বিলাইছড়ি প্রকল্প

মুক্তির গান (মার্চ ২০২৪)

Jamal Uddin Ahmed
মোট ভোট ১৮ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৩৮
  • ১২
  • ৩৮৮
মাগরেবের আজান পড়েছে।। তওফিক সাহেব মনোযোগ দিয়ে আজানের ধ্বনি শোনেন। ইদানীং তিনি কান পেতে আজানের সুর অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠের লালিত্যের কারণে নাকি এমনিতেই আজানের আওয়াজ তার কাছে করুণ আহ্বান বলে মনে হয়। বিগত পঞ্চাশ বছরে তার কাছে এ সত্যটি ধরা পড়েনি। অবশ্য এতদিন ধর্মকর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর তার সময়ও ছিল না। একাব্বর মিয়া গত সপ্তায় তেত্রিশ কানির মধ্যে আট কানি জমির সম্ভাব্য ক্রেতাদের সংবাদ দিয়ে গিয়েছে। কথাবার্তায় পোষালে শিগগিরই এই জমি বিক্রি করে তওফিক সাহেব একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানার কাজ শুরু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। ইতিমধ্যে উলামা পরিষদের কয়েকজন কর্তাব্যক্তির সাথে এ ব্যাপারে কথাবার্তাও এগিয়ে রেখেছেন।

শারীরিক দুর্বলতা ও শীতের কারণে তওফিক সাহেব তায়াম্মুম করে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে দুহাত তুলে মোনাজাত করেন। মোনাজাত করতে বসলে এখন প্রায়শই তার দুচোখ বেয়ে শীতকালের শিশিরের মতো ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে। স্ত্রী দিলরুবা তখন পাশে থাকলে টিস্যুপেপার এগিয়ে দেন।

গত কয়েকদিন থেকে তওফিক সাহেবের মনটা বেশ খারাপ। বয়সের সাথে সাথে রোগব্যাধি শরীরে এসে আগাছার মতো শেকড় গাড়তে শুরু করলে মৃত্যুচিন্তা সবার মতো মাঝে মাঝে তাকেও একটু ভাবিয়ে তুলতো। কিন্তু কিছুদিন আগে প্রাক্তন সহকর্মী রহমান সাহেবের বেমক্কা অপমৃত্যু তাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রেনে কাটা পড়ে লোকটার মৃত্যু দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা তা নিয়েও বিস্তর জল্পনা-কল্পনা আছে। তার দুই পুত্র জোরগলায় বলেছে, এটা নিছক দুর্ঘটনা; কারণ তাদের বাবা স্মৃতিভ্রষ্টতায় অনেকটা কাবু হয়ে পড়েছিলেন। কখন বেখেয়ালে রেল-লাইনে উঠে পড়েছিলেন বুঝতে পারেননি।

হালের শুদ্ধি-ভাবনা তওফিক সাহেবের মধ্যে জোরালো হতে শুরু করলে দিলরুবা ভূইয়াঁ প্রতিবাদী না হলেও কিছুটা প্রতিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অগাধ প্রভাব প্রতিপত্তিসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে দিলরুবা পৈত্রিক দাপটের চিহ্ন হিসেবে স্বামীর পরিবারে এসেও ভূইয়াঁ পদবিটি নামের সাথে রেখে দিয়েছেন। জামাইয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিবেচনায় রেখেই তার পরিবার কাস্টমস ইন্সপেক্টর তওফিক সাহেবের সাথে দিলরুবার বিয়ে দিয়েছেন। তওফিক সাহেবও কর্মজীবনে পদোন্নতির সাথে সাথে তার পদবেষ্টিত সার্বিক সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেছেন। তবে কঠোর বাস্তবতা এবং পরলোক-চিন্তা ধীরে ধীরে তার মানসজগতে ভীতির সঞ্চার করার পর তিনি তার অর্জিত অঢেল সম্পত্তির ভার যতটা সম্ভব ঝেড়ে ফেলার জন্য দৃঢ়পদ হয়ে উঠেছেন।

দিলরুবা ভূঁইয়া স্বামীর এই হঠকারী সিদ্ধান্তের সাথে একমত নন। তার কথা হলো, ভাল হোক আর মন্দ হোক তোমার তিন ছেলেমেয়ে রয়েছে; দান-খয়রাত করতে চাও কর, কিন্তু এজন্য ছেলেমেয়েদের নিঃস্ব করে দিয়ে হাজী মোহাম্মদ মহসিন হতে হবে কেন? অপরদিকে তওফিক সাহেবের যুক্তি হলো, ছেলেমেয়েরা অমানুষ হলেও তিনি তো তাদের একেবারে বঞ্চিত করেননি। মেয়ে সোহানা জাত-মান-কুল খুইয়ে তার গানের দলের সাথি জোসেফ ডি কস্টার হাত ধরে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার পরেও পেনসিলভ্যানিয়ায় তাদের বাড়ি কেনার জন্য তিনি টাকা পাঠিয়েছেন। দুই বখাটে ছেলে হাশেম ও কাশেমকে বসুন্ধরায় দুটি প্লট কিনে দিয়েছেন। ওরা ডেভেলপার কোম্পানি দিয়ে বহুতল দালান বানিয়ে কয়েকটা ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে। এখন তাদের বদখাসলতের জন্য যদি তারা ফ্ল্যাটগুলো বেঁচে দিয়ে রাস্তায় নেমে যায় এজন্য তো তিনি দায়ী নন।

সহকর্মী রহমান সাহেব ছিলেন চৌকস খেলুড়ে; তার বিত্ত-বৈভবের প্রসার ঘটেছিল বিদ্যুৎ গতিতে। নামে বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট করেছিলেন গোটাকয়েক। সবগুলোই ঢাকা শহর এবং তার আশেপাশেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তেতলা আয়েশা সুপার মার্কেটটি যদিও স্ত্রীর নামে করেছিলেন, তার নামকরণ করেছিলেন প্রবাসী শ্যালিকার নামে। তবে অবসর নেয়ার পর যখন তিনি জানলেন আয়েশা সুপার মার্কেটটি তার স্ত্রী গোপনে তার ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন তখনই ঘটে যায় বিষম বিড়ম্বনা। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রহমান সাহেব স্ত্রীর সাথে শুধু যুদ্ধই করেছেন কিছুদিন, কিন্তু আইনের আশ্রয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। অবশেষে একদিন পরিবার-পরিজন জলাঞ্জলি দিয়ে সাভারের রাজাসনের বাড়ির ভাড়াটে সরিয়ে তিনি নিজে গিয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে যখন তিনি তার গার্হস্থ্য সহকারীর সহযোগিতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে মধ্যবয়সী এক বিধবাকে কলেমা পড়িয়ে নিয়ে এসে ঘরে তোলেন।

রহমান সাহেবের কথা চিন্তা করলেই তওফিক সাহেব শিউরে ওঠেন। যদিও জমিজিরেত সবটুকু বিক্রি করে তিনি সাদকায়ে জারিয়ায় ব্যয় করবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তবুও মনে ভয় জাগে তিনি কি তা পারবেন! কেননা বেশির ভাগ জমিই তো ভাই-ভাতিজা-ভাগ্নে-শালার নামে কেনা। রহমান সাহেবের স্ত্রীর মতো ওরাও যদি প্যাঁচ লাগিয়ে দেয় তবে তিনি বেকায়দায় পড়ে যাবেন। অনেকেই বলে রহমান সাহেবের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়; তিনি দুর্ঘটনা কবলিত হননি কিংবা আত্মহত্যাও করেননি। আপনজনেরাই তাকে হত্যা করে ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়েছে।

তওফিক সাহেবের জমি বিক্রির প্রচেষ্টার খবর কোনো না কোনোভাবে বেনামি মালিকদের কানে পৌঁছে গেলে প্রথমেই তার বড়ভাই রফিক তেড়ে আসেন। নিম্নবিত্ত গৃহস্থ বড়ভাই ও তার ছেলেদের নামে জমি কিনলেও তওফিক সাহেব কখনই তাদের কাছে উপস্বত্ব দাবি করেননি বা আনতে যাননি। ফলে তার বড়ভাইয়ের পরিবার তওফিক সাহেবের কেনা জমিতে চাষবাস করে বেশ সচ্ছলভাবেই দিন গুজরান করছিল। এখন তওফিক সাহেব জমি বিক্রি করে দিলে তারা আবার সেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থায় ফিরে যাবে। তাই রফিক কোনোভাবেই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন না। তার কথা, ‘সম্পদ যার নামেই থাক, এইটা তো তোমার। বেচবা ক্যান? তোমার পোলাপানের লাইগা রাইখা যাও।’

তওফিক সাহেব ভাল করেই বোঝেন, নিজের টাকা দিয়ে কেনা সম্পদের ওপর এখনই যখন মালিকানা ফলাতে পারছেন না, ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরা সেখানে গিয়ে দাঁত ফোটাবার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়্যত করে ফেলছি আখেরাতের জন্য কিছু একটা করমু। আমার টাকার দরকার।’

রফিক সাথে সাথেই জবাব দেন, ‘আখেরাতের লাইগা কিছু করবা ভালা কথা। সম্পদ তো তোমারে আল্লায় অনেক দিছে। অন্য কিছু বেইচ্চা ফালাও। ধানী জমি বেচবা ক্যান? এলাকার লোকজনের কাছে কি মান-সম্মান থাকব?’

তওফিক সাহেব জানেন, জোর গলায় কথা বলার তার আইনি ভিত নেই। শুধুমাত্র ভাগ্নের নামে যেটুকু জমি তিনি কিনেছেন তা হয়তো জোরাজুরি করলে বিক্রি করতে পারবেন; ভাই-ভাতিজা তো দেবেই না, শালার নামে কেনা পাঁচ কানিও তিনি উদ্ধার করতে পারবেন বলে মনে হয় না। দিলরুবা ভূইয়াঁ ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই তার ভাইকে এব্যাপারে সজাগ করে দিয়েছেন। তবুও তওফিক সাহেব উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন এলাকায় কেনা তার সব জমির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার জন্য একাব্বর আলীকে লাগিয়ে দেন।

বাপের ধর্মকর্মে মনোযোগের কথা তওফিক সাহেবের ছেলেরা বেশ আগে থেকেই জেনে এসেছে। হয়তো বাবার পরিবর্তন দেখে তারা মুখ টিপে হেসেছেও। কিন্তু পিতার পুরোপুরি সাধু বনে যাওয়ার খবরটা তাদের কানে পোঁছাবার পর তারা প্রথমেই মায়ের শরণাপন্ন হয়েছে। হাশেম বলেছে, ‘ভণ্ডামির একটা সীমা থাকা দরকার। কামাই করার সময় ধর্মকর্ম কোথায় ছিল?’ বেয়াড়া কাশেম বলেছে, ‘মা, বাবা কি পাগল হয়ে গেছে নাকি? গ্রামের জমি বিক্রি করা হয়ে গেলে তো ঢাকার যা কিছু আছে তা-ও বিক্রি করতে আরম্ভ করবে। বাবাকে সাবধান করে দিয়ো, নইলে পাবনায় চলে যেতে হবে।’ ছেলেদের অবস্থানের সাথে দিলরুবা ভূঁইয়া একমত। কিন্তু তিনি সরাসরি সে কথা বলে ছেলেদের কাছে খাটো হতে চান না। তিনি বলেন, ‘তোরা অসভ্যের মতো উলটাপালটা কথা বলবি না। বিক্রি করে দেব বললেই কি বিক্রি করে ফেলতে পারবে? এত সহজ না।’

উলামা পরিষদের মাওলানা ফাইজুল হক পিরোজপুরী সাহেবের ঘনঘন ফোন আসতে থাকায় তওফিক সাহেব বিব্রত হয়ে পড়লে তিনি একাব্বর আলীকে জরুরি তলব করেন। একাব্বর আলী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেও তার কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শুনে তওফিক সাহেব পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েন। জমির দলিল ওদের হাতে না থাকলেও তাদের নামে কেনা সম্পত্তি তারাই দীর্ঘদিন থেকে ভোগদখল করে আসছে এই অজুহাতে তওফিক সাহেবের ভাই-ভাতিজা-শালা- কেউই জমি ছাড়বে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। ভাগ্নে সুলতানও ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করলে তার মা তাকে ধমক দিয়ে বলেছে, ‘মামার লগে নিমকহারামি করিস না; সারাজীবন মামারটাই খাইছস, তোর বাপের কি কিছু আছিলো?’ একাব্বর আলীর আশা যে সুলতানের নামে কেনা জমিটুকু পাওয়া যেতে পারে। অতএব তওফিক সাহেব তার এরাদা পূরণ করার জন্য এমুহূর্তে নিজের নামের ও ভাগ্নে সুলতানের নামে কেনা জমিটুকু বিক্রি করে দিতে পারেন। তাছাড়া সবটুকু না হলেও বাকি জমির কিছু অংশ উদ্ধারের জন্য ভবিষ্যতে তিনি ভোগদখলকারীদের সাথে বোঝাপড়া করার চেষ্টা করতে পারেন।

একাব্বর আলীর চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেয়ে তওফিক সাহেবের মাথা ঘুরে যায়। তিনি লজ্জায়, হতাশায় মুষড়ে পড়েন। আহার-নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় কিছুটা দুর্বলও হয়ে পড়েন। দিনরাত বেশির ভাগ সময় তিনি জায়নামাজে পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। স্ত্রী দিলরুবা স্বামীর এমন বাড়াবাড়িতে ক্রমেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তার কথাবার্তার লাগামও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢিলে হয়ে পড়েছে। তিনি সেদিন বলেই ফেলেছেন, ‘দান-খয়রাত করে তো আর বেহেশত কিনে ফেলতে পারবে না। এত উচাটন হওয়ার কী আছে?’

স্ত্রীর এমন আলটপকা মন্তব্যে তওফিক সাহেব খুব কষ্ট পেলেও তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন না। তিনি সুর নরম করে বলেন, ‘তা তো জানি বউ; কিন্তু আমি চেষ্টা করছি দোযখের পাড়ে যদি একটা বাঁধ তৈরি করতে পারি। এসব কাল সম্পদের বোঝা নিয়ে আমি কবরে ঢুকতে চাই না। আল্লাহর নামে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে তওবা করতে চাই।’

দিলরুবা চড়া গলায় বলেন, ‘কেন? রাক্ষসের মতো গেলার সময় আল্লাহর কথা মনে ছিল না? এখন আল্লাহকে ঘুস দিয়ে খুশি করার জন্য পাগল হয়ে গেছ। নিজের মাথা বন্ধক রেখে যা কামাই করেছ তা কি এখন নিজের বলতে পারবে? নিজের নামে তো কিছু কর নাই। এখন হাউকাউ না করে চুপচাপ বসে তসবিহ টেপো।’

তওফিক সাহেবের মাথা আবার ঘুরে যায়। আসলেই তো, নিজের বললেও তার অবৈধভাবে অর্জন করা সম্পদ তো বেশির ভাগই অন্যদের নামে করেছেন। ধানী জমি নিয়ে সমস্যা তো আছেই। অবশ্য শহরের সম্পদের তুলনায় তা অল্পই। শহরের সম্পদের মধ্যে বসুন্ধরার দুটি প্লট না হয় দুই ছেলে পেয়েছে এবং অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং বানিয়ে তা ভোগ করছে। মেয়ে সোহানার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি রেমিটেন্স আইনের সুবিধা নিয়ে মেয়ের নামে পূর্বাচলে যে প্লট কিনেছেন সে যদি এখন বিশ্বাসঘাতকতা করে তা ফেরত না দেয়! স্যার সলিমুল্লাহ রোডের বর্তমান এই ফ্ল্যাটটিও তো স্ত্রী দিলরুবা ভূইয়াঁর নামে করা – এটা তো সঙ্গত কারণেই ছাড়া যাবে না। মিরপুরের শাহ আলী প্লাজার চারটি দোকান শালার নামে কিনলেও বুদ্ধি করে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিজের নামে নিয়ে রেখেছিলেন। শালা ঝামেলা না করলে হয়তো তিনি সেগুলো কোন শক্তিশালী পার্টির কাছে বিক্রির চেষ্টা করতে পারেন। নিজের নামে বলতে তওফিক সাহেবের পাঁচটি আন্তঃজেলা বাস আছে। অবসরে আসার পর তিনি আরও চারজনকে সাথে নিয়ে কুয়াকাটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেন – বাসগুলো এই কোম্পানিরই আওতাধীন। এ ক্ষেত্রে হয়তো নির্ঝঞ্ঝাটে তিনি তার শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারবেন।

একাব্বর আলী অতি ঘনিষ্ঠ না হলেও তওফিক সাহেবের খুবই বিশ্বস্ত লোক। স্কুলের সহপাঠী হলেও লেখাপড়ায় খুব বেশি এগোতে পারেনি। তবে জমিজমার বিষয়ে খুবই সমঝদার। তার সাহায্য নিয়েই তওফিক সাহেব অধিকাংশ জমি কিনেছেন। এক্ষেত্রে তার সাথে একাব্বর আলী কোনো ফেরেববাজি করেনি। তাছাড়াও মাঝেমধ্যে ঢাকায় এলে সে তওফিক সাহেবের বাসায় দুয়েকদিন থেকে যায়। শৈশবের স্মৃতিচারণ ছাড়াও অন্যান্য বৈষয়িক ব্যাপারেও তওফিক সাহেব একাব্বর আলীর সাথে মত বিনিময় করেন। এখন জমি বিক্রি করতে হলে তো একাব্বর আলীকে তার অবশ্যই প্রয়োজন। এ ছাড়াও কয়েকদিনের জটিল মানসিক টানাপোড়েনে তার মনে যে বিভিন্ন ভাবনার উদয় হয়েছে তা তিনি একাব্বর আলীর সাথে আলোচনা করবেন বলে মনস্থ করেন।

একাব্বর আলী আসার সময় নদীর কিছু তাজা মাছ নিয়ে এসেছিল। তওফিক সাহেব বেশ কয়েকদিন পর তৃপ্তি করে নদীর মাছ দিয়ে পেট পুরে ভাত খেয়েছেন। তারপর একাব্বর আলীকে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে ধনে, মৌরি, কালোজিরা মেশানো পান খেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখেছেন। স্ত্রী শুয়ে পড়ার পর তওফিক সাহেব একাব্বর আলীর ঘনিষ্ঠ হয়ে তার আসল বিষয়ের অবতারণা করেন। একাব্বর আলী তার অনেক কিছু জানলেও তওফিক সাহেব তার জীবনের ঘটনাপঞ্জীর অনেক বাঁক ও মাইলফলকের কথা কিছুটা তৃপ্তির সাথে আবার কিছুটা আক্ষেপের সাথে বর্ণনা করেন। অবশেষে গ্যাঁড়াকলে পড়া বর্তমান অবস্থার কথা অসহায়ের মতো তিনি একাব্বর আলীর কাছে তুলে ধরেন।

একাব্বর আলী তার দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘তুমি তো জান তওফিক মিয়া, আমি অশিক্ষিত মানুষ, তোমারে বুঝ দেয়ার মতো গেয়ান আমার নাই। একলগে কিছুদিন ইশকুলে পড়ছিলাম এইজন্য তুমি আমারে মহব্বত কর। আমিও তোমারে মহব্বত করি; তোমার মতো একজন বড় অফিসার আমার ছোটবেলার সাথি ছিল এইজন্য আমি গর্ব করি…’

তওফিক সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এইসব রাখ, এখন আমারে বুদ্ধি দেও আমি কুনদিকে যামু।’

একাব্বর আলীর মুখের সামনের দিকে ওপর-নিচে দু’টি করে চারটি দাঁত নেই। সে ওই ফোঁকলের মধ্যে তার ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে আরও কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে। তারপর তওফিক সাহেবের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে, ‘পছন্দ করলেও করতে পার, না-ও করতে পার, আমার মাথায় যা আসছে তা কইতে চাই।’

তওফিক সাহেব বেচইন হয়ে বলেন, ‘কও, কও।’

‘তুমি তোমার সম্পদ বেচলেও শান্তি পাইবা না, না বেচলেও পাইবা না। তোমার পরিবার, তোমার আত্মীয়স্বজন তোমারে শান্তিতে বাচতে দিব না।’ একাব্বর আলী একথা বলে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তওফিক সাহেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তিনি ক্যাবলার মতো বলেন, ‘তাইলে কি আমার মুক্তি নাই? আমি তো পাপমুক্ত হইতে চাই, একাব্বর আলী। এখন আমি কী করুম?’

একাব্বর আলী বলে, ‘তুমি যে বুঝতে পারছ, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেছ, এইটা কয়জন করে? তুমি যা করছ তা আরও লক্ষকুটি লোক করছে, কয়জন ফিরা আইছে? আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, তার পরেও আমি তোমারে একটা বুদ্ধি দিতে পারি যদি তোমার মনে ধরে।’


তওফিক সাহেব ধীর স্থিরভাবে বড় একটি স্যুটকেসে তার প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় এবং নথিপত্র গুছিয়ে রেখেছেন। আজ রাতেই তিনি রওয়ানা দেবেন। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে তিনি খুব শান্তভাবে উত্তর দিয়েছেন যে তিনি তবলিগের চিল্লায় বেরোবেন। গত দুই মাস তিনি পুরোপুরি শান্ত ছিলেন; সম্পত্তি বিক্রি বা মসজিদ-মাদ্রাসার দান-খয়রাত নিয়ে পরিবারের কারুর সাথে কথাবার্তা বলেননি। তবে বিভিন্ন কাজের অছিলায় বেশ কয়েকবার ঘরের বাইরে গিয়েছেন। দিলরুবা ভূইয়াঁ এই ভেবে আনন্দিত হয়েছেন যে তার স্বামীর পাগলামি রোগ ভাল হয়ে গেছে।

রাত দশটার দিকে একটি টেলিফোন কল এলে তওফিক সাহেব স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমে অপেক্ষমাণ অটোরিকশায় ওঠেন। অটোরিকশায় একাব্বর আলীও আছে। তারা সোজা ফকিরাপুল গিয়ে রাঙ্গামাটিগামী নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়েন। গাড়িতে উঠেই তওফিক সাহেব তার মোবাইল ফোনের সিম খুলে ফেলে দেন।

আলমারির যে ড্রয়ারে সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ রাখা আছে সেখানে তওফিক সাহেব বিভিন্ন নামে কয়েকটি খাম রেখে এসেছেন। খামের ভেতরের চিঠির মূল বার্তা একই “……এই সম্পত্তি যদিও তোমার নামে করা হয়েছে, এর মালিক তুমি না, আমিও না। এ আমার পাপের ফসল। পাপমুক্তির জন্য আমি আল্লাহ্‌র নামে তা বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা তা হতে দিলে না। এখন পাপের দায়ভাগ তোমাদের ওপর বর্তাবে। আর যদি তা তোমরা আল্লাহ্‌র নামে ছেড়ে দাও তবে তোমরা নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে। আমি আমার অপরাধের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চেয়েই যাব। ইতি – তওফিক এলাহী”

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে একাব্বর আলীর আত্মীয়সহ বেশ কয়েকটি বাঙালি পরিবার আছে। কিন্তু তাদের কোনো জামে মসজিদ নেই। পরিকল্পনামাফিক তওফিক সাহেব ওখানে একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করবেন। তাছাড়া নিজে থাকার জন্য একটি ছোট ঘরও বানাবেন। একাব্বর আলী ছুটোছুটি করে সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে রেখেছে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় জায়গা বায়না করা হয়ে গেছে। মিস্ত্রী, নির্মাণসামগ্রীর ব্যাপারেও কথাবার্তা মোটামুটি পাকা। তওফিক সাহেব গন্তব্যে পৌঁছামাত্র অনতিবিলম্বে সবকিছু নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কেননা জমি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত টাকা উলামা পরিষদের হাতে দিয়ে এলেও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির শেয়ার এবং শাহ আলী প্লাজার দোকান বিক্রি করে যে টাকা তিনি পেয়েছেন তাতে তার বিলাইছড়ি প্রকল্প ভালভাবেই সম্পন্ন হবে। আর খাওয়াপরার জন্য পেনশনের টাকাই যথেষ্ট।

তাদের মূল গন্তব্য বিলাইছড়িতে গিয়ে পৌঁছলে তওফিক সাহেব আয়েশি ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে মুক্তির আনন্দে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে সশব্দে উচ্চারণ করেন ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জুলফিকার নোমান অভিনন্দন, সেই সাথে শুভ কামনা রইলো।
সাদিক হাসান আসলেই অসাধারণ
আপনি পড়েছেন এতেই আমি খুশি। অনেক ধন্যবাদ।
বিষণ্ন সুমন ভাই আপনার গল্প পড়ে মুখ থেকে কেবল একটা শব্দই বেরিয়ে আসে, অসাধারণ।
আমার সীমাবদ্ধতা জানি, তবু আপনার মুক্তোর হার ভাল লাগে। অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ মাইদুল সরকার সুন্দর গল্প।++++
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ফয়জুল মহী চমৎকার প্রকাশ l পাঠে বিমোহিত হলাম শুভকামনা অবিরত
অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

মাগরেবের আজান পড়েছে।। তওফিক সাহেব মনোযোগ দিয়ে আজানের ধ্বনি শোনেন।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৫১ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৩৮

বিচারক স্কোরঃ ২.৬৮ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৭ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী