অসুর বধ

একটি নতুন সূর্য (ডিসেম্বর ২০২৩)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ৩৯
একটু ডাগর হওয়ার পর দাদাজানের দেয়া নাম চাঁদনী তার আর ভাল লাগে না। ভারী ভারী, খেত খেত। উপরন্তু, দুষ্ট বান্ধবীগুলো মূল নামের ওপর আধুনিকতার প্রসাধন লেপে তাকে যখন চুন্নি ডাকা আরম্ভ করে তখন তারও কেমন স্মার্ট স্মার্ট লাগছিল। কিন্তু গোল বাঁধালেন দাদাজান। একদিন বিন্তি এসে দাদাজানের সামনে যখন চাঁদনিকে চুন্নি নামে ডাকতে আরম্ভ করল তখন দাদাজান ভুরু বাঁকা করে বিন্তির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই যে মিস, এখানে চুন্নি কে? আমি তো শুধু বিন্তি আর চাঁদনিকে দেখতে পাচ্ছি।’

বিন্তি তখন খিলখিল হেসে উঠে বলে, ‘আমরাই চুন্নি নামটি আবিষ্কার করেছি, দাদাজান। চাঁদনি নাম কেমন ভারিক্কি ভারিক্কি লাগে।’

চাঁদনি কিছু বলে না যদিও তার অস্বস্তি লাগে। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক দাদা এখন নাম নিয়ে হয়তো একটি লম্বা বক্তৃতা দিয়ে বসবেন।

হলোও তাই। দাদাজান বলেন, ‘ভাল কথা, সেকেলে নাম বাদ দিয়ে বান্ধবীর জন্য চোস্ত নাম বেছে নিয়েছ; চুন্নি নামের অর্থ কী, জানো?’

দাদার কথায় বিন্তি চাঁদনি দুজনে এক সাথে ঘাড় ফিরিয়ে দাদার দিকে বোকার মতো তাকায়। এর অর্থ হলো তাদের দুজনের কেউই চুন্নি শব্দের অর্থ জানে না।

দাদা এবার বিজ্ঞজনের মতো বলেন, ‘চোরের বউ হলো চুন্নি! তবে অসুবিধা নেই, অর্থ যাই হোক নামটা একহারা, জিহ্বায় আটকাবে না।’

এবার চাঁদনি আর বিন্তি যুগপৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে। বিন্তি বলে, ‘স্কুলে গিয়ে তোর নামের অর্থ চাউর করে দেব।’

চাঁদনি চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘খবরদার ফাজলামি করবি না।’

এ যুগের ছেলেমেয়েরা ভীষণ স্মার্ট। পঁচাত্তরোর্ধ্ব দাদাজান তা আরও ভাল করে জানেন কেননা তিনি সারাজীবন চেংড়াদের সাথেই কাটিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি অন্য কোনো পেশা অনায়াসেই গ্রহণ করতে পারতেন কিংবা আরও অনেকের মতো রাজনীতি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকতাই বেছে নিয়েছিলেন। আদর্শ জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে এক ছেলে ও দুই মেয়েকে যথাসাধ্য ভাল শিক্ষাদান করেছেন। বড় মেয়ে হুসনা শ্বশুরবাড়ির অনিচ্ছার কারণে চাকরিবাকরি না করলেও ছোট মেয়ে হাসনা জুট মিল কর্পোরেশনে মোটামুটি ভাল পদেই চাকরি করছে। ছেলে আশফাক একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত।

সোজা-সরল আদর্শ মানুষটি স্ত্রী হারিয়েছেন করোনার প্রথম ধাক্কায়। নানাবিধ অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত স্ত্রীর শরীর আগ্রাসী মহামারীর সামনে দাঁড়াতেই পারেননি। এরপর থেকে আশরাফ মজুমদার অর্থাৎ চাঁদনির দাদাজান মানসিকভাবে অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। তাঁর ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে আদর্শের প্রবল উপস্থিতি ছিল তা যুগের পরিবর্তনের কারণে নাতি-নাতনির মধ্যে ততটা নেই – এ বিষয়টাও তাকে কষ্ট দেয়। এই যেমন তাঁর নাতি আফজালকে তাঁরা কেউ আটকে রাখতে পারলেন না; বিদেশি ডিগ্রি লাগবে বলে সে জার্মানিতে চলেই গেল। আশরাফ সাহেবের খুব ইচ্ছে ছিল নাতিকে ডাক্তারি পড়াবেন, কিন্তু তা আর হলো কই। তাই এখন চাঁদনিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন এবং তাকে ডাক্তার বানানোর যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গ্রিন স্কোয়ারের যে ফ্ল্যাটে আশরাফ সাহেব অবসর যাপন করছেন তা মূলত তাঁর চাকরি শেষে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কেনা। অবশ্য এর ক্ষুদ্র একটি অংশ ছেলে যোগান দিয়েছে। অবসরে যাওয়ার পর কিছুদিন নাতি-নাতনিদের লেখাপড়ার ওপর নজরদারি রাখলেও শেষপর্যন্ত ধৈর্যে কুলায়নি। সঙ্গত কারণে বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তাদের কোচিং-এ যেতে হয়েছে। আশরাফ সাহেব তাই মূলত নামাজ-কালাম, বই ও সংবাদপত্র পড়া এবং বাজার সদাই নিয়েই সময় কাটাচ্ছেন। তবে একথা সত্য, তাঁর উপস্থিতি নাতি-নাতনিসহ পুরো পরিবারের ওপর একটা প্রভাব বিস্তার করে আছে। বাবার জন্যই আশফাককে তার ছেলেমেয়ে তথা পরিবার নিয়ে বেশি ভাবতে হয় না। বিশেষ করে মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে বদলি হলেও সে বাবার ওপর ভরসা করে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকে।

আদর্শবান মানুষ হওয়ার কারণেই হয়তো দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আশরাফ সাহেবকে খুব ভাবায়। কেন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন এবং অর্ধশতাব্দী পরে দেশ আজকে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা চিন্তা করলে তিনি খুবই কষ্ট পান। এখন খবরের কাগজ খুললেই তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে। পাতার পর পাতা উল্টিয়ে তিনি দুয়েকটা ভাল খবরের সন্ধান করেন। বেশি ভয় পান হালের প্রজন্মের উচ্ছন্নে যাওয়া দেখে। হাস্যকর হলেও রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে থামে পেঁচানো টেলিফোন, ইন্টারনেট এবং ক্যাবল টিভির জটপাকানো তারগুলোর দিকে তাকালেই আশরাফ সাহেবের মস্তিষ্কের তন্ত্রীগুলো এলোমেলো হয়ে যায় এবং তখনই এসময়কার তারুণ্যের চিত্র তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সমাজে কত কী যে ঘটছে: আপাদমস্তক দুর্নীতি ছাড়াও খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, অরাজকতা, বেলেল্লাপনা, পরকীয়া, ধর্ষণ কী অবলীলায় সমাজে আসন পেতে বসে আছে।

ভাগ্যিস – আশরাফ সাহেব এই ভেবে কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন - নাতি আফজাল গড্ডলিকায় ভেসে যাওয়ার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। খাম্বায় ঝোলানো তারের জটের মতো সমাজে এদেশের তরুণরা কী করতে পারবে? আফজালই বা কী করতে পারত? পশ্চিমা দেশের জীবনযাত্রা এবং মূল্যবোধ ভিন্ন হলেও আমাদের দেশের মতো পচে যাওয়ার সহজ পথ নেই। কিন্তু এতেও আশরাফ সাহেবের দুশ্চিন্তা পিছুছাড়া হয়নি। মেয়েদের সন্তানসন্ততির কথা বাদ দিলেও নিজের ঘরে থাকা পৌত্রীকে নিয়ে ভাবতে গেলে তাঁর কপাল কুঁচকে যায়।

দাদাজান খুব ভালবাসেন চাঁদনিকে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কিংবা পেনশনের টাকা তুললে সবার অজান্তে নাতনির হাতে দু’তিন হাজার টাকা তুলে দেন। অবশ্য মেয়েরা বেড়াতে এলে তাদের ছেলেমেয়েদেরও তিনি সুইটস খাওয়ার পয়সা দিতে ভোলেন না। এসব কিছুর পরও চাঁদনির জন্য বেশি ভাবনা হয় আশরাফ সাহেবের। এই বয়সের ছেলেমেয়েরাই বিপদকে আহ্বান করে কিংবা সহজেই বিপদে পড়ে। সময়ের পরিবর্তনে মানুষ যেমন অনেক বেশি স্বাধীন হয়েছে তেমনি হয়েছে অরক্ষিতও।

প্রমোশন হওয়ার পর আশফাককে ছয় মাসের জন্য কুমিল্লায় পাঠানো হয়েছে। তবে প্রতি সপ্তায় না হলেও অন্তত পনর দিনে একবার ঢাকায় এসে সে পরিবারের সাথে ছুটি কাটিয়ে যায়। ছেলে সাথে না থাকলে আশরাফ সাহেবের চাপ একটু বেড়ে যায়। তিনি পরিবারের সার্বিক ব্যাপারে অধিক সচেতন হয়ে পড়েন। চাঁদনি বাসায় ফিরে না আসা পর্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকেন। কাঁঠাল বাগানে রফিক স্যারের কাছে প্রাইভেট টিউশন শেষ করে কোনোদিন চাঁদনির ফিরতে একটু দেরি হলে তিনি হৈচৈ আরম্ভ করে দেন।

চাঁদনি বলে, ‘দাদাজান, আপনি এত অস্থির হয়ে পড়েন কেন? বিন্তি, রোকেয়া, মেরী, আমি – আমরা একসাথে স্যারের কাছে পড়তে যাই না?’

দাদাজান বলেন, ‘যাস, ঠিক আছে। কিন্তু দেরি হলেই তো টেনশনে পড়ে যাই। রাস্তাঘাট, যানবাহন, মানুষ কিছুই তো ঠিক নাই আজকাল।’

চাঁদনি নিশ্চিত করে, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, দাদাজান। আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।

আশরাফ সাহেবকে মাসে অন্তত একবার পান্থপথের এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে যেতে হয়। তিনি আগে একাই ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছেন। কিন্তু ইদানীং চাঁদনির মা শ্বশুরকে একা ছাড়তে চায় না। চাঁদনিকে সাথে দিয়ে দেয়। একদিন ডাক্তার দেখিয়ে রিক্সায় করে ফেরার পথে দাদাজান চাঁদনিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোকে তো ঝামেলায় ফেলে দিলাম দিদিমণি।’

চাঁদনি বলে, ‘কেন দাদাজান, কী ঝামেলা?’

‘এই যে, তোর টিউটরের কাছে যাওয়া হলো না’, দাদাজান বলেন।

চাঁদনি বলে, ‘ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। স্যার এটা মেক আপ করে দেবেন। খুব ভাল লোক।’

যানজটে রিক্সা দাঁড়িয়ে পড়লে আশরাফ সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, ওই টিউটর তো তোদের হলিক্রস স্কুলের শিক্ষক, তাই না?’

‘হ্যাঁ, খুবই ভাল শিক্ষক। এক বছর হয় জয়েন করেছেন।’

‘তো, বাসায় কোচিং করান, বাসার লোকজনদের অসুবিধা হয় না?’, দাদাজান কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করেন।

চাঁদনি বলে, ‘আরে না। আমরা কয়েক ব্যাচ মেয়েই তো পড়ি। তাছাড়া স্যার বাসায় একাই থাকেন, বিয়েটিয়ে করেননি।’

চাঁদনির কথায় আশরাফ সাহেব কেন জানি একটু আঁতকে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘ও আচ্ছা, তোমরা তো ব্যাচ করে পড়তে যাও। নিশ্চয়ই খুব ভাল পড়ান তিনি?’

চাঁদনি বলে, ‘খুব! তাঁর স্টুডেন্টরা এবার এসএসসিতে খুব ভাল রিজাল্ট করেছে। এজন্য তো আমরা পড়তে যাই।’

আশরাফ সাহেব আর কিছু বলেন না।

চাঁদনির সামনে এখন এসএসসি পরীক্ষা। তার মুখ দেখলেই বুঝা যায় সে খুব টেনশনে আছে। কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে বাসায় বিন্তিকে নিয়ে এলেও তারা এতোই ব্যস্ততার মধ্যে থাকে যে দাদাজানের সাথে আগের মতো কথা বলার সময় পায় না। টেবিলে বসে বইখাতা নাড়াচাড়া করতে করতে তারা নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে কথা বলে; আগের মতো খিলখিল করে না। তাদের এই আদা-জল খাওয়া একাগ্রতার ভেতর কখনও কখনও দাদাজান নিজ থেকেই ঢুকে পড়েন, ‘কীরে, তোরা কীসের মধ্যে ডুবে আছিস যে আশেপাশের কাউকে দেখতে পাস না?’

বিন্তিই উত্তর দেয়, ‘আর বলেন না, দাদাজান। খুব টেনশনে আছি। দোয়া করবেন পরীক্ষাটা যেন ভাল হয়। তারপর আবার জমিয়ে গল্প করব।’

দাদাজান বলেন, ‘টেনশনের কিছু নেই; শুধু রাইট ট্র্যাকে থাকলেই হল। ফল ইনশাল্লাহ ভাল হবে।’

এক মাস পরই চাঁদনির টেস্ট পরীক্ষা। সেজন্য চাঁদনির বাবা-মা’র চেয়ে আশরাফ সাহেবই বেশি উদ্বিগ্ন। অবশ্য শুধু চাঁদনিকে নিয়ে নয় আরও বহুমুখী চিন্তার জটে তিনি আটকে আছেন। স্ত্রী বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর সাথে চিন্তাভাবনা কিছুটা ভাগাভাগি করতে পারতেন। আর, বন্ধুবান্ধবও অধিকাংশ গত হয়েছেন। যে দুয়েকজন এখনও বেঁচে আছেন তাদের সাথে দেখাসাক্ষাতের সুযোগ কম। কদাচিৎ ফোনে কথাবার্তা হলেও লম্বা সময় ধরে গসিপ করার মতো এনার্জি কারুরই নেই।

যতই দিন যাচ্ছে চাঁদনি আরও বেশি বেশি অন্তর্মুখী হচ্ছে। আশরাফ সাহেব সুযোগ পেলেই প্রবোধ দেন, ‘এত ভাবিস না দিদিমণি, তুই তো ভালভাবেই পাশ করবি। দেখেছিস, খামাকা চাপ নিয়ে কেমন কাহিল হয়ে পড়েছিস?’

চাঁদনি পারতপক্ষে দাদাজানের কথার জবাব দেয় না। কিংবা একটু মুচকি হেসেই সে আবার বইখাতায় ডুবে যায়।

কিছুদিন ধরে বিন্তিও আসছে না। নিশ্চয়ই সে-ও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। শেষ এসেছিল যেদিন চাঁদনি বাইরে কী খেয়ে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেদিন। ফুড পয়জনিং হয়েছিল বলে বমিও করেছিল। বিন্তিই তড়িঘড়ি করে ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ কিনে দিয়ে গিয়েছিল। চাঁদনির শরীরটা এখনও পুরো ঠিক হয়নি। আশরাফ সাহেব ভেবেছিলেন সপ্তাহান্তে ছেলে বাসায় এলে তার মেয়েকে একজন ভাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু কাজের চাপ থাকায় আশফাকের এ সপ্তায় আসা হয়নি।

পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসায় চাঁদনিদের এখন আর প্রতিদিন টিউটরের কাছে যেতে হচ্ছে না। তবে বিশেষ প্রয়োজনে যেতে হলে বিন্তি আর চাঁদনি একসাথেই যায়। আজ বিকেলের দিকেও তারা দুজন টিউটরের উদ্দেশে বেরিয়েছে। আশরাফ সাহেব সাবধান করে দিয়েছেন, ‘সন্ধ্যার আগে আগেই কিন্তু চলে আসবি।’

কিন্তু সন্ধ্যার আগে চাঁদনি ফিরে না আসায় আশরাফ সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। চাঁদনির মা-ও একবার শ্বশুরের কাছে এসে চাঁদনির কথা জিজ্ঞেস করেন। আশরাফ সাহেব বলেন, ‘তুমি চিন্তা করো না, বৌমা। আমি নামাজ পড়েই খোঁজ নিচ্ছি।’

মাগরেবের নামাজ পড়ে আশরাফ সাহেব চাঁদনিকে ফোন করেন। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও তার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আশরাফ সাহেব অশান্ত হয়ে ওঠেন। কী আশ্চর্য! চাঁদনির ফোন বন্ধ। তিনি চেঁচিয়ে বৌমাকে বলেন, ‘তোমার কাছে বিন্তির নম্বর আছে নাকি, মা? চাঁদনি তো ফোন ধরছে না।’ চাঁদনির মা কাতর হয়ে বলেন, ‘না আব্বা, আমার কাছে বিন্তির নম্বর নেই।’

ঠিক তখনই বিন্তি আশরাফ সাহেবের কাছে ফোন করে, ‘দাদাজান! আন্টিকে কিছু বলবেন না; আপনি একটু সেন্ট্রাল হসপিটালে আসুন। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’

আশরাফ সাহেব কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘চাঁদনি কেমন আছে?’

বিন্তি বলে, ‘আছে। ভাল আছে। আপনি একটু কষ্ট করে আসুন, দাদাজান।’

আশরাফ সাহেবের ভেতরে ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা এখন প্রকাশ করা যাবে না। তিনি বউমাকে বলেন, ‘চাঁদনির শরীর খারাপ করেছে। এখন ডাক্তারের কাছে আছে। তুমি চিন্তা করো না; আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসব।’ তারপর তিনি দ্রুত বেরিয়ে যান।

আশরাফ সাহেব হৃদরোগের রুগি একথা বিন্তিও জানে। তাঁকে শান্ত রাখার জন্য বিন্তি তাকে জড়িয়ে ধরে হাসপাতালের চেয়ারে বসে থাকে। সে বলে, ‘দাদাজান, চাঁদনি এখন আউট অব ডেঞ্জার; আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না। দেখি, একটু পরে ডাক্তার ছেড়ে দিলে তাকে বাসায় নিয়ে যাব।’

আশরাফ সাহেব মুখে কিছু না বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বিন্তির দিকে তাকান। তাঁর চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি ভীত এবং ক্লিষ্ট।

বিন্তি তাই অনন্যোপায় হয়ে দুয়েকটা মন্তব্য করে তার দায়িত্ব পালন করে। যেমন, ‘কেন সে এমন বোকামি করল। আমাকেও কিছু বলেনি কখনও। বাথরুমে ঢুকেই দুম করে বিষ খেয়ে বসল।’

বিন্তি যে একেবারে কিছু জানত না একথা আশরাফ সাহেব কেন কেউই বিশ্বাস করবে না। তিনি দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করেন, ‘ওই বাস্টার্ড মাস্টার কোথায়?’

বিন্তি কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ‘বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে চাঁদনিকে সে-ই বের করেছিল; তারপর হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছেও দিয়েছিল। এরপর থেকে তাকে দেখতে পাচ্ছি না।’

প্রায় আধাঘন্টা পর একজন অল্পবয়সী ডাক্তার চাঁদনির অভিভাবকের খোঁজ করলে আশরাফ সাহেব এগিয়ে যান, সাথে বিন্তিও।

ডাক্তার তার হাতের রিপোর্ট দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে, ‘কী যে অবস্থা!’ তারপর আশরাফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ও আপনার কী হয়?’

আশরাফ সাহেব আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন, ‘নাতনি।’

ডাক্তার বলে, ‘ও তো কনসিভ করেছে – বিয়ে নিশ্চয় হয়নি?’ বলে তেরচা চোখে তাকায়। ডাক্তার উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে, ‘ওর স্টমাক পরিস্কার করা হয়েছে; রক্ষা, হারপিক খেয়েছিল। তবে আরও দুই তিনদিন থাকতে হবে। কী করতে হবে অনুসন্ধান থেকে বিস্তারিত জেনে নিন।’

আশরাফ সাহেব যতই থরথর করে কাঁপছেন বিন্তি ভয়ে ততই আড়ষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারের কক্ষ থেকে বেরিয়েই আশরাফ সাহেব খপ করে বিন্তির হাত ধরে বলেন, ‘চল।’ তাঁর চোখ লাল হয়ে আছে। তাঁর দৃষ্টি এখন তমসায় আচ্ছন্ন। কোথাও কোনো প্রদীপ নেই, তারা নেই, চাঁদ নেই, সূর্য নেই। তার হয়তো মনে পড়ছে নিকষ কাল এরকম এক অন্ধকার রাতে তিনি জীবন বাজি রেখে আলোর খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তারপর দীর্ঘ সময় রক্ত সিঞ্চনের পর পূর্ব দিগন্ত হতে এক নতুন সূর্য জাতির ভাগ্যাকাশে টেনে তুলেছিলেন। কিন্তু অর্ধশতাব্দীর খাবলাখাবলিতে সেই উজ্জ্বল সূর্য আঁধারের পেটে বিলীন হয়ে গেল। এখন কী হবে? এই আঁধারের পর্দা ছিঁড়ে আরেকটি নূতন সূর্য ছিনিয়ে আনবে সেই অরুণ প্রাতের তরুণদল কই? এই পচে যাওয়া সময়ে সুস্থ তারুণ্যই বা কোথায়?

বিন্তি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘দাদাজান, কোথায় যাবেন এখন?’

আশরাফ সাহেব হেঁচকা টানে বিন্তিকে নিয়ে সামনে কদম ফেলে গর্জে ওঠেন, ‘অসুর বধ করতে যাব।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুন্দর সাবলীল উপস্থাপন ।
অনেক ধন্যবাদ।
অথই মিষ্টি সুন্দর হয়েছে
অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

একটু ডাগর হওয়ার পর দাদাজানের দেয়া নাম চাঁদনী তার আর ভাল লাগে না।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ভালবাসা”
কবিতার বিষয় "ভালবাসা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জানুয়ারী,২০২৫