নাম তার আম্ফান

ঘূর্ণিঝড় (জুলাই ২০২৪)

Jamal Uddin Ahmed
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.২৩
  • 0
  • ১৬০
মধ্যবাড্ডার ঘিঞ্জি বেপারী পাড়া রোডে গাছপালার আড়ম্বর তেমন নেই। রাস্তার মোড়ে হঠাৎ কোথাও কোথাও শিশু, রেইনট্রি, মেহগনি, নিম কিংবা নাম না জানা কিছু গাছ দেখা যায় – কেউ কখনও শখ করেই হয়তো লাগিয়েছিল। কেননা, এসব রাস্তায় পরিকল্পনা করে কোনো কর্তৃপক্ষের গাছ লাগাবার নজির নেই। গতকাল অফিসে যাবার পথে দিলারা একটি রেইনট্রিকে রাস্তার মাঝখানে সটান শুয়ে থাকতে দেখেছে। আম্ফানের ধকল ঢাকার ওপর দিয়েও কম যায়নি এটিই তার প্রমাণ। আধেক মাটি আধেক ইট-সুরকিকে কামড়ে ধরে গাছটি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। দিলারা শুনেছে রাতের বেলায় লোকজনবিহীন রাস্তায় বিদ্যুতের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা একটি রিক্সাভ্যানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে গাছ।

আজ দমকা হাওয়ার ধমক কিছুটা কমেছে। কিন্তু বৃষ্টি এখনও পুরোপুরি থামেনি। শ্বশুরের বানানো বেপারী পাড়া রোডের টিনশেডের বাড়িতে দিলারার শাশুড়ির লাগানো কাঁঠাল গাছ ও লিচু গাছ এখনও ঝিরিঝিরি ঝরনায় গোসল করছে। টিনের চালের ওপর বৃষ্টি থেমে থেমে মেঘমল্লার রাগের রেওয়াজ করছে। লিচু গাছে তেমন ফল না ধরলেও কাঁঠাল গাছে মাশাল্লাহ প্রতি বছরই গুটিকয়েক সুস্বাদু কাঁঠাল ধরে। এই সকালেও টুনি আর টুটুল দাদাভাইয়ের সাথে মুড়ি মাখিয়ে গপাগপ কাঁঠাল গিলছে। কাঁঠাল দিলারা এবং বকুলেরও প্রিয় ফল। এমুহূর্তে বকুল থাকলে সে-ও তার বাপ ও বেটা-বেটির সাথে যোগ দিত আর ডায়াবেটিসের দোহাই দিয়ে বাপকে ঠেকানোর চেষ্টা করতো। ছেলের কথা কি বজলু সাহেব শুনতেন? শুনতেন না। তিনি দরকার হলে ইনস্যুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবেন, তবু কাঁঠালের পরিমাণ কমাবেন না।

দিলারা ছাতামাথায় কর্মস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা করলে বজলু সাহেব জিজ্ঞেস করেন, ‘বকুলের সাথে কথা বলেছ, বৌমা?’

‘কাল রাতে কথা হয়েছে আব্বা; সকালে আর ফোন করিনি।’ দিলারা জবাব দেয়।

বজলু সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘ও ঠিক আছে তো?’

দিলারা বলে, ‘ঠিক আছে। তবে খুব ব্যস্ত আছে বললো।’ দু’কদম সামনে গিয়ে সে একটু থেমে আবার বলে, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, আব্বা। আর বৃষ্টি না থামলে আজ আর টুনি-টুটুলকে নিয়ে স্কুলে যাবেন না।’

দিলারা গুলশানে এমিনেন্স নামের এক অভিজাত পোশাকের দোকানে কাজ করে। পশ্চিমের নামী ব্র্যান্ডের পোশাক পাওয়া যায় বলে উচ্চশ্রেণির দেশি এবং বিদেশি ক্রেতাদের কাছে দোকানটি পরিচিত। দিলারা সেখানে মূলত সেলস পারসন হিসেবে কাজ করে এবং তার দক্ষ ও কুশলী সেলসম্যানশিপে মালিকপক্ষ সন্তুষ্ট। বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যা পায় তা অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় মন্দ বলা যায় না। বকুল এনজিও’র চাকরি থেকে যা বেতন পায় তা দিয়ে সংসারের খরচ ভালভাবেই চলে যায়। তাই দিলারার বেতনের একটি বড় অংশ সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে।

দিলারা ও বকুলের একটি স্বপ্ন আছে। এটা তারা নিজেদের মধ্যে গোপন রেখেছে। অন্তত বজলু সাহেব যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তা প্রকাশ করা যাবে না। কেননা বিপত্নীক বজলু সাহেবের ধ্যান-জ্ঞান তাঁর পরিবার। সরকারি দপ্তরের উচ্চমান সহকারীর চাকরি ছেড়ে তিনি অনেকদিন সৌদি আরবে কাটিয়েছেন। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন ছাড়াও নিজের দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে শুধুমাত্র ভাল শিক্ষাদীক্ষা দেয়ার জন্য ঢাকা শহরে রেখেছেন। তারপর ছেলেমেয়েদের বিয়েও দিয়েছেন। এসব করেও বেপারী পাড়ায় অল্পদামে তিন কাঠা জমি রাখতে পেরেছিলেন বলে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসার আগেই তিনি একটি প্রমাণ সাইজের টিনশেড ঘর তুলতে পেরেছেন। ইতিমধ্যে ছেলে উপার্জনক্ষম হয়ে গেলেও শেষ বয়সের কথা ভেবে ছড়ানো ছিটানো জীবনের অবশিষ্ট সম্বল মুদারাবা হিসেবে সঞ্চয় করে রেখেছেন। টাকার অংক ছেলেমেয়েদের না জানালেও তারা বুঝতে পারে বাবা কারুর মুখাপেক্ষী না হয়েও চলতে পারবেন। কিন্তু তিনি কখনও এসব নিয়ে বাহাদুরি দেখান না। তবে চিকিৎসা, ওষুধপথ্যের জন্য ছেলে জোর করে টাকা দিতে চাইলেও তিনি নিতে চান না। বরং ঈদে-পর্বে তিনি ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির জামা-কাপড়ের জন্য নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে দিতে খুবই আনন্দ পান। বিশেষ করে টুনি আর টুটুল যা চায় দাদাভাই তা এনে দিতে কসুর করেন না। নাতি-নাতনিদের নিয়ে তিনি লুডু খেলেন, ক্যারম খেলেন। বিজয়ীকে পুরষ্কার দেন। ছেলেমেয়েরাও বাবার এই আনন্দকে ম্লান করতে চায় না। তারা চায় এই আনন্দের মাঝেই বাবা যেন তাদের মায়ের অভাবটা ভুলে থাকতে পারেন। বাবার এই অবাধ স্বাচ্ছন্দ্যে ছেলেমেয়েরা বরং খুশিই হয়। তারা তো জানেই যে ব্যাংকের জমানো মূল টাকা একদিন তারাই পাবে; বাবা মুনাফার টাকা নিজের মতো করে খরচ করলে কার কী বলার আছে?

দিলারার খুবই শখ তার একটি ছিমছাম ফ্ল্যাট হবে, তা মোহাম্মদপুরে হোক বা মিরপুরেই হোক। জমানো টাকার সাথে ব্যাংক লোন মিলিয়ে এই শখ পূরণ করা যায় বৈকি। কিন্তু শ্বশুর বেঁচে থাকা অবস্থায় এসব চিন্তা করা যাবে না। তাছাড়া বকুলের একটি বিকল্প চিন্তাও আছে। সময় ও সুযোগ এলে তার বোনদের নিয়ে বাবার এই প্লটের ওপর একটি পাঁচতলা দালান তৈরি করার ইচ্ছে তার। এতে সবার একসাথে থাকা হবে এবং বোনদের হিস্যাও যথাযথভাবে পরিশোধিত হয়ে যাবে। ঘিঞ্জি পরিবেশের জন্য দিলারার নাক একটু উঁচু হলে বকুল যুক্তি দেখিয়েছে, এমনিতে তো একসাথে থাকার সুবিধা অনেক, তাছাড়া ততদিনে বাড্ডা অঞ্চল আরও উন্নত ও বসবাসোপযোগী হয়ে উঠবে। পরিকল্পনাটা যেহেতু ভবিষ্যতের জন্য দিলারা তাই পাল্টা যুক্তিতর্ক নিয়ে এগোতে চায়নি। সে মনে করে ততদিনে তাদের যেহেতু আরও আয় উন্নতি হবে, সেই সাথে রুচি ও মানসিকতার পরিবর্তনও তো ঘটতে পারে।

বকুল জলবায়ু বিষয়ক একটি এনজিওতে কাজ করার সুবাদে প্রায়ই তাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফিল্ড ট্রিপে যেতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে তো কথাই নেই, তাকে পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আম্ফান আঘাত করার পর আজ তিনদিন হয় সে পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত আছে। তাই দিলারা তো এব্যাপারে উদ্বিগ্ন আছেই, বজলু সাহেবও টেলিভিশনের পর্দায় চোখ গেড়ে বসে আছেন। তিনি কিছুক্ষণ পরপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলছেন, ‘দেখেছ বৌমা, দশটা গ্রাম পানির নিচে চলে গেছে।’ আরেকবার এসে বলছেন, ‘শুনেছ, নৌকা উল্টে বিশজন লোক মরে গেছে; কী সাংঘাতিক কথা!’

দিলারা তার কর্মস্থলে থাকলেও বজলু সাহেব ফোন করে তাকে আপডেট দিতে থাকেন। দিলারা শ্বশুরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আব্বা, আপনি শুধুশুধু টেনশন করবেন না। আমি আপনার ছেলের সাথে কথা বলেছি; সে নিরাপদে আছে। আপনি টুনি আর টুটুলের সাথে লুডু খেলতে থাকুন। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব।’

আম্ফান তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাবার পরই কেবল এক এক করে দুর্গত এলাকার খবর আসতে শুরু করেছে। বৃহত্তর বরিশাল ও নোয়াখালী অঞ্চলের বাঁধ-ভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাস, গৃহধ্বস, মানুষ এবং পশুর প্রাণহানি ছাড়াও মাছের খামার, চিংড়ির ঘের, কাঁকড়ার খামার বন্যার জলে ভেসে যাওয়ায় পুরো এলাকায় যে মাতম ওঠে তা সামাল দেয়ার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

শ্বশুরের ছটফটানিকে তত পাত্তা না দিলেও পরদিন সকালে দিলারা যখন তার স্বামীকে ফোনে পেতে ব্যর্থ হয় তখন তার টনক নড়ে। সে দ্রুত খাবার টেবিলে গিয়ে দেখে বজলু সাহেব তখনও নাশতা খেতে বসেননি। শ্বশুরের প্রিয় কাঁঠাল, রুটি-ভাজি সবই পড়ে আছে। সকালে ঘরের কাজে দিলারা সময় দিতে পারে না, কারণ কাজে যাওয়ার জন্য তাকেও প্রস্তুত হতে হয়। নাশতা বানানো, দুপুরের খাবারের আয়োজন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব গৃহকর্মী ফুলির মায়ের ওপর। দিলারা উঁকি দিয়ে দেখে বজলু সাহেব আলুথালু বেশে টুনি ও টুটুলকে জড়িয়ে ধরে সোফায় বসে একদৃষ্টে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি দিলারাকে দেখে উদ্ভ্রান্তের মতো বলেন, ‘বৌমা দেখো দেখো, কী অবস্থা!’ আবার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করেন, ‘বকুলের সাথে কথা বলেছ?’

শ্বশুরের প্রশ্নে দিলারা বেকায়দায় পড়ে যায়। সে যে ফোনে বকুলকে পায়নি একথা বলবে কেমন করে? তাছাড়া ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী তাণ্ডবের কথা শুনে সে-ও যে মুষড়ে পড়েছে তা লুকাবেই বা কেমন করে? পরিস্থিতি সামাল দিতে সে তড়াক করে বলে, ‘ওর ফোনে বোধ হয় চার্জ নেই আব্বা; এই পরিস্থিতিতে ওখানে বিদ্যুৎ থাকার কথা না। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ট্রাই করে যাব।’

বজলু সাহেব ভড়কে গিয়ে বলেন, ‘কী বল? সে ফোন ধরেনি?’

দিলারা বলে, ‘আমি ওদের অফিসে ফোন করবো, আব্বা। আপনি চিন্তা করবেন না। এখন টুনি-টুটুলকে নিয়ে টেবিলে আসেন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

বজলু সাহেব অনিচ্ছায় গাত্রোত্থান করেন। টুনি-টুটুলকে নিয়ে টেবিলের দিকে যেতে যেতে তিনি বলেন, ‘আমার খুব ভয় লাগছে, বৌমা। দশ ফুট উঁচু বন্যার জল……।’

এ ক’দিন আম্ফানের ভয়াবহতা দিলারার মনে কোনো রেখাপাত করেনি। কিন্তু টেলিভিশনের লাইভ সংবাদে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখে সে-ও এখন ভড়কে গিয়েছে। এ অবস্থায় বকুলকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সে অফিসে পৌঁছেই সমীরদাকে ফোন করে। সমীর বকুলের অফিসের অ্যাডমিন ও এইচআর হেড। তাছাড়া সমীরের সাথে বকুলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে।

সমীর জানায়, ‘ভাবী, একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা; বিদ্যুৎ তো নাই-ই, এলাকার লোকজনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আমাদের পাঁচজন লোক ওখানে কাজ করছে। সবার ফোন বন্ধ। তবে সরকারি এক কর্মকর্তা অন-রিকোয়েস্ট আমাকে ফোন করে জানিয়েছে আমাদের লোকজন ভাল আছে; ফোন চার্জ করতে পারলে তারা কথা বলবে।’

দিলারা এই হালনাগাদ তথ্যে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তার মনের আকাশে চিন্তার মেঘ আরও ঘনীভূত হয়। সে সমীরকে জিজ্ঞেস করে, ‘দাদা, ওরা কী খাচ্ছে, কোথায় বিশ্রাম নিচ্ছে এসব জানেন নাকি?’

সমীর বলে, ‘খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তো আপনি জানেনই, এসব পরিস্থিতিতে ওরা ড্রাই ফুড আর জল সাথে রাখে। আর বিশ্রামের ব্যাপার হলো, ওরা যখন যেখানে সুযোগ পায় একটু ঘুমিয়ে নেয়। আপনি চিন্তা করবেন না। কোনো আপডেট পেলে আমি অবশ্যই আপনাকে জানাব।’

সংবাদমাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে অনেকটা জানা গেলেও ঢাকা থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে আম্ফান-আক্রান্ত এলাকাবাসী ছাড়াও ত্রাণকর্মীরা প্রকৃতপক্ষে কী ধকল পোহাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে শুধু মানুষই না, গৃহপালিত পশুদেরও উদ্ধার করতে হচ্ছে। খাবার নিয়ে ছুটতে হচ্ছে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ওষুধপথ্য নিয়েও দৌড়াতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। যারা মারা গিয়েছে তাদের সৎকারের ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে নৌকা ছাড়া কোনো বাহনও নেই। গলাচিপা, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী এসব গ্রামে যাওয়ার পথে স্রোতের টানে নৌকাডুবিও হচ্ছে। বকুলদের মতো আরও অনেকে এসব ঝুঁকি নিয়ে দুর্গত অঞ্চলে কাজ করছে।

দিলারা ভাবে, বকুল সাঁতার জানলেও ঘূর্ণিঝড়-কবলিত প্রতিকূল অবস্থায় তার এই দক্ষতা কতটুকু কাজে আসবে। নদী-খাল পরিবেষ্টিত যাদের জীবন সেই স্থানীয় লোকজনই অকুস্থলে ডুবে মরছে। দিলারা আর ভাবতে পারে না। তার মাথা ভনভন করছে। কর্মস্থলে সবাই তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে অভয় দিচ্ছে। ম্যানেজার ফারজানা আরেকটু বেশি সহানুভূতি দেখিয়ে বলেছে, ‘তুমি আজ একঘণ্টা আগেই বাসায় চলে যেও।’

দিলারা সন্ধ্যার আগে আগেই বাসায় ফিরে দেখে শাহানা তার বাবার সাথে বসে উদ্বেগের সাথে টিভি দেখছে। শাহানার বাসা বেশি দূরে নয়; বনশ্রীতে। টুনি ও টুটুল বারান্দায় বসে ফুফুর ছাতা নিয়ে খেলা করছে। দিলারা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপা, আপনি কখন এসেছেন? আমাকে তো একটা ফোন করলেন না – কিছু খেয়েছেন?’

শাহানা টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বলে, ‘বাবার ফোন পেয়েই চলে এলাম – এই তো কিছুক্ষণ।’

বজলু সাহেব তখন অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোনো খবর পেয়েছ, বৌমা?’

দিলারার সম্বল সমীরদার ওই আপডেটটুকু। সে ওটাতেই ভর করে বলে, ‘বকুলের অফিস খোঁজ নিয়েছে, আব্বা। ওদের লোকজন ভাল আছে। তবে ফোনে চার্জ নেই বলে তারা কথা বলতে পারছে না।’

‘ওরা ফিরবে কখন, কিছু জানো?’ বলতে বলতে শাহানা দিলারার কাছে উঠে এসে আস্তে আস্তে বলে, ‘বাবা ভীষণ টেনশনে আছেন; একবার যদি বকুলের সাথে কথা বলতে পারতেন।’

দিলারা শ্বশুর ও শাহানার জন্য চা-নাশতা বানিয়ে এনে টি-টেবিলের ওপর রেখে সে-ও গভীর মনোযোগের সাথে টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টিপাত করে। তার টেনশন কি কম? সে তা সচেতনভাবে চেপে রেখেছে। বাসায় এসে ছেলেমেয়েদের প্রতিও নজর দিতে পারেনি।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান হলে বজলু সাহেব আসন ছেড়ে ওঠার তোড়জোড় করেন। শাহানাও ওজু করার জন্য বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়। তখনই দিলারার ফোন বেজে ওঠে। সে তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে দেখে সমীরদা। ফোন রিসিভ করতেই সমীর বলে, ‘ভাবী, ওদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। ওরা আজ রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেবে।’

দিলারা উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে, ‘বকুল তো একটা ফোন করতে পারতো আমাকে।’

সমীর বলে, ‘ভাবী, ব্যাপারটা হচ্ছে কী, ওদের কারুর ফোনেই চার্জ নেই। আমি ওখানকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার লোকদের সাথে কথা বলেছি। ওরা একটা অ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে আমাদের লোকদের ঢাকায় পাঠাচ্ছে…।’

‘অ্যাম্বুলেন্স!’ দিলারা আকাশ থেকে পড়ে। বলে, ‘অ্যাম্বুলেন্সে কেন দাদা? কী হয়েছে, খুলে বলেন।’

মুহূর্তে শাহানা ও বজলু সাহেব ছুটে এসে দিলারার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। উত্তেজনায় বজলু সাহেব কথার মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স? কে? বকুলের কী হয়েছে?’

ওপাশ থেকে সমীর বলে, ‘ভাবী, আপনারা এত অস্থির হবেন না। ধৈর্য ধরুন। শুনুন, শুনুন। বিধ্বস্ত একটা গ্রামের দিকে যাওয়ার পথে আমাদের বোটের ওপর একটি গাছ উপড়ে পড়ে। এতে বোটের কমবেশি সবাই আহত হয়েছে। একজন তো সাঁতার জানেই না। বোট উলটে গেলে ও প্রায় ডুবেই গিয়েছিল। তবে সাথে সাথে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে।’

ঘটনার বর্ণনা শোনার ধৈর্য দিলারার নেই। সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, ‘বকুলের কথা বলুন, ওর অবস্থা কী?’

সমীর বলে, ‘আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, ভাবী। শুনেছি ওদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর, তবে তাদের নাম জানা সম্ভব হয়নি। আপনারা দোয়া করতে থাকুন; বকুলসহ সবাই যেন ভাল থাকে, সুস্থ হয়ে যায়।’

দিলারা কানের কাছ থেকে ফোন সরিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে। ওদিকে সমীর হেলো হেলো বলতে বলতে লাইন কেটে দেয়।

দিলারার কান্নার সাথে সাথে ঘরের পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। শাহানা দিলারাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় যোগ দেয়। বজলু সাহেব চোখ মুছতে মুছতে পাগলের মতো এঘর ওঘর করতে থাকেন। টুনি ও টুটুল সবার দেখাদেখি হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। এ অবস্থায় সবাই মাগরিবের নামাজের কথাও ভুলে যায়।

মিনিট পাঁচেক পরে সমীর আবার দিলারার কাছে ফোন করে। বলে, ‘ভাবী, তখন তো আপনাকে বলার সুযোগ পাইনি; আমরা ঢাকা মেডিকেলে ওদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। আশা করছি শেষরাতের দিকে ওরা এসে পৌঁছে যাবে। আমি অবশ্য হাসপাতালে থাকবো। সকালের দিকে আপনার কাছে ফোন করব। এখন ধৈর্য ধরুন আর উপরওয়ালার নাম জপ করতে থাকুন।’

দিলারা বলে, ‘আমি এখনই হাসপাতালে আসব।’

সমীর বলে, ‘আরে না না, এখন এসে কী করবেন? কাল সকালে আমি ফোন করে আপনার সাথে কথা বলি, তারপর নাহয় আসবেন।’

টুনি-টুটুল খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমের ভারে শুয়ে পড়েছে। শাহানার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে; এরই মধ্যে রক্তে সুগারের মাত্রা সীমা অতিক্রম করেছে। ব্লাডপ্রেশারও হাই। ডাক্তার ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে। সাথে খাবারের বিধিনিষেধও বলে দিয়েছে। হলে কী হবে? মাপজোক করে খাওয়াদাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই তো সন্ধ্যাবেলার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও সে এক থালা কাঁঠাল সাবাড় করেছে। তারপর ভাতও খেয়েছে। ওষুধ খেয়ে সে-ও ঘুমাবার চেষ্টা করছে। বজলু সাহেবকে মাঝে মাঝে ঘুমের বড়ি খেতে হয়। আজ আবশ্যিকভাবে তাঁকে একটি ডায়াজিপাম খাওয়ানো হয়েছে। ওষুধ খেয়ে তিনি নির্জীব হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কিন্তু দিলারা চেষ্টা করেও বিছানায় গা লাগাতে পারছে না। শাহানার জোরাজুরিতে সে কয়েক লোকমা ভাত গিলেছে বটে। কিন্তু মানসিক উত্তেজনায় তা গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইছে।

দিলারার ধর্মকর্মে মনোযোগ কম। কিন্তু চোখে ঘুম না আসায় সে আজ কয়েক রাকাত নফল নামাজ পড়েছে। তারপর যে কয়টি দোয়া জানে তা পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছে।

ফজরের নামাজ পড়ে দিলারা অধীর আগ্রহে সমীরদার ফোনের অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সূর্য উঠে গেলেও যখন সমীরের কাছ থেকে কোনো ফোন আসে না তখন সে নিজেই সমীরকে ফোন করতে থাকে। অনেকবার কল করার পরও সমীরের কাছ থকে সাড়া না পেয়ে দিলারা অস্থির হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে শাহানার ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে ছুটে এসে দিলারাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার ভাইয়ের খবর কী?’

দিলারা তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, ‘আপনার ভাইয়ের কোনো খবর পাচ্ছি না, আপা। আমাকে একটা গাড়ি ডেকে দেন; আমি হাসপাতালে যাব।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাইদুল সরকার শেষ পর্যন্ত কি বকুল মারা গেল ? জানার ইচ্ছে রইল। দারুন সুপাঠ্য গল্প উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। +++
দিলারা গিয়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না! অনেক অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মধ্যবাড্ডার ঘিঞ্জি বেপারী পাড়া রোডে গাছপালার আড়ম্বর তেমন নেই

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.২৩

বিচারক স্কোরঃ ২.৪৩ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪