মোকাব্বির ভাই

গণহত্যা (অক্টোবর ২০২৪)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • 0
  • ৭২
১.
মোকাব্বির ভাই বিনোদনের পাত্র অনেকের কাছে, তবে রহস্যেরও বহুলাংশে। ব্যস্ততামুক্ত প্রবীণদের কাছে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পাত্র না হলেও অনেকটা কৌতূহলের। তারা মসজিদ থেকে ফেরার পথে কিংবা বাজারের দিকে যেতে যেতে মোকাব্বির ভাইয়ের দেখা পেলে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান এবং যার যা ইচ্ছা তাই ভাবেন। তবে মনিপুরিপাড়ার বিটকেলে ছোকরাদের কাছে মোকাব্বির ভাইয়ের রহস্য কখনোই প্রধান বিষয় নয় বরং তিনি তাদের আনন্দের যোগানদাতা । প্রাতঃকালীন আড্ডায় ছটকুর চা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বাম হাতে কনভেন্সড মিল্কের চায়ের কাপ আর ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে ওরা যখন রাজ্যের হাতি ঘোড়া মারতে থাকে তখনই হয়তো দেখা যায় মলিন ট্রাউজার এবং বুকে ক্রিকেটের ব্যাট-বল আঁকা কলাপাতা রঙের টি-শার্ট পরে মাথা নিচু করে মোকাব্বির ভাই রাস্তার দুপাশে কী যেন খুঁজে চলেছেন।

হয়তো মিন্টু তখন ডাক দিয়ে বলে, ‘কী হাল মোকাব্বির ভাই?’

মোকাব্বির ভাই তখন মাথা তুলে তার স্বভাবসুলভ কেলানো মুখে ছোকরাদের দিকে তাকান। আর সাথে সাথে তার ফোকলা দাঁতের ওপরের পাটি এক মায়াময় আবহের সৃষ্টি করে।

রাজু বলে, ‘হাতে ভাবদণ্ড নাই যে?’

মোকাব্বির ভাই বরাবরের মত গৎবাঁধা বুলি আওড়ান, ‘তোমাগো মতো আমার কি বাপের হোটেল আছে? আমার আগে কামাই করতে অইবো।’

ভাবদণ্ড মোকাব্বির ভাইয়েরই নিজের দেয়া নাম। একটি ছেঁড়া ছালা হাতে নিয়ে মোকাব্বির ভাই সকাল বিকাল দুই বেলা ফুটপাতে এবং বিভিন্ন দোকানের সামনে রাখা ময়লার ঝুড়ি থেকে মূলত প্লাস্টিকের বোতল খুঁজে বেড়ান। বেশ ক’টি জমা হয়ে গেলে সেগুলো তিনি বড় রাস্তার ফুটপাত দখল করে বসা ভাঙ্গারির দোকানে নিয়ে যান। রাস্তা চষে তুলে আনা তার এই অমূল্য সম্পদ ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে কখনো কুড়ি টাকা আবার কখনো ত্রিশ টাকা পান। এই টাকা দিয়ে তিনি মাঝারি মানের সিগারেট কিনে আয়েসে ফুঁকতে ফুঁকতে পায়চারি করেন। এই সিগারেটই হল তার ভাবদণ্ড। সিগারেট টানার সময় নাকি তার একটা ভাব আসে।

মিন্টু, রাজু, খোকনরা অনেকবার মোকাব্বির ভাইকে সিগারেট সেধেছে। মোকাব্বির ভাই কি আর খয়রাতি সিগারেট খাওয়ার লোক। তিনি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেছেন, ‘আমি ফকিন্নি নাকি রে? আমার কি পয়সা নাই?’ তাই তারা আর সিগারেট সেধে মোকাব্বির ভাইকে ছোট করতে চায়নি। তারা বরং এক সারিতে দাঁড়িয়ে চা খায় আর মোকাব্বির ভাইয়ের সাথে হাসিঠাট্টা, রং তামাশা করে আনন্দ পায়। শুধু হাসি ঠাট্টা নয় দেশ-বিদেশী হালনাগাদ খবরাখবরও রাখেন তিনি।

সত্য মিথ্যা কারুর জানা নেই। তবু উত্তেজিত হয়ে পড়লে মোকাব্বির ভাই হাত-পা ছুড়ে সরকারের গোষ্ঠী উদ্ধার করেন। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন রণক্ষেত্রের কথা বলেন, নিকষ কালো অন্ধকার রাতে হামাগুড়ি দিয়ে এসে ব্রিজ কালভার্ট ভাঙার কথা বলেন তখন বড়দের মতো ছোকরাদের মনেও এক ধরনের ধন্দ হয়, মোকাব্বির ভাই কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন!

মোকাব্বির ভাই মাঝেমধ্যে মসজিদে গিয়ে নামাজও পড়েন; জুমার নামাজে অবশ্যই যান। এলাকার লোকজন তাকে মোটামুটি চেনেন। পুরনোদের কাছে তার আচরণ কিঞ্চিৎ রহস্যপূর্ণ হলেও কেউই তাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করেন না কিংবা বলতে গেলে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু আনন্দ ভিলার মালিক দফাদার সাহেব সময়ে অসময়ে অন্য মুসল্লিদের কাছে মোকাব্বির ভাই সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করেন। কেউ কেউ দফাদার সাহেবকে বলেন, ‘সে যা ইচ্ছে করুক, আপনার তাতে সমস্যা কী? আর নাহয় আপনিই তার সাথে একবার কথা বলুন।’

একদিন বিকেলে যখন মোকাব্বির ভাই বোতল বিক্রির টাকা দিয়ে পাশের দোকান থেকে সিগারেট কিনে সুখটান দিতে দিতে ফিরছিলেন তখনই উল্টোদিক থেকে দফাদার সাহেব এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ান। তখন অবশ্য পাড়ার ছেলে-ছোকরা কিংবা পরিচিত কেউ আশেপাশে ছিল না। দফাদার সাহেব সরাসরি মোকাব্বির ভাইকে বলেন, ‘আচ্ছা মোকাব্বির সাহেব একটা কথা জিজ্ঞেস করি।’ একথা বলে দফাদার সাহেব এক মুহূর্ত মোকাব্বির ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া অবলোকন করেন।
- কন।
- আপনি তো বেশ কিছুদিন ধরে আপনার বোনের বাসায় আছেন। শুনেছি আপনার ভাগ্নে-ভাগ্নিরা আমেরিকায় থাকে; বাসায় শুধু আপনি, আপনার বোন আর কাজের লোক।
- জি। ভগ্নীপতিটা মারা গেল, আর বইনটাও ছেলেমেয়েদের কাছে কিছুতেই যাইতে চাইল না। তারপর আমারে ধইরা আইনা আটকাইয়া রাখছে।
- আটকাইয়া রাখছে মানে?
- আরে আমি কি বন্দী থাকার লোক? এখন বইনটা একা, অসুস্থ। তারে ফালাইয়া আমি যাই কেমনে?

দফাদার সাহেব কথা বাড়াবার মওকা পান। তিনি ভাবেন, লোকটা আর যাই হোক পাগল নয়। আরও দু’চারটা কথা হয়তো বলা যাবে। তিনি বলেন, ‘আপনার ফ্যামিলি কি দেশে থাকে?’
- ফ্যামিলি কী? আমি তো একা মানুষ।
- ও! বিয়ে-শাদী করেন নাই?

দফাদার সাহেবের কথা শুনে এবার মোকাব্বির ভাই ঘাড় সোজা করে, চোখ বড় করে তার দিকে তাকান। মোকাব্বির ভাইয়ের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বোঝা যায়, তিনি দফাদার সাহেবের এ প্রশ্নে বিরক্ত হয়েছেন। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে তিনি চলে যেতে উদ্যত হলে দফাদার সাহেব বলেন, ‘একটু দাঁড়ান।’
- বলেন।
- কিছু মনে করবেন না। আপনি একজন ভাল লোক, আপনার বোনের পরিবারও ভাল। নিশ্চয়ই ভাগ্নে-ভাগ্নিরা টাকা-পয়সা দেয়, ঢাকা শহরের মোটামুটি ভদ্র এলাকায় থাকেন, আপনাদের আর্থিক অনটন থাকার কথা নয়…
- বুজছি, আপনি এখন যা কইবেন আমি বুজছি। এইটা আমার নেশা; বুজলেন? খারাপ নেশা। এই খারাপ জিনিস খাওনের লাইগা আমি বইনের পয়সা নষ্ট করুম না। এর লাইগা আমি টোকাইয়ের কাম কইরা পয়সা জুগাই। কে কী কইল তাতে আমার আসে যায় না।

দফাদার সাহেব তার অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান। তিনি আর কোনো প্রশ্ন করার উৎসাহ পান না। এই সুযোগে মোকাব্বির ভাইও গজগজ করতে করতে তার উদ্দিষ্ট পথে পা বাড়ান।

বেশ কিছুদিন পর ঘটেছিল আরেক ঘটনা। সেদিন ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজে দেরিতে আসার কারণে পাড়ার মসজিদের দোতলায় স্থান পেয়েছিল রাজু। নামাজ শেষ করে অনেকেই যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল তখনই দোতলা থেকে শোরগোল শুনতে পায় সে। মসজিদের ফটকের সামনে লোকজনের চেঁচামেচি থেকে বোঝা যাচ্ছিল না কারা কী নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে। তবে হঠাৎ রাজুর মনে হলো তেজস্বী গলাটা মোকাব্বির ভাইয়ের। সে তখন তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এসে দেখে মিন্টু মোকাব্বির ভাইকে পেঁচিয়ে ধরে সামলাবার চেষ্টা করছে আর দফাদার সাহেবসহ আরও কয়েকজন মারমুখী হয়ে তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। রাজুও যখন ছুটে গিয়ে মিন্টুর পাশে দাঁড়ায় তখন মোকাব্বির ভাই দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে হাত-পা ছুঁড়তে থাকেন। রাজু ও মিন্টু দুজন মিলে মোকাব্বির ভাইকে প্রায় পাঁজাকোলা করে সরিয়ে নেবার সময়ও তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে চিৎকার করতে থাকেন, ‘নিজেরা রাজা হইয়া গেছে, আর আমরা প্রজা! ব্যাটা, আমরা রক্ত দিছি। রক্ত দিয়া এই দ্যাশ স্বাধীন করছি, আর তোমরা চুরি-চামারি কইরা এই দেশের মালিক হইয়া গেছ। মানুষরে মানুষ মনে করো না। গন্ধ লাগে? পাশে দাঁড়াইয়া নামাজ পড়তে পারো না! আমি তো তোমাগো মতন চেয়ারে বইসা নামাজ পড়িনা, মাটিতে বইসা পড়ি…’

মোকাব্বির ভাই বিচ্ছিন্নভাবে আরও অনেক কিছু বললেও রাজু বা মিন্টু তাকে আর সওয়াল-জওয়াব না করে সোজা তাকে তার বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে। তবে তাদের বৈকালিক আড্ডায় ছটকুর দোকানে গিয়ে রাজুরা মূল ঘটনা জানতে পারে। ধূম্রসেবী মোকাব্বির ভাইয়ের জামা-কাপড়ে একটু পোড়া পোড়া গন্ধ থাকবেই এ কথা স্বতঃসিদ্ধ; এমনটি আরও অনেকের আছে। তাছাড়া মোকাব্বির ভাই দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারেন না। আবার চেয়ার তার পছন্দ নয় বলে মাটিতে খানিকটা পা ছড়িয়ে বসে তিনি নামাজ পড়েন। আগে এ ব্যাপারে কেউ আপত্তি না জানালেও ওইদিন জুমার নামাজ শেষ হতে না হতে তার পাশেই চেয়ারে বসা বুরহান সাহেব মোকাব্বির ভাইকে চড়াগলায় দু’চার কথা শুনিয়ে দেন। মোকাব্বির ভাইও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। উত্তেজনার পারদ যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন দফাদার সাহেবসহ আরও কয়েকজন এসে বুরহান সাহেবের পক্ষ নেন।

ছটকুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরেফিরে অপ্রত্যাশিত এই বচসার কথা আলোচনা করতে করতে তারা অস্বস্তি বোধ করলেও রাজুরা প্রথমবারের মতো অন্য একটি তথ্য জেনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে। মোকাব্বির ভাইয়ের বোনের পুরনো কাজের লোক আক্কাস যদি আসল সত্যটা না বলতো তবে তারা জানতোই না যে মোকাব্বির ভাই সত্যি সত্যিই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন সময় উত্তেজনার বশে বর্ণিত তার যুদ্ধের খণ্ডচিত্রকে তারা জারিজুরিই মনে করতো। কিন্তু তার নাকি কোনো সনদ-টনদ কিছুই নেই; এবং এ ব্যাপারে তার আগ্রহ বা আক্ষেপ কোনোটিই নেই। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় সোনার ডিমপাড়া রাজহাঁস হয়ে ওঠার পর পরিবারের অনেকে তাগিদ দিলেও মোকাব্বির ভাই নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠাতে যাননি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, আক্কাস জানায়, রণাঙ্গনে তার হাঁটুতে গুলি লেগেছিল। তাই নামাজ পড়তে হলে তাকে কিছুটা পা ছড়িয়ে বসতে হয়।

মোকাব্বির ভাইয়ের জীবনের মহান অধ্যায় উন্মোচিত হওয়ার পর মিন্টু, রাজু, খোকনরা অনেক সংযত হয়ে যায়। তারা মোকাব্বির ভাইয়ের সাথে খোশগল্প করা ত্যাগ না করলেও ফালতু ইয়ার্কি-ফাজলামি সচেতনভাবেই বাদ দেয়। সিগারেটের প্রসঙ্গ তো বাদই, তারা বরং তাকে আন্তরিকভাবে চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করে।

২.
মনিপুরিপাড়ার ছোকরাদের এই দঙ্গলটার সবাই যে বখে-যাওয়া এমনটি নয়। তারুণ্যের টগবগে রক্ত গায়ে থাকলেও দেশের দূষিত রাজনীতি তাদের গ্রাস করতে পারেনি। দীপু আর ছ্যাঁকা সায়েম ছাড়া বাকিরা মোটামুটি ট্র্যাকে আছে। যেমন রাজু প্রথমবার বিসিএসে অকৃতকার্য হয়ে এবার আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিন্টু ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ করে এখন বাইরে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে; তার খুব ইচ্ছা মাস্টার্সটা ইউএস থেকে করবে। খোকন পড়ালেখায় খুব একটা ভাল করতে পারেনি। বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হলেও অনার্স শেষ করা হয়ে ওঠেনি তার। এখন বাপের ব্যবসার সাথে সে একটু একটু করে সম্পৃক্ত হচ্ছে - সাতক্ষীরায় কয়েকটি চিংড়ির ঘের আছে তাদের।

স্বাধীনতার পর সময়ের বাঁকে বাঁকে দেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে, গণজোয়ারে রাজপথ কেঁপে উঠেছে বহুবার, রক্তপাতও কম হয়নি। কিন্তু প্রকৃত গণহত্যার দৃশ্য স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম দেখেনি। স্বাধিকারের দাবিতে সারা দেশ যখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল তখনও রক্ত ঝরেছিল অনেক, কিন্তু রক্তের বন্যা ছোটে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে। প্রকৃত যোদ্ধাদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। এই যোদ্ধাদের অনেকেই হয়তো মোকাব্বির ভাইয়ের মতো সনদহীন। কিন্তু যারা যুদ্ধ করেনই নি এমন অনেকেই তুলে নিয়েছেন গামলা গামলা মাখন। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন অংশত মাখনখোরদের প্রতি উষ্মার কারণ।

আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে জুলাইয়ের শেষদিকে পুলিশের গুলিতে ক’জন ছাত্র মারা গেলে তা সর্বশ্রেণির মানুষের বাঁধভাঙ্গা গণ-জোয়ারে পরিণত হয়। মনিপুরিপাড়ার ছোকরাগুলোর দেহের রক্তও তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠায় তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুলেটের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। মিন্টু, রাজু, খোকনরা প্রায় প্রতিদিন শাহবাগ, নিউমার্কেট, টিএসসিতে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। এই প্রজন্মের তরুণরা গণ-আন্দোলন আর গণহত্যার কথা বই আর ভিডিও থেকেই জেনেছে; এবার তারাই সে ধরনের এক ঐতিহাসিক ঘটনার কুশীলব হয়ে উঠেছে। ছটকুর চায়ের দোকানে ওদের খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় কেউ কারও সাথে ঠিকমতো যোগাযোগও করতে পারছে না। মোকাব্বির ভাইয়ের সাথেও সঙ্গত কারণে তাদের যোগাযোগ ঘটছে না। তবে দীপু সেদিন বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গলির মুখে মোকাব্বির ভাইকে দেখতে পেয়েছিল। মোকাব্বির ভাই সিগারেটে লম্বা টান দিতে দিতে তার হাতের ছেঁড়া থলে ফুটপাথে আছড়াচ্ছিলেন আর চিৎকার করে কীসব বলছিলেন। দীপুর হাতে সময় ছিল না বলে সে দাঁড়ায়নি। তবে যেতে যেতে মোকাব্বির ভাইয়ের দুয়েকটা কথা তার কানে বেজেছিল, ‘বেটা আমি সিক্সটিনাইনের প্লেয়ার, একাত্তরে রক্তের ভিতর দিয়া সাঁতার কাটছি, গুলির ভয় দেখাও, দেখি তোমার কয়ডা গুলি আছে……’



৩.
ভয়ঙ্কর এবং অস্থিতিশীল অবস্থার ভেতর দিয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পার হয়েছে দেশে। লেলিহান আগুন, লাশের সারি আর ভাঙ্গাচোরার স্রোতে পড়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ যেন কোথাও গিয়ে দাঁড়াতে পারছে না। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বিক্ষিপ্ত লুটতরাজের ও জিঘাংসার ঘটনাও ঘটে চলেছে। মানুষ গণমাধ্যমে একের পর এক লাশের খবর শুনে যুগপৎ আতংকিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ছটকুর চায়ের দোকানও সপ্তাহ খানেক বন্ধ থাকার পর দুদিন হয় খুলেছে। কিন্তু বাঁধা ক্রেতার অনুপস্থিতিতে বেচাকেনা এখনও জমে ওঠেনি।

পরবর্তী জুমার দিনে দেশের প্রত্যেক মসজিদে দেশের শান্তি-স্থিতিশীলতা এবং আন্দোলনে শহীদ ছাত্র-জনতার জন্য নিয়মমাফিক দোয়া করা হয়। মনিপুরিপাড়ার মসজিদেও নামাজের পর অত্যন্ত গাম্ভীর্য নিয়ে দেশের শান্তি কামনা করে দোয়া করা হয়। দোয়া শেষ হতেই হঠাৎ কে একজন গিয়ে ইমামের কানে কানে কিছু একটা বলে। তখন ইমাম সাহেব বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আমাদের এলাকারও একজন প্রবীণ ব্যক্তি, আপনাদের অনেকে হয়তো উনাকে চেনেন, মাঝে মাঝে মসজিদে এসে নামাজ পড়তেন, তিনিও নাকি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।’

ইমাম সাহেবের কথা শেষ না হতেই লোকজনের হৈচৈ এবং হুড়োহুড়িতে বোঝা গেল না নিহত লোকটি কে কিংবা কোথায় মারা গেল অথবা কোথায় তাকে দাফন করা হলো।

মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাজু, খোকন ও দীপু যখন নিহত প্রবীণ ব্যক্তির পরিচয় জানার চেষ্টা করছিল তখন কোথা থেকে আক্কাস ছুটে এসে রাজুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। কান্নার কারণ বলার আগেই রাজুরা বুঝে ফেলে নিহত প্রবীণ ব্যক্তি আর কেউ নন, মোকাব্বির ভাই। উপস্থিত অন্য লোকজন না কাঁদলেও রাজু, খোকন ও দীপু অশ্রু সামলাতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদে আক্কাস বলে, ‘ভাই, আমরা মামারে আটকাইয়া রাখতে পারি নাই। উনি একটা লাঠি হাতে নিয়া মিছিলে চইলা গেছে। তারপর দুইদিন খবর নাই। পরে খোঁজ নিয়া হাসপাতালে লাশ পাই।’

মোকাব্বির ভাইয়ের লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়েছে। আজকেই কেবল মোকাব্বির ভাইয়ের বোনকে নিয়ে আক্কাস ঢাকায় ফিরেছে; সাথে গ্রাম থেকে দুজন লোকও এসেছে। তাদের সাথে দেখা করতে মিন্টু, রাজু, খোকন, দীপু ও ছ্যাঁকা সায়েম সন্ধ্যায় মোকাব্বির ভাইয়ের বাসায় যায়। সে আরেক করুণ দৃশ্য। এই ছোকরাদের সাথে তার জানাশোনা না থাকলেও মোকাব্বির ভাইয়ের বোন তাদের দেখে বিলাপ করে কাঁদতে আরম্ভ করেন।

পরিবেশ একটু শান্ত হয়ে এলে রাজু বলে, ‘আপা, মোকাব্বির ভাই এমনিতেই আমাদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন; কিন্তু আমরা তার ব্যক্তিগত কিছু তেমন জানিনা। উনার কি ছেলে-মেয়ে, সংসার…?’

মোকাব্বির ভাইয়ের বোন আবার বিলাপ করে ওঠেন, ‘তোমরা আর কইও না, আমার ভাই অনেক ভাল ছাত্র আছিল। যুদ্ধে গিয়া জান বাজি রাইখা যুদ্ধ করছে, গুলি খাইছে; তখন মরে নাই’ বলেই তিনি বুক চাপড়াতে থাকেন। আবার বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার ছয় মাস পর সে দেশে আসে। আসার পরে শুনি সে হাসপাতালে আছিল।’ মোকাব্বির ভাইয়ের বোনের গলা ধরে আসে।

ইতিমধ্যে আক্কাস সবাইকে চা-বিস্কুট দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে রাজু উসখুস করে। শেষে বলেই ফেলে, ‘বলছিলাম আপা, উনার বউ-বাচ্চা সম্বন্ধে তো কিছু জানি না…।’

মোকাব্বির ভাইয়ের বোন এবার বলেন, ‘না। যুদ্ধ কইরা আইসা আর সে কলেজে গেল না। এরপর আব্বা-আম্মা চাইলেন বিয়া করাইয়া দিতে; সে করলো না।’

দীপু সাথে সাথে বেয়াড়ার মতো জিজ্ঞেস করে, ‘কেন? বিয়া করলো না ক্যান?’

মিন্টু দীপুকে ধমক দেয়, ‘রাখ, তুই কথা বলিস না।’

মোকাব্বির ভাইয়ের বোন একটু স্থির হয়েছেন। তিনি আর রাখঢাক না করেই বলেন, ‘আমার ভাই নাই, এইসব কথা কইয়াও কোনো লাভ নাই। আমার বান্ধবীর সাথে তার খুব ভাব আছিল। যুদ্ধের পর পর আমার ভাই ফিরা না আসায় সবাই মনে করছে সে মইরা গেছে। তাই তার বাবা মা তারে বিয়া দিয়া দিছে।’ তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘ফাতেমা খুব কানছিল।’

মোকাব্বির ভাইয়ের বোনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ওরা অনেক কথা বলতে পারতো; মোকাব্বির ভাইয়ের বীরত্বের কথা বলতে পারতো, তার আত্মদানের কথা বলতে পারতো। কিন্তু তা না করে মিন্টু, রাজু, খোকন, দীপু ও ছ্যাঁকা সায়েম হতভম্বের মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে থাকে। নিবিড়ভাবে তাকালে বোঝা যায় তাদের অক্ষিগোলক ইঁদারার শান্ত জলের মতো চকচকে কিন্তু স্থির। শুধু ছ্যাঁকা সায়েম তার চক্ষুকুঠরির জল ধরে রাখতে পারেনি; টপ করে বুকের ওপর ঝরে পড়ে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মোকাব্বির ভাই বিনোদনের পাত্র অনেকের কাছে, তবে রহস্যেরও বহুলাংশে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী