মুয়াজ্জিন এশা’র আজান দিয়েছেন। মসজিদের ইমাম একাব্বর আলি পাঞ্জাবি কাঁধে ফেলে দাঁতে মেসওয়াক ঘষতে ঘষতে হুজরা থেকে বেরোবার জো করছেন। দোতলা থেকে নেমে গিয়ে তিনি প্রথমে এস্তেঞ্জা সারবেন, তারপর ওজু করবেন। ওজু সেরে মসজিদে গিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই জামাতের সময় হয়ে যাবে।
হুজরা থেকে বেরোনোর আগে তিনি একবার মুনাজ্জির মৃধার দিকে তাকান। ইমামের হুজরাখানার ভেতরে রক্ষিত দ্বিতীয় চৌকিতে চোখ বন্ধ করে মুনাজ্জির সাহেব শুয়ে আছেন। তাঁর গায়ে বেশ জ্বর। ইমাম সাহেবের ঝাড়ফুঁকের পাশাপাশি কিছু প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও আনা হয়েছে ফার্মেসি থেকে। ট্যাবলেট খেলে জ্বর কিছুটা প্রশমিত হলেও আবার তা ১০০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। এ অবস্থা গত দুই দিন ধরে। মুয়াজ্জিন মাঝে মাঝে মাথায় পানি ঢালেন আবার কখনও জলপট্টি লাগিয়ে দেন। কিন্তু কোনো উপকার হচ্ছে না। রুগি কিছু খেতে না চাইলেও জোর করে পাউরুটি-দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মহল্লার অবস্থাসম্পন্ন মুরব্বী এবং মসজিদের মুতাওয়াল্লী করিম সাহেব সকালে এক বাটি স্যুপ নিয়ে এসেছিলেন। অনেক কষ্টে প্রায় অর্ধেক বাটি খাওয়ানো গেছে। এ অবস্থা নিয়ে রুগির জামাতে শরিক হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তাই ইমাম সাহেব মুনাজ্জির সাহেবকে না ডেকেই হুজরা থেকে বেরিয়ে যান।
এশা’র নামাজ শেষে রীতিমত মুনাজ্জির সাহেবের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়। মুসল্লিরা ইমাম সাহেবের কাছ থেকে রুগির শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। সবাই চলে গেলে করিম সাহেব মুনাজ্জির সাহেবের স্বাস্থ্য নিয়ে ইমাম সাহেবের সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করেন। নামাজে আসার সময় তিনি এক হালি শবরী কলা এনেছিলেন; আলোচনা শেষে তা নিয়ে রুগিকে দেখতে তিনি ইমাম সাহেবের সাথে হুজরায় যান। মুনাজ্জির সাহেব ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসে উসখুস করছিলেন। মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি পুরো দিনে আজ একবারও জামাতে শরিক হতে পারেননি বলে তাঁর খুব খারাপ লাগছিল। ইমাম সাহেবের সাথে মুতাওয়াল্লী সাহেবকে দেখে মুনাজ্জির সাহেব মুখে কিছু না বলে হাত তুলে সালাম করেন।
করিম সাহেব রুগির বিছানায় বসে তাঁর হাত ধরে বলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আপনি ইনশাআল্লাহ ভাল হয়ে যাবেন। আগামী কাইল একজন ডাক্তার নিয়া আসুম।’
মুনাজ্জির সাহেবের গায়ে জ্বর, কথা বলতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যান। তবুও তিনি মৃদুকণ্ঠে বলেন, ‘আপনারা আমার লাইগ্যা আর তকলিফ কইরেন না। আমি ইনশাআল্লাহ এমনিই ভালা হইয়া যামু।’
টিফিনবাটিতে করে ইতিমধ্যে রাতের খাবার চলে এসেছে। মুনাজ্জির সাহেব তেমন খেতে পারছেন না তবুও প্রথামাফিক মহল্লার লোকজন দুইবেলা ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং মুনাজ্জির সাহেবের জন্য পালা করে খাবার পাঠিয়ে যাচ্ছেন। নাশতার দায়িত্ব মহল্লাবাসীর না হলেও হুজরাবাসীর তা কিনে খেতে হয় না বললেই চলে। প্রায়ই ইমাম সাহেবের কাছে গ্রামের লোকজন দোয়া চাইতে কিংবা তেলপড়া, পানিপড়া নিতে আসে। তখন হাদিয়া হিসেবে সবাই টাকাপয়সা না দিতে পারলে নিজের লাগানো গাছের কলা, পেঁপে, ডাব কিংবা মৌসুমি ফল, যেমন, আম কাঁঠাল পেয়ারা ইত্যাদি দিয়ে আসে। মুসল্লিদের মধ্যে সচেতন কেউ কেউ, যেমন মুতাওয়াল্লী সাহেব, মাঝেমধ্যে কিছু চিড়ামুড়িও কিনে দেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কোনো কোনো দিন গরু-ছাগলের দুধও কেউ নিয়ে আসে। তাই নাশতার জন্য কোনো নিয়মমাফিক আয়োজনের প্রয়োজন হয় না।
ইমাম সাহেব ইতিমধ্যে মুনাজ্জির সাহেবের মাথায় হাত দিয়ে তাপ পরখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘জ্বর কিন্তু এখনও বেশ আছে।’ সে মুহূর্তে মসজিদের মুয়াজ্জিন একটি ছোট তোয়ালে টিউবওয়েলের শীতল জলে ভিজিয়ে নিয়ে এলে ইমাম সাহেব নিজ হাতে মুনাজ্জির সাহেবের মাথা মুছে দিতে দিতে বলেন, ‘খালি পেটে দাওয়াই খাওয়া যাবে না ভাইজান; আগে দুই লুকমা ভাত মুখে দিয়া নেন।’
মুনাজ্জির সাহেব বিরতিহীন মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলেন, ‘নাহ, না, আমি ভাত মুখে নিতে পারুম না।’
করিম সাহেব তাঁর নিয়ে আসা কলা এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘অন্তত দুইটা কলা খান।’
ইমাম সাহেব বলেন, ‘পাউরুটিও আছে। দুধ দিয়া ভিজাইয়া খাইতে পারেন। তারপর প্যারাসিটামল খাইলে জ্বর সাইরা যাইব, ঘুমাইতে পারবেন।’
কোনোমতে দুই পিস পাউরুটি গিলে দুটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট একসাথে খেয়ে মুনাজ্জির সাহেব শয্যা নেন। জলপট্টি এবং ওষুধের প্রভাবে জ্বর নেমেও আসে কিছুক্ষণ পর। মুয়াজ্জিন তাঁর ছোট প্রকোষ্ঠে চলে গেলে ইমাম সাহেবও দোয়া-দরুদ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। মুনাজ্জির সাহেবের অসুস্থতার কারণে তাঁরও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। কিন্তু করার কিছু নেই। মুনাজ্জির সাহেব তাঁরও যেমন প্রিয় মানুষ, মহল্লাবাসীর কাছেও তিনি অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাছাড়া এই মসজিদই মুনাজ্জির সাহেবের একমাত্র ঠিকানা ও আশ্রয়। আর কোথাও তাঁর যাবার যায়গা নেই।
শেষরাতে মুনাজ্জির সাহেবের গোঙানিতে ইমাম সাহেবের ঘুম ভাঙে। অবশ্য স্বাভাবিক অবস্থায় প্রায়ই তাঁরা দুজন এরকম সময়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েন ও রোনাজারি করেন। ইমাম সাহেব তড়িঘড়ি করে উঠে মুনাজ্জির সাহেবের মাথায় হাত রাখেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি অসহায়ের মতো পাশের কক্ষে নিদ্রিত মুয়াজ্জিন সাহেবকে ডাক দেন। মুয়াজ্জিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলে ইমাম সাহেব বলেন, ‘জলদি তোয়ালে ভিজায়ে নিয়ে আসেন আর পুরা গা মুইচ্ছা দেন।’একই সময়ে ইমাম সাহেব সুরা আর-রহমান তেলাওয়াত করতে আরম্ভ করেন। ইমাম সাহেব বেশ ভয় পেয়েছেন বলেই মনে হয়। ভয় পাবারই কথা। দুদিন পার হয়ে আজ তৃতীয় দিনে পড়েছে। মুনাজ্জির সাহেবের শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং অবনতি হয়েছে। আল্লাহ্ মানুষকে যে কতভাবে পরীক্ষা করেন। নইলে মুনাজ্জির সাহেবের আজ এ অবস্থা হবার কথা নয়।
ফজরের নামাজ পড়ে আজ এশরাকের জন্য অপেক্ষা না করে ইমাম সাহেব মুতাওয়াল্লী সাহেবকে নিয়ে দ্রুত হুজরায় ফিরে আসেন। আরও কয়েকজন হুজরাতে উঁকি দিলে করিম সাহেব তাদের জটলা না করে ফিরে যেতে বলেন। মুয়াজ্জিন সাহেব জলপট্টি দিতে গেলে মুনাজ্জির সাহেব একটু নড়েচড়ে ওঠেন। তাঁর মুখ থেকে প্রলাপের মতো কিছু শব্দও শোনা যায়, ‘হালিমা তুমি আইছ? এতদিনে কই আছিলা? বাপের বাড়ি কেউ এতদিন থাকে……?’
করিম সাহেব ও ইমাম সাহেবকে চিন্তামগ্ন দেখা যায়। এমন জটিল অবস্থায় তাঁরা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। করিম সাহেব স্বগতোক্তির মতো বলেন, ‘ভাবছিলাম শহরের ডাক্তাররে যেভাবেই হোক আজ একবার নিয়া আসুম। উনি তো আবার চেম্বারে বিকালে আসে। এই গ্রামের বাজারে আর কোনো ভাল ডাক্তারও বসে না।’
ইমাম সাহেব রুগির কপালে হাত দিয়ে আরেকবার জ্বরের মাত্রা দেখেন। তারপর একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন, ‘যদি কোনোভাবে উনাকে শহরে নেওয়া যাইত…।’
করিম সাহেব নিরুপায়ের মতো বলেন, ‘ব্যাপারটা ঠিক হইব কি না জানিনা, নইলে উত্তর পাড়ার জব্বার ভাইয়ের জামাইরে একটু কইয়া দেখতাম…।’
ইমাম ও মুয়াজ্জিন দুজনই প্রশ্নবোধক চোখে করিম সাহেবের দিকে তাকান। জব্বার সাহেবদের আলাদা একটি মসজিদ আছে। সাধারণত এ মসজিদে তাঁর আসা হয় না। তবে তিনি এলাকার পরিচিত লোক।
করিম সাহেব আরেকটু পরিষ্কার করে বলেন, ‘গতকাল জামাই আসছে। সে নাকি আমেরিকার একজন বড় ডাক্তার।’
ইমাম সাহেব উদগ্রীব হয়ে বলেন, ‘তাইলে মনে হয় এই কাজটাই করা উচিৎ মুতাওয়াল্লী সাহেব। বিষয়টা বুঝাইয়া কইলে জব্বার সাহেবও অমত করবেন না ইনশাআল্লাহ।’
সকাল নয়টার দিকে করিম সাহেব মুয়াজ্জিন সাহেবকে সাথে নিয়ে জব্বার সাহেবের বাড়িতে হাজির হন। অনেকদিন পর প্রবাসী জামাই ও মেয়েকে কাছে পেয়ে জব্বার সাহেবের বাড়িতে উৎসবের আমেজ। হেঁশেলে তখন নানা পদের নাশতা তৈরি হচ্ছিল। বাড়ির পথ থেকেই সুবাস পাওয়া যাচ্ছিল।
হঠাৎ করিম সাহেবের আবির্ভাবে জব্বার সাহেব বিস্মিত হলেও তিনি সাদরে তাঁকে ভেতর-বাড়িতে আহ্বান করেন। কিন্তু করিম সাহেব রাস্তায় দাঁড়িয়েই তাঁর আসার কারণ কোনো ভূমিকা ছাড়াই বিবৃত করেন এবং লজ্জার মাথা খেয়ে ডাক্তার জামাইয়ের সাহায্য চান। জব্বার সাহেব সঙ্গত কারণে একটু বিব্রতবোধ করলেও মানবিক কারণে জামাইয়ের সাথে কথা বলতে সম্মত হন।
সবেমাত্র নাশতার টেবিলে বসা জামাইয়ের কাছে গিয়ে জব্বার সাহেব হালকাভাবে কথাটি তুলতেই জামাই টেবিল ছেড়ে উঠে বলে, ‘আব্বা, কোনো অসুবিধা নেই। তবে রুগির অবস্থা কেমন তা জানলে ভাল হয়।’
জব্বার সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, ‘তুমি আগে নাশতা শেষ কর, পরে শুনবা।’
জামাই বলে, ‘আমি নাশতা খেয়েই যাব। তবে আগে একটু শুনে নিই।’
সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর করিম সাহেব রুগির অবস্থা বিস্তারিতভাবে জানালে জামাই বলল, ‘আমি অবশ্যই আসব। তবে আমাকে একটু হেল্প করলে ভাল হয়। আপনারা তাড়াতাড়ি একটা প্যারাসিটামল সাপোজিটরি কিনে এনে রুগির পায়খানার রাস্তায়…’
‘…জানি। আমি বুঝতে পারছি বাবা’, করিম সাহেব জামাইর কথা কেড়ে নেন। তারপর বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা আছে। আপনি নাশতা খাইয়া ধীরেসুস্থে আসতে পারলে খুশি হমু। আমি সাপোজিটরির ব্যবস্থা করতাছি।’
জব্বার সাহেব জরুরি পরিস্থিতির কারণে করিম সাহেব এবং মুয়াজ্জিন সাহেবের আতিথেয়তা করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ওই ভদ্রলোকের কথা মনে হইতাছে শুনছিলাম, কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানি না। উনার পরিচয় কী, বাড়ি কই উনার?’
করিম সাহেব বলেন, ‘ইনশাল্লা, আপনারে বিস্তারিত কমু এক সময়। আপনি যে উপকারটা করলেন, আল্লাহ্ আপনারে তার জাযা দেইক। আমরা একটু তাড়াতাড়ি রুগির কাছে যাই।’
সাপোজিটরি দেওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুনাজ্জির সাহেবকে ক্লান্ত দেখালেও তিনি বেশ শান্ত এখন। ইতিমধ্যে করিম সাহেবের বাড়ি থেকে অল্প গরম জাউ, ডিম পোচ ও এক গ্লাস দুধ চলে এসেছে। ডাক্তার জামাইও শ্বশুরকে সাথে নিয়ে দ্রুত মসজিদে চলে এসেছে।
ডাক্তার জামাইয়ের হাতে স্টেথিস্কোপ বা থার্মোমিটার না থাকলেও সে ভালভাবে রুগিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখল। রুগির পূর্বাপর তথ্য বিশ্লেষণ করে সে একটি প্রেসক্রিপশনও লিখে দিল। তবে সে একথাও বলল যে আরও ভাল চিকিৎসার জন্য কিছু টেস্টের প্রয়োজন হতে পারে।
ইমাম সাহেব ও মুতাওয়াল্লী সাহেব জব্বার সাহেবকে যথেষ্ট সম্মানের সাথে বসিয়ে মুনাজ্জির সাহেব সম্পর্কে টুকটাক কথা বলছিলেন। ডাক্তারের রুগি দেখা শেষ হলে জব্বার সাহেব রুগির সামনে এগিয়ে এসে বসেন। রুগির সুস্থতা কামনা করে দুয়েক কথা বলার পর তিনি বলেন, ‘ভাই সাহেব কিছু মনে না করলে একটা কথা জিগাইতে চাই।’
সাপোজিটরির তাৎক্ষণিক ক্রিয়ায় মুনাজ্জির সাহেব অনেকটা স্থিত। আস্তে আস্তে কথাও বলতে পারছেন। কিছু জাউ এবং দুধও ইতিমধ্যে খেয়েছেন মুয়াজ্জিনের সহযোগিতায়। তাঁর অসুখের কারণে আশেপাশের সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন এটাই মুনাজ্জির সাহেবকে অনেক শরমিন্দা করে ফেলেছে। এখন জব্বার সাহেবের কথায় তিনি আরও বিব্রতবোধ করেন। তাই তিনি কোনো কথা না বলে জব্বার সাহেবের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকান।
‘বলতেছিলাম ভাইজান’, জব্বার সাহেব মুনাজ্জির সাহেবের জবাবের অপেক্ষা না করেই বলেন, ‘আপনার এই শারীরিক অবস্থায় আপন লোকজন – এই ধরেন, আপনার কোনো ছেলে বা মেয়ে কাছে থাকলে ভাল হইতো না?’
মুনাজ্জির সাহেব কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই সোজা জবাব দেন, ‘আমার তো কোনো ছেলে-মেয়ে নাই; এনারাই আমার সব। এইডাই আমার ঠিকানা।’
বললে কী হবে, মুনাজ্জির সাহেব যে তাঁর সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কিংবা ছাড়তে বাধ্য হয়ে গত দুই বছর যাবত এই মহিমপুর পূর্বপাড়া মসজিদের হুজরায় অবস্থান করছেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ জব্বার সাহেব ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছেন। অবশ্য পূর্বপাড়া মসজিদের প্রায় সকল মুসল্লিই সাধারণভাবে কথাটা এভাবে জানেন যে মুনাজ্জির সাহেব মসজিদ সম্প্রসারণ কাজের জন্য তাঁর হাতে থাকা পুরো সঞ্চয় অর্থাৎ বিশ লাখ টাকা মসজিদে দান করে দিয়েছেন এবং এই মসজিদে তাঁকে খাদেম হিসেবে রাখার জন্য মহল্লাবাসীর কাছে আবেদন করেছেন। মহল্লাবাসী অবশ্য তাঁকে খাদেম হিসেবে নয় বরং মেহমান হিসেবে ইমাম সাহেবের সাথে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মসজিদে অনুদান দেয়ার পর যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা তিনি ইমাম সাহেবের কাছে গচ্ছিত রেখেছেন যা থেকে তিনি নিজের প্রয়োজনীয় খরচ যেমন তেল সাবান, ওষুধ-পথ্য , লুঙ্গি-গামছা ইত্যাদির জন্য খরচ করেন। তিনি ইমাম সাহেবকে একথাও বলে রেখেছেন যে তিনি হঠাৎ করে মরে গেলে তাঁর সৎকারের খরচটা যেন ওই গচ্ছিত টাকা থেকে মেটানো হয়।
জব্বার সাহেব বলেন, ‘শুইনা খারাপ লাগল ভাইজান যে আপনি সারাটা জীবন সৌদি আরবে কাটাইয়া সংসারের ভরণপোষণ করলেন, সয়সম্পত্তি করলেন, আর শেষপর্যন্ত ছেলেরা আপনার সাথে এই আচরণ করল।’
পুরনো কথা নতুন করে ওঠায় মুনাজ্জির সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তিনি চান না তাঁর অতীত নিয়ে কোনো কথা হোক। কিন্তু এজন্য জব্বার সাহেবকে কোনো কড়া কথাও বলতে পারেন না। তিনি কিছু একটা বলার খাতিরেই বলেন, ‘মেয়েটা বাইচা থাকলে হয়তো তার কাছেই থাকতাম; তবে এইখানেও খুব ভাল আছি, আপন জনের মতো আছি। আল্লাহ্ যতদিন বাঁচাইয়া রাখেন এইখানেই থাকুম ইনশাল্লা।’
জব্বার সাহেবের হঠাৎ খেয়াল হয় জামাই করিম সাহেবের সাথে বসে আস্তে আস্তে কথা বলছে। তিনি তখন লজ্জা পেয়ে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বলেন, ‘চল বাবা, বাড়িতে যাই।’
জামাই বলে, ‘কোনো অসুবিধা নেই, আব্বা। আপনি কথা বলুন। রুগির অবস্থা আরেকটু অবজার্ভ করে যাই।’ জামাইয়ের চোখেমুখে একধরণের কৌতূহল চকচক করছে।
করিম সাহেব বলেন, ‘আমরা আপনারে কষ্টে ফেলাইয়া দিলাম বাবা।’
‘ঠিক তা নয় চাচা’, জামাই বলে, ‘আমার ইচ্ছা, আমি ওনার সাথে একটু কথা বলব। রহমতপুর তো আমাদের পাশের গ্রাম।’ জামাই করিম সাহেবের কাছ থেকেই জেনেছে মুনাজ্জির সাহেব মূলত রহমতপুরের লোক।
জব্বার সাহেব চমকে উঠে বলেন, ‘তাই নাকি? তাইলে কও, কথা কও। তবে আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া দরকার, সবাই অপেক্ষা করতাছে।’
মুনাজ্জির সাহেব জামাইয়ের কথা শুনে চোখ বড় করে তার দিকে তাকান। জামাই উঠে গিয়ে মুনাজ্জির সাহেবের পালস্ দেখে; মাথায় হাত দিয়ে তাপমাত্রা অনুভব করে – জ্বর আবার বাড়তে আরম্ভ করেছে। তারপর তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি হরিষকান্দির সাইফুল ভুইয়াঁর ছেলে কামরুল। আমার নাম হয়তো আপনি জানেন না। কিন্তু আপনি যদি রহমতপুরের মুনাজ্জির চাচা হন তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আমার বাবাকে চিনেন।’
মুনাজ্জির সাহেবের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। জামাই তাঁর এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাইফুলের ছেলে! সাইফুল ভুইয়াঁ বেশ ক’বছর আগে মারা গেছেন। ভাল বংশের লোক হলেও সংসারে বেশ অনটন ছিল। মুনাজ্জির সাহেব সৌদি আরব থাকাকালীন সময়ে মাঝেমধ্যে বন্ধুর বিপদে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধু সাইফুল সাহেব নয়, আরও অনেককেই তিনি অল্পবিস্তর সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের কথা তিনি ইচ্ছা করেই স্মৃতিতে ধরে রাখেননি। নিজের সন্তানেরাই যখন স্বার্থপরতার শেষপ্রান্তে গিয়ে বাপকে ত্যাগ করেছে তখন অন্যদের কথা মনে রাখার কোনো মানে হয় না। তবুও হয়তো আল্লাহ্ মেহেরবান বলে এই মহিমপুরের তাঁর প্রবাসী সহকর্মী আফজালের কল্যাণেই তিনি এই মসজিদের হুজরায় আশ্রয় পেয়েছেন। সেই বন্ধুপ্রতীম সহকর্মী আফজালও গত বছর ইন্তেকাল করেছেন।
বন্ধু সাইফুলের কথা মনে পড়ায় মুনাজ্জির সাহেবের চোখে জল চলে আসে। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে তিনি জব্বার সাহেবের জামাই কামরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘তুমি সাইফুলের ছেলে?’
ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। ইমাম সাহেব কিছুটা সৌজন্য দেখিয়ে বলেন, ‘ইজাযত দিলে আমি আপনাদের লাইগা একটু চা আনানোর ব্যবস্থা করতাম; কাছেই দোকান আছে।’
জব্বার সাহেব বাধা দিয়ে বলেন, ‘আরে না না, আপনার তো এমনিই তকলিফ হইতাছে।’তখন করিম সাহেব উদগ্রীব হয়ে বলেন, ‘দোকান ক্যান, আমার বাড়ি থাইক্যাই আনাইতে পারুম, দেরি হইব না।’ কিন্তু জব্বার সাহেব সজোরে মাথা নাড়িয়ে বলেন, ‘ওইটা আরেকদিন হইব, আজকে না।’
কামরুল আবেগাপ্লুত হয়ে মুনাজ্জির সাহেবকে বলে, ‘চাচা, আমি বাড়িতে এসেই আপনার খোঁজ করেছিলাম। কেউই আপনার ব্যাপারে কিছু বলতে পারল না। শুধু দুয়েকজন আপনার ট্রাজেডির কথা যতটুকু শুনেছে ততটুকুই বলেছে। আপনার ছেলেদের সাথে আমার পরিচয় থাকলে ওদের কাছে যেতাম।’
প্রসঙ্গ উঠে গেছে বলেই তখন হয়তো মুতাওয়াল্লী করিম সাহেব মুখ খোলেন, ‘ওরা তো মানুষ না, বাবা। মানুষ হইলে বাপের রক্ত পানি করা পয়সায় কেনা জমিজমা নিজেগো নামে লেখাইয়া নিয়া বাপেরে তাড়াইয়া দিত? বেচারার বউ বাইচ্যা থাকলে হয়তো পরিস্থিতি এমন হইত না। মাইয়াটাও মইরা গেল অল্প বয়সে।’
মুনাজ্জির সাহেব চোখে আর পানি ধরে রাখতে পারেন না। তিনি কামরুলের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমার বাপের লগে আমার গভীর সম্পর্ক থাকলেও বিদেশ থাকার কারণে তোমাগো লগে দেখাসাক্ষাতের তেমন সুযোগ হয় নাই। তোমারেও কোনোদিন দেখছি বইলা আমার মনে পড়তেছে না।’
তখন কামরুল বলে, ‘আপনাকে আমি ছোটবেলা দুই একবার হয়তো দেখেছি, চাচা। কিন্তু সেজন্য না, আপনি তো আমার জন্য মহান ব্যক্তি অন্য কারণে।’
মুনাজ্জির সাহেবের মুখটা একটু হা হয়ে যায়, ‘বুঝলাম না, বাবা।’
কামরুল বলে, ‘আমার বাবা বলে গেছেন, আমি যেন কোনোদিন আপনার অবদানের কথা ভুলে না যাই।’তার গলা ধরে আসে। সে বলে, ‘চাচা, আপনার কি মনে আছে যে আপনার টাকা না পেলে আমি মেডিকেলে ভর্তি হতে পারতাম না?’
মুনাজ্জির সাহেব বলেন, ‘আমার খেয়াল নাই, বাবা।’
‘শুধু মেডিকেল কেন, আমার এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার সময়ের বকেয়া এবং পরীক্ষার ফিস আপনার পাঠানো টাকা দিয়েই পরিশোধ করা হয়েছে।’ বলে, কামরুল তার মাথাটা একটু ঘুরিয়ে নেয়। হয়তো সে তার আর্দ্র চোখ লুকাতে চেষ্টা করে।
আবেগঘন এই পরিস্থিতিতে উপস্থিত সবাই যেন মূক হয়ে গেছেন। শ্বশুর হিসেবে জব্বার সাহেব জামাইয়ের পরিবারের দৈন্যদশার কথা জামাইয়েরই মুখে শুনে খুব বিব্রত হয়েছেন বলে মনে হল না। তবে ইমাম সাহেব তখন অনুচ্চস্বরে উচ্চারণ করেন, ‘মাশাআল্লাহ, এইটা তো অনেক বড় কথা।’
মুনাজ্জির সাহেবের জ্বর বেড়ে যাওয়ায় তিনি আর বসতে পারছিলেন না। নিজের ছেলেরা পশু হয়ে গেলেও বন্ধুর ছেলে আজ শুধু ডাক্তার নয়, একজন উপযুক্ত মানুষ হয়েছে সেই তৃপ্তিতে হোক কিংবা জ্বরের আতিশয্যে হোক তাঁর দুই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল। হয়তো তিনি ভাবছিলেন বন্ধুর ছেলের এই সার্থক মুখচ্ছবিই হয়তো তাঁর জীবনের পরম অর্জন। তিনি আর কোনো কথা না বলেই বিছানায় শুয়ে পড়েন।
ইতিমধ্যে কেউ না বললেও মুয়াজ্জিন তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এসে ডাক্তারের সামনে দাঁড়ান।
কামরুল মুয়াজ্জিনকে বলে, ‘আপনি গা-টা মুছিয়ে দেন।’তারপর জব্বার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আব্বা, একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা যাবে? আমি ওনাকে শহরে নিয়ে যাব।’