করমচা গাছটি অল্পদিনে বড় হয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। কী সুন্দর চকচকে তার পাতা! ফল গুলোএখনও সবুজ; কবে যে তারআসল রূপেআসবে? আধো আলতা আধোসর-শাদারং না ধরলে করমচাকে লোভনীয় মনে হয়না। তার মন মোচড়ানো রূপ যেমন সবাইকে অভিভূত করে তেমনি তারস্বাদও টকপাগল মেয়েদের মাতিয়ে তোলে। সূচনাও ওইদলের একজন। ছোট্টমেয়ে বয়স সবে দশ পেরিয়েছে। দোতলার বারান্দা থেকে রোজ সে করমচার বেড়েওঠা পরখকরে।
শুধু করমচাই নয়, প্রায় সারাদিন বারান্দায় বসে দূরের আকাশও দেখে সূচনা। উঠোনের ওপাশের কাঁঠাল গাছে নজর যায় একটুবেশি। কাঁঠাল গাছের লেজ ফোলানো কাঠবিড়ালির অস্থির লাফালাফি দেখলে সূচনার শিরায় কাঁপন ওঠে। কাঠবিড়ালির মতো তারও কুটুস কুটুস করে ছুটতে ইচ্ছে করে। পথের ধারের নারকেল গাছের মাথায় ফিঙ্গেরা ডিগবাজি খেলে সূচনারও ডানা মেলে লেজ দোলাতে মনচায়। কিন্তুছুটোছুটি, লেজ দোলানো কোনোটাই যখন হয়না, তখন তার মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়; মুখভার করে বসে থাকে সে। মা এসে তখন হয়তো পাশের মোড়ায় বসে জোর করে একটু স্যুপ খাওয়াতে চেষ্টা করেন।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সাব্বির সাহেবের একমাত্র কন্যা সূচনা। তাদের সরকারি কোয়ার্টারটা পুরনো হলেও এটি একটি পূর্ণাঙ্গবাড়ি; গ্রামের বাড়ির মতোই। পাঁচিল ঘেরা দোতলা বাড়ির চারপাশ নানা ধরনের গাছগাছালিতে ভর্তি। রাস্তার দিককার দেয়াল ঘেঁষে একটি ছোটপুকুরও আছে। পানি পরিষ্কার হলেও ওইপুকুর তেমন কেউ ব্যবহার করেনা। তবে মাঝে মাঝে আকমল সাহেবের দুই ছেলে হল্লা করে পুকুরে নেমেহাঁসের সাথে সাঁতার কেটেআসে। উপসহকারী প্রকৌশলী আকমল সাহেবের পরিবার নিচতলায় থাকে বলে কিছু হাঁস-মুরগি পালনের ব্যবস্থা তারা করেনিয়েছে। দুবছর আগে সাব্বির সাহেব প্রমোশন পেয়ে যখন এখানে বদলি হয়ে আসেন তখন সূচনা একদিন আব্বুর সাথে পুকুরে নেমে সাঁতার কেটেছিল। ওই একবারই। পাপ্পু আর লকুস্কুল মাঠেফুট বল খেলে ছুটে এসে কখনও যখন পুকুরে ঝাঁপ দেয়, তখন সূচনার প্রাণটা কেমন করে ওঠে। তারও হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে।
সূচনা সাঁতার শিখেছে দাদার বাড়ির বড়পুকুরে। দাদা নিজেপুকুরে নামিয়ে নাতনিকে হাতের ভরের ওপর রেখে হাত-পা ছোঁড়ার কৌশল শিখিয়ে সাহসী করে তোলেন। তারপর একদিন টুপ করে ছেড়ে দেন।সেদিন নাক-মুখদিয়ে পানি ঢুকে সূচনার কীযে অবস্থা! সে কান্না জুড়ে দিলেও বাকি সাথীরা হাত তালি দিয়ে চিৎকার করতে থাকে, ‘এইত্তো হিইক্যাফালাইছে, এইত্তো হিইক্যাফালাইছে।’ সূচনার কান্না তখন থেমে যায় এবং মুখে অল্প বিজয়ের হাসি ফোটে। পরদিন সে দাদার সাহায্য ছাড়াই একভেলা পরিমাণ জায়গা সাঁতার কেটে ঘাটে ফিরেছে। সেদিনের কথা তার খুব মনে পড়ে। দাদাকে দেখতেও মন চায় খুব। দাদার অসুখ, তাই অনেকদিন হয় তাদের দেখতে আসেননি।
দাদার বাড়ি অনেক সুন্দর। গ্রামটি তারচেয়েও সুন্দর। ছোট্ট নদীর পাশে নকশী কাঁথার মতো বিছানো গ্রামের ছবি সূচনার বুকের ভেতর আঁকা রয়েছে। তবে মজার ব্যাপার হল, সূচনা যত বার দাদার বাড়ি গিয়েছে ততবার তার বিস্ময় আরও ঘনীভূত হয়েছে। কেননা, কখনও গিয়ে দেখেছে পুরো তল্লাট সবুজ আর সবুজ চাদরে ঢাকা। কখনও দেখেছে মাঠজুড়ে কেউ যেন সোনা রংছড়িয়ে রেখেছে। একবার এসেতো সর্ষে ফুলের বাগানে ঢুকেসে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। তাই দাদার বাড়ির কথা মনে পড়লে সূচনার কষ্ট হয়। আম্মু বলেছে সামনের ঈদে আব্বু তাদের সবাইকে নিয়ে গ্রামে যাবে। কিন্তু সূচনার ভর সাহয় না।
পাপ্পু পাশ করলে এবার সপ্তম শ্রেণিতে উঠবে। লকু সূচনার সহপাঠী; সূচনা পরীক্ষা দিতেনা পারলেও লকু অবশ্যই হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে যাবে। পাপ্পু লকু দুজনই সূচনার সাথে সুন্দর করে কথা বলে। স্কুলে যাবার সময় ওরা ওপরের দিকে তাকায়। সূচনা বারান্দায় বসে থাকলে ওরা জিজ্ঞেস করে, ‘সূচনা, যাবে স্কুলে? ’সূচনা করুণ মুখে তখন বলে, ‘নারে। আম্মু বলেছে আর কিছুদিন পর।’
গত বছর সূচনা যখন ক্লাসে প্রথম হয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হল, তখন তাদের আনন্দ দেখে কে! সাব্বির সাহেব উপজেলার খাঁটি দুধের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে কালজাম, রসমালাই এবং মিষ্টি দই নিয়ে এসেছিলেন। আকমল সাহেবের পরিবারকে তো সেদিন বাসায় ডেকেছিলেনই, অফিসের দুজন কর্মচারীকেও ডেকে এনে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। মেয়ে যে মেধাবীতা সাব্বির সাহেব জানতেন। তার খুব ইচ্ছে, সন্তান যখন আল্লাহ্ দিয়েছে একটিই, মেয়েকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তুমাত্র এক বছরের মাথায় এসে আজ মেয়েটির যে হাল প্রাথমিক ফাইন্যাল পরীক্ষা দিতে পারে কিনা সন্দেহ, বৃত্তি পরীক্ষা দূরে থাক।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমি বৃহত্তর শ্রীহট্ট অঞ্চল। পাহাড়-টিলা, হাওর-নদী দিয়ে সাজানো ভূমণ্ডলে ঢেউখেলানো মনভোলানো চায়ের গালিচা। এ ছবি সূচনার দাদার গ্রামের ছবির চেয়ে আলাদা; অন্যরকম। এই নয়নাভিরাম ভূভাগের কমলগঞ্জ উপজেলায় আসার পর সাব্বির সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়ে সূচনাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশ যে কত সুন্দররেমা, না দেখলে বুঝবি না। আমরা একদিন লাউয়া ছড়ায় যাব।’ সূচনা বলেছিল, ‘শুধু লাউয়াছড়া? আম্মু আরও কত কত জায়গার কথাব লেছে।’ সাব্বির সাহেব বলেন, ‘হবে হবে, একবার একদিকে যাব। আশে পাশের যা আছে কিছুই বাদ দেবনা।’ কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেননি।
সেদিন সূচনার জীবনে যা ঘটল তা স্বাভাবিক অবস্থায় মেয়েদের জীবনের কাঙ্ক্ষিত একপর্বেরই সূচনা। নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মেয়েরা যেমন ভয়কে জয় করে তেমনই মায়েরাও মেয়েদের প্রতি আরও বেশি দায়িত্বশীল হয়। সূচনাকেও তার মা মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের কথা একটু একটু করে বুঝিয়ে আসছিলেন। সেদিন সে যন্ত্রণায় কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলে তার অভিজ্ঞ মা মেয়েকে চটজলদি অভয় দিয়ে তার কান্না থামান। মেয়েদের সুরক্ষার পদ্ধতি হাতে কলমে তাকে শিখিয়ে দেন। তারপর নিজেই লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মোছেন। প্রাকৃতিক নিয়মেই এ পরিবর্তন; এটা অনাহুত নয়। সূচনার মায়ের কাঁদার কথা ছিলনা, তবুও তিনি কেঁদেছেন–অজানা আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়।
দিন যতই যাচ্ছে সাব্বির সাহেব মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়ছেন। তিনিও লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মোছেন। তার বড় আক্ষেপ, মেয়েটিকে কথা দিয়েও তিনি কথা রাখতে পারেন নি। একবার স্কুল থেকে শিক্ষকরা মনিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্সে ছাত্রদের নিয়ে গিয়েছিল–এইটুকুই যা তার দেখাদেখি! আকমল সাহেব তার বাচ্চাদের নিয়ে চুপিচুপি বেশ কিছু জায়গা ঘুরে এসেছেন। অথচ সাব্বির সাহেব নিজের মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেননি। গত ছয় মাসে তিনি তিনবার ঢাকা গিয়েছেন সূচনাকে নিয়ে। তখন চলতি ট্রেনথেকে আঙুল দিয়ে তাকে দেখিয়ে বলেছেন, ‘ওই যে দেখ লাউয়াছড়া…।’ মেয়েকে খুশি করার জন্য বিলক্ষণ চেষ্টা করেছেন তিনি, কিন্তু কষ্টে তার বুকটা ফেটে গিয়েছে।
সূচনা স্কুলে যেতে পারছেনা বলে পাপ্পু-লকুদেরও মন খারাপ হয়। ওদের মা-বাবাও ফিসফিসিয়ে সূচনার কথা বলেন। তবে মা কথা বলতে গেলে কাঁদো কাঁদো হয়ে যান। বলেন, ‘আল্লাহ্একটা বাচ্চাই দিল ওনাদের……। ভাবী লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।’ এসব দেখে একবার লকুইমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মা, সূচনা সুস্থ হয় না কেন? স্কুলেও যায়না।’ মা তখন বলেছেন, ‘চুপচুপ, বাবা। অসুখ নিয়েও দের সাথে তোমরা কথা বলোনা। ওরা কষ্টপাবে। সূচনা সুস্থ হয়ে গেলে আবার তোমাদের সাথে স্কুলে যাবে।’
সেদিন মায়ের কাছে শুয়ে শুয়ে সূচনা বলছিল, ‘ট্রেনে চড়তে চড়তে চা বাগান ভালভাবেই দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু আম্মু, এখানে কোথায় নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওর আছে– হাকালুকি। যদি হাওরে নৌকায় চড়ে আকাশটা দেখতে পারতাম।’ মা আঁচলে চোখ মুছে মেয়ের মাথায় বিলিকেটে দিতে দিতে বলেন, ‘অবশ্যই যাব মা, আমারও দেখতে ইচ্ছে করে। আমরা যখন যাব তখন জেলেদের কাছ থেকে অনেক তাজা মাছ কিনে নিয়ে আসব।’ সূচনা তখন একটুচুপ করে থাকে। একটু পর আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মু, আমি কি ভাল হবনা? পরীক্ষা দিতে পারবনা? ’মা তখন ত্রস্ত হয়ে বলেন, ‘কে বলেছে তুমি পরীক্ষা দিতে পারবে না? ডাক্তার বলেছে আর কিছুদিন পর তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।’
সূচনার প্রায়ই জ্বর থাকে। তবুও সে বারান্দায় এসে মোড়ায় বসে। করমচাগাছের ডালগুলো দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। সবুজ ফলগুলো একটু হলদেটে রং ধরতে শুরু করেছে। সূচনাতার অসুস্থ শরীর নিয়ে এটা ভাবতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না যে করমচার মতো তার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে, সে-ও একদিন করমচার মতো সফলতার রঙ্গিন সোপানে আরোহণ করবে। তবে ইদানীং সূচনার সাথে কয়েকটা চড়ুইয়ের ভাব হয়েছে। সে বারান্দায় বসলেই ওরা কিচিরমিচির করে ওর চারপাশে ওড়াওড়ি করতে থাকে। সূচনা তখন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মাকে ডাকতে থাকে। মা খুশি হন–মেয়েটা একটু হাসতে পারছে। তিনি একটি বাটিতে করে কিছু মুড়ি বাচাল নিয়ে এসে সূচনাকে দিয়ে বলেন, ‘ওরা তোমার বন্ধু, ওদের আপ্যায়ন করবে না? এইনাও; বারান্দায় ছিটিয়ে দাও। দেখবে ওরা মজা করে খাবে।’ সূচনা মনে মনে ভাবে, যাক, কাঠবিড়ালিদের সাথে খেলতে না পারলেও চড়ুইদের তো পাওয়া গেছে।
সন্ধ্যায় সূচনা শুয়ে থাকলে সাব্বির সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে কথা বলেন। এই কথার মধ্যে আনন্দ বা সুখের ছোঁয়া নেই। থাকে শুধু কান্না আর হতাশা। সূচনার মা হতাশাকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ। তাঁর কথা হল, আমাদের তো একটা মেয়ে ছাড়া কিছু নেই। সর্বস্ব দিয়ে হলেও মেয়েকে সারিয়ে তুলতে হবে। ডেলটা মেডিকেলে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর সূচনার লিউকেমিয়া ধরা পড়লে সাব্বির সাহেব দিশেহারা হয়ে পড়েন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা অভয় দিয়ে বলেছে, ঠিকমতো চিকিৎসা করলে রুগির সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। সাব্বির সাহেব আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে ডেলটাতেই চিকিৎসা শুরু করে দেন। কিন্তু সূচনার মা নাছোড় বান্দার মতো স্বামীকে রাজি করিয়ে ঢাকার এক পুরনোহোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের কাছে মেয়েকে নিয়ে যান। হোমিও ডাক্তার বলেছেন, হোমিও ওষুধ অ্যালোপ্যাথের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। অতএব দুটোই একসাথে চলতে পারে। সূচনা ধারে কাছে না থাকলে স্বামী-স্ত্রী ক্ষীণকণ্ঠে শুধু মেয়েকে নিয়েইহা-হুতাশ করেন।
যদিও রোগ জটিল পর্যায়ে যায়নি, মেয়ের লক্ষণীয় কোনো অগ্রগতি দেখতে না পেয়ে সাব্বির সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়ে। এসব সরকারি ডিপার্টমেন্টকে লোকজন যা-ই মনে করুক, সাব্বির সাহেব তার দপ্তরে একটু ব্যতিক্রম। চাকরির খাতিরে যতটুকু কাদা গায়ে না মাখলেই নয়, ততটুকুই তিনি মাখতে বাধ্য হয়েছেন। তাই এমন কোনো সামর্থ্য তার নেই যে চাইলেই হুট করে তিনি মেয়েকে নিয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড বা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারবেন। এমন জটিল অবস্থায় একদিন সূচনার মা স্বামীকে জোর করে ধরে বললেন, ‘আমি শুনেছি এই কমলগঞ্জে অনেক খাসিয়া-মনিপুরী লোক আছে। এরা জটিল জটিল রোগের কবিরাজি চিকিৎসা করে। প্লিজ, চলোনা একটাবার ওদের কাছে যাই।’ সাব্বির সাহেব নির্বিকার ভাবে বলেছেন, ‘একটু খোঁজ করতে দাও।’
সূচনার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সেদিন কয়েকটি ফুল আর কিছু চকলেট নিয়ে সূচনাকে দেখতে আসেন। সূচনা ম্যাডামের চকলেটের চেয়ে ফুলই অধিক পছন্দ করে। ম্যাডাম বলেন, ‘কোনো চিন্তা করোনা। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। তোমার আব্বুর সাথে কথা হয়েছে। তুমি পরীক্ষার সময় স্কুলে গিয়ে শুধু বসবে, যা পার তাই লিখবে। ব্যস।’সূচনা খুশি হয়ে বলে, ‘অবশ্যই যাব ম্যাডাম। আর আমি ভাল হয়ে গেলে আমাদের বাসায় আরেকদিন আসবেন।’ ম্যাডামের মন একটু ভারাক্রান্ত হলেও প্রিয়ছাত্রীকে তা বুঝতে না দিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি সুস্থ হয়ে গেলে আমি দাওয়াত খেতে আসব।’
অসুখের জন্য এমনিতেই তার চলা ফেরায় সীমাবদ্ধতা অনেক, উপরন্তু সাম্প্রতিক শারীরিক পরিবর্তনের কারণেও সূচনার মধ্যে একটু জড়তা কাজ করছে। বারান্দায় বসলেও সে আগের মতো উন্মুক্ত আচরণ করতে পারেনা। পাপ্পু-লকুদের দেখলে ও সে আর যেচে কথা বলেনা। ম্যাডাম পরীক্ষার দিনে যেহেতু স্কুলে যেতে বলেছেন তাই সূচনা কষ্ট করে হলেও বইয়ের দুয়েকটা পাতা উল্টাতে চেষ্টা করে। সেসুস্থ থাকলে মা হয়তো অনেক সচেতনতা মূলক পরামর্শ তাকে দিতেন। কিন্তু এখন সবকিছু বাদ দিয়ে তাঁদের সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা মেয়ের সুস্থতা নিয়ে।
মা-ই সূচনাকে একয় দিন কষ্ট করে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন। কোনো চাপ ছাড়াই তাকে তার ইচ্ছা মতো যতটুকু পারে ততটুকুই লিখতে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে এই প্রশ্ন তাকে কেউ করেনি। পরীক্ষার শেষ দিনে রিক্সা থেকে নেমে বাসায় ঢুকতেই সূচনা বলল, ‘আম্মু, ঘাটে একটু বসব। দেখ, হাঁসগুলো কী সুন্দর সাঁতার কাটছে।’ তার মা বললেন, ‘চল, বসি। তবে বেশিক্ষণ বসব না, তোমার গায়ে জ্বর আছে।’ ঘাটলায় বসতে বসতে সূচনা একটু উচ্চ কিত হয়ে বলে, ‘আম্মু, দেখ দেখ অনেক গুলো শাপলা গাছ! কিন্তু ফুল নেই কেন?’ মা একটু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন, ‘ফুটবে মা, আবার বর্ষার দিন আসলেই ফুল ফুটবে।’
কিছু দিন পর সাব্বির সাহেব সন্ধ্যাবেলা বাসায় হন্ত দন্ত হয়ে ঢুকে স্ত্রীকে বলেন, ‘কাল সকালে মৌলভীবাজার পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে; আমারতোআছেই, তোমার আর সূচনার আর্জেন্ট পাসপোর্ট করব।’
সূচনার মায়ের নাম হাসনা হলেও সাব্বির সাহেব স্ত্রীকে কখনও নাম ধরে ডাকেননি। প্রয়োজনে, ‘এই শুনছ’ কিংবা ‘সূচনারমা’ বলেই চালিয়ে এসেছেন। তবে এই নাম ধরে না ডাকা কোনো ভাবেই তাদের ভালবাসার গভীরতা কমিয়ে দেয়নি। স্ত্রীও স্বামীকে একই ভাবে সম্বোধন করেন। অবশ্য আগে যখন মন ফুরফুরে থাকত তখন সূচনার আব্বুকে তিনি ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’ বলে ডাকতেন। সংসারের প্রতিটি ব্যাপারে তাঁরা দুজন কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন। শুধু সূচনার অসুস্থতার পর থেকেই নিয়মের একটু ব্যত্যয় ঘটছে। যেমন, সূচনার চিকিৎসক খুঁজে বের করতে সাব্বির সাহেব স্ত্রীর পরামর্শ চাননি। কিংবা হোমিওচিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন কিনা সে অনুমোদন স্ত্রীস্বামীর কাছ থেকে নেননি। এই পাসপোর্ট কিংবা বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটাও সাব্বির সাহেব স্ত্রীর সাথে আলাপ করেননি। হাসনা বোঝেন, এখানে কোনো ভুল হয়নি; এখন মত বিনিময়ের সময় নয়। মেয়ের অসুস্থতা তাদের একমুহূর্তও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছেনা।
পাসপোর্ট অফিসের কাজ সেরে এসে সাব্বির সাহেব দুপুরের খাবার সেরে তার অফিসে চলে যান। স্ত্রী বাড়তি কোনো প্রশ্ন করেননি তাঁকে। সূচনা অবশ্য মাকে একটু উত্তেজনা নিয়েই জিজ্ঞেস করেছে, ‘আমরা কি বিদেশে যাব, আম্মু? কোন দেশে যাব?’
মা একটু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, ‘দেখি, যেখানে গেলে আমরা সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখতে পারব, জায়গা দেখতে পারব, সেখানেই যাব।’
সূচনা বড়দের মতো একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই আমরা ডাক্তারের কাছে যাব, তাইনা?’
হাসনা কষ্ট করে একটি দীর্ঘশ্বাস চেপে ধরে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই একসাথে তোমাকে একজন ভাল ডাক্তারও দেখিয়ে নিয়ে আসব।’
সন্ধ্যায় সূচনা শুয়ে পড়লে সাব্বির সাহেব স্ত্রীকে বলেন, ‘চিন্তা করে দেখলাম, মেয়েটা না বাঁচলে আমাদের তো কোনো কিছুরই দরকার নেই, এই জীবনেরও দরকার নেই…’
স্বামীর গলা ভারী হয়ে আসলে হাসনা আঁচলে চোখ মুছে বলেন, ‘একটু খুলে না বললেতো কিছু বুঝতে পারছিনা, শান্তিও পাচ্ছিনা।’
‘কী বলব, বল’, সাব্বির সাহেব একটু স্থির হয়ে বলেন, ‘আল্লাহ্র ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। ডেল্টার ডাক্তার ভদ্রলোককে আমার মানবিকই মনে হয়েছে। তিনি নিজেই ফোন করে আমাকে খবরটা দিয়েছেন।’
হাসনা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী বলেছেন তিনি?’
‘উনি বলেছেন যে চেন্নাই অ্যাপোলোর অনেকবড় একজন বাঙালিচিকিৎসক আগামী সপ্তায় কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেন ঈগলসেআসবেন–শিডিউল থাকলে এভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আসেনও। সূচনার ওই চিকিৎসকই ইন্ডিয়ার ডাক্তারের সাথে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ এতটুকু বলে সাব্বির সাহেব থামলেন।
সূচনার মা স্বামীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন কিন্তু কিছু বললেন না। তখন সাব্বির সাহেব আবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইংল্যান্ডে নাকি একটি কমবয়েসী মুমূর্ষুছেলের ওপর চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একটা এক্সপেরিমেন্ট করে সফল হয়েছেন–ওটা নাকি ডিএনএ’ রবেস এডিটিং নাকি কী যেন চিকিৎসা। ইংল্যান্ডের ডাক্তাররা নাকিশত ভাগসফল হওয়ায় চেন্নাইর চিকিৎসকরাও ভারতে এই পদ্ধতি পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর বেশি কিছুজানিনা। আল্লাহ্ওপর ভরসা করে যাব। এই।’
যাবার আগের দিন অনেক হুলস্থূল হল। খারাপ শরীর নিয়ে সূচনাকে দেখতে দূরের পথপাড়ি দিয়ে দাদা এসে হাজির। নাতনিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে অনেক কাঁদতে কাঁদতে নিজের ছেলেকে তিনি দোষারোপ করতে থাকেন, ‘তুই আমারে আগে জানাস নাই কেন্। আমিতো মইরা যাই নাই।’ হাসনা হন্তদন্ত হয়ে বলেন, ‘আব্বা, আপনি শান্ত হোন; আপনি অসুস্থ। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন তাই জানানো হয়নি।’
বিকেলে পাপ্পু লকু দুজনই সূচনাকে দেখতে এসেছিল। ওদের মা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছিলেন সেভাবেই তারা সূচনার সাথে কথা বলেছে। লকু বলেছে, ‘তোমার কিছু হয় নাই, এইতো ভাল হয়ে যাবে। তারপর আমরা একস্কুলেই পড়ব।’ পাপ্পু যোগ করে, ‘সূচনা কত ভাল ছাত্রী; সে ডাক্তার হবে। আঙ্কেল হয়তো তাকে অনেক ভাল স্কুলে পড়াবেন।’ সূচনা কিছুই বলেনা। শুধু তার ফ্যাঁকাসে মুখে আলতো হাসি চাপিয়ে তাদের কথা শুনতে থাকে।
সাব্বির সাহেব স্যুটকেস এবং ডাক্তারি কাগজ পত্র গোছাতে গোছাতে ওদের কথা শুনছিলেন। পাপ্পুর কথা শুনে তাঁর চোখ ভিজে যায়। সেতো ঠিকই বলেছে। নিজের মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন বলে সাব্বির সাহেব পণ করে রেখেছেন। জীবনে তেমন কিছুই তিনি পাননি। শুধু একটাই স্বপ্ন তাঁর–মেয়ে বড় ডাক্তার হবে। স্বামীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হাসনার দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি এগিয়ে এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, আমার মেয়েকে আমরা অনেক বড় ডাক্তার বানাব। সে তার দাদা-দাদীর চিকিৎসা করবে, আমাদের চিকিৎসা করবে।’ সাথে সাথে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাইনা মা?’
সূচনা আগের মতোই হাসিহাসি মুখ করে বসে থাকে। এদিকে তার পিতা, সাব্বির সাহেব চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিশ্চুপ প্রার্থনা করতে থাকেন, ‘আমাদের স্বপ্ন যেন সত্যি হয়, খোদা। তুমিতো পরমদয়ালু ও দাতা।’