লেক অন্টারিও

বৃষ্টি ও প্রেম (অক্টোবর ২০২২)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৫৮
হাম্বার বে পার্কের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে অন্টারিও লেকে যাচ্ছিলাম। কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রর মাঝখানের এই বিশাল হ্রদের পাড়ে যাবার হাজারটা পথ। আমি টরোন্টোর ইটোবিকোকে এসে আশ্রয় গেড়েছি বলে সুযোগ পেলেই পার্কের নয়নাভিরাম এই হাঁটা-পথে অন্যান্য বুড়োবুড়ি ছোঁড়াছুঁড়ির সাথে দুলতে দুলতে আর্চ ব্রিজ পর্যন্ত চলে যাই। পুরো সামারেই এই শীতের দেশের লোকজন প্রাণ খুলে এবং পোশাকের বাহুল্যকে সযতনে ছুঁড়ে ফেলে তাদের বিশাল ভূখণ্ডে ছুটোছুটি করে। অন্টারিও লেকও বিনোদন ও অবকাশ যাপনের এক নন্দিত ঠিকানা। তো, ওই বুনোপথের মাঝখানে হাম্বার পার্ক প্যাভিলিয়ন নামের যে ছাউনিটা আছে সেখানে গিয়েই দাঁড়াতে হয়েছিল কিছুক্ষণ।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শীত হাতছানি দিচ্ছে – সে তো দেবেই। মাঝে মাঝে ঝাপটা বৃষ্টিও আছে। এরকম ঝাপটায় পড়ে প্যাভিলিয়নের ছাউনিতে মাথা গলিয়ে দেখি আরোও দু’চার জনের সাথে স্বল্পবসনা রথী দাঁড়িয়ে। বেশির ভাগ সাইক্লিস্ট পায়ে কেডস মাথায় হেলমেট এবং ছোটখাটো পোশাক পরেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কেউ কেউ হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতেও সাইকেলের প্যাডেল মারে। রথীর কানে কোনো ইয়ারফোন বা হেডফোন নেই। কানাডাবাসী রথীর সাজসজ্জায় আমার বিস্মিত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। কিংবা এ পোশাকে তাকে চিনতেও আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। সে অবশ্য আমাকে দেখে একটু চমকে উঠেছিল, ‘আরে তুমি! তুমি এখানে! কেমন করে?’
প্যাভিলিয়নের ছাউনির নিচ থেকে দেখলাম, না, ঝাপটা বৃষ্টি সবাইকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। অনেকগুলো হোঁতকা, কিছু চোপসানো নরনারী বৃষ্টির মধ্যেও জোর কদমে ছুটছে। শুধু তাই নয়, কিছু হার-না-মানা সবল সাইক্লিস্ট প্যাডেল মেরেই চলেছে। রথী থেমে পড়ল কেন জানি না; তার সাইকেলটি অদূরে একটি ম্যাপল ট্রির সাথে ঠেস দিয়ে রেখেছে। বছরখানেক আগেই সে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিল, তা আমি জানতাম। তবে কেন, কীভাবে – এসব ব্যাপারে আমি বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারিনি। অন্য কথায়, খোঁজ নেয়ার আগ্রহও প্রবল ছিল না। এখন তাকে দেখে ওইসব প্রশ্নের উত্তর জানার কিছুটা ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বললাম, ‘গত মাসে এসেছি। বলতে পার, বেড়াতে – ভিজিটর ভিসায়।’
‘ইন্টারেস্টিং!’ রথী বলে, ‘একা?’
আমি এসেছি স্ত্রী শাহানা এবং ছেলে শান্তকে নিয়ে। সম্বন্ধীর বদান্যতায়। থাকছিও তার বাসায়। রথীকে তা-ই জানালাম, কোনো বাহুল্য বা ভণিতা ছাড়া।
রথীর মানসগঠন আগের মতো যে নেই তা সহজেই বোঝা যায়। আমার কথায় তার মনে কষ্ট কিংবা ক্ষোভের সঞ্চার হল বলে মনে হল না। সে বলল, ‘ভেরি গুড, হ্যাভ আ নাইস স্টে।’
রথীর ঋজু সংলাপ শোনার পরও আমার শব্দ চয়ন ও প্রক্ষেপণে দৃঢ়তার অভাব দেখে সে নিজেই আমাকে একটু ঝাঁকিয়ে সোজা করে নিয়ে বলল, ‘দেখ, এই সময়ের কানাডার বৃষ্টির সাথে ঢাকার পশলা বৃষ্টির মিল আছে। ঝুম করে এসেই দুম করে বিদায়।’
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি।’
‘কেন, মনে নেই?’ রথী স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় হঠাৎ বিনা নোটিশে ঝপাস করে এক পশলা এসে পড়লে আমরা ছুট লাগাতাম যাত্রী ছাউনির দিকে…।’
মনে থাকবে না কেন? এ তো সেদিনের কথা। একটু মোহ আর মুগ্ধতায় আর্দ্র হয়ে গেলে রথী আর আমি নিরাপত্তার জন্য প্রায়শই সন্ধ্যায় কচুক্ষেত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আশা-নিরাশার হাজার কথা বলতাম। নিরাপত্তার ব্যাপারটা রথীর জন্য যতটা না জরুরি, তার চেয়ে বেশি ছিল আমার জন্য। কেননা রথী তখন হাত-পা ঝাড়া, স্বাধীন। সিনেমার প্রডিউসার তার এক্স-স্বামী ততদিনে উঠতি এক নায়িকার সাথে স্থায়ীভাবে লিভ-টুগেদারে মজে আছে।
রথীর ইর্ষনীয় স্মার্টনেস তো ছিলই, সাথে দুর্দমনীয় নির্ভীকতাও। ও আমার কলেজের সহপাঠিনী ঊর্মির ছোটবোন। আমাদের বাসাও একই এলাকায়, ছয় নম্বর সেকশনে। ঊর্মি আমার ভাল বন্ধু হলেও ওর সাথে মন দেয়া-নেয়ার ব্যাপার ঘটেনি বা ঘটার সুযোগ ছিল না। তার ফরেন ক্যাডারের স্বামীর সাথে সে এখন বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর কথা কী নির্দ্বিধায় রথী বলে ফেলল। আমি পারতাম না। এটাই তার সাহসিকতার প্রমাণ। এটি ছাড়াও আরোও অনেক প্রমাণ আছে। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়। পরিবারের কেউ রাজি না থাকলেও একদিন হুট করে সিনেমার প্রযোজক ইকবালকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসে সে। তারপর বাবা-মার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তো, ওই ঊর্মির সূত্রেই রথীর সাথে আমার পরিচয়, টুকটাক কথাবার্তা। তবে সে আমার সাথে আপনি আপনি করে কথা বললেও আমি মেপে মেপে কথা বলতাম, কখন সে ঠাস করে ভয়ঙ্কর কথা বলে ফেলে সেই ভয়ে।
ইকবালের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে রথী আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করত। তার সংসারের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি, সে নিজেই গড়গড় করে বলেছে কীভাবে ইকবালকে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছে। তারপর, ফোনে কথা বলতে বলতে, ওই যে, মোহ আর মুগ্ধতার জালে আটকা পড়ে কয়েক দফা এখানে ওখানে দেখা করতে যাই তার সাথে। এক সময় সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে রথী অবলীলায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে এল। বলল, ‘রনি ভাই, কাল সন্ধ্যায় আমরা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যাব। তোমার অফিস তো বনানীতে; তুমি কাকলী হয়ে কচুক্ষেত চলে এস। নিরিবিলিতে গল্প করতে করতে হাঁটব।’
ওই হাঁটাহাঁটির গল্পটা একটু দীর্ঘ ও বহুমাত্রিক। তবে রথী বৃষ্টির কথাটিকেই শুধু টেনে এনেছে। সাহসী মেয়ে বটে। এক সন্ধ্যায় ঝুম করে বৃষ্টি নামলে আমি আর রথী দৌড়ে যেয়ে একটি ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ওটা কি যাত্রী ছাউনি নাকি সৈনিকদের জন্য নির্মিত কোনো চালা ছিল তা বুঝতে পারিনি। তবে ওখানে তৃতীয় কেউ না থাকায় রথী আমাকে বাঘিনীর মতো জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল। এবং বলেছিল, ‘চল, সব ছেড়েছুড়ে আমরা অন্য কোনো দেশে চলে যাই।’
বৃষ্টি আরোও কয়েকবার হয়েছিল এবং বৃষ্টি ছাড়াও রথীর দুঃসাহসিকতা আমাকে সাহস যুগিয়েছিল। কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে পরিযায়ী পাখির মতো অন্য কোথাও চলে যাবার সাহস আমি সঞ্চয় করতে পারিনি।
‘পরিচয় করিয়ে দিই…।’ রথীর কণ্ঠ শুনে আমার ঘোর কেটে যায়। তাকিয়ে দেখি রথীর পাশে সুদর্শন এক শাদা যুবক। রথী বলে, ‘আমার বয়ফ্রেণ্ড ডন, ডোনাল্ড।’
আমি হে হে করে ডনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে রথী বলে, ‘মাই গুড ওল্ড ফ্রেণ্ড ফ্রম বাংলাদেশ, রনি।’
ডন বলে, ‘নাইস মিটিং ইউ মিস্টার রনি; সি ইউ অ্যাগেইন।’
ঝাপটা বৃষ্টিতে রথী থেমে গেলেও ডন কিন্তু সাইকেল চালানো থামায়নি। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় রথীও তার সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আবার কোনোদিন বৃষ্টি হলে দেখা হবে রনি ভাই।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাসুম পান্থ চমৎকার খুব ভালো লাগল প্রিয়
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শ্রাবনী রাজু ভালো লাগলো দারুণ
অনেক ধন্যবাদ। সাথে থাকুন।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

বৃষ্টিও প্রেমের আবহ তৈরি করে, এবং কখনও প্রেমের নিয়ামক। রথী-রনির জীবনের ক্ষুদ্রাংশ জুড়ে ক্ষণিকের প্রেমালু বৃষ্টি এসেছিল। বর্তমানের বৃষ্টি অতীতের বৃষ্টির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪