রাফির ফ্লাইট কনফার্মড; মাত্র দু’দিন পর যাত্রা। টার্কিশ এয়ারে ইস্তাম্বুল যেতে হবে প্রথমে, সেখান থেকে ডালাস। একটু লম্বা সময় নিলেও ভাড়া তুলনামূলক কম। খরচ বাঁচানোর জন্য রাফিও তাই করেছে। আজকে সে তার বিশেষ বন্ধু ফয়সলকে দুপুরে চিলক্সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সাথে সায়মাকেও।
গত সপ্তায় কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বনানীর ইয়াম চা ডিস্ট্রিক্টে ডিনারের জন্য ডেকেছিল রাফি। সবই তার ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ড, শুধু রাজীবের বউটি ছাড়া। রাজীব ছাড়া বাকিরা এখনও বিয়ের গিলোটিনে মাথা রাখেনি। সোহেলই ভাগ্যবান, সে বিসিএসে টিকে গিয়েছে; শিগগিরই যোগ দেবে অ্যাডমিন ক্যাডারে। বাকিরা এখানে ওখানে টুকটাক করছে, কিন্তু জুতসই ক্যারিয়ার পাথ ধরতে পারেনি। তবে এসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি বন্ধুদের জম্পেশ আড্ডায় প্রভাব ফেলতে পারেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেও ফয়সলের সাথে রাফির ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। ঢাকা কলেজে একসাথে পড়েছে। তাদের কথাই ছিল, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা দুজন টিকে যাবে সেখানে একসাথে ভর্তি হবে। টিকেছে জাহাঙ্গীরনগরে, অবশ্য সাবজেক্ট ভিন্ন। রাফি সিএসই এবং ফয়সল পরিসংখ্যানে।
দুই সপ্তাহের জন্য দেশে এলেও রাফি ফয়সলের সঙ্গেই বেশি সময় কাটিয়েছে। ফয়সল অবশ্য আগেভাগেই কৈফিয়ত জানিয়ে রেখেছে ফয়সলকে, ‘দোস্ত জানিস তো, প্রাইভেট কলেজ, ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। তোর সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে পারছি না।’ তার পরও সে অবসর ও অফ ডে’র পুরো সময় রাফির সাথে কাটিয়েছে। এক শুক্রবারে তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসও দেখতে গিয়েছে তারা। সাথে সায়মাও ছিল।
সাভারের পথে উবারে যেতে যেতে রাফি সায়মাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তোমারও তো প্রায় শেষ। কী প্ল্যান, মিস?’
সায়মা হেসেই জবাব দিয়েছে। বলেছে, ‘দেখি, কিছু একটা তো করতে হবে। আমি তো ভাই আপনাদের মতো ভাল সাবজেক্ট নিয়ে পড়িনি।’
‘কেন? ইংলিশের তো হাই ডিমান্ড আছে। আর কিছু না হোক, বিসিএস দিয়ে সরকারি কলেজে ঢুকে পড়তে পারলে আর কী?’, রাফি বলে।
সায়মা উষ্মা নিয়ে বলে, ‘দেখেন না আরেকজন তো কলেজে মাস্টারি করছে, কিন্তু এখনও স্থির হতে পারছে না। বাইরে যাবার জন্য দাপাদাপি করছে। মানে সব মিলিয়ে কেমন অচলাবস্থা।’
ফয়সল চুপ করেই বসেছিল। রাফি তাকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কীরে, কী ভাবছিস? ঝিম মেরে বসে থাকলে হবে নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম, দেশে এসে তোদের শুভ অনুষ্ঠানে যোগ দেব। তোর প্ল্যান কী?’
সায়মাই ফয়সলকে উদ্দেশ করে বলে, ‘ওমা! তুমি রাফি ভাইকে কিছু বলনি?’
‘না, ডিটেইল কিছু বলা হয়নি।’ ফয়সল বলে, ‘তবে একটু হিন্ট দিয়েছি।’
বন্ধুমহলে সুদর্শন ফয়সল অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। তার নায়কোচিত দেহকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ে কত তরুণীর মনে ঝড় তুলেছে তার ইয়ত্তা নেই। বিভিন্ন বাহানায় কাছেও এসেছে অনেকে। কিন্তু সবাইকে ডিঙ্গিয়ে সায়মা যখন ফয়সলের হৃদয়ের তন্ত্রীতে টুং টাং সুর ভাজতে আরম্ভ করে তখন অন্যদের দৃষ্টি বলাবাহুল্য তির্যক হয়ে যায়। দু’বছরের কনিষ্ঠ সায়মা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেই ফয়সলের দখল নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কমনীয় ও শান্ত স্বভাবের সায়মাকে রাফিসহ অনেকেরই মনে ধরে। তবে ফয়সলেরই ভাগ্যের শিকা ছেঁড়ে।
রাফি আক্ষেপ করে বলত, ‘আল্লাহ আমাদের এমন রমনীমোহন করে বানাননি রে!’ রাফির ক্ষেত্রে কথাটি অধিক সত্যি। মেধাবী হলেও তার গায়ের রং যেমন অনুজ্জ্বল তেমনি তার উচ্চতাও মান-অনুত্তীর্ণ। হয়তো এ কারণেই তার প্রেম-টেম না হওয়ার মনের মধ্যে একটা সুপ্ত খেদ আছে। এজন্যই হয়তো বিধাতা তাকে অন্যভাবে পুষিয়ে দিয়েছেন। সে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও একাগ্রতায় ডালাসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পন্সরশীপের আওতায় কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করার একটি সুযোগ বাগিয়ে নেয়। সৌভাগ্য আরও প্রসন্ন হওয়ায় সে পিএইচডি করার সুযোগও পেয়ে গেছে। বাবা-মার চাপেই সে এবার দেশে এসেছে। তাঁদের কথা হল, পণ্ডিত হও আর যা-ই হও দেশে এসে দেখেশুনে একটা বিয়ে করে তোমার বউকে নিয়ে যাও, নইলে বলা তো যায় না আমেরিকার মতো দেশে কখন কী ঘটে যায়।
নায়কোচিত ফিগার হলেও দু’দুবার বিসিএসে ব্যর্থ হয়ে ফয়সল হতাশ হয়ে পড়ে। এই হতাশা সায়মাকেও কিছুটা স্পর্শ করে। মেয়ের পছন্দের কথা বাবা-মা জানেন বলে সায়মার বিয়ের কথাবার্তা তাঁরা তুলতে পারেন না। সায়মা তাঁদের বলেছে, ফয়সলের একটা ভাল চাকরি হয়ে গেলেই সে আর দেরি করবে না। কিন্তু শিক্ষকতার যে চাকরি ফয়সল পেয়েছে এটাতে সে যেমন সন্তুষ্ট নয়, তেমনি সায়মাও নয়।
ক্যাম্পাসের ফুরফুরে জীবন আর ক্যাম্পাসবিচ্ছিন্ন জীবনমুখী ঘোড়দৌড় এক জিনিস নয়। কেউ কেউ সে দৌড়ে শেষ সীমানা স্পর্শ করতে পারলেও অনেকে পারে না। ফয়সলও দৃশ্যত সেরকম অকৃতকার্য একজন। এখন সে বাইরে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইউএসএ কানাডায় সম্ভাবনা কম বলে সে ইউরোপের কিছু দেশে বিনা খর্চায় পড়ার সুযোগ খুঁজছে। স্কলারশিপ পাওয়া দুরূহ হলেও জার্মানী ও নেদারল্যান্ডসে টিউশন ফি-মুক্ত পড়াশোনার সুযোগ আছে। সে এখন অগত্যা এরকম একটি সুযোগ বেছে নেবে বলে মনে হয়।
আত্মসম্মানের জন্য কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক ফয়সল তার হতাশা বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে রাফির সাথে বিস্তারিত কথা বলেনি। তবে সায়মা ফয়সলের অগোচরেই রাফির সাথে এব্যাপারে অনেক কথা বলে ফেলেছে। একাধিকবার ফোন করে রাফির সাথে গল্পগুজবের ফাঁকে ফাঁকে ফয়সলের কথা এবং একই সাথে তাদের অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা উৎকণ্ঠার সাথেই আলাপ করেছে।
রাফি সায়মার কথা শুনে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে এবং নিরাশ না হওয়ার উপদেশ দিয়েছে। সে এ-ও বলেছে যে ফয়সল চাইলে যে কোনো সহযোগিতায় সে এগিয়ে আসবে।
তখন সায়মা বলেছে, ‘না না রাফি ভাই, ফয়সলকে এসব শোনাতে যাবেন না। সে মাইণ্ড করতে পারে।’
রাফি সাথে সাথে বলেছে, ‘আমি তো শুধু ফয়সলের কথা ভাবছি না, তোমার কথাও ভাবছি।’ তারপর একটু রসিকতা করে বলেছে, ‘তুমি তো ফয়সলকে পছন্দ করে কেবল এক দঙ্গল মেয়ের শত্রু হওনি, এক পাল ছেলের বুকও মরুভূমি করে দিয়েছ।’
সায়মা খিল খিল করে উঠে বলেছে, ‘আপনিও কি মরুভূমির উট?’
রাফি বলেছে, ‘সে সব কথা এখন বাসি। এখন তোমাদের পথটাই সুগম হোক।’ বলে, নিজেরই অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তখনই সায়মা বলেছিল, ‘আব্বা-আম্মার কাছে আপনার গল্প করেছি। তাঁরা বলেছেন: ছেলেটাকে আসতে বল না, আবার বিদেশে চলে যাবে, একবেলা আমাদের সাথে খেয়ে যাক।’
রাফি চমকে উঠে বলেছে, ‘তাই নাকি?’
‘সিরিয়াস।’ সায়মা জোরালোভাবে বলেছে, ‘আসেন না কাল দুপুরে, প্লিজ। আব্বা-আম্মা খুব খুশি হবেন।’
রাফি একটু ভেবে বলেছে, ‘তাহলে তো ফয়সলকেও বলতে হয়।’
সায়মা বলেছে, ‘ফয়সলকে বললে আসবে না, তাছাড়া তার তো কলেজ আছে।’ একটু থেমে সে আবার বলেছে, ‘আমার মনে হয় এব্যাপারটা ফয়সলকে জানানোরও দরকার নেই।’
প্রতিদিনকার মতো ফয়সলের সাথে রাফির সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে, আড্ডাবাজি হয়েছে। কিন্তু সায়মার সাথে তার কথোপকথনের কিছুই সে ফয়সলকে বলেনি। শুধু নিমন্ত্রণের কথা নয়, ফয়সলের অজ্ঞাতে সে সায়মার সাথে যে আরও কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে তা-ও কখনও উল্লেখ করেনি। ফয়সল চলে যাবার পর রাফি চোখ বুজে এ ক’দিনে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে জোড়া লাগাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে তার বুকের ভেতর এক ধরণের অপরাধবোধ চিনচিন করে ওঠে।
কিছু ফলমূল এবং মিষ্টি নিয়ে রাফি যথাসময়ে সায়মাদের কাজীপাড়ার বাসায় হাজির হয়। সায়মার পিতা মাকসুদ শিকদার সকালবেলা তাঁর রিয়েল এস্টেট প্রজেক্ট কাজ সেরে এসেছেন। তিনি রাফিকে আন্তরিকতার সাথেই স্বাগত জানান।
হালকা চা-নাশতা খেতে খেতে সায়মার আব্বা-আম্মা রাফির কুশল জিজ্ঞেস করেন, তার জাহাঙ্গীরনগর জীবনের টুকিটাকিও জিজ্ঞেস করেন। এসব খুবই সাধারণ সৌজন্য আলাপচারিতা।
খাবার টেবিলে বসে মাকসুদ সাহেব রাফির উদ্দেশে বলেন, ‘সায়মার কাছ থেকে তোমার একাডেমিক এক্সেলেন্সের কথা শুনে ভাল লাগল। পিএইচডি করে নিলে তো অনেক সম্ভাবনা সামনে চলে আসবে। তোমার বাবা-মা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এখনই বিয়েশাদীর কাজ সেরে ফেলা উচিৎ।’
সায়মা মন্তব্য করে, ‘রাফি ভাইর তো কোনো মেয়েই পছন্দ হয়নি।’
মেয়ের কথায় মাকসুদ সাহেবের তেমন বিকার ঘটে না। তবুও চাপা অস্বস্তির প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পছন্দ অপছন্দ সাবজেক্টিভ। আবার অনেক পছন্দ নিরর্থক। দেখেশুনে ভাল ঘরের একটা মেয়ে বিয়ে করে ফেল।’
মাকসুদ সাহেবের কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে সেটা রাফি, সায়মা, সায়মার মা সবাই বুঝতে পারে। সায়মা তো বাপের কথায় মাথা নিচু করে ফেলে।
রাফি একটু জড়তা নিয়ে বলে, ‘আংকেল, এটা তাড়াহুড়ার কিছু না। আল্লাহ্র হুকুম যখন হবে, তখনই হবে।’
সায়মার আম্মা ত্রস্ততার সাথে বলেন, ‘তা ঠিক, তুমি ঠিক বলেছ; সবকিছুই আল্লাহর হুকুমেই হয়। তবে বিয়েশাদীর ব্যাপারে অনেক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হয়। আর এখনকার কঠিন বাস্তবতায় মানুষের আবেগের চেয়ে বিচার-বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দেয়া উচিৎ।’
সায়মার আম্মার আপাতজটিল বক্তব্য রাফির কতটুকু বোধগম্য হলো তা বুঝা গেল না। কোনো কথা বলার চেয়ে তাকে খাবারের দিকেই বেশি মনোযোগী মনে হলো।
মাকসুদ সাহেব রেজালার বাটি রাফির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সব খাবার একটু চেখে দেখ, বিদেশি খাবারে তো আর দেশি স্বাদ পাবে না।’
সায়মা তখন চেয়ার থেকে উঠে নিজ হাতে সার্ভ করতে চাইলে রাফি থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমিই নেব, সব কিছুই নেব। খুব মজা হয়েছে।’
খাবার শেষ করে রাফি আরও কিছুক্ষণ বসে সায়মার সাথে গল্প করে। খাবারের স্বাদ নিয়ে বলা কথার ভেতরে ঘুরেফিরে সায়মার হতাশার কথাও লঘুচালে আবর্তিত হয়। দ্বিধাজড়ানো কণ্ঠে সায়মা একবার বলে ফেলে, ‘তাহলে বিয়ে না করেই ফিরে যাচ্ছেন; বাবা-মা’রা রাগ করেননি?’
রাফি বলে, ‘মনের মতো পাত্রী তো পেলাম না; দেখি নেক্সট টাইমে কী হয়।’
সায়মা বলে, ‘আপনার আগ্রহ কম, নইলে ভালভাবে গরুখোঁজা করলে অবশ্যই সুন্দরী পাত্রী পেয়ে যেতেন। বাংলাদেশে কি পাত্রীর আকাল পড়েছে?’
রাফি তখন হেসে বলে, ‘আমার জন্য সুন্দরী পাত্রীরা তো বসে নেই। তোমরাই তো নায়কমার্কা ছেলেদের হাত ধরে কেটে পড়লে।’
সায়মা কিছু না বলে হো হো করে হেসে ওঠে।
রাতে বিছানায় গিয়ে সায়মা রাফিকে ফোন করে।
ফোন স্ক্রিনে সায়মার নাম দেখে রাফি বিস্মিত হয়। এ ক’দিনে বেশ কয়েকবার কথা হলেও সায়মা তাকে রাতে ফোন দেয়নি। এমন কোনো জরুরি বিষয়ও নেই যে রাতে ফোন করতে হবে। তবুও সে ফোন ধরে বলে, ‘হ্যালো!’
‘কী করছেন রাফি ভাই? খাওয়াদাওয়া শেষ?’ সায়মার কণ্ঠস্বর মৃদু।
‘তোমাদের বাসায় ঠেসে খেয়েছি; এরপরও কি খাওয়া যায়? কী খবর?’
‘না, এমনিই ফোন করলাম। আম্মা আপনার কথা খুব বলছিলেন তো।’
‘আচ্ছা! কী কথা?’
‘অ্যাই, ছেলেটা ভাগ্যবান, তার বন্ধুরা এখনও টোটো করে ঘুরছে আর সে বিদেশে গিয়ে পিএইচডি করছে, এসব আরকি।’
রাফি বলে, ‘ভাগ্য আর প্রসন্ন হলো কই। একটি মেয়েও জুটলো না কপালে।’
‘একেক জনের দুঃখ একেক রকম। আমারটা হলো উলটো।’
‘সেটি কেমন?’
সায়মা বলে, ‘দেখছেন না, কেমন? জুটলো তো সুদর্শন সুপুরুষ, কিন্তু হিসেব তো মিলছে না।’
রাফি মুহূর্তকাল দম ধরে রাখে। তারপর বলে, ‘এটাই জীবন; সবসময় দুয়ে দুয়ে চার হয় না। তোমরা একটা কাজ করতে পার; বাস্তবতা মেনে নিয়ে বিয়ে করে ফেল।’
‘আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। তাছাড়া আব্বা-আম্মা খাপ্পা হয়ে আছেন। তাঁরা ভেবেছিলেন তাদের জামাই আর কিছু না হোক একটা সরকারি জব করবে। কিন্তু এখন দেখেন; সময়ও তো বসে থাকে না।’
রাফি বলে, ‘ফয়সল বিদেশে চলে গেলে তো ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেতে পারে।’
‘আর বিদেশ যাবে! কখন নয় মণ ঘি পুড়বে আর কখন রাধা নাচবে? সত্যি কথা বলতে গেলে, রাফি ভাই, আমি টোটালি ফেড আপ।’
‘তাহলে এখন কী করবে?’
সায়মা কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলে, ‘আমি আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে চাই না। কঠিন শোনালেও স্থিতিশীল একটি জীবনের জন্য আমি নতুন করে হিসাব কষতে রাজি ।’
সায়মার শেষ কথার ওপর কোনো মন্তব্য না করে ঘুমের অজুহাতে রাফি আলাপ সংক্ষিপ্ত করে শুভরাত্রি বলে লাইন কাটে। কিন্তু সায়মা কী বার্তা দিতে চাইল সে কথা ভাবতে গিয়ে তার গা কাঁপতে থাকে। অনেক চেষ্টা করেও রাত্রে সে ঘুমোতে পারে না।
অনেক বেলা হয়ে যাবার পর মায়ের চেঁচামেচিতে রাফির ঘুম ভাঙ্গে। বহু চেষ্টা করেও ছেলের কোনো ব্যবস্থা করতে না পারায় রাফির বাবা-মা দুজনই মনঃক্ষুণ্ণ। আবার কখন সে দেশে আসবে আর কবে বিয়ে করবে তার ঠিক নেই। মা বলেন, ‘এত ঘুমাচ্ছিস কেন? নাশতা খাবি না?’
রাফি চুপচাপ উঠে গিয়ে নাশতা খেয়ে আবার এসে শুয়ে পড়ে। সাধারণত দিনে দুয়েকবার সে ফয়সলের সাথে ফোনে কথা বলে। আজ সারাদিনে একবারও সে ফয়সলকে কল করেনি। বিকেলে ফয়সলই তাকে ফোন করে, ‘কী দোস্ত, শরীর ভাল? নাকি পাত্রীর সন্ধানে ব্যস্ত? আজ একবারও কল করলি না।’
রাফি বলে, ‘না দোস্ত, রাতে ঘুম হয়নি তাই শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। তাই শুয়ে আছি।’
ফয়সল বলে, ‘তাহলে আজ বেরোনোর দরকার নেই, রেস্ট নে। তোর তো যাবার সময়ও হয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার ঝামেলা।’
রাফি বলে, ‘তা ঠিক। তুই একটা কাজ কর দোস্ত; কাল তো শুক্রবার, চল কাল দুপুরে বনানীর চিলক্সে লাঞ্চ করি। সায়মাকেও নিয়ে আসিস।’
ফয়সল ইতস্তত করে বলে, ‘সায়মা কি আসতে পারবে? ছুটির দিনে তাদের সবাই বাসায় থাকে, তারও ব্যস্ততা থাকে। তাছাড়া…’
‘তাছাড়া কী?’
ফয়সল বলে, ‘না মানে, ইদানীং তার মুড অফ থাকে। বরং তুই ওকে ইনভাইট কর না; তোর কাছে ওর ফোন নম্বর আছে না?’
রাফির মনের মধ্যে কীসের ঝড় বইছে তা সে ফয়সলকে বলতে পারবে না। সায়মার সাথে তার ধারাবাহিক আলাপনের সমাপ্তিতে এসে যে এক প্রচ্ছন্ন বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে তা এতই অস্বস্তিকর যে সে না ফয়সলকে এব্যাপারে কিছু বলতে পারছে, না সায়মাকে নতুন হিসাব কষার সংকেত দিতে পারছে।
চিলক্সে বসে রাফি স্বাভাবিক মেজাজেই কথা বলে গেছে। ফ্রুট জ্যুস, অ্যাপিটাইজার খেতে খেতে ফয়সলের ফিনল্যাণ্ড, জার্মানির অগ্রগতির কথাও জিজ্ঞেস করেছে। সায়মার সাথেও যখন কথা বলেছে তখন বোঝাই যায়নি এই আশা-নিরাশার গল্পের বাইরেও অন্য একটি অদৃশ্য সম্ভাবনার অস্তিত্ব কোথাও রয়েছে। রাফির চোখে আজই প্রথম স্পষ্টভাবে ফয়সল ও সায়মার স্বতঃস্ফুর্ততার অভাব ধরা পড়ে। তবে সে তা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায়।
লাঞ্চ সেরে উঠতে উঠতে কিছুটা দার্শনিকের মতো রাফি বলে, ‘জীবনটা কী জটিল, না? স্টুডেন্ট লাইফে আমরা কেমন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতাম; যতই দিন যায় আমরা ততই জটিলতার মুখোমুখি হই। আমাদের চিন্তা-চেতনারও পরিবর্তন ঘটে।’
ফয়সল বলে, ‘শুধু তাই নয়, নিয়তি বলেও একটা কথা আছে। আমরা চেষ্টা করলেও অনেক কিছুই আমাদের মতো হয় না। দোয়া করিস।’
ফ্লাইটের আগের রাতে রাফির শেষবারের মতো কথা হয় সায়মার সাথে। সে এ ক’দিনে নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনেকটা ঋজু হয়েছে। সায়মাকে সে বলেছে, ‘সায়মা, যাবার আগে আমি তোমাকে এটুকু নিশ্চিত করতে চাই, আমি গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবল চেষ্টা করছি। এতদিনে যা বুঝেছি, তোমার ফ্রাস্ট্রেশন আর আমার সুপ্ত বাসনার নবজাগরণ একটি বিন্দুর দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, নৈতিকতা আর বিশ্বাসের বেড়া ডিঙ্গানো কত কঠিন।’
সায়মা বলেছে, ‘রাফি ভাই, আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে তুমুল প্রতিযোগিতার এই যুগে মানুষ আবেগের চেয়ে হিসেবনিকেশকে বেশি প্রাধান্য দেয়। মনে আছে, সেদিন আম্মা বলেছিলেন: এখনকার কঠিন বাস্তবতায় মানুষের আবেগের চেয়ে বিচার-বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দেয়া উচিৎ? তাছাড়া প্রয়োজনের চাপেই মানুষ অকেজো নীতিকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। আশা করি, আপনি আমাকে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।’
রাফি চোখ বুজে মাথার চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে সব দুর্ভাবনাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ছোট করে বলে, ‘খুব শিগগিরই।’