মিতা গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। আমি কিন্তু মাঝবেলার খাবার খেয়ে ছুটির দিনেও ঘুমাই না; অভ্যেস নেই। তবে সকালে লম্বা সময় নিয়ে ঝড়ে উপড়ানো গাছের মতো পড়ে থাকি বিছানায়; মিতা বলে কুম্ভকর্ণের ঘুম।আজও ঘুমিয়েছি সকাল দশটা অবধি। তারপর তো অনেক কাজ – নাশতা খাওয়া, দাড়ি কামানো, গোসল করা, জুমার নামাজে যাওয়া, ইত্যাদি। আমার ব্যতিক্রমী নিয়মের জন্য অন্যান্য চাকরিজীবী পুরুষের মতো ছুটির দিনে থলে-হাতে বাজারে ছুটতে হয় না। আমি তা আগের দিনই অফিস থেকে ফেরার পথে সেরে নিই।
এখনকার ডিজিটাল যুগে খবর জানতে পত্রিকা পড়তে হয় না। হাতের মুঠোয় এমনি এমনি সব এসে যায়। কিন্তু চোখের সামনে ধরে ছাপা অক্ষরের কাগজ পড়ার বাতিকটা পুরোপুরি যায়নি। তাই ছুটির দিনে ওই চর্চাটা চালু রাখি। তবে কোনো পত্রিকা নয়, মূলত কিছু পুরনো বই, বইমেলা থেকে কেনা হালের কিছু পছন্দের বই এবং গোটা কয়েক ঈদসংখ্যাই আমার পড়ার রসদ। ছুটির দিনে বাইরের কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে মনোযোগী ছাত্রের মতো অধিকাংশ সময় গল্প-উপন্যাস-কবিতার পাতায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকি। মিতা সুবোধ মেয়ে। এব্যাপারে আমার আবদার সে মেনে নিয়েছে; আমাকে মিছেমিছি বিরক্ত করে না। আমিও তাকে বুঝি, ভালভাবেই। স্কুলের বিজ্ঞান-শিক্ষিকার খাটুনি অনেক। ছুটির দিনে সে-ও একটু বিশ্রাম নিতে ভালবাসে। তবুও সে কোথাও যেতে চাইলে – তা উইন্ডো শপিং হোক কিংবা রেস্তোরাঁ বিলাস হোক – আমি কখনও আপত্তি করি না। আর বিয়ে, জন্মদিনের অনুষ্ঠান থাকলে তা তো পরিকল্পনা মাফিকই হয়।
বাবার ফ্ল্যাটের এক চিলতে বারান্দায় দোল-চেয়ারে বসে আমি গত ঈদের ঈদসংখ্যার একটি উপন্যাস পড়ছি। পান-সিগ্রেটের অভ্যেস নেই বলে আমি মাঝে মধ্যে বাদাম চিবোই। বই-টই পড়ার সময় একটু বেশিই খাই। মর্জিনা খালা তাই ছুটির দিনে এক কৌটা চিনেবাদাম কিংবা কাজুবাদাম বারান্দার ছোট টেবিলটার ওপর রেখে দেয়। ফোনে বর্ষার গান টিপে রেখেছি। এখন বাজছে, যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, রবীন্দ্র সংগীত। আমি মাঝে মাঝে বাদাম মুখে দিচ্ছি আর গ্রিলের বাইরে তাকাচ্ছি। রাস্তার কৃষ্ণচূড়া গাছের ওপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে; ঝমঝম নয়। রাস্তায় ঝরে পড়া ফুলগুলোরও আগুন-লাগা রূপ জ্বলজ্বল করছে।
‘কী সুন্দর আবহাওয়া! তাই না?’
ফিরে দেখি মিতা এসে কখন দাঁড়িয়েছে পেছনে। আমি বলি, ‘ঘুমাওনি?’
‘না, একটু তন্দ্রা এসেছিল, মর্জিনা খালা ডেকে নিয়ে গেল।’ মিতা বলে, ‘গিয়ে দেখি বাবার বোবায় ধরেছে। গোঙাচ্ছেন।’
বাবার কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। বয়স তেমন বেশি হয়নি। দুবছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অডিটর ছিলেন। নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলেও শরীর সুস্থ-সবলই ছিল। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর গত এক বছরে কেমন জবুথবু হয়ে পড়েছেন। বাসায় মন টেকে না বলে কয়েক দফায় গ্রামে গিয়ে চাচা-ফুফুদের সাথে থেকে এসেছেন। আত্মীয়স্বজনরা বাবার নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে নাকি একটি সমাধানের কথা পেড়েছিল, কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হননি। তারা বলেছিল, হায়াত-মওত আল্লাহ্র ইচ্ছা, তবে এই বয়সে পাশে একজন সঙ্গী থাকা খুবই জরুরি। বাবা বলেছেন, তাঁর সঙ্গীর প্রয়োজন নেই। মর্জিনাই তার দেখভাল করতে পারবে।
মর্জিনা খালাকে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। এখন সে-ও বুড়িয়ে গেছে। তার কোনো ছেলেপুলে নেই। স্বামীটাও অনেক আগে মরে গেছে। বাবা লোকটাকে গ্রামে একটা দোকান করে দিয়েছিলেন। মর্জিনা খালাকে নিয়ে আসার পর মাঝে মাঝে তার স্বামী আমাদের বাসায় বেড়াতে আসত। সাথে শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদিও নিয়ে আসত। আবার আমরা গ্রামে বেড়াতে গেলে মর্জিনা খালা তার স্বামীর বাড়িতে গিয়ে থাকত। আমরা তাকে আমাদের পরিবারের একজন হিসেবেই মনে করি। আসলে এখন তার যাবার কোনো জায়গা নেই, ইচ্ছেও নেই।
মিতা কৌটা থেকে কয়েকটি বাদাম তুলে নিয়ে চিবোতে চিবোতে আনমনে বলে, ‘এরকম আবহাওয়ায় মাকে নিয়ে বারান্দায় বসে বাবার গরম কফি খাওয়ার কথা ছিল…।’ বলে, সে থমকে যায়, পাছে আমার মন খারাপ হয়।
আমার ফোনে এক নাগাড়ে রবি ঠাকুরের বর্ষার গান চলছিল। এখন বাজছে, বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথা? আমি বোতাম টিপে গান বন্ধ করে দিই। এই তো কিছুদিন আগেই মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। গ্রামে গিয়ে মায়ের কবর জিয়ারত করে এসেছি; কিছু দান-খয়রাতও করেছি। সময় যে কত দ্রুত চলে যায়! মিতাকে বলি, ‘মা বৃষ্টির দিনে ভুনা খিচুড়ি পাকাতেন; তুমিও তো তাঁর কাছ থেকে শিখেছিলে।’
মিতা বলে, ‘কত কিছুই শেখার ছিল, কিন্তু মাকে পেলামই বা কয়দিন। আমার বিয়ের আট মাস পরই তো চলে গেলেন।’
আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও চোখে জল ভর করেছে টের পাই। স্বাভাবিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে বলি, ‘দেখ না একটা রিফ্রেশ কোর্স করে, তোমার শেখা হাতের কাজটা এখনও কাজ করে কি না।’
মিতা মুচকি হাসে। বলে, ‘দেখি, আজ রাতে করা যায় কি না। মর্জিনা খালা তো আছেই, না পারলে সে সাহায্য করবে।’
আমার মনে পড়ে মায়ের লাশ নিয়ে কত কষ্ট করে হবিগঞ্জে পৌঁছেছিলাম। ঝুম বৃষ্টিতে সামিয়ানার নিচে কবর খুঁড়তে হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরপর কবরে পানি জমে গেলে তা তুলে ফেলতে হতো। মাকে কবরে নামাবার সময় বাবার গা বেয়ে এমনভাবে জল ঝরছিল যে কোনটা বৃষ্টির জল আর কোনটা চোখের জল বুঝা যাচ্ছিল না। নতুন বৌয়ের আড়ষ্টতা থাকলেও মিতা বাড়ির মেয়েদের জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছিল। মা হঠাৎ ম্যাসিভ স্ট্রোক করে মারা গেলে আপু আর মাকে দেখতে পায়নি। লন্ডনে বাচ্চাকাচ্চাদের রেখে হুট করে তার চলে আসা সম্ভব ছিল না; পরে অবশ্য এসেছিল।
গরুর মাংসের মিশেলে তৈরি ভুনা খিচুড়ি খুবই মজা হয়েছে। বাবা খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিলেও খুব আয়েশ করে খেয়েছেন। একটু গদগদ হয়ে বলেছেনও, ‘বৌমার হাতের রান্না পাক্কা তার শাশুড়ির মতো। খুব মজা হয়েছে!’ মিতা অবশ্য বলেনি যে এ কৃতিত্ব তার একার না, মর্জিনা খালারও। আসলে মর্জিনা খালাই মায়ের রান্নার সব কারিকুরি ভালভাবে রপ্ত করেছে।
পেট পুরে খাওয়াদাওয়ার পর মনটা বেশ ফুরফুরে আমার। একটি মশার কয়েল জালিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসেছি। বৃষ্টিটা এখন ঝিরঝিরে নয়, ঝমঝম। রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেছে। সড়কবাতির আলোয় যতটুকু দেখা যায়, এখন কৃষ্ণচূড়ার পাতা-ফুল একটু লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে। নিচের ঝরা ফুলগুলিও ভারি বর্ষণে থেঁতলে গিয়ে তার রূপ-সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। মাস্টারনি মিতা দুবার চক্কর দিয়ে জানিয়ে গেছে, ‘আমি কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লাম; কাল আমার স্কুল আছে।’ আমি গা করিনি, মানে প্রকৃতির এই রিমঝিম আবহকে বাইরে রেখে আমার বিছানায় যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া আমার তো আর কাল অফিস নেই; আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক।
আপুর বিয়ের দুবছর আগেই আমরা সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে উঠেছি। বাবার কেনা ফ্ল্যাটে উঠে মা খুবই খুশি হয়েছিলেন। অনেকটা জাতে ওঠার মতো। তাছাড়া ভেবেছিলেন তার মেয়েটার মাথা থেকে পিরিতের ভূতটা নেমে যাবে আর সে লেখাপড়ায়ও মনোযোগী হবে। দুর্ভাগ্য, তাঁর সে আশা পূরণ হয়নি। আপু কলোনির সেই ছেলেটাকে আর মাথা থেকে নামাতে পারেনি। অবশ্য ছেলেটি অর্থাৎ আমার দুলাভাই, সুমন, লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল। একসময় লন্ডনে স্টুডেন্ট ভিসায় তার যাওয়া ফাইন্যাল হয়ে গেলে এবং বাবার কাছে বিভিন্ন মহল থেকে জোর আবেদন আসা শুরু করলে অনেকটা অনুরোধের ঢেঁকি গিলেই একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাবা-মা আপুকে সুমনের হাতে তুলে দেন। আপুর লেখাপড়ার দৌড় ইন্টারমিডিয়েটের বেশি না হলেও সংসারজীবন তার সফল। সুমন কিছুদিনের মধ্যেই আপুকে তার কাছে নিয়ে যায় এবং কয়েক বছরের মধ্যে লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই কীভাবে কীভাবে কাজটাজ বাগিয়ে লন্ডনেই সেটেল করে ফেলে।
আপুর মতো দুঃসাহসী আমি হতে পারিনি। তাই মেনিমুখো আমার কারুর সাথে ভাবসাব হয়নি। ভাবসাব হয়নি কথাটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। হব হব করছিল কিংবা হতে পারত এমন সময়ে সে সম্ভাবনা সমূলে উৎপাটিত হয়ে যায়। এর পর থেকে আর কখনও আমি এমন সম্ভাবনার দ্বারে টোকা দিইনি। তাই তো আমার চাকরি হবার এক বছরের মধ্যে বাবাই তাঁর এক কলেজশিক্ষক বন্ধুর মেয়ের সাথে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন। তাতে অবশ্য আমি হারিনি। ডাকের সুন্দরী না হলেও মিতা মিষ্টি মেয়ে। শান্তশিষ্ট স্বভাবের এবং ঘরপ্রেমী মানুষ। বিয়ের আগেই তার একটি নামকরা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে বিয়ের কিছুদিন পর সে কাজে যোগ দেয়।
বৃষ্টির বেগ কিছুটা শ্লথ হয়েছে মনে হয়। একটু আগে আমাদের রুমের দরজা খোলা দেখে মর্জিনা খালা একবার উঁকি দিয়েছিল। আমি বারান্দায় বসে আছি বুঝতে পেরে সোজা চলে এসে বলেছিল, ‘তোমারে এক কাপ চা দেই, মামা?’ আমি না বলে দিয়েছি। এখন চা খেলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
সেনপাড়া পর্বতার এই ঘন খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকায় জোসেফ আংকেলই বাবাকে টেনে এনেছিলেন। সহকর্মী হওয়ার সুবাদে তিনি এই বিল্ডিং-এ ভাল কমিশনে এই অ্যাপার্টমেন্টটি কিনে দিয়েছিলেন। আমাদের বিল্ডিং-এ বেশ কয়েকটি খ্রিষ্টান পরিবার আছেও। ধর্মের ভিন্নতা আমাদের কোনো সমস্যা করে না। ওদের যেমন গির্জা আছে, আমাদেরও মসজিদ আছে। একে অপরের সুপ্রতিবেশী এবং বন্ধুও।
গির্জার ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসলে খেয়াল হলো রাত বার’টা বেজে গেছে। আর বসা যাবে না, ঘুমোতে যেতে হবে। অথচ এক সময় না ঘুমিয়ে এই ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় পড়ার টেবিলে বসে থাকতাম। ঢং ঢং শব্দ শোনার পরই আমি আপুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসতাম। তখন রাস্তার ওপারের চারতলা দালানের তৃতীয় তলার বারান্দার দিকে ঈগল-চোখে তাকিয়ে দেখতাম কখন প্রিসিলা এসে বারান্দার বাতি জ্বেলে এমাথা থেকে ওমাথায় দুটো চক্কর দিয়ে আবার বাতি নিভিয়ে ঘরের ভেতর চলে যায়। এই লুকোচুরি প্রিসিলার চাপানোই এক শর্ত ছিল। প্রিসিলা ছিল দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া জোসেফ কাকার মেয়ে। ওই দালানটি জোসেফ কাকারই। আগে অবশ্য ওখানে কৃষ্ণচূড়া গাছটি ছিল না, কিংবা খুবই ছোট ছিল।
লাজুক হিসেবে মেয়েদের সাথে আমার খুব বেশি মেলামেশার সুযোগ না হলেও তাদের সাথে কথা বলার ঔৎসুক্য ছিল না এমনটি বলা যাবে না। আধুনিক কলেজপড়ুয়া টগবগে তরুণ আমি। তাছাড়া আবডালে আপুর ফুসুর ফাসুরও আমার ভেতর একটা কৌতূহল তৈরি করেছে ততদিনে। আমার কোনো মোবাইল ফোন না থাকলেও আপু কীভাবে একটা জোগাড় করে ফেলেছিল – পরে জেনেছি ওটা সুমনের দেয়া উপহার ছিল। তাকে ফোনে খুব একটা কথা বলতে না দেখলেও সারাক্ষণই ওটা নিয়ে টেপাটিপি করতে দেখতাম। তার কাছে চাইলেও সে আমাকে তার ফোনটি দিত না; বলত, ‘ল্যান্ডফোন থেকে কথা বল।’
কিছুদিনের মধ্যে আপুর বিয়ের বাদ্য বেজে উঠল। বাবা হৈহুল্লোড় না চাইলেও আপুর প্রায় আধা ডজন বান্ধবী বিয়ের দুদিন আগে এসেই হাজির হয়। ওদের চিৎকার চেঁচামেচি থামায় কে! যে যেমনভাবে পারছে রংতামাশা করছে, একটার পর একটা গান বাজাচ্ছে, তাদের দু’তিনজন গানের সাথে সারাক্ষণই নাচছে। আবার এদের সাথে অনাহূতভাবে এসে যোগ দিয়েছে প্রিসিলা। এতে আপু খুশিই হয়। বলে, ‘অ্যাই, নাচতে পারবি? তোর মাস্টার কিন্তু ঘরে আছে।’
প্রিসিলা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, ‘রাখ তোমার মাস্টার, গান লাগাও।’
আপুরা বিদেশ থেকে তিন বছর পর প্রথমবার দেশে এসেছিল। ততদিনে আমার লুতুপুতু ভাগ্নি হাঁটতে শিখছে মাত্র। দেশে থাকার অল্প কয়েকদিনেই আমার সাথে খুব ভাব হয়ে যায় ওর। আপু শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে বারকয়েক। তবে আমাদের সাথেই থেকেছে বেশিদিন। হঠাৎ একদিন সে আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘আচ্ছা বল তো, প্রিসিলার ঠিক কী হয়েছিল?’
আপুর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও আপাত-অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে আমি একটা হোঁচট খাই। তার প্রশ্ন শুনে মনে হয় সে ধরেই নিয়েছে যে আমি প্রিসিলার খুব কাছের মানুষ ছিলাম এবং তার ব্যাপারে আমিই সবচেয়ে ভাল জানি। আমি ভ্যাবাচ্যাকার মতো বলি, ‘আমি আর নতুন করে কী বলব, যা হয়েছিল তা তো সবাই জানে; তুমিও শুনেছ।’
‘তা তো শুনেছিই। তুই তো তার টিউটর ছিলি; ভাবলাম অন্যের চেয়ে তুই বেশি জানিস।’ তারপর আপু আমার দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি করে বল তো, ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক ছিল?’
এবার আমার মাথা গরম হবার জোগাড়। প্রিসিলাকে আমি ভালভাবেই জেনেছি এবং তার সাথে আমার একটা ঘোরমাখা সম্পর্ক ছিল একথা সত্যি। কিন্তু আপুকে তো এসব বলা যাবে না। আমি বলি, ‘সবাইকে তোমার মতো ভাবো নাকি?’
আপু ফিক করে হেসে তার অপবাদ অপসারণ করতে গিয়ে বলে, ‘না তা হবে কেন, তুই তো ধোয়া তুলসী পাতা।’
পরদিন মিতা স্কুলে চলে গেলে আমি আয়েশ করে আবার বারান্দায় বসি। বাবার সাথে নাশতা সেরে মর্জিনা খালাকে আমার চা বারান্দায় দিয়ে যেতে বলেছি। নাশতার টেবিলে বাবা একটু কাঁইমাই করছিলেন যে এই বৃষ্টির মধ্যে বৌমা স্কুলে গেল কেমন করে। আমি বলেছি, যেভাবে হোক যেতে তো হবেই। আসলে বাবা মিতাকে মেয়ের মতোই ভালবাসেন।
আমি চা খেতে খেতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি। মোবাইল ফোনে চেপে দেয়া গান বাজছে, ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে– আয় গো আয়।
গত রাতের ভাবনাটা আবার মস্তিষ্কে ভনভন করতেই মনে হল সময় যে কত দ্রুত চলে যায়। এই তো সেদিন আমরা এখানে এলাম। আমার কলেজ-ইউনিভার্সিটির কাল এখানেই কাটল। এই এলাকার কতজনের সাথে চেনা-পরিচয় হলো। কিছুদিন প্রিসিলার গৃহশিক্ষক ছিলাম। এখানে আসার এক বছরের মধ্যে আপুর বিয়ে, তার বিদেশ যাওয়া, সন্তান-সন্ততির মা হওয়া – কতকিছুই ঘটে গেল। আর হ্যাঁ, পড়া শেষ করে চাকরি পেতে এবং বিয়ে করতে আমারও বেশি দেরি হয়নি।
মা মারা যাওয়ার পর মর্জিনা খালার কাছ থেকেই মিতা জানতে পেরেছিল ওই বাসার একটা খ্রিষ্টান মেয়ে মারা গিয়েছিল যাকে আমি পড়াতাম। একথা শুনে মিতার মনে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। তবে সে অনেক আগ্রহ ও বিস্ময় নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল বিষয়টি সত্যি কি না। ঘটনা তো মিথ্যে নয়, প্রিসিলা অপঘাতে মারা গেছে – এখানে সত্য-মিথ্যার কী আছে? আমি খুবই স্বাভাবিকভাবে তাকে জানিয়েছি, প্রিসিলা আমার ছাত্রী ছিল, খুবই হাসিখুশি স্মার্ট মেয়ে ছিল, কপাল খারাপ ছিল বলে সে ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যায়। আমি মিতাকে একথা বলতে ভুলিনি যে ঘটনাটি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। এর পর থেকে প্রিসিলার ব্যাপারে মিতার কোনো কৌতূহল দেখা যায়নি।
কাল রাতের ঘণ্টার আওয়াজ শোনার পর থেকে এসব এলোমেলো টুকরো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। আগেও মাঝে মাঝে অমনটি হয়েছে। মনও খারাপ হয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু আমি মিতাকে তা বুঝতে দিইনি। এই মন খারাপের সাথে প্রিসিলার স্মৃতি অবশ্যই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রিসিলার চপলতা আমার খুব ভাল লাগত, কিন্তু আমার আচরণে কখনও তা প্রকাশ পায়নি। ভীতু আমি কীভাবে তার মতো দুরন্ত হতে পারি?
প্রথম থেকেই প্রিসিলা আমাকে এক ধরনের বশ করে ফেলেছিল। যেমন, প্রথম দিনই প্রিসিলা বলেছিল, ‘আপনাকে স্যার-টার বলতে পারব না। ঠিক আছে, ভাইয়া, মানে রিপন ভাইয়া ডাকব। চা-নাশতা আনলে আপত্তি করবেন না; শুয়োর-টুয়োর খাওয়াব না। পড়া সুন্দর করে বুঝিয়ে দিবেন। ঠিক আছে?’
আমি তো থ। বলে কী মেয়েটা! ওর গড়গড় করে বলে যাওয়া কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। আগেও তার সাথে অনেকবার কথা বলেছি, তবে হাই-হ্যালোর বেশি নয়। সে দশম শ্রেণীর পুঁচকে ছাত্রী, আর আমি ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র। জোসেফ কাকা জোর করে আমাকে ধরে এনেছেন তাঁর মেয়েকে পড়ানোর জন্য। ও তো একটু সমীহ করে কথা বলতে পারত। আমি নিজের ব্যক্তিত্বকে একটু টানটান রাখার চেষ্টা করে বলেছি, ‘খাওয়াদাওয়ার কোনো প্রয়োজন হবে না। মূল কাজ পড়ালেখা; ওখানে ফাঁকিজুকি চলবে না।’
প্রিসিলা একটু দুষ্টু হাসি হেসে বলেছে, ‘দেখব, কেমন পড়ান।’
সময় যতই গড়িয়েছে প্রিসিলা আমাকে ততই গোলকধাঁধার চক্করে ফেলে ঘুরিয়েছে। একদিন দরজা খোলার পর যেই তাদের পড়ার রুমে ঢুকেছি প্রিসিলা বলল, ‘রিপন ভাইয়া, চুপ, নড়বেন না।’ বলেই, আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা গভীর চুমু খেয়ে বসল।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমার বুক ধড়ফড় করতে থাকলে ভয়ে ভয়ে ডানেবাঁয়ে তাকাই। চোখের চামড়া নেই নাকি মেয়েটার! না, কেউ দেখেনি। আমি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, ‘এ কী ধরনের অসভ্যতা? কী করলে তুমি?’
প্রিসিলা অবলীলায় বলল, ‘বেশ করেছি। আমার মন চেয়েছে তাই করেছি।’
আমি বললাম, ‘আমি আর আসব না।’
‘আসতেই হবে।’ প্রিসিলা কঠোরভাবে বলল, ‘আপনি না এলে আমি আপনার বাসায় গিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে আসব।’ তারপর আমার অসহায় অবস্থা দেখে সে একটু মুচকি হাসল।
আমি নিরুপায়ের মতো সেদিন চলে আসার সময় তাকে শাসিয়ে আসি, ‘শোন, তুমি এরকম পাগলামি করলে আমি তোমাকে পড়াব না।’
সে বলল, ‘ঠিক আছে, আর করব না।’ বলে সে মুখ টিপে হাসল।
প্রিসিলার সেদিনকার আচরণ আমাকে প্রথমবারের মতো মনোদৈহিকভাবে কিছুটা বিচলিত করে ফেলে। আমি তখন নিজেকে একটি ঘোরের মধ্যে আবিষ্কার করি। সে আর ওসব করবে না বললেও যখনই সুযোগ পেত তখনই ওরকম পাগলামি করত। এবং আবার স্যরি বলত। এভাবে একসময় সঙ্গদোষে আমারও জড়তা অনেকটা কেটে যায়।
আমার পরীক্ষার প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে প্রিসিলাকে আমি আন্তরিকভাবেই পাঠদান করছিলাম, কারণ তার এসএসসি ফাইন্যাল সামনেই ছিল। তখন আমি কড়াভাবে তাকে বলেছিলাম, ‘ভাল রিজাল্ট করতে চাইলে লেখাপড়া ছাড়া আর সবকিছু মাথা থেকে ধুয়ে ফেলতে হবে।’
মেয়েটি মোটেই ছিঁচকাঁদুনে ছিল না। কিন্তু সেদিন সে তার স্বভাবজাত আচরণ ভুলে হঠাৎ ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর শান্তভাবে বলেছিল, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। তবে একটা কথা বলেন, রিপন ভাইয়া, আপনি কি আমাকে বুঝতে পারেন না?’
আমি কোনো সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে বলেছিলাম, ‘বুঝি, তুমি একটা পাগল।’
প্রিসিলা তখন হেসে দিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ পাগল, আপনার জন্য।’
আমি তখন চোখ বড় করে বলি, ‘বলেছি না, মাথায় পড়াশোনা ছাড়া……’
‘বুজেছি, বুজেছি, আর কোনো ভাবনা থাকবে না’, প্রিসিলা আমার কথা কেড়ে নেয়। তারপর বলে, ‘পরীক্ষার পর কিন্তু, হুম।’
তার পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন আমার আর যাওয়া হয়নি প্রিসিলাদের বাসায়। জোসেফ কাকা একদিন ডেকে বললেন, ‘তোমার ছাত্রী তো পরীক্ষা দিল। খোঁজটোজ নিয়েছ কেমন পরীক্ষা দিল?’
আমি বললাম, ‘ভালই দিয়েছে বলল। আমার তো সামনে পরীক্ষা, দোয়া করবেন কাকা। আচ্ছা, আমি নাহয় আসব একবার।’
দুদিন পর যখন তাদের বাসায় যাই প্রিসিলা তখন মুখ ভার করে বসে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও কথা বলে না। বুজতে পারি এটা তার অভিমান। আমি কাকা-কাকীর সাথে কথা বলে চলে আসার সময় প্রিসিলা আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিতে দিতে গজগজ করে বলল, ‘একটা বারও আমার কথা ভেবে আসতে পারলেন না? মোবাইল ফোনও তো নেই আপনার যে কথা বলব।’
আমি বললাম, ‘পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছি; পরীক্ষা আছে না?’
‘ওসব বুঝি না।’ প্রিসিলা বলে, ‘একদিন আমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু। বলেন কবে যাবেন?’
আমি বেকায়দায় পড়ে বললাম, ‘ঠিক আছে, একটা সময় বের করে তোমাকে বলব।’
প্রিসিলা বলে, ‘যদি না যান, তবে আমি …’, তার কথা আর পুরো হয় না।
আমি পড়াশোনা নিয়ে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে প্রিসিলার আবদার তাকে তুলে রাখতে বাধ্য হই। আপু লন্ডন চলে যাবার পর রাত বার’টার ঘণ্টা শুনে আমাকে বারান্দায় আসতে আর লুকোচুরি করতে হতো না। কিন্তু পড়াশোনার ব্যস্ততা কিংবা বাহানায় আমি আর প্রতিদিন বারান্দায় যাই না।
সেদিন রাতেও বৃষ্টি ছিল, ঝুম। গির্জার ঘণ্টার ধ্বনিও আমি শুনতে পেয়েছি, কিন্তু বারান্দায় যাইনি। একটু পর রাস্তায় হট্টগোল শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখে জোসেফ কাকাসহ ওই দালানের লোকজন হৈহল্লা করে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। কেউ বলছে হাসপাতালে নিতে হবে, কেউ বলছে একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাক।
আমার বুজতে বাকি রইল না যে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি বাসায় কাউকে না বলে একটা ছাতা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে দ্রুত নেমে যাই। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের গার্ড ততক্ষণে ফটক খুলে কী ঘটেছে তা জেনে এসেছে। আমাকে ছুটতে দেখে সে বলল, ‘ভাইয়া, জোসেফ স্যারের মেয়ে ছাদ থেকে পড়ে… … মনে হয় মরে গেছে।’
আমার বুক ধক করে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘প্রিসিলা?’
‘জি।’
গার্ডের কথা শুনে আমার পা বৃষ্টির জল ও কাদায় যেন আটকে যায়। তবুও নিজেকে কোনোরকম টেনে নিয়ে গিয়ে যখন রাস্তায় দাঁড়াই তখন জোসেফ কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ঈশ্বর এত নিষ্ঠুর কেন হলো রে বাপ, আমি কী দোষ করেছি?’ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে থাকি এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে রাত বার’টায় প্রিসিলার ছাদের ওপর যাওয়ার কী দরকার ছিল। আর সে পা পিছলে নাকি লাফ দিয়ে পড়েছে তা তো কেউ দেখেনি।
আমার মুখ থেকে কোনো কথা সরছে না। দেখতে পাই কাকী হাউমাউ করে কাঁদছেন এবং লোকজন রক্তাক্ত প্রিসিলাকে ধরাধরি করে একটি ইয়েলো ক্যাবে উঠাচ্ছে। আমি ভয় এবং একধরনের অপরাধবোধে কাঁপতে থাকি। ছাতা কখন যে আমার হাত থেকে পড়ে যায় আমি বুঝতে পারিনি। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির অঝোর ধারায় ভিজতে থাকি। আমার তখন ইচ্ছা হচ্ছিল চিৎকার করে বলি, ‘তুমি কি একটু ধৈর্য ধরতে পারলে না, প্রিসিলা। অভিমান করে চলেই গেলে?’ কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারিনি, কাউকে না, কোনোদিনও না।