শ্রীমঙ্গলে অমঙ্গল

ভয়াল রাত (সেপ্টেম্বর ২০২৩)

Jamal Uddin Ahmed
মোট ভোট ১৭ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৪.৭৪
  • ১০
  • 0
  • ৮৫
গালে টনটনে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় তা হাত দিয়ে ছোঁব ভাবলাম। কিন্তু হাত তো নড়াবার উপায় নেই। তাই হাঁটু দিয়ে কষ্ট করে স্পর্শ করে দেখি বাম চোখের নিচটা ছোট আলুর মতো গোল হয়ে আছে। ওটার পাশে চড়চড়ে কিছু একটা লেগে আছে মনে হল; হাঁটু দিয়ে ঘষে এনে দেখি খয়েরি রঙের গুড়ো। আমি বুঝতে পারি ফোলা জায়গা কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়েছিল; এখন শুকিয়ে গিয়ে এ অবস্থা।

- ফণী!
- জে স্যার।
- বান্দরটারে নিয়া আস।

এস.আই. জব্বারের আদেশে কনস্ট্যাবল ফণী হাজতের তালা খুলে আমার বাঁ পাঁজরে কষে একটা লাথি মেরে বলে ‘উঠ মাদারচুত।’

আমি চিৎকার দিয়ে বানরের মতো লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াই। আমার হাত দুটি পিছমোড়া করে বাঁধা। পরনের জিন্সের প্যান্ট কাদামাটিতে ময়লা হয়ে গেলেও ছিঁড়ে যায়নি, কিন্তু ম্যাজেন্টা রঙের টি-শার্টের গলার একদিক পুলিশের খামচাখামচিতে বেমক্কা ছিঁড়ে গিয়ে কুকুরের জিভের মতো ঝুলে আছে। স্যান্ডেল দুপাটি কোথায় পড়েছে খেয়াল নেই।

এস.আই. জব্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সে টেবিল থেকে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চা খাবে?’

রাতের খাবার আমি খাইনি। এই মধ্যরাতে আমার পেট চোঁ চোঁ করবার কথা। কিন্তু আমি খিদে অনুভব করছি না। আর এই অসময়ে চা-ই বা কেন খাব বুঝতে পারছি না। আমি বলি, ‘না স্যার, আমি চা খাব না।’ তারপর কাকুতি করে বলি, ‘আমার পেছনের বাঁধনটা খুলে দেন; হাতকড়া লাগিয়ে রাখুন, আমি পালাব না।’

এস.আই. জব্বার সরোষে চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার আলুফোলা গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে বলে, ‘মামার বাড়ির আবদার! এইখানে তাফালিং চলবে না।’

আমি ব্যথায় ককিয়ে উঠে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাই। গালটায় যে হাত বুলাবো সে উপায়ও নেই। আমি আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।

শ্রীমঙ্গল থানায় এই মধ্যরাতে এস.আই. জব্বার ছাড়াও বেশ কয়েকজন কনস্ট্যাবলের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। টহল গাড়িতে আমাকে ধরে নিয়ে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে ফণীসহ দুজনকে আমি দেখতে পাচ্ছি, বাকিরা হয়তো অফ-ডিউটিতে চলে গেছে। কিল-ঘুষি, লাথি শুধু এ দুজনই মারেনি ব্যাটন দিয়েও পিটিয়েছে ক’জন। এখন শুধু মুখে নয় আস্তে আস্তে সারা গায়েই যন্ত্রণার উপস্থিতি টের পাচ্ছি।

এস.আই. জব্বার সিগ্রেট ধরিয়ে অফিসকক্ষে কয়েক চক্কর দিয়ে আবার চেয়ারে গিয়ে বসে। ফণী কাছে এসে জিজ্ঞাসু-নেত্রে দাঁড়ালে জব্বার বলে, ‘দড়ি খুলে হাতকড়া লাগাও। আর শালার পুতেরে টোস্টসহ চা দেও; দুইটা কলাও দিয়ো।’ তারপর সে বেরিয়ে যায়।

পুলিশের দেয়া চা-বিস্কুট আমাকে বাধ্য হয়েই খেতে হয়েছে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য একটা আধাপচা নেপালি কলাও বিনা বাক্যব্যয়ে গিলে ফেলি।

দুই গ্লাস পানি খেয়ে আমি টয়লেটে যেতে চাই। ফণী ঘাড় বাঁকা করে কাছে আমার কাছে এসে বলে, ‘হাগবি না মুতবি?’ আমি কিছু না বলায় আমার পিঠে একটা বিরাশি সিক্কা ওজনের কিল বসিয়ে বলে, ‘উঠ, উঠ।’

নোংরা পুতিগন্ধময় দরজা-খোলা পায়খানায় বসে কোনোরকমে কাজ সেরে ফিরে এসে আমি আবার আগের চেয়ারেই বসি। আমার ফোনটা পুলিশের হাতে থাকায় জানতে পারছি না বোর্ডিং থেকে বা শাহেদের কাছ থেকে কোনো কল এসেছিল কি না। দুপুরের দিকে শ্রীমঙ্গল এসে পৌঁছার পর আমি ও শাহেদ সময় নষ্ট না করে অটোরিক্সায় শেয়ারে লাউয়াছড়া ভ্রমণে চলে যাই। সর্পিল রাস্তা ধরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। ঢাকা থেকে মোটামুটি দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি একেবারে উবে যায়। আমরা লাউয়াছড়া ট্রিপ শেষ করে শ্রীমঙ্গল ফিরেই একটি সাধারণ রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া শেষ করে বোর্ডিং খুঁজে বের করি। তারপর গোসল করে বিছানায় গা এলিয়ে দিই।

কিছুক্ষণের মধ্যে এস.আই. জব্বার সদর্পে অফিসে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, ‘ও কিছু খাইছে?’

ফণী বলে, ‘জে স্যার, চা-বিস্কুট আর কলা। পায়খানায়ও গেছিল।’

জব্বার বলে, ‘ঠিক আছে। তোমাদের শিফট চেঞ্জ করে নাও। আমি এই ব্যাটারে ধরি।’ বলে, সে আমার দিকে তাকায়।

একটা সিগ্রেট মুখে পুরে এস.আই. জব্বার এবার বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চালাকির চেষ্টা করলে স্ট্রেট ক্রসফায়ার। যা জিজ্ঞেস করব ঠিক ঠিক উত্তর দিবা।’

আমার শরীরের ব্যথা আরও বেড়েছে। দোয়া-দরুদ যা জানি মনে মনে অনবরত পড়ে যাচ্ছি আর নিজেকে ভর্ৎসনা করছি, কেন যে আমি শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এলাম।

জব্বার টেবিলের ওপর কী একটা যন্ত্র টিপ দিয়ে রেখে সওয়াল-জওয়াব আরম্ভ করে। প্রথমেই বলে, ‘তোমার বিস্তারিত পরিচয় দাও।’

আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাশ করে অনেক জায়গায় ছুটোছুটি করেও হতাশা ছাড়া আর কিছুর দেখা পাইনি। দুই একটা টিউশনিতেও ভাগ্য যাচাই করেছিলাম, কিন্তু কোথাও দুতিন মাসের বেশি থাকতে পারিনি। শেষমেশ শাহেদ তার প্রাক্তন এক ছাত্রী সুমাইয়ার বাপকে ধরে সত্যমিথ্যা অনেক কথা বলে তার মেয়েকে পড়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওখানেও আমি ব্যর্থ হই। মেসের অন্য কেউ তেমন বুঝতে না পারলেও শাহেদ ভালভাবে আঁচ করতে পেরেছিল যে বিদ্যাবুদ্ধির ধার না থাকলে টিউশনিও করা যায় না। তার পরামর্শেই আমি এখন আইটির ওপর বিভিন্ন কোর্স করছি যাতে আমি ফ্রিল্যান্সিং-এ কিছু একটা করতে পারি। কিন্তু এত কথা না বলে এস.আই. জব্বারকে আমি সংক্ষেপে বলি, ‘স্যার, আমি মইনুল, বেকার, ঢাকায় থেকে চাকরি খুঁজছি।’

‘তুমি বেকার! শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে আসছো কেমনে? আর ওই ডেডবডির সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী?

ডেডবডির কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। আমি কেমন করে বুঝাব যে ওই ডেডবডির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া আমার বন্ধু শাহেদই আমাকে জোর করে শ্রীমঙ্গলে নিয়ে এসেছে। আমি যখন আর্থিক দুর্বলতার জন্য শ্রীমঙ্গল আসতে রাজি হচ্ছিলাম না সে তখন অতি অল্প খরচের একটি বাজেট উপস্থাপন করে আমাকে ফুসলাতে থাকে। সে একথাও বলে যে বাজেট অতিক্রম করে গেলে বাড়তি খরচ সে বহন করবে। তাই আমি তার কথা ফেলতে পারিনি।

আমি বলি, ‘স্যার, আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে এসেছে। আর ওই ডেডবডি কার আমি জানি না।’

একথা বলতে না বলতেই এস.আই. জব্বার তার লাঠি দিয়ে আমার বাঁহাতে একটা জুতসই বাড়ি বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘আগেই বলছি না চালাকি করবা না। ডেডবডি না চিনলে তুমি ওইটার পাশে কী করতেছিলে?’

আমি বলি, ‘স্যার আমি এক রত্তি মিথ্যা বলছি না। আমি ভাড়াউড়ার দিক থেকে বোর্ডিং-এ ফিরে আসার পথে হঠাৎ দেখলাম একটি সিএনজি অটোরিক্সা কালীমন্দিরের কাছে কী একটা জিনিস ফেলে দ্রুত চলে গেল। আমি কেন যে জিনিসটা দেখার জন্য ওইটার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি পলিথিনে জড়ানো একটা মেয়ের লাশ।’

‘রাত নয়টায় তুমি ভাড়াউড়ায় গিয়েছিলে কেন? আচ্ছা, এখানে কোন হোটেলে উঠেছ? আর তোমার বন্ধু কোথায়?’

খরচ বাঁচানোর জন্য বেনামী বোর্ডিং হাউসের ঠিকানা শাহেদই যোগাড় করেছিল। বললাম, ‘স্যার, কলেজ রোডের একটা বোর্ডিং-এ আমরা উঠেছি। সতীশ বাবু না কি যেন মালিকের নাম। সন্ধ্যাবেলা আমার বন্ধু তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে চলে গেলে আমি একটু হাঁটতে বের হই।’

এস.আই. জব্বার বলে, ‘তোমার বন্ধু কী করে? সে এখন কোথায়?’

আমি বলি, ‘সে একটা গ্রুপ অফ কোম্পানিতে চাকরি করে। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাউন্টিং-এ পাশ করেছে। এখন তার বোর্ডিং-এ থাকার কথা।’

‘তুমি ঠিকমতো জান না সে এখন কোথায় আছে?’

‘আমি আর যোগাযোগ করতে পারিনি; আমার ফোনটা তো আপনাদের কাছে’, আমি বলি।

এস.আই. জব্বার হাঁক দেয়, ‘অ্যাই, কয়টা বাজে?’

বিল্লাল নামের কনস্ট্যাবল এগিয়ে এসে বলে, ‘সার, সাড়ে তিনটা।’

জব্বার আবার বলে, ‘ফণী তো নাই, দেখ তো ওর ফোনটা কোথায়?’

এস.আই. জব্বার চেয়ার ছেড়ে উঠে আরেকটি সিগ্রেট ধরায়। তারপর কয়েকটি চক্কর দিয়ে বলে, ‘লাশ ময়নাতদন্তের জন্য গেছে। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায় যে তোমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল, তবে তো বুঝতেই পারছ …’

আমি বলি, ‘স্যার, আমি কি আমার বন্ধুর সাথে একটু কথা বলতে পারি?’

‘নো!’ এস.আই. গর্জন করে ওঠে। ‘ভোরবেলা ওরেও ধরে আনব, তারপর প্যাঁদানি দিব।’ তারপর সে বিল্লালকে আদেশ করে, ওরে লকআপে ভর।’

ব্যথায় আর ধকলে আমার শরীর নেতিয়ে এলে আমি নোংরা মেঝেয় কুকুরকুণ্ডলী দিয়ে পড়ে থাকি। কিছুক্ষণ তন্দ্রার ঘোরের মধ্যে থাকতেই হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে হকচকিয়ে উঠি। আর্ত চিৎকার থেকে টের পাই এ যে শাহেদের কণ্ঠ। আমার বুকটা ধক করে ওঠে। নিশ্চয়ই হার্মাদরা তাকেও মারছে। পুলিশের সওয়াল জওয়াব থেকে বুঝতে পারলাম শাহেদ আমাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে না পেয়ে সতীশ বাবুর পরামর্শে থানার সহযোগিতা নিতে এসেছে। কিন্তু পুলিশ তার এই সহজ কথাটি এত সহজভাবে বুঝতে যাবে কেন? তারা কয়েক ঘা কিল-ঘুষি বসিয়ে শাহেদকেও আমার তথাকথিত অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে।

এস.আই. জব্বার বিশ্রাম থেকে ফিরেই একটি চটকনা মেরে শাহেদকে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘সত্যি করে বল ওই লাশটির সাথে তোমারও সম্পর্ক আছে কি না।’

শাহেদ ভ্যাবাচ্যাকার মতো বলে, ‘কোন লাশ স্যার, শুনেছি সন্ধ্যায় নাকি কালীমন্দিরের কাছে একটি মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, ওইটি?’

জব্বার জোরসে টেবিল চাপড়ে বলে, ‘ব্যস, কেল্লা ফতে! বল এখন ওই লাশের সাথে তোমাদের সম্পর্ক কী?’

শাহেদ কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে, ‘স্যার, আমি ওই লাশ দেখিনি, মইনুলকে খুঁজতে গিয়ে লোকজনের মুখে লাশের কথা শুনেছি। আমি তো আমার বন্ধুকে খুঁজে না পেয়ে আপনাদের সাহায্য নিতে এসেছি।’

‘চালাকি করবে না।’ এস.আই. বলে, ‘ঢাকা থেকে ফুসলায়ে মেয়ে নিয়ে আসছো ফুর্তি করার জন্য; তারপর ঝামেলা দূর করতে চাইছো। তাই না?’

শাহেদ বলে, ‘স্যার, আমার বন্ধু কি আপনাদের কাছে আছে? ও কী করেছে? আমরা তো বেড়াতে এসেছি। এখানে কারুর সাথে তেমন পরিচয় নেই। আমরা মেয়ে , লাশ এসব কিছুই জানি না।’

জব্বার বলে, ‘বললেই হলো? তোমার বন্ধুরে বোর্ডিং-এ রেখে তুমি কোথায় গেছিলা?’

‘আমার এক বন্ধু চায়ের ব্যবসা করে। ওকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।’ শাহেদ যোগ করে, ‘আগে তো আসিনি, তাই ঠিকানা খুঁজে পেতে দেরি হয়ে যায়।’

এস.আই. জব্বার অধৈর্য হয়ে হাঁক দেয়, ‘বিল্লাল, এই শালারেও লকআপে ভরো। দেখি সকালবেলা কী রিপোর্ট আসে। তারপর দুইটারেই চালান দিয়া দিব।’

বিল্লাল শাহেদকে টান মেরে চেয়ার থেকে তুলে নিয়ে হাতের সুখ মিটিয়ে দুইটা ঘুষি মেরে আমার সামনে এনে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর আমার পিঠে একটা লাথি মেরে বলে, ‘এখন ঘুমাইয়া ল, আর সুযোগ পাইবি না।’

শাহেদ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আক্ষেপ করে সে বলতে থাকে, ‘কেন যে আমি তোকে ফেলে গেলাম। আর ওই লাশের সাথে তোর সম্পর্ক কী? তুই জড়ালি কেমন করে?’

আমি শাহেদকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। পুলিশ যে আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করতে চায়নি সেটাও তাকে জানালাম।

শাহেদ বলল, ‘এখানে কে আমাদের সাহায্য করতে পারবে? আমার বন্ধুটি এ ঝামেলায় জড়াতে আসবে বলে মনে হয় না। কারণ পুলিশে ছুঁলে কত ঘা তা তো আমরা টের পাচ্ছি।’

আমার একথা ভাবতে খুব কষ্ট হলো কেন যে ওই ছোঁড়া বস্তু দেখার কৌতূহল হলো আমার। পুলিশের গাড়ি থামার পরও কৌশলে কেটে পড়া যেত। তা না করে আমি আশা করেছিলাম পুলিশকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করলে আমাকে তারা বাহবা দেবে। এখন সে বাহবা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

হালকা আলোয় আমার থ্যাবড়ানো চেহারা দেখে শাহেদ মুষড়ে পড়ে। ওর এতটুকু দুরবস্থা হয়নি। সে কাতর কণ্ঠে আমাকে ভরসা দেয়, ‘ভয় পাসনে দোস্ত, ইনশাল্লাহ ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে।’

হঠাৎ কী মনে করে আমি শাহেদকে কানে কানে জিজ্ঞেস করি, ‘তোর ফোনটাও কি নিয়ে গেছে?’

শাহেদ বলে, ‘না। কেন?’

আমি বলি, ‘সতীশ বাবুকে কি আমাদের অবস্থাটা জানানো যায় না? যদি সে আমাদের কোন উপকার করতে পারে।’

শাহেদ বলে, ‘জানানো যায়, তবে কোনো উপকার পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পুলিশি ঝামেলায় কেউ আসতে চাইবে না।’

আমি বলি, ‘সতীশ বাবু এবং তোর বন্ধুকে অন্তত আমাদের অবস্থাটা জানিয়ে রাখা দরকার। পরে আমাদের ভাগ্যে কী না কী ঘটে।’

শাহেদ কিছুক্ষণ ভেবে তার পকেট থেকে ফোন বের করে তার বন্ধু বরকতকে কল করে। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর অপর প্রান্ত থেকে বিরক্তিভরা কণ্ঠে বরকত বলে, ‘কীরে, তোরা ঘুমাস নাই?’

শাহেদ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে অসহায়ের মতো বলে, ‘দোস্ত, আমরা বড় বিপদে। থানা হাজত থেকে তোকে ফোন করছি…।’

এটুকু বলতে না বলতেই এক কনস্ট্যাবল চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘অ্যাই, কে কথা কয়?’ তারপর হনহন করে এসে হাজতের তালা খুলে শাহেদের গালে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় বসিয়ে তার ফোনটা কেড়ে নেয়।

আমার খুব খারাপ লাগে, কেন যে আমি শাহেদকে ফোন করতে বললাম। আমার জন্যই মারটা খেল সে।

শাহেদ একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘কপালে আর কী দুর্গতি আছে আল্লাহ্ই ভাল জানে।’

থানায় রাতের এই শেষ প্রহরে আর কোনো শোরগোল না থাকায় এই নোংরা পরিবেশে আমরা ঝিমিয়ে পড়ি। ক্লান্তিতে কখন যে মেঝেয় গা ছড়িয়ে দিয়েছি বুজতে পারিনি।

যখন আবার চিৎকার চেঁচামেচিতে আমরা ধড়ফড়িয়ে উঠলাম তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমরা নতুন বিপদের আশংকায় একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অসহায় পশুর মতো নির্জীব বসে থাকি। কিন্তু ওদিকে ওসি সাহেবের কক্ষে হুমকি ধমকি আর আর্তনাদে থানা মাথায় উঠে আছে। আমরা বুঝতে পারছি না কোন নতুন অপরাধী আবার ধরা পড়েছে। আবার নিজেদের নিয়তির কথা ভাবতে গিয়ে আপনা-আপনি চুপসে যাই। শরীরের ব্যথা অনেক বেড়েছে। এখন ওসি যদি নতুন করে ইন্টারোগেশন আরম্ভ করে তবে আমাদের উপায় কী হবে? শাহেদ আমার চেয়ে বেশি দোয়া-দরুদ জানে। তাকে বললাম, ‘দোস্ত, তুই চালিয়ে যা, আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।’ শাহেদ গুণগুণ করে তার বিদ্যা জাহির করে যেতে থাকল।’

বেলা অনেক হয়ে গেলেও পুলিশ আমাদের কাছে আসছে না দেখে চিন্তা আরও বেড়ে গেল। আমরা তাদের পদচারণা দেখতে পাচ্ছি অথচ তারা যেন আমাদের দিকে তাকাচ্ছেই না। শাহেদের কথা জানি না, আমার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। একটু পানি খেলেও হতো; কিন্তু পানি চাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারছি না।

ঠিক তখনই একজন কনস্ট্যাবল হাজতের তালা খুলতে এল। সাথে আরেকজন অচেনা যুবক। আমি ভাবলাম এ হয়তো আমাদের নতুন সঙ্গী। কিন্তু শাহেদ আচমকা গলা ছেড়ে ডাক দেয়, ‘বরকত!’

বরকত! মানে শাহেদের ওই বন্ধু। সে হাসি হাসি মুখ করে আমাদের উদ্দেশে হাত নাড়ে। কনস্ট্যাবল তালা খুলে আমাদের কাছে এসে কোনো কথা না বলে আমার হাতকড়াটি খুলে বলে, ‘চলেন।’

পুলিশের এমন ভাল ব্যবহার দেখে আমি চমকে যাই। আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কনস্ট্যাবলকে অনুসরণ করি।বরকত ইশারায় আমাদের শান্ত থাকতে বলে।

আমাদের যখন ওসি’র কক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন থানার বাইরেও লোকজনের মৃদু শোরগোল শুনতে পাই। বরকতের আগমন, বাইরে লোকজনের সমাগম, হাজত থেকে আমাদের বের করে আনা এসব আমাদের কাছে রহস্যময় মনে হয়। ওসির সামনে যাওয়ার পর আমাদের অবস্থা যে কী হয় সেই ভয়ও মনের মধ্যে সক্রিয়।

কনস্ট্যাবলের পিছুপিছু ওসির কক্ষে ঢুকতে গিয়ে কাদের গোঙানি শুনতে পাই। তাকিয়ে দেখি পিছমোড়া করে বাঁধা দুই যুবক ফ্লোরে কাঁত হয়ে পড়ে কাঁদছে। আমরা যেই ঢুকেছি অমনি দেখি এস.আই. জব্বার ব্যাটন দিয়ে ওই দুই যুবকের পিঠে সজোরে দুই ঘা বসিয়েছে; আর অমনি ওরা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো লাফ দিয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। শাহেদ এই দৃশ্য দেখে চকিতে আমার গায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়।

ওসির কক্ষ এস.আই. জব্বার ছাড়াও অন্যান্য পুলিশের লোকে ভর্তি। ওসি আমাদের দেখে জব্বারকে লক্ষ করে জিজ্ঞেস করে, ‘ওরাই তো?’

‘জি স্যার’, জব্বার উত্তর দেয়।

ওসি আমাদের চেহারার দিকে নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে, ‘এসব কী করেছ তোমরা? এভাবে কেউ ইন্টারোগেট করে?’

এস.আই. জব্বার বলে, ‘অকারেন্সটা সিরিয়াস ছিল বিধায় একটু বেশি টেনশনে ছিলাম স্যার। সামান্য মিসহ্যাণ্ডলিং হয়ে গেছে।’

আমি ওদের কথোপকথন শুনে আশ্বস্ত হই যে হয়তো ওরা আমাদের আর রামধোলাই দেবে না। তবুও স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার হাতটি ফুলে ওঠা গাল স্পর্শ করে।

ওসি তখন পকেট থেকে একটি এক হাজার টাকার নোট বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘স্যরি, পুলিশের ডিউটিতে অনেক সময় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। আশা করি আপনারা মাইন্ড করবেন না। তারপর টাকার নোটটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভাল করে নাশতা করে নিয়েন; আর ফার্মেসি থেকে কিছু ঔষধ নিয়ে নিবেন। ঠিক আছে?’

আমাদের এখন কিছু বলা না বলা অবান্তর। আমার গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। হয়তো জ্বর এসেছে। মন-প্রাণ ম্রিয়মাণ হয়ে বলছে, ছেড়ে দেয় মা কেঁদে বাঁচি।

বরকত আস্তে করে শাহেদকে বলে, ‘চল, কেটে পড়ি।’ সে মুহূর্তে এস.আই. জব্বার আমাদের ফোনগুলি ফেরত দিতে দিতে বলে, ‘সাশপিশাস কোনো কিছুতে আগ বাড়িয়ে নাক গলাবেন না। পুলিশের চাকরিই এমন। স্যরি।’

আমি এস.আই. জব্বারের কথার কোনো জবাব না দিয়ে শাহেদকে নিয়ে বরকতের পিছু পিছু থানা থেকে বাইরে পা বাড়াই। তখনই সমবেত উৎসুক জনতা হুড়মুড় করে আমাদের দিকে ছুটে আসে। তাদের অর্ধেক হয়তো ধারণা করছে আমরাই দুষ্কৃতি, অন্যরা যারা বরকতকে চেনে তারা হয়তো ভাবতে পারে আমরা পরিস্থিতির শিকার।

বরকত দুহাত দিয়ে লোকজন সরিয়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ভাই আমি দুঃখিত। জীবনের প্রথম শ্রীমঙ্গলে এসেই দুর্দশায় পড়লেন।

শাহেদ বরকতের উদ্দেশে বলে, ‘তোর দুঃখিত হয়েও লাভ নেই, দোস্ত। আমাদের কপালে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে। এখন বল তো আসলে ঘটনাটা কী আর আমাদের ছেড়ে দিলই বা কেন?’

বরকত বলে, ‘সে অনেক লম্বা কাহিনী। তবে মোদ্দা কথা হলো এই, ওই মেয়ের প্রকৃত খুনি দুইটিকে টহল পুলিশ রাজনগর থেকে পাকড়াও করেছে। ওরা অস্বাভাবিক গতিতে চলা সিএনজি অটোরিক্সায় করে পালাচ্ছিল । পুলিশ ওদের অ্যারেস্ট করার পর গাড়ির ভেতর চেক করতে গিয়ে রক্তের দাগ দেখতে পায়। তারপর তো দেখতেই পেলে এখন ওরা পুলিশের হাতে।’

আমি বললাম, ‘আর, আপনি আমাদের বের করে আনলেন। এজন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

‘আরে না।’ বরকত বলে, ‘আমি এসে যখন আসল ঘটনা জানতে পারি তখন ভিকটিমদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওসিকে অনুরোধ করলাম মাত্র।’

বরকত আমাদের ওর বাসায় জোর করে নিতে চাইলে আমি প্রবল আপত্তি জানাই। কারণ শ্রীমঙ্গলের অমঙ্গল দেবতা আমাকে যে এক দুঃসহ রাত উপহার দিয়েছে এরপর আমার আর কোথাও যাওয়ার শক্তি অবশিষ্ট নেই।

আমি আর শাহেদ সতীশবাবুর বোর্ডিং হাউসের দিকে দ্রুত পা চালাই।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন অভিনন্দন ভাই। সবসময় পাঠক মনে আদরনীয় হয়ে থাকুন এই আশায় শুভকামনা রইলো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
Faisal Bipu গল্পের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম ভাই। অসাধারণ
ভালো লাগেনি ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
পরিচিত হয়ে ধন্য হতে চাই ভাই
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
সাথে থাকুন, ভাই। আমি অতি নগণ্য। আরও কথা হবে।
ভালো লাগেনি ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
ফয়জুল মহী অনবদ্য লেখনী শুভেচ্ছা ও শুভকামনা অবিরাম
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
বিষণ্ন সুমন ভাই টানটান উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমি গল্প পড়ছি। মনে হচ্ছিল আমি নাটক দেখছি। কি যে ভালো লিখেন আপনি। অসাধারণ।
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
অনেক ধন্যবাদ। লেখার মান ভাল না হলেও আপনারা পড়েন বলে উদ্দীপ্ত হই।
ভালো লাগেনি ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গালে টনটনে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় তা হাত দিয়ে ছোঁব ভাবলাম

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৫৯ টি

সমন্বিত স্কোর

৪.৭৪

বিচারক স্কোরঃ ২.১৯ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৫৫ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪