মিতার শ্বশুর ফারুক সাহেব এসেছেন মিতাদের বাড়ি অর্থাৎ মিতার বাপের বাড়ি – রাজাবাজারে। এটা নতুন নয়, আরও অনেকবার তিনি বেয়াইয়ের বাড়ি এসেছেন – কখনও একা, কখনও বউমাকে নিয়ে। হৈ হুল্লোড় করেছেন। ভাজা ভুনা হরেক পদের খাবার খেয়েছেন। সিঙ্গেল বিয়াইনের সাথে রঙ্গ-তামাশার গল্পও করেছেন তারিয়ে তারিয়ে। অবশ্য স্ত্রী কুলসুম বেগম সাথে থাকলে কথাবার্তায় একটু লাগাম দিতে হয়েছে এই আর কী। তবে আজকের আসাটা সেরকম নয়। আজ তিনি প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় অসহায় ও লাজুক মুখে বাবুলের শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন।
ডেইজি পারফিউম মেখে দু’মাস আগেও মিতা যখন তার কর্মস্থল হলি চাইল্ড স্কুলে গিয়েছে ঠোঁটকাটা সহকর্মী মারিয়া তখন তাকে চিমটি কেটে বলেছে, ‘কীরে, এত খাই খাই সুগন্ধি কার জন্য মাখিস? তানভীর তো এই গন্ধে পাগল হয়ে যাবে!’
মিতা ঠোঁট উলটে বলেছে, ‘তোর কি মনে হয় আমি রস-গন্ধের লঙ্গরখানা খুলে বসেছি। যে আসবে তাকে গামলা গামলা করে বিলাবো?’
‘না, বলছি এজন্য যে তোর রূপলাবণ্যের ঠিকাদার তো বিদেশে পড়ে আছে’, মারিয়া ফোড়ন কেটেছে, ‘এখন শুধু তানভীর কেন আরও অনেকেই চুক চুক করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কী বলিস?’
মারিয়া মিথ্যে বলেনি। সুদর্শন সহকর্মী তানভীরের ন্যাওটামো অনেকের চোখেই পড়ে। মিতাও পুরুষদের স্বভাব বোঝে। স্বামী ছাড়া দুই দুই বছরের লম্বা সময়ে তাকে কম খানাখন্দ পেরোতে হয়নি। অনেক সহমর্মী, সমব্যথী বৃত্তের চারপাশে এসে ঘুরঘুর করেছে। মিতা কাউকেই বৃত্তের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। সহকর্মী বলে তানভীরটাই বেশি লাই পায়। ওর অবশ্য একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু সে ইউনিভার্সিটি থেকে না বেরোনো পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না বলে তানভীরকে জানিয়ে দিয়েছে। এজন্য সুযোগ পেলেই সে ডানে-বায়ে জলে-ডোবায় বড়শি ফেলে – যদি হঠাৎ কোনো খলসে, পুঁটি ঠোকর দেয়! মিতা দূরত্ব বজায় রেখে লেজ নাড়লেও টোপ গেলে না।
আগপাছ কিছু না ভেবে হুট করে মিতাকে কোর্ট ম্যারেজ করে ঘরে নিয়ে এলেও বাবুলের মা-বাবা সিনেমাটিক কায়দায় বেঁকে বসেননি; বরং একমাত্র ছেলের আনাড়িপনাকে প্রশ্রয় দিয়ে তারা মিতাকে আপন করে নেন। তবে মুশকিলটা থেকে যায় অন্যখানে। প্রেম প্রেম খেলায় স্মার্ট বাবুল এগিয়ে থাকলেও বিদ্যের জাহাজের গতি তেমন বাড়াতে পারেনি। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে টেনেটুনে বিবিএ করার পর এমবিএ’র জন্য ভর্তি হয়েও সে ছিটকে পড়ে। এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করে টুকটাক কিছু করলেও জুতসই কিছু তার কপালে জোটে না। ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পড়ুয়া মিতা ভাল ছাত্রী হয়েও সঙ্গদোষে মাঝপথে হোঁচট খায়। বি.এড শেষ করার পরপর লুকিয়ে বিয়ে করেই সে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করে। শেষপর্যন্ত স্কুলের মাস্টারিতেই তার নিয়তিকে জড়াতে হয়।
বাপের হোটেলের ভাত খেতে খেতে আর স্ত্রীর উপার্জনে পকেট খরচ চালাতে গিয়ে এক সময় বাবুলের আত্মসম্মানে হালকা আঁচড় লাগে। তাই মা-বাবা এবং স্ত্রী মিতার মানা উপেক্ষা করে বিয়ের বছর না ঘুরতেই সে নাছোড়বান্দা হয়ে এক দালালের মাধ্যমে ফ্রান্সের উদ্দেশে দেশ ছাড়ে। সবার মতো বাবুলও জানতো ফ্রান্স বা ইতালিতে যাওয়া মোটেই সহজ নয়; এভাবে যারা গিয়েছে তারা পাহাড়ে জঙ্গলে মাসের পর মাস গা ঢাকা দিয়ে থেকেছে, বরফঢাকা গিরিপথ পাড়ি দিয়েছে, নৌকায় করে সমুদ্র পার হয়েছে, দালাল আর পুলিশের হাতে পড়ে কতভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছে, শেষমেশ কেউ কেউ গন্তব্যে পৌঁছতে না পারলেও কোথাও না কোথাও একটা ঠিকানা পেয়েছে। আর যারা ইঁদুর কপালে তারা নৌকাডুবি বা ঠাণ্ডায় রাস্তায়ই মারা পড়েছে। এসব জানার পরও প্রচণ্ড জেদ নিয়ে ভাগ্য ফেরানোর আশায় বাবুল সব ঝুঁকিই নিয়েছে।
মিতা কাঁদতে গেলেই বাবুল তাকে বুকে চেপে ধরে বলেছে, ‘শুধু একটা বছর কষ্ট করো, আমি মাথাটা ঢুকালেই তোমাকে নিয়ে যাব। তখন আমাদের জীবন অন্যরকম হয়ে যাবে। প্লিজ।’
মিতা বলেছে, ‘তুমি মাথা ঢুকাবার আগেই যদি সমুদ্রে ভেসে ওঠো কিংবা বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকো, তখন?’
বাবুল মিতার মুখ চেপে ধরে বলেছে, ‘খবরদার! নিগেটিভ কথা বলো না। নো রিস্ক, নো গেইন।’
যতটা ঝুঁকির আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটার মুখোমুখি হতে হয়নি বাবুলের। তবুও পাঁচ মাসের বেশি সময় পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে, সাগর-উপসাগর সাঁতরে সে গ্রীস, তুরস্ক, বসনিয়ার গলি-ঘুপচিতে আত্মগোপন করে একসময় ক্রোয়েশিয়ায় গিয়ে কীভাবে যেন থাকা এবং কাজ করার একটা ব্যবস্থা করে ফেলে। মিতা যখন জিজ্ঞেস করে, ফ্রান্স-ইতালিতে না গিয়ে ক্রোয়েশিয়ায় খুদ-কুড়োর জন্য মাথা ঢুকালে কেন তখন বাবুল বলে, ‘দাঁড়াও না, কয়েকটা দিন জিরোতে দাও। লাইন-ঘাট পেয়ে গেলে এখানে আর থাকে কে?’
বাবুলের মা কুলসুম বেগম একমাত্র সন্তান বাবুলের জন্য প্রায় সারাক্ষণই দুশ্চিন্তা করেন। ক্রোয়েশিয়ার মতো গরিব দেশে ছেলেটা কী খায়, কীভাবে থাকে এসব নিয়ে সারাক্ষণ হাহুতাশ করেন। স্বামীর জন্য বিরহ-বেদনা শাশুড়ির চেয়ে বেশি হলেও মিতা শাশুড়িকে প্রবোধ দিয়ে বলে, ‘মা, ও যখন একটা পণ করেছে একটু কষ্ট করুক না। ও তো ক্রোয়েশিয়ায় পড়ে থাকবে না।’
ফারুক সাহেবও মাঝে মাঝে বউমার কথায় সায় দিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, কোনোভাবে ফ্রান্সে ঢুকে যেতে পারলে সে সব ঠিক করে নিতে পারবে। দেখ না, কত ছেলে দুই নম্বরি কাগজপত্র করে ওসব দেশে গিয়ে দিব্যি টিকে যায়।’
কুলসুম বেগম মুখ ঝামটি দিয়ে বলেন, ‘ও তো সবসময়ই দুই নম্বরের ওপর আছে। ক্রোয়েশিয়ায় গিয়েও দুই নম্বরি করে টিকে আছে।’
শাশুড়ির কথা শুনে মিতা মুখ টিপে হাসে। সে মনে মনে ভাবে, বাবুল বিয়েটাও দুই নম্বরি করে করেছে। তাকে গতানুগতিক বিয়ের পিঁড়িতে না বসিয়ে জোর করে কাজী অফিসে নিয়ে গেছে। অজুহাত, বাবা ডিফেন্সে কাজ করা লোক, মেজাজের নিশ্চয়তা নেই, একমাত্র ছেলের পছন্দকে যদি না মেনে নেন। কিন্তু ফারুক সাহেব ডিফেন্স অর্থাৎ এয়ার ফোর্সের লোক হয়েও তেমন মেজাজ না দেখিয়ে ব্যাপারটা সহজভাবে গ্রহন করেছেন। উলটো মিতার পরিবার বাবুলের ঠনঠনে অবস্থার অজুহাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ছেলে লেখাপড়ায় ভাল করতে না পারলেও ফারুক সাহেবের একটা সান্ত্বনা ছিল। কিছু করতে না পারলেও ডিওএইচএসের বাড়তি দুটি ফ্ল্যাটের ভাড়া দিয়ে যে ছেলে মোটামুটিভাবে চলতে পারবে এ ভরসা তিনি পোষণ করতেন। তবে সব বাবাদের মতো তিনিও চান তার ছেলে স্বাবলম্বী হোক । ছেলে ক্রোয়েশিয়া থেকে মাঝে মাঝে যে কিছু টাকা পাঠায় ফারুক সাহেবের তার প্রয়োজন নেই। ফ্ল্যাটের ভাড়া এবং পেনশন ছাড়াও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির লগ্নি থেকে তিনি ভাল অঙ্কের টাকা পান। কিন্তু ছেলের পাঠানো টাকা পেয়ে তিনি তাকে থ্যাংকস জানাতে ভোলেন না। পরে টাকাগুলো ভাগ করে তিনি কুলসুম বেগম এবং মিতাকে দিয়ে দেন। মিতা এ খবর বাবুলকে জানিয়েছে। বাবুল খুশি হয়ে বলেছে, ‘তাহলে ভালই হলো, বউ-শাশুড়ি এখন খাও-দাও, ফুর্তি করো।’মিতা খেপে গিয়ে বলেছে, ‘রাখ তোমার টাকা! তোমার লেবারগিরির টাকা না হলেও আমার চলবে।’
যতই উদ্যম থাকুক, উত্তেজনা থাকুক, বাবুলও রক্তমাংসের মানুষ। মিতাকে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার দোলায় দুলালেও দুনিয়ার অপর পিঠে বসে তার মনও খচখচ করে, কখনও তার মাথার ভেতরে ক্রোয়েশিয়ার আকাশের মতো শূন্যতা বিরাজ করে। তাই সেই একঘেয়ে শূন্যতাকে বাঙময় করার জন্য সে যখনই সুযোগ পায় ক্রোয়েশিয়া থেকে মিতার জন্য পারফিউম কিংবা ছোট ছোট গিফট আইটেম পাঠায়। মিতা বাবুলের পাঠানো উপহারগুলোয় হাত বোলায়, চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের সাথে চেপে ধরে রাখে। তখন বুকের গহীন থেকে উষ্ণ শ্বাসবায়ু উদ্গীরিত হয়ে তা তার চোখের উপত্যকায় এসে ঘনীভূত হয়। মিতা চোখ মুছতে মুছতে নিজেকে প্রবোধ দেয়, আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো মিতা, সুখ বেশি দূরে নয়। আবার কখনও ভিডিও কল দিয়ে কথা বলতে গিয়ে সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। বাবুলের জড়সড় অবস্থা দেখে প্রশ্ন করে, ‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? অসুখ করেছে নাকি?’ বাবুল জবাব দেয়, ‘আরে ধুর, অসুখ করবে কেন, শীতের দেশ, মানুষ একটু আড়ষ্ট হয়ে থাকে।’
তানভীর একদিন বলেছিল, ‘তোমার জন্য কষ্ট হয় মিতা, চাতকের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ডিহাইড্রেশনে মরবার দশা।’
‘ডিহাইড্রেশন হলে তো মানুষ স্যালাইন খায়। তুমি খাওয়াতে চাও নাকি?’, মিতা তির্যকভাবে প্রশ্ন করে।
তানভীর মিনমিন করে বলে, ‘না, বলছি তেষ্টায় কাতর হয়ে পড়লে কেউ ফিল্টার, পুকুর, নদী এসব বাছবিচার করে না; জল পাওয়াটাই মুখ্য হয়ে পড়ে।’
এবার মিতা দৃঢ় গলায় বলে, ‘আমি হলাম মরুভূমির উট। জানো না উট অনেকদিন জল না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে?’
তানভীর হো হো করে হেসে উঠে বলে, ‘অনেকদিন নয়, অল্প কিছুদিন।’
মিতার কাছে এসব ইঙ্গিত নতুন কিছু নয়। সে তানভীরের সাথে এ প্রসঙ্গ নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। তবে তানভীরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও তৃষ্ণার প্রাবল্যকে সে অস্বীকার করতে পারে না। সাথে সাথে বাবুলের কথাও তার মনে পড়ে। ক্রোয়েশিয়া মরুর দেশ নয় সত্য; তবে শীতপ্রধান দেশে কি মানুষের তেষ্টা পায় না? বাবুল বলেছিল জাগরেবে সাভা নামে একটা সুন্দর নদী আছে। তবে কি সাভার জলেই বাবুল পিপাসা মেটায়। এসব ভাবতে গেলে মিতার মাথা চক্কর দেয়। আর তখনই সে অন্য কোনো বিষয়ে ব্যস্ততার তালাশ করে।
একমাস আগে মিতা যখন বাপের বাড়িতে যেতে চাইল ফারুক সাহেব বা কুলসুম বেগম তখন তাকে বরাবরের মতোই হাসিমুখেই যেতে দিয়েছেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে শ্বশুর-শাশুড়ি মিতাকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেন; মাঝে মাঝে এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যান, কখনও দেশি-বিদেশি রেস্তোরাঁয় গিয়ে আজগুবি সব খাবার চেখে আসেন। তারপরও তারা বউমার একাকীত্বের কষ্ট বোঝেন। বাপ না থাকলেও বেচারি তার মা-ভাইদের সাথে কিছুদিন থেকে আসলে তার মনটা যে চাঙ্গা হয় একথা তারা বোঝেন।
এই একমাসে ফারুক সাহেব এবং কুলসুম বেগম বৌমার সাথে ফোনে অনেকবার কথা বলেছেন এবং এক সপ্তাহ আগে তারা সশরীরে রাজাবাজার এসে মিতাসহ পরিবারের সবার সাথে কথা বলে গেছেন। মিতা বাপের বাড়িতে এসে কখনও তিন দিনের বেশি থাকেনি। এবার এসে মাস পার করেও সে শ্বশুরবাড়িমুখো হতে চায় না এটা তো ভয়ঙ্কর ভাবনার কথা। মিতার মা মাহমুদা বেগম মেয়ের এই অদ্ভুত আচরণে একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছেন। মিতার ভাই-ভাবী দুজনই ব্যস্ত মানুষ; ভাই আন্তর্জাতিক এক সংস্থার প্রকল্প পরিচালক এবং ভাবী প্রাইভেট মেডিকেলের এমবিবিএসের সাথে এমপিএইচ ডিগ্রি যুক্ত করে একটি এনজিওতে চাকরি করে। পরিস্থিতির জটিলতা নিরসনে তারা দুজনও আলোচনায় যোগ দিয়েছেন।
শ্বশুর-শাশুড়ি তো পারেনই নি, অনেক সাধ্যসাধনা করে মাহমুদা বেগমও মেয়ের মনের উদ্দেশ্য-বিধেয় কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। ভাবী মিথিলাও মিতাকে আড়ালে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘সত্যি করে বল, বাবুলের সাথে ঝগড়া করেছিস?’
‘না।’
ভাবী বলে, ‘কিছু মনে করিস না, তুই কি অন্য কিছু ভাবছিস?’
মিতা চোখ বড় করে তাকিয়ে বলে, ‘কী ভাবছি?’
‘না মানে, হয় না, অনেক সময় মানুষের মনের গতি পরিবর্তন হয়, অন্য কিছু ভাববার স্বাধীনতা সব মানুষেরই আছে…’ মিথিলা ইঙ্গিতে মিলির অন্য কারও দিকে ঝুঁকে যাবার সম্ভাবনার কথা জানার চেষ্টা করে।
মিতা এবার রাগ করে বলে, ‘ভাবী, প্লিজ, আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। তোমরা যা ভাবছ, আসলে ওসব কিছু না। আমি কয়েকটা দিন নিরিবিলি থাকতে চাই। আমি স্কুল থেকে উইদাউট পে লিভ নিয়েছি।’
মিথিলা বলে, ‘নিরিবিলি থাকবি ভাল কথা। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস না, কেন যাচ্ছিস না তা-ও বলছিস না, সবাই তো টেনশনে আছে।’
‘সবাইকে বলে দাও, আমি পরে যাব।’ মিতা বলে, ‘এখন আমি একটু মানসিক ধকলে আছি, একটু রেস্ট নেব।’
সেদিন এভাবে অমিমাংসিতভাবে কথা শেষ হলে ফারুক সাহেব এবং কুলসুম বেগম হতাশ হয়ে ফিরে যান। কিন্তু আজ ফারুক সাহেব একা এসেছেন – বিধ্বস্ত, আলুথালু। কাউকে ডাকাডাকি না করে ধপাস করে সোফায় বসে তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গৃহকর্মী মেহেরজান ভেতরে গিয়ে মাহমুদা বেগমকে খবর দেয়।
মেয়ের ব্রতচারী আচরণের কোনো কূলকিনারা করতে না পারায় মাহমুদা বেগম নিজেও মুষড়ে পড়েছেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে বেয়াইয়ের এরকম বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তিনি ভয়ে কেঁপে ওঠেন। তিনি ফারুক সাহেবকে জিজ্ঞেস করার কিছু খুঁজে পান না। তখন ফারুক সাহেব মাথা তুলে কাতরকণ্ঠে বলেন, ‘বিয়াইন সাব, আমি বউমা’র সাথে একটু কথা বলতে চাই, আলাদাভাবে হলে ভাল হয়।’
বেয়াইয়ের গলার আওয়াজে মাহমুদা বেগম আরও ভীত হয়ে পড়েন। অজানা আশঙ্কার ছায়ায় তার মুখ ছেয়ে যায়। তিনি কোনো কথা না বলে দ্রুত মিতার কক্ষের দিকে এগিয়ে যান এবং মেয়েকে তার মতো করে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা জানান।
মিতা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মায়ের জোরাজুরিতে সে দ্বিধান্বিতভাবে শ্বশুরের সামনে এসে সালাম দেয়।
ফারুক সাহেব অপরাধীর মতো এক পলক মিতার দিকে তাকিয়ে তাকে ইশারায় তার পাশে বসতে বলেন। মিতা কোনো কথা না বলে চুপ করে পাশের সোফায় বোসে। তার ভাব দেখে মনে হয় শ্বশুর হয়তো এমন কোনো কথা বলবেন যা সে জানে। আড়চোখে সে লক্ষ করে দেখে তার শ্বশুরের মুখে আগের ঔজ্জ্বল্য তো নেইই বরং চোখ দুটি লাল এবং ভেজা।
ফারুক সাহেব টিস্যুপেপারে চোখ মুছে মিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘মা, আমি তোমাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করতে এসেছি। তুমি আমার সাথে এয়ারপোর্টে চল, আমার ছেলেকে রিসিভ করব।’বলেই, তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
মিতা শ্বশুরের কথা শুনে চমকে ওঠে, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না।
ফারুক সাহেব আবার বলেন, ‘আমি তোমার মন খারাপের কারণ জানতে পেরেছি। শুনেছি অ্যানা নামের মেয়েটি তোমার সাথে কথা বলেছে। কিন্তু এখন যে আর অভিযোগের সময় নেই মা। মেয়েটি তোমাকে বাবুলের অসুখের কথা বললেও ওর যে এইডস হয়েছে সেকথা তোমাকে বলেনি।’ ফারুক সাহেব ধরা-গলায় বলেন, ‘ও বোধ হয় আর বেশি দিন বাঁচবে না; ক্রোয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।’
এ মুহূর্তে মিতার লাফ দিয়ে ওঠার কথা কিংবা চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যাবার কথা। এবং হতে যাচ্ছিলও তাই, কিন্তু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া শিলাপাথর ঠেকানোর মতো করে শরীর ও মনের সকল শক্তি দিয়ে সে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যানা নামের মেয়েটি যখন ফোন করে বাবুলের শরীর খারাপ এবং চিকিৎসার কথা বলছিল, মিতা তখন বাবুলের দিকে মনোনিবেশ করার কথা ভাবতে পারেনি। সে বরং মেয়েটির পরিচয় জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অ্যানা কিছু লুকায়নি। সে বলেছে, ‘তুমি শান্ত হয়ে আমার কথা শোনো। আমি জানি তুমি বাবুলের স্ত্রী; সে তোমাকে খুব ভালবাসে। তোমাকে সুখী করার জন্য সে বিদেশে এসেছে। জাগরেবের রাস্তায় সে যখন আরও অনেক অবৈধ অভিবাসীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তার অসহায়ত্ব দেখে আমি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। আমি তাকে এখানে লিগ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে থাকার জন্য সব ধরনের সহায়তা করি। আমার ঘরে তাকে আশ্রয় দিই। মিথ্যা বলব না, তোমার কথা জানার পরেও আমি কিছুদিনের মধ্যে বাবুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। বাবুল অপরাধবোধে দংশিত হয়েও আমাকে গ্রহন করে। হয়তো তার মনে ভবিষ্যতের জন্য অন্য কোনো স্বপ্ন ছিল। কেননা সে আমাদের এই সম্পর্কটা গোপন রাখার জন উদগ্রীব ছিল। কিন্তু আজ আর ব্যাপারটা গোপন রাখতে পারলাম না। বাবুলের শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। আমার শরীরটাও ভাল না……’
মিতা এ পর্যন্ত শুনেই অ্যানার ফোন কেটে দেয়। অসুখ, চিকিৎসার কথা আর সে শুনতেই চায়নি। সেদিন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সে স্কুল থেকে ছুটি নেয় এবং শ্বশুর-শাশুড়িকে বলে বাপের বাড়ি চলে আসে। গত একমাসেও সে স্বাভাবিক হতে পারেনি। এমন কি, বাবুলের কী অসুখ হয়েছে সে কথাটা জানারও তার ইচ্ছা হয়নি। শুধু একটি প্রশ্নই তার মাথায় সারাক্ষণ ভনভন করেছে, বাবুল কেমন করে এত বড় প্রতারণা করল। দেশে তার তেমন কোনো আর্থিক অনটন ছিল না। তবে কি এই নষ্টামি করার জন্যই সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল?
ফারুক সাহেবের কথা শোনার পর মিতা কয়েক মুহূর্ত ঝিম মেরে বসে থাকে। তারপর খুব ধীরে ধীরে গাত্রোত্থান করে। তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে; চারপাশ অন্ধকার মনে হয়। অন্ধকারে অজস্র জোনাকিপোকা সে দেখতে পায়। তবুও সে তার কক্ষের দিকে টলটলায়মান পা বাড়ায়।
তখন ফারুক সাহেব আর্তনাদের মতো উচ্চারণ করেন, ‘তুমি কি আমার সাথে যাবে মা?’
মিতা তার সব শক্তি জড়ো করে দৃপ্ত কণ্ঠে বলে, ‘না।’