মানিক তার বাড়ি থেকে ফিরেছে গতকাল। মায়ের সাথে ঈদ উদযাপন করে আসার সময় অনেক ধরনের পিঠা – আমি সবগুলোর নামও জানি না, নারকেল, বিন্নি চাল, আরও কী সব নিয়ে এসেছে।
আমি বলি, ‘অ্যাই, তুমি এতোসব কী নিয়ে এসেছ?’
মানিক চালাক ছেলে। গ্রামের ছেলে হলেও মেধা আছে গড়ের ওপরে। ডাক্তারি পড়ার সুযোগ না পেলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হতে পেরেছে। সে বলে, ‘আমি কী করব? মা-ই তো জোর করে দিল।’
জিজ্ঞেস করার খাতিরেই জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার মা কেমন আছে?’
আমার প্রশ্নে মানিকের হাসি হাসি সপ্রতিভ মুখখানা একটু অনুজ্জ্বল দেখাল। সে বলল, ‘আছে। মোটামুটি। আগের মতোই।’তবে কথোপকথনের ধারাবাহিকতাকে ভারাক্রান্ত না করার জন্য সে কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনি তো অনেকদিন দেশে যান না, মামা। মা বলেছেন একবার ঘুরে আসলে আপনার পুরনো অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হতে পারত।’
তা ঠিক; অনেকদিন হয় দেশের বাড়িতে যাইনি। তবে বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা মানিক যেমন বলছে সে রকম নেই। অনেকেই মরে গেছে। কয়েকজন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আর অল্প কয়েকজন হয়তো রোগব্যাধি নিয়ে বেঁচে আছে। মা-বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখন ঈদে-পর্বে গিয়েছি, গ্রামের আত্মীয়স্বজন এবং স্কুলবন্ধুদের কারও কারও সাথে তখন দেখা হয়েছে। তবে মায়মুনা অর্থাৎ মানিকের মায়ের সাথে অনেকদিন দেখা হয়নি। ওর বিয়ের পর সাকুল্যে হয়তো দু’বার দেখা হয়েছিল।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তো, বাড়িতে গিয়ে কেমন কাটালে?’
মানিক বলে, ‘খুব আনন্দে কাটিয়েছি, মামা। আপনার দেয়া পাঞ্জাবিটা সবার পছন্দ হয়েছে। আর শাড়িটাও মা’র খুব পছন্দ হয়েছে। নতুন শাড়ি আরও ছিল, কিন্তু আপনার দেয়াটা তিনি এত পছন্দ করেছেন যে ঈদের দিন ওটাই সারাদিন পরেছিলেন; একবারও খুলেননি।’ তারপর লাজুক মুখে প্রায় সাথে সাথেই বলে, ‘এবার না আমি এতেকাফে বসেছিলাম।’
‘বাহ! তাই নাকি?’
মানিক আর কিছু বলে না। ইচ্ছে করে তার মায়ের অসুখের কথা তো বললই না। ওই প্রথম আমার বাসায় আসার পর যা বলেছিল, ওটুকুই। ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, চোখের সমস্যা মায়মুনাকে কাবু করে ফেলেছে। সুচিকিৎসা হয়নি বা হওয়ার তেমন সুযোগও ছিল না। পঞ্চাশের কোটায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মানিকের পিতা, মানে আমাদের বি.কম স্যার হৃদরোগে অক্কা পান। এরপর মায়মুনাকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। যৌথ পরিবারে থাকায় খাওয়া-পরা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ভালভাবে এগোয়নি। মেয়ে আফসানা ও রুকসানা এসএসসি পাশ করতে না করতেই চাচা ফুফুরা মিলে তাদের শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। শুধু সবার ছোট মানিকের পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছা থাকার কারণে তার ছোটমামা তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। এইচএসসি পেরোনোর পর সে ডাক্তারি পড়ার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে। একই সাথে সে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা দেয়। শেষমেশ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরই বড় সমস্যা এসে হাজির হয়। ঢাকায় থাকবে কোথায়, খাবে কী? তখনই মায়মুনা, হয়তো অপারগ হয়ে, একটি চিঠি লিখে মানিককে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়।
আমার স্ত্রী স্বপ্না পিঠেপুলি খুব পছন্দ করে। আমিও যে পছন্দ করি না তা নয়। তবে স্বপ্নার চেয়ে ডাক্তারের কথা আমি বেশি মেনে চলি। আমি মিষ্টি খুব একটা খাই না। কিন্তু মানিকের আনা বিন্নি চাল আর নারকেল দিয়ে তৈরি পায়েস এবং মায়মুনার বানিয়ে দেয়া পিঠা খাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারিনি।
স্বপ্না মানিককে বলে, ‘তোমার মায়ের কাছ থেকে পিঠা বানানো শিখতে পারলে ভাল হতো। আমি তো এসব পারি না।’
মানিক বলে, ‘মামি, একবার মামাকে নিয়ে দেশে চলেন, মনের সাধ মিটিয়ে পিঠা খাবেন আর আম্মার কাছ থেকে পিঠা বানানোও শিখে আসবেন।’
স্বপ্না আমার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘তোমার মামা আর নিয়ে যাবে!’
মানিক এবার আমাকে বলে, ‘মামা, আপনি এখন তো আর খুব একটা কোর্টে যান না। আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টরাই সব করে। কুরবানির ঈদে চলেন, দেশে ঈদ করবেন।’
আসলেই বয়সের জন্যই শরীরটা একটু ভারি হয়ে গিয়েছে। খাটাখাটনি এখন আর ভাল্লাগে না। জটিল মামলা থাকলে মাসে দুয়েকবার কোর্টে উঠতে হয়। সাধারণ কেইসের বেলায় আমার দু’জন জুনিয়রই চালিয়ে নেয়, শুধু অ্যাডভাইজারি সার্ভিসটাই আমি দিই। আমার বেশি খাই নেই। নিজের একটা মধ্যম মানের ফ্ল্যাট আছে, খাদক আমরা স্বামী-স্ত্রী দুইজন, ভালই চলে যায়। একটি মাত্র মেয়ে স্বামীর সাথে সুইডেনে আছে; প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। একটু ধকল নিয়ে গ্রামের বাড়ি হয়তো যাওয়া যায়। কিন্তু আলস্যই বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানিক কোথা থেকে আমার ঠিকানা যোগাড় করে অনেক গলিঘুপচি ঘুরে তার মায়ের চিঠি নিয়ে যখন আজিমপুরের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় তখন আমি একটু চমকে উঠেছিলাম। আমি তাকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না, তার বেলায় এটি আরও বেশি সত্য। আমাদের পাশের পাড়ার সাব্বির আমার ক্লাসমেট ছিল, ও মানিকের ছোটমামা। ওদের পরিবারের সাথে আমাদের মাঝেমধ্যে যাওয়া আসার সম্পর্ক ছিল। সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের ছেলে হয়েও সাব্বির বিদেশ যাওয়ার নেশায় পড়ে যায় এবং প্রথম সুযোগেই সে দুবাই পাড়ি দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের সুযোগ-সুবিধা কমে গেলে সে প্রায় পনর বছরের প্রবাস জীবনের ইতি টেনে দেশে ফিরে ঢেউটিনের ব্যবসা শুরু করে। ও-ই হয়তো মানিককে আমার ঠিকানা যোগাড় করে দিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে একটা নিরাপদ থাকার জায়গা দরকার। ওরা আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় না হলেও মায়মুনা আশা করে তার ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। তাছাড়া আমার বাসায় মূলত আমরা দুজন লোক; বাড়তি একজন পরিচিত লোক থাকলে ভালই হয়। এ সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই আমি আর স্বপ্না মানিককে আমাদের বাসায় থাকার অনুমতি দিয়ে দিই। তার হাসিখুশি এবং আন্তরিক আচরণ আমাদের ভালই লাগে। কিছুদিনের মধ্যে সে আমার পরিবারকে এমন আপন করে নিয়েছে যে আমাদের কাজের বুয়া থাকা সত্ত্বেও সে জোর করে আমার স্ত্রীকে শিশুসুলভ সরলতায় গেরস্থালি কাজে সাহায্য করতে আরম্ভ করে। আমার মেয়েও বৃদ্ধ বাবা-মা’র একজন সঙ্গী হয়েছে জেনে খুশি হয়েছে।
আমাদের সম্পর্ক সহজ হয়ে যাবার পর খাবার টেবিলে আমরা প্রায়ই মানিকের সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি, অরাজকতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আন্তর্জাতিক বিষয়াদি – সবকিছু নিয়ে আলোচনা করি। এর বাইরে তো আছেই আমার পুরনো দিনের টুকরো টুকরো স্মৃতি। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার স্কুলজীবনের কাসুন্দি রগড়াতে পছন্দ করি। যেমন, আমার সহপাঠীরা কেমন ছিল, শিক্ষকরা কেমন ছিলেন, ইত্যাদি।
বছর খানিক পার হবার পর একদিন এভাবে আমার বাল্যস্মৃতির কথা তুলতেই মানিক মৃদুস্বরে অনুযোগের মতো করে বলে, ‘মামা, আমার আব্বাও যে আপনাদের শিক্ষক ছিলেন তা তো বললেন না।’
আমি যে ইচ্ছা করে তার পিতার কথা এড়িয়ে গেছি তা মানিকের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় আমি বেশ লজ্জা পাই। তবুও কপট বিস্ময় নিয়ে বলি, ‘কী! বলিনি? আরে, আমাদের প্রিয় বি.কম স্যারের কথা বলিনি? দেখ কী কাণ্ড, কেমনে যে সব এলোমেলো হয়ে যায়। তিনি কিন্তু বেশিদিন আমাদের স্কুলে ছিলেন না, তবে আমিও তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তা, তোমার কেমন করে ধারণা হলো যে আমিও তাঁর ছাত্র ছিলাম?’
‘আম্মা বলেছেন’, মানিকের ছোট্ উত্তর।
সে আমি বুঝি, মায়মুনা তার ছেলেকে বলবেই। আমি শুধু আমার অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানিককে প্রশ্নটা করি।
বি.কম পরীক্ষা দিয়েই একহারা গড়নের সুদর্শন বি.কম স্যার আমাদের মদনপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অংকে তিনি তুখোড় ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষার পূর্বে অনেকের সাথে আমিও বি.কম স্যারের কাছে প্রাইভেট টিউশন নিয়েছি। মায়মুনাও তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়েছে। আমরা যে বছর স্কুল ছাড়ি সে বছর মায়মুনা ক্লাস নাইনে উঠেছে। সদাচঞ্চল, রূপসী মায়মুনার রূপের পাপড়ি তখন একটা একটা করে মেলতে শুরু করেছে।
মানিক তার মায়ের যে চিঠিখানি নিয়ে এসেছিল তা ছিল একজন দূরাত্মীয়ের কাছে পরিণত বয়সের একজন মহিলার সহযোগিতার আবেদন। সেই আবেদনপত্রে মদনপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কিংবা সুদর্শন বি.কম স্যারের প্রেমে পড়ে সিনিয়র ক্লাসের মেয়েদের হাবুডুবু খাওয়া কিংবা সুন্দরী মায়মুনার নেকনজরে পড়ার আকাঙ্ক্ষায় লালায়িত সহপাঠী বা উপর ক্লাসের বড়ভাইদের হাহুতাশের কোনো নাম-গন্ধ খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। আমিও তার ছেলের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে দু’চার লাইনের একটা জবাব লিখে মানিকের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য আমি দাপ্তরিক অভ্যাসবশত সেই পত্রে আমার পুরো নাম-ঠিকানাই লিখেছি।
এই ডিজিটাল যুগে কেউ ডাকে চিঠি না পাঠালেও কয়েকমাস আগে আমি একটি চিঠি পাই – মায়মুনার কাছ থেকে। আমার মেইল বক্সে হলুদ খামটি পেয়ে আমি বিস্মিত হয়নি, উত্তেজিতও হয়নি। তবে তা সতর্কতার সাথে আমি পড়েছি এবং সংরক্ষণ করেছি। সতর্কতার কারণ হচ্ছে, রাগ-গোস্বা কিংবা জেদ-হিংসার বয়স না থাকলেও স্বপ্না এই চিঠি পড়লে আমাকে ভুল বুঝতে পারে এবং অহেতুক অশান্তির কারণ হতে পারে।
মায়মুনা যথেষ্ট আন্তরিকতা দিয়ে আমার উপকারের প্রশংসা করেছে, আমাদের সুস্বাস্থ্য ও সুখী জীবন কামনা করেছে, আমার স্ত্রীর কাছে সালাম দিয়েছে এবং আরও কিছু কথা লিখেছে যা বর্তমান সময়ে দৃশ্যত অসার ও অপ্রয়োজনীয়। তবে তা অনেকটা ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে হাড়-মচকানো ব্যথার মতো যা বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আবার জেগে ওঠে এবং কষ্ট হয়।
চিঠির এক জায়গায় মায়মুনা লিখেছে, ‘কবীর ভাই, আমি জানি আমার একটা চিঠির জন্য তুমি কতো কাঙ্গাল ছিলে। দিনের পর দিন পথের মোড়ে, স্কুলের গেইটে আমার জন্য অপেক্ষা করতে আর আমার হাতে কখনও লম্বা চিঠি, কখনও চিরকুট, আবার কখনও রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেমের কবিতার দুই ছত্র গছিয়ে দিতে। আমি তোমাকে হাসির ভান করে বলতাম, এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই, পাবে, উত্তর পাবে, এখন কলেজে যাও। মনে আছে? আমার এই ছলনার জন্য আমি এখনও কষ্ট পাই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তোমাকে চিঠি লিখতেই হলো। আমার এই আচরণ তুমি ক্ষমা করে দিয়ো। তুমি তো জানতেই বি.কম স্যার আমাকে যাদু করেছিল, আমি তাকে ছাড়া তখন আর কারও কথা ভাবতে পারিনি। সে-ও এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। জানিনা এটা কারুর অভিশাপ কি না।’
আমি প্রত্যুত্তর লিখব না। লিখলে মায়মুনাকে বলতাম, ‘না, আমি কোনো অভিশাপ দিইনি। হ্যাঁ, সেই কচি বয়সে আমি তোমার জন্য পাগল ছিলাম সত্য; তুমি ভালবাসলে আমি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম। কিন্তু সেসব তো হয়ে ওঠেনি।’একবার তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম আমার কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে বি.কম স্যারকে একটা রামধোলাই দেব। সেজন্যই কিনা জানি না, বি.কম স্যার অল্পদিনের মধ্যে অন্যত্র একটি স্কুলে চাকরি নিয়ে আমাদের এলাকা ত্যাগ করেন। শুধু তাই নয়, বি.কম স্যারের সাথে মায়মুনার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেলে সাব্বির মওকা পেলে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, ‘বামন হয়ে কতজন যে চান্দের দিকে হাত বাড়ায়!’ তখন থেকেই সাব্বিরের সাথে বলতে গেলে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটে। এই পরিণত বয়সে সেইসব পাগলামির কথা মনে পড়লে আমার হাসি পায় ঠিকই, তবে শিরায় শিরায় একটা বিষধর কাল পিঁপড়ার হেঁটে বেড়ানোও টের পাই।
পরে প্রসঙ্গ এলে মানিকের সাথে তার পিতা অর্থাৎ বি.কম স্যার সম্বন্ধে দু’চার কথা বলেছি। তার পিতা মারা যাবার সময় মানিক ছোটই ছিল, কিন্তু তার স্মৃতি খুবই উজ্জ্বল। সে জানিয়েছে, তার পিতা শেষপর্যন্ত ওই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন। তবুও প্রচুর প্রাইভেট টিউশনি করতেন। তাঁর আয়েই তাদের পরিবার সচ্ছলভাবে চলত। তাছাড়া তিনি খুবই ভোজনরসিক ছিলেন। প্রায়ই থানাশহর থেকে গরুর আস্ত সিনা নিয়ে আসতেন। ছানার মিষ্টিও খেতেন প্রচুর। এভাবে শরীরে চর্বি জমাতে জমাতে একদিন ঠাশ করে পড়ে মরে গেলেন। শুনে যতটা না কষ্ট পেয়েছি বি.কম স্যারের জন্য তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছি মায়মুনার জন্য। কিন্তু এ যে নিয়তি।
এই কিছুদিন আগে মানিক আবার ফস করে জিজ্ঞেস করে বসে, ‘আচ্ছা মামা, আমাদের মামারা নাকি আপনাদের কী সম্পর্কের আত্মীয় হয়, সত্যি নাকি?’
এবার সে ধরেছে জায়গামতো। আমি এ ব্যাপারে স্বপ্নার সাথে কোনোদিন আলাপ করিনি। মানিকের কাছ থেকে তো এ প্রসঙ্গ সজ্ঞানে সরিয়ে রেখেছি। শুধু তাই নয়, নিজে উপযাচক হয়ে কখনও তার মা কিংবা মামাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতে চাইনি। মানিক যতটুকু তার মায়ের সার্বিক অবস্থা সম্বন্ধে বলেছে তা শুনে শুধু উঁ আঁ করেছি। আসলে আমি খাল কেটে কুমির আনতে চাইনি। মা-মামা এসব নিয়ে কথা বললে সঙ্গতভাবে আত্মীয়তার একটা সূত্র বেরিয়ে আসবে সে ভয় আমার ছিল। কিন্তু মানিকের কাছে তো এটা অজানা রইল না। নিশ্চয়ই সে তার মা অথবা মামার কাছ থেকে সূত্র উদ্ধার করেছে। আর তা শোনার পর তার মনে নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে আমি তার বাপের কথা নাহয় না-ই জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু তার মামার বাড়ির সাথে আমাদের যে সামান্যতম সম্পর্ক আছে তা নিয়ে কেন কোনো কথা বলিনি। তাহলে কি মানিক তার মা বা মামার কাছ থেকে অন্য কিছুও শুনেছে?
আর কিছু না শুনুক অন্তত এটুকু তো শুনতে পারে, তার মা-মামারা গর্ব করে বলতেও পারে, আমরা হতদরিদ্র ছিলাম। মানিকের মামারা রংবেরঙের ইস্ত্রি করা জামা গায়ে দিয়ে বাটার স্যান্ডেল পরে স্কুলে যেত। তখন রং চটে যাওয়া দুটি শার্ট পরে আমাকে সারা বছর স্কুলে যেতে হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতার জন্য যে পুরনো একজোড়া স্যান্ডেল ছিল তা পরে ফুটানি করে স্কুলে যাবার প্রশ্নই উঠেনি। হাফ-ফ্রি বেতনও সময়মতো দিতে পারতাম না। আর বাকি তো অনেক কিছুই আছে। আমার কি তাদের সাথে টেক্কা দেবার মুরোদ ছিল? মায়মুনার দিকে হাত বাড়াবার আমার কী কোনো যোগ্যতা ছিল?
মানিক যখন ধরে বসেছে আমি ভাবলাম ব্যাপারটা পরিষ্কার করে ফেলাই ভাল। মানিক যা মনে করার করুক, এটা তার ব্যাপার। আমি বললাম, ‘কথা সত্য। আমরাও ছোটবেলা থেকে জানতাম আমাদের পূর্বপুরুষের সাথে তোমার মামাদের পূর্বপুরুষের আত্মীয়তার একটা সম্পর্ক ছিল। তবে তোমার মামাদের পরিবার ডাকসাইটে এবং উচ্চবিত্ত ছিল…।’
মানিক আমার বাকি কথার অপেক্ষা না করেই অবলীলায় বলে, ‘না, মামাদের আর আগের মতো অবস্থা নেই। নানা মারা যাবার পর মামারা সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে শেষ করে ফেলেছে। এখন শুধু ছোটমামা বেঁচে আছে; দোকানদারি করেই সংসার চালায়।’
আমি বলি, ‘তাহলে তোমার মা-ও সম্পত্তির অংশ পেয়েছে নিশ্চয়।’
মানিক হতাশ কণ্ঠে বলে, ‘না, অংশটংশ কিছু তারা দেয় নাই; আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে মাঝেমাঝে কিছু টাকা দিত, আবার বোনদের বিয়ের সময়ও কিছু দিয়েছে। এই আর কি।’
আমি আর বলার কিছু খুঁজে না পেয়ে চুপ করে বসে থাকি। মানিকের মামার পরিবারের অধঃপতনের কথা শুনে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে আমার মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আমি মায়মুনার মনের কথা ভাবতে থাকি। আমার কাছে তার ছেলেকে পাঠানোর সময় তার মন কি ছোট হয়ে যায়নি?
মানিক তখন নীরবতা ভেঙ্গে বলে, ‘কিছু মনে করবেন না মামা, আপনার কাছে আমাকে পাঠাতে ছোটমামার মত ছিল না। আম্মাই জোর করে পাঠিয়েছেন। আম্মা বলেছেন: তোর কবীর মামা খুব ভাল লোক, তোকে আদরযত্ন করে রাখবে।’
আমার বুকটা ভারি হয়ে যায়। মায়মুনা আমার জন্য, আমার ঘরের জন্য নিজেকে মানানসই মনে না করলেও তার ছেলেকে আমার ঘরে পাঠিয়েছে। মানিক তো তার জীবনেরই অংশ। সে আমার কাছে থাকলে অবচেতন মনে আমি মায়মুনার উপস্থিতি টের পাই। তাছাড়া আমার দেয়া ঈদের শাড়িটা মায়মুনা পছন্দ করেছে। এটাও আমার জন্য এক অভূতপূর্ব আনন্দের ব্যাপার। আমি আমার বিষণ্ণতা আড়াল করার জন্য মানিককে বলি, ‘তোমার মা ঠিক কাজটাই করেছে।’