায়।
তাহসান আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে ভাবতে থাকে, কাল তো দেখা হবেই কিন্তু সেই দেখাটা কি অন্যদিনের চেয়ে আলাদা হবে, সিঁথির কথাটা কি সম্মতির লক্ষণ?
আজকের আকস্মিক ঘটনায় সিঁথির মনে তোলপাড় চলছে। এখনও তার মন থেকে দুলাল স্যারের কালো ছায়া অপসৃত হয়নি। এরই মধ্যে তাহসান এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে। ভাবীকে তো সবকথা বলতে হবে। ভাবী তার বন্ধুর মতো; সে অবশ্যই সুপরামর্শ দেবে। এসব ভাবতে ভাবতে সিঁথি অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো পেছন দিকে ফিরে তাকায়। ওমা! তাহসান একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তার চলে যাওয়া দেখছে। তাহসানের পাগলামি দেখে কঠোর সাবধানতা সত্ত্বেও সিঁথির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
তাহসান হয়তো এটুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে হাত নেড়ে সিঁথিকে বিদায় জানায়।