সাপের গতরের মতো বাঁকানো পূব থেকে পশ্চিম বরাবর যে সরু নালা পাশাপাশি দু’বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে তার জলও সাপের লহুর মতো শীতল। দু’ধারের উপুড় হয়ে পড়া ঘন মুর্তার বন নালাটিকে ঢেকে রেখেছে বলে বছরের কোনো মাসেই ওটির জল পুরোপুরি শুকিয়ে যায় না। ফসল তোলার তোড়জোড় সমাপ্ত হলে হেমন্তের শেষদিকে দু’বাড়ির চ্যাংড়া ছেলেরা হাড়কাঁপা ঠাণ্ডা নালায় নেমে বাঁধ দেয়। তারপর সেঁউতি দিতে পানি সেঁচে ফেলে জিয়ল মাছ ধরে। কালো কালো শিং, মাগুর, টাকি এবং কাদায় লোকানো বাইম মাছ ধরার আনন্দে তাদের জমে যাওয়া হাত-পা গরম হয়ে ওঠে । কারও কারও হাতে শিং মাছের কাঁটা ফুটলেও বিষ-যন্ত্রণাকে ওরা পাত্তাই দেয় না।
নালার ওপর বরাক বাঁশের তৈরি এই সাঁকোটাই দু’বাড়ির সংযোগের মূল মাধ্যম। দক্ষিণবাড়ির মনু, যার ভাল নাম, মইনুল ইসলাম, সেই শিশুবেলা থেকেই এই সাঁকোকে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো একটা স্বাভাবিক অংশ মনে করে। উত্তরবাড়ির সেলিনাও হয়তো তাই মনে করে। শুধু মনু আর সেলিনা কেন, তাদের পূর্বপুরুষরাও হয়তো সাঁকোটিকে আটপৌরে লাঙল-জোয়াল, কোদাল-খুন্তির মতো জীবনযাত্রার অনুষঙ্গই মনে করে। থুত্থুড়ে বুড়োরা এখনও যারা অগস্ত্য যাত্রার অপেক্ষায় আছে তারাও সঠিক বলতে পারে না কোন অব্দে, কীভাবে তাদের পূর্বপুরুষ এই মোল্লারগাঁওয়ে এসে বসতি গেড়েছিল। তবে ভূষণ্ডির কাক দবির মোল্লার দাবী, মুঘলরা যখন প্রথম বারোভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় সুবাদারি প্রতিষ্ঠা করে তখনই তাদের আফগানী পূর্বপুরুষ মুঘলদের সেনাদলে ছিল। বিজয়াভিযান শেষে সেই পাঠান জোয়ান বাঙালি ললনার পাণি গ্রহণ করে এদেশেই শেকড় গাড়ে। এর চেয়ে গোছানো এবং কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী আর কারও কাছে নেই। নালার দু’পারের বাড়ি সেই আফগান সৈনিকের অধস্তন পুরুষ হলেও বংশের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কুটুম্বিতা নেই। তাছাড়া শত শত বছরের পরম্পরায় মোল্লাদের গায়ে পাঠানদের কোনো রক্ত অবশিষ্ট নেই, সেই তেজও নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া মোল্লাদের অনেকেই হয়তো দেশে-বিদেশে ভাল অবস্থানে আছে যাদের মোল্লারগাঁওয়ের সাথে কোনো সম্পর্কই নেই। তবে এ গ্রামে যে মোল্লারা আছে তাদের ওপর কদাচিৎ ঝড় আসলে এই গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের সব মোল্লারা একজোট হতে বেশি সময় নেয় না।
উত্তরবাড়ি ও দক্ষিণবাড়ির লোকদের রক্তের ঘনিষ্ঠতা খুঁজে পাওয়া দুরূহ হলেও তাদের মধ্যে সৌহার্দের কমতি নেই। কালেভদ্রে ছোটখাটো বিষয়াদি নিয়ে কথা কাটাকাটি বা মন কষাকষি যে হয়নি এমনটি নয়। কিন্তু মনু ও সেলিনার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে ইদানীং যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তা স্পর্শকাতরতার পর্যায়েই পড়ে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকালেই সেই জটিলতা অধিক গতি সঞ্চার করে।
সেলিনা বলে, ‘আমার দাদা কী করিছে আর তোমার দাদা কী করিছে তা নিয়ে আমরা ঝগড়া কত্তি যাবো কেন, মনু ভাই? ওদের কাইজ্যা ওরা করুক, আমাগের কী আসে যায়?’
‘আসে যায়, ঢের আসে যায়। তুই কী বুঝবি?’, মনু হাত নেড়ে নেড়ে উত্তর দেয়।
সেলিনা বলে, ‘সবকিছুই তো ঠিক ছিল। তুমিই না প্যাঁচটা বাজায়ে দিছো।’
এবার ফোঁস করে ওঠে মনু, ‘কী ক’লি? আমি প্যাঁচ বাজাইছি? এই রাজাকারের নাতিন, মুখ সামলে কথা ক।’
‘মনু ভাই, আবারও তুমি ঝগড়া বাঁধাচ্ছো। কতবার কয়েছি, দাদা রাজাকার ছিল; হেই দোষ কি আমার?’ সেলিনা ধরাগলায় বলে, ‘দাদার জন্যি তো আমাগের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে না।’
মনু বলে, ‘দাদা রাজাকার ছিল, সেইটে নাহয় গেল। এরপরও তো তোমরা পল্টিবাজি ছাড়ো নাই। তোর বাপ জামাতী, তোর রহিম চাচা করে বিএনপি। আচ্ছা যাক, অতীতের গন্ধ মোছার জন্য নাহয় তারা এই দল সেই দল করলো। কিন্তু ছোটটা? করিম; সে তো আওয়ামী আজরাইল – এখন পালাইলো কেন? তোমাগের কে যে কোনদিকে ঝুলে থাকে বোঝা মুশকিল।’
সেলিনা আগের সেই খুকি নেই। দিন যত গিয়েছে সে-ও লাউয়ের ডগার মতো লকলকে হয়ে বেড়ে উঠেছে। তাই তার পরিবারও এবার নড়ে বসেছে। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে সে ক’দিন পর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। পরীক্ষা শেষ হলেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। এ কথা জানতে পেরে সেলিনার মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। কেননা, মনু ভাইয়ের সাথে তার মন লেনদেন বছরতিন আগে থেকে, যখন মনু তাকে কিছুদিন প্রাইভেট পড়িয়েছিল। তার থেকে প্রায় তিন বছরের বড় মনু এখন ঢাকা কলেজে বিএ অনার্স পড়ছে। নগরবাসী হয়ে গেলেও পল্লীবালিকা সেলিনাকে সে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। তাদের এই ভালবাসাবাসির গোপন খবর দু’বাড়ির লোকজনের কাছে তেমন গোপন নয়। ব্যাপারটা এমন যে কখনও প্রসঙ্গটা আলোচনার টেবিলে উঠে গেলে মুরব্বিদের কারুরই তাতে আপত্তি থাকবে না। কেউ কেউ এমনও মত পোষণ করে যে মোল্লাদের বিচ্ছিন্ন শেকড় জোড়া লাগার এটা একটা মওকা। কিন্তু গত জুলাইয়ের আন্দোলনই সব তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। মনু যদি এভাবে বেঁকে বসে থাকে তবে সে আশায় গুড়ে বালি।
সেলিনার ছোটচাচা গাঁওগেরামে যখন দাবড়ে বেড়িয়েছে, অন্যের নাকের ডগার ওপর দিয়ে থানার ঠিকাদারি কাজ, গঞ্জের ইজারা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে তখন তার জামাতী বাপ, জাতীয়তাবাদী চাচা কেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছিল, সেটাই মনুর বড় প্রশ্ন। তবে সবচেয়ে আপত্তিজনক ব্যাপার হলো, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এই করিম চাচা অন্যদের সাথে নিয়ে মিছিলে মিছিলে হানা দিয়েছে। বেশ ক’জন ছাত্র তার হাতে মারও খেয়েছে।
সেলিনার অভিমানভরা কথার জবাবে মনু বলেছে, ‘সাঁকোর উপর একসাথে বইসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরিছি, মুর্তাফুলের মধু চুষে খেয়েছি, তাতে কী হয়েছে? চামচাবাজি তো করি নাই ।’
সেলিনা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, ‘তুমি আমাকে কতদিন মারিছো, আমি কানতি কানতি বাড়ি গেছি…’
মনু রেগে গিয়ে বলেছে, ‘আহারে, ননীর পুতুল! মারিছি, ভাল করিছি; আরও বেশি মারা উচিৎ ছিল। তোরে প্রাইভেট পড়ায়ে ভুল করিছি, পরীক্ষায় তোর ফেল মারাই ঠিক ছিল।’
মেয়ের মুখ দেখে সেলিনার মায়ের বুঝতে বাকি থাকে না ঈশান কোণে শুধু ঘোরকালো মেঘই জমেনি, দমকা হাওয়াও বইছে মুহুর্মুহু। আন্দোলনের লণ্ডভণ্ড বিজয়ে দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে ইতিমধ্যে। করিম কোন ইঁদুরের গর্তে ঢুকেছে কেউ জানে না। এদিকে এতদিন ঘাপটি মেরে থাকা সেলিনার বাপ কাশেম মাথায় টুপি পরে হৈ হৈ করে ছুটে বেড়াচ্ছে জানবাজ নেতাদের পেছনে পেছনে। কূপমণ্ডূক রহিম নবতর উদ্যমে দলবল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পতিত দলের পরিত্যক্ত মাঠ বিপুল বিক্রমে নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছে। রহিমের লম্ফঝম্ফের আতিশয্য দেখে তার দলের কিছু বেয়াড়া ছেলে ফোঁড়ন কাটতেও ছাড়েনি। সিনিয়ররা অবশ্য বিষয়টা এভাবে ব্যালেন্স করেছে যে তার ভাই সরকারি দলের লোক হয়ে তাফালিং করলেও রহিমের কখনও পদস্খলন ঘটেনি; সে দুর্যোগের পুরো সময় তার দলের প্রতি অনুগত থেকেছে। এসব হযবরল কর্মকাণ্ডে সেলিনার মায়ের কিছু যায় আসে না; রাজনীতি আর ক্ষমতার তেমন কিছু সে বোঝে না এবং এসবে তার কোনো আগ্রহও নেই। বরং খ্যাপাটে মনুর কারণে সেলিনার মলিন মুখ তাকে ভাবিয়ে তুলেছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কাল থেকে সেলিনাদের পরিবার বিভিন্ন মাত্রায় এবং বিভিন্ন পোশাকে রাজনীতিতে লেগে থাকলেও মনুদের পরিবারে রাজনীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি কখনওই ছিল না। মনু ঢাকাতে যাওয়ার পরই কেবল রাজনীতি বুঝতে শুরু করে। তবে তার নানার পরিবারে অল্প হলেও রাজনীতির নামগন্ধ আছে; মনুর নানা জব্বর মুন্সি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাথেই জড়িত ছিলেন।
মনুর বড় হবার পর সেলিনার পরিবারের রাজনৈতিক বহুগামিতা তাকে বেশ ভাবিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেলিনার মোহময়ী চোখের গভীরে ডুব দিলেই নিঃসীম মায়াপুরী ছাড়া সে আর কিছু দেখে না । তাছাড়া শিশুকাল থেকে ফুলে-দলে একসাথে হৈচৈ করে ছুটতে ছুটতে মনুর আবিষ্ট দৃষ্টি কখন যে এসে নিজের অজান্তে সেলিনার রূপের আগুনে পতঙ্গের মতো আত্মাহুতি দিয়ে বসে আছে। মফস্বলের চারুশীলা বালিকা সেলিনার উড়বার ডানা আর কতটুকুই বা প্রশস্থ যে সে মনুর আকাশ পেরিয়ে যাবে। তাই সে গিরিবাজ কবুতরের মতো আকাশে ডিগবাজি খেলেও সে আকাশ মনুর, আর নিচে নেমে এসে যেখানটায় দাঁড়ায় তা-ও যে মনুর বুকের চাতাল।
পাশাপাশি বাড়ির দুই মোল্লা পরিবারের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। এক পরিবারের মিশ্র রাজনৈতিক মতাদর্শ তাদের সামাজিক সম্পর্কে চিড় ধরাবার মতো জোরালো নয়। কিন্তু করিমের কর্মকাণ্ড মনুকে খেপিয়ে তোলায় ভজকট অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেলিনার মা কানেকানে স্বামীর কাছে মেয়ের ব্যাপারে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্ত্রীর মতো মনুর প্রতি কাশেম মোল্লারও দুর্বলতা আছে। তিনি স্ত্রীকে বলেছেন, ‘করিম দোষ করেছে, তার শাস্তি সে-ই পাবে। আমরা তো স্বৈরাচারের লোক ছিলাম না, আমাগের উপর চটলে তো চলবে না। তুমি মনুর মা’র সাথে একটু বোঝাপড়া করার চেষ্টা করো।’
সেলিনার মাকে মনুর মায়ের কাছে যেতে হয়নি। তার আগেই ঘটে যায় আরেক ঘটনা। কাশেম মোল্লার সাথে সেদিন হাট থেকে ফিরছিলেন মনুর বাপ, আজগর মোল্লা। আজগর মোল্লা মূলার মতো সাদামাটা, সহজ-সরল লোক। খেত-খামার, গরুছাগল, হাঁসমুরগি এসব নিয়েই অধিক স্বচ্ছন্দে থাকেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দেশের গণ্ডগোল ইত্যাদি নিয়ে জাবর কাটতে কাটতে যখন তারা বাড়ির পথ ধরেছিলেন তখন আজগর মোল্লা সাতপাঁচ না ভেবে সহজভাবে জিজ্ঞেস করেন, ‘কাশেম, তোমার মেয়ে কি পড়াশোনা শেষ করি ফেলিছে?’
‘প্রায় শেষ; সামনে পরীক্ষা।’ কাশেম বলেন, ‘কেন ভাইজান?’
‘না, এমনি কই। মেয়েটা খুব ভাল।’ তারপর আমতা আমতা করে বলেন, ‘মেয়েটারে আমার পরিবারে যদি নিতি পারতাম।’
আজগর মোল্লার কথায় কাশেম মোল্লা শিহরিত হোন। তার ধারণা হয়, মনু আর সেলিনা যে দুজন দুজনকে পছন্দ করে একথা পরিবারের অন্যরা জানলেও আজগর মোল্লা হয়তো জানেন না। এখনকার এই সহজ সরলোক্তি নিতান্তই তার নিজের মনের কথা। তার এই সহজ কথার প্রতিক্রিয়ায় কী বলবেন তা কাশেম খুঁজে পান না। তিনি শুধু হে-হে বলে তাৎক্ষণিকভাবে উতরে যান। তবে উদ্ভূত জটিলতা থেকে এটা যে এক মহা উত্তরণ একথা ভেবে তিনি বেশ পুলকিত হোন।
সপ্তাখানেক বাড়িতে থাকার পর মনুর ঢাকা ফেরার সময় হয়ে যায়। বাড়িতে আসার পর প্রথম সাক্ষাতেই যখন সেলিনার সাথে তার মুখোমুখি একচোট হয়ে যায় এরপর সে সেলিনার ফোনও ধরেনি। এতে সেলিনার চেয়ে তারই বরং বেশি কষ্ট হয়েছে। একবার অনুতপ্ত হয়ে ভেবেছে, দোষ তো করেছে করিম চাচা; এজন্য সেলিনাকে শাস্তি দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? সেলিনার সাথে রাগারাগি করলেও এক মুহূর্তের জন্যও মনু তাকে মনের আড়াল করতে পারছে না।
যাত্রার ঠিক আগের দিন মনু সেলিনার কাছ থেকে একটি এসএমএস পায়। কাতর অনুরোধ, সন্ধ্যার পর শেষবারের মতো সাঁকোর ওপর যেন দেখা হয়। সেলিনার আহ্বানের কাছে মনুর সব যুক্তি ও তর্কের প্রাচীর হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। রাগ বজায় রেখেও সে সেলিনার সাথে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে ওঠে।
দু’বাড়ির কেউ দেখছে কি না, বদনামের ঝুঁকি আছে কি না এসব পরোয়া না করে সেলিনা কাগজের পোটলায় কিছু ছাল-ছাড়ানো পানিফল নিয়ে যথাসময়ে সর্পিল নালার পাড়ে এসে দাঁড়ায়। আকাশে একাদশীর চাঁদ; ফকফকে আলো না থাকলেও কাছের বস্তু স্পষ্ট দেখা যায়। মুর্তার বনে জোনাকিরাও আজ মেলা বসিয়েছে কী মনে করে। সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ঐকতানও ভেসে আসছে বাড়ির পেছন থেকে। মনু কিন্তু সাঁকোর ওপর খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েই ছিল। সেলিনা সাঁকোয় উঠছে না দেখে মনু ধমক লাগায়, ‘লুলা নাকি? এখানে আসতে পারিস না?’
মনুর হাঁক শুনে সেলিনা কেঁপে ওঠে। তার ঘাড় থেকে নালার জলের মতো শীতল একটি সাপ তরতর করে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। অভিমান, কষ্ট আর আনন্দ মনের মধ্যে কচলাকচলি করে ভর্তার মতো হয়ে গেলে তার চোখে ঝাঁজ লাগে। তার দু’চোখ অনায়াসেই ভারি হয়ে ওঠে। সে সাবধানী পদক্ষেপে সাঁকোয় উঠে পানিফলের পোটলাটা হাত বাড়িয়ে মনুর দিকে এগিয়ে দেয়, কিন্তু কোনো কথা বলে না।
মনু ‘তামাশা করস?’ বলে খপ করে সেলিনার হাত ধরে ফেলে। এতে পোটলা থেকে কয়েকটি পানিফল নালায় পড়ে যায়।
পানিফলের সাথে সাথে সেলিনার চোখের বাঁধ ভেঙ্গে ক’ফোটা লোনা পানি ছিটকে পড়ে। একই সাথে তার মুখের ছিপিটাও খুলে যায়। সে মুখ ভার করে বলে, ‘তোমারে শেষবারের মতো দেখতে চাইল মনটা।’ মুহূর্তের বিরতির পর আবার ধরা-গলায় বলে, ‘আমারে মাফ করে দিয়ো, মনু ভাই।’
‘তোরে মাফ করলেও তোর পল্টি বংশকে মাফ করবো না।’ সেলিনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মনু আবার বলে, ‘না, তোরেও মাফ করা যায় না।’
সেলিনা গাল ফুলিয়ে বলে, ‘দাও না, শাস্তি দাও। আমি কি মানা করিছি।’
মনু ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর একটু নামিয়ে বলে, ‘প্যাঁচ তো লাগায়ে দিছে আমার বাপ।’
সেলিনা জিজ্ঞেস করতে পারতো ‘কী প্যাঁচ?’, কিন্তু সে তার ঠোঁটে তালা ঝুলিয়ে রেখে মনুর পরবর্তী সংলাপ শোনার অপেক্ষায় বসে থাকে।
মনু বলে, ‘বাবা মায়ের সাথে ফিসফিস করে কথা বলিছে।’ বলে, সে আলোআঁধারিতে সেলিনার মুখে প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করে।
মনুর বাবা-মা ফিসফিস করে কী বলতে পারেন সেলিনা তা আন্দাজ করতে পারে। কেনোনা তার বাবাও ফিসফিস করে তার মায়ের কাছে ফিরতিপথের হাটুরেদের গল্প বলেছেন। শুধু তাই নয়, মেয়ের মুখের অন্ধকার দূর করার মানসে তার মা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মনুর স্তুতি কীর্তনও করেছেন।
সেলিনা কিছু বলছে না দেখে মনু আবার তেড়ে ওঠে, ‘মুখে ঠুলি পরিছিস? নাকি কুলুপ আঁটিছিস?’
‘এমনিতেই ঢের ঝাড়িছ; মুখ খুলে আবার বিপদে পড়বো নাকি?’ অপক্ক জ্যোৎস্নায় ভালোভাবে না দেখা গেলেও বোঝা যায় সেলিনার মুখে আলতো আলোর ঝিলিক খেলা করছে।
সেলিনার কথায় মনু এবার উত্তেজিত হয় না। সে বরং তার অপূর্ণ কথাটা পূরণ করার জন্য বলে, ‘বাবা মাকে বলিছে, তোমার ছেলেরে ফোঁসফোঁসানি কমাতি কও।’
সেলিনা রহস্যঘন চন্দ্রিমায় এই প্রথম আড়চোখে মনুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আর কিছু কয় নাই?’
কপট ধমক দিয়ে মনু বলে, ‘আর কী ক’বি? তোর জন্যি প্রস্তাব পাঠাবি?’
সেলিনাও কম যায় না। সে-ও কপট অভিমানের সুরে বলে, ‘আমি তাহলে যাই এখন; অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই আমাগের শেষ দেখা।’ বলে, সে সাঁকো থেকে নামতে উদ্যত হয়।
ঠিক তখনি মনু সেলিনার চুলের বেণী ধরে টান দিয়ে বলে, ‘যাবি কই, পূর্ণিমা তো সামনে!’
সেলিনা পা টলে প্রায় পড়তে গিয়ে কোনোমতে টাল সামলে বলে, ‘তুমি কি আমারে নালায় ডুবায়ে মারতি চাও?’
মনু বলে, ‘তুই না, আমি ডুবি মরতি চাই।’