আশ্রয়শিবির

প্রত্যাশা (আগষ্ট ২০২২)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • 0
  • ৮১
অর্ধেক টেনে নেভী সিগ্রেটের বাকি অংশ কালাম্যার দিকে এগিয়ে দেয় ময়নার বাপ অর্থাৎ মফিজ । কালাম্যার সিগ্রেট কিনে বিলাসিতা করার মুরোদ নেই। মুফতে পেলে দু’টান দেয়। মূলত হুঁকোতেই সে বন্দী। তবে মফিজ হুঁকোর ঝামেলায় যেতে অনীহ। সে অল্পদামের নেভী নাহয় শেখ সিগ্রেট কিনেই খায়। নিভিয়ে নিভিয়ে খেলেও কম করে হলেও আটটা সিগ্রেট তার দৈনিক লাগে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গুনাই নদীর তীরের জমির আলে মফিজ তার ছাগলগুলি ছেড়ে দিয়ে পাগলা রোডের গাব গাছের নিচে বসেছিল। কালাম্যা তখন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে উচ্ছিষ্ট চাল, চিড়া, ডাল ইত্যাদি নিয়ে ফিরছিল। মফিজকে দেখে একটু গালগল্প করার জন্য সে-ও তার পাশে বসে পড়ে।

কিছুক্ষণ দেশের হালচাল নিয়ে কথা বলার পর মফিজ জিজ্ঞেস করে, ‘ঘরবাড়ির কতা কিতা কইল?’

‘কইছে দিব; যারার ঘর মাটিত মিশ্যা গেছে তারা আগে পাইব।’ কালাম্যা দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলে।

মফিজ জিজ্ঞেস করে, ‘সরকারের পয়সা আছেনি? ঘর বানাইব কেবা কইরা?’

‘আরে মিয়া, সরকারের টাইম আছেনি?’ কালাম্যা বলে, ‘এই যে আমরা রিলিফ পাইলাম, ইতান কারা দিছুইন; পাবলিক দিছে, দেশ-বিদেশ থন পাবলিক টেহা পাঠাইছে, কুটি কুটি টেহা। তাইনেরাই আমরার ঘর বানাইয়া দিবাইন।’

আরোও বেশ কিছুক্ষণ তাদের কথার পিঠে কথা চলে। এবং দুজনই মোটামুটি এই সত্যে একমত হয় যে দেশটা পচে গেলেও এখনও কিছু মানুষ পচে যায়নি; মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মফিজের ব্যাপার একটু আলাদা। ঢেউটিন-ঘেরা ঘরের ভেতর পানি উঠে গেলে হাফিজ ছুটে আসে গাজীপুর থেকে। কাঁথা-বালিশ, বাসনকোসন ইত্যাদি প্যাক করে বাপ-মা এবং ছোটবোন ময়নাকে বলে, ‘নৌকায় ওঠ।’

মফিজ বলে, ‘আমি যাইতাম না। আমার ছাগলগুলান কিতা হরাম?’

হাফিজ রেগে বলে, ‘ছাগলগুলান ছাড়ান দেও, আগে নিজে বাচো। আমার বাসায় কষ্টমষ্ট কইরা কয়ডা দিন থাকবাইন।

মফিজ বুঝিয়ে বলে, ‘হুন বাজান, আমার অসুবিধা অইত না, তুই তারারে লইয়া যা। আমি একটা সুবিধা পাইছি, ছাগলগুলান লইয়া আমি আরামে থাকবাম। তুই তারারে তোর বাসাত লইয়া যা।’

ছেলে অনেক সাধাসাধি করলেও মফিজের মত পালটাল না। সে গিয়ে উঠল পাইলট স্কুলের আশ্রয় কেন্দ্রে। সে এক আজব দুনিয়া। গবাদিপশু আর মানবসন্তানের সহাবস্থান। লঙ্গরখানার খাবার মিললেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগশোকে প্রায় সবাই কমবেশি ভুগেছে। ডায়রিয়ায় দুইটি শিশুও মারা গেছে। মফিজ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তবে মুক্তিযোদ্ধা এবং একাত্তরে ভারতে আশ্রয় নেয়া অনেকের কাছ থেকে সে শরণার্থীশিবিরের অমানবিক পরিবেশের কথা শুনেছে। আশ্রয়শিবিরে উঠে তার মনে হয়েছিল একাত্তরের শরণার্থীরা হয়তো এমন পরিবেশেই নয়টি মাস ছিল।

মফিজের ঘর ধ্বসে পড়েনি, তবে জল-কাদায় থকথকে অবস্থা। বাড়ানো চালার নিচের পাকঘরটার অবস্থাই বেশি খারাপ। উনুন আবার নতুন করে বানাতে হবে। কোনোমতে সে ইটের ওপর পাতিল বসিয়ে চাল-ডাল ফুটিয়ে খায়। কড়ি বরগার সাথে ঝুলিয়ে রাখা কাঁথা-বালিশের বস্তাটি নামিয়ে চৌকিতে শোয়ার ব্যবস্থাও করে নিয়েছে। হাফিজ জানিয়েছে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সে তার মা এবং ময়নাকে নিয়ে আসবে না। তাছাড়া তার ছেলে দাদী ছাড়া এখন কিছু বোঝে না।

শাশুড়িকে পেয়ে হাফিজের বউ সুলতানাও খুশি। তারা স্বামী-স্ত্রী একই গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করে। পরিচয়-প্রণয় ওই কর্মস্থলেই। গার্মেন্টস কর্মীর অনেকেই তাদের বাচ্চা মাখনের মায়ের কাছে রেখে যায়। বাচ্চাপ্রতি দৈনিক পঞ্চাশ টাকা করে নিলেও মাখনের মায়ের সুনাম আছে। সে গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের দিবাযত্ন অর্থাৎ ডে কেয়ারকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে। সুলতানাও তার ছেলেকে এতদিন খাবারের টিফিনবক্সসহ মাখনের মায়ের কাছে রেখে যেত। শাশুড়ি আর ননদ আসার পর আপাতত তার ছেলেকে মাখনের মায়ের কাছে রাখতে হচ্ছে না।

মফিজের খাবারদাবারের কষ্ট হলেও পোয়াখানেক ছাগলের দুধে তার পুষ্টি-চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। যে ছাগলের দোহাই দিয়ে সে ছেলের সাথে যায়নি তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। দুটিই মাত্র ছাগী, একটা গাভীন আর অন্যটা বন্যার আগে আগেই দুটি বাচ্চা প্রসব করেছে। স্ত্রী-কন্যার অবর্তমানে এগুলো নিয়েই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে মফিজ।

সেদিন রাস্তায় পেয়ে আবুল্যার বউ মাঝারি সাইজের একটি কাঁঠাল ধরিয়ে দিয়েছে মফিজকে। মফিজ যতই না না বলুক আবুল্যার বউ শুনবেই না। সে বলেছে, ‘নিতাইন না ক্যারে বাইসাব, আফনে কত উপকার করছুইন আমরার। আফনে না থাকলে কী যে বিফদে পড়তাম আমরা।’

মফিজ বলেছে, ‘তুমরা এখন তো আরো বড় বিফদে আছ; ঘরের বেড়াটেড়া ভাইঙ্গা পড়ছে না?’

‘ভাঙছে টিহই; তয় আমরা কুনুরকম মেরামত কইরা আছি।’ আবুল্যার বউ বলে, ‘হুনছি সরকার নয়া ঘর বানাইয়া দিব।’

মফিজ মৃদু অবজ্ঞার হাসি হাসে, ‘বালা; সরকারে ঘর বানাইয়া দিলে তো বালা-ই অয়।’

উত্তরপাড়ার আবুল্যাও বন্যার তোড়ে তার বউকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছিল। কিছু বদনাম থাকায় আরোও কিছু লোকের মতো মফিজও আবুল্যার পরিবারের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কিন্তু দুর্যোগের সময় দূরত্ব বলতে কিছু থাকে না। বিশেষ করে আশ্রয়শিবিরে ওঠার একদিন পরই যখন দাস্ত আর জ্বরের দাপটে আবুল্যা মরো-মরো হয়ে পড়ে তখন মফিজই দৌড়ঝাঁপ করে ওষুধ-স্যালাইন যোগাড় করে দিয়েছিল। মফিজের সাথে ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও সেদিন থেকেই আবুল্যার বউ তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে যায়। আশ্রয়শিবিরে পরের কয়েকদিন অবস্থানকালে তাদের সম্পর্ক সহজ ও আন্তরিক হয়ে যায়। এমন কি একদিন সন্ধ্যাবেলা স্কুলঘরের পেছন দিকে আবুল্যার বউ যখন লুকিয়ে বিড়ি টানছিল তখন মফিজ এগিয়ে গিয়ে তাকে এক শলা শেখ সিগ্রেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘চুরি কইরা খাওনের দরকার নাই, এইডা নেও।’ আবুল্যার বউ আচমকা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেও পরে ঠিকই মফিজের দেয়া সিগ্রেট শলাকা নিয়ে নেয়। এরপর আরোও অনেকবার তারা একসাথে বসে আজাড়ে গল্প করতে করতে সিগ্রেট টেনেছে।

মফিজ আবুল্যার বউয়ের দেয়া কাঁঠাল না নিয়ে পারেনি সেদিন। তবে তার মন ভীষণ খচখচ করছিল, যদি কেউ দেখে ফেলে। দেখে ফেললে কী হবে তা সে জানে। কেউ কেউ মন্দ বলবে। বলবে, তাহলে আবুল্যার বউ মফিজকেও কাবু করে ফেলেছে। মফিজ এ ব্যাপারে খুব সাবধান, ঝুঁকি নেয়ার মতো তার সাহস বা অভিরুচি নেই। কিন্তু একথা সত্য, আবুল্যার বউ ছুঁড়ে ফেলার মতো বস্তুও নয়। সুডৌল শ্যামাঙ্গী মহিলার বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি তা সহজে বোঝা যায় না। গরীব ঘরের মেয়ে বলেই হয়তো আবুল্যাকে ছেড়ে চলে যায়নি। পরিচিত মহলে আবুল্যার নপুংসকতার কথা প্রায় সবারই জানা। তবে তাদের ছেলেপুলে না থাকায় কেউ কেউ আবার, বিশেষ করে মহিলা মহল, আবুল্যার স্ত্রীর দিকেই আঙুল তোলে – মেয়েটা বাঁজা। তা, পাঁচপাড়ার নুন আনতে পান্তা ফুরানো লোকজনদের এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করার সময়, সুযোগ কিংবা আগ্রহ কোনোটিই নেই। হলে কী হবে, সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় একান ওকান হয়ে আবুল্যার বউয়ের ব্যাপারে এরকম কথাও সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় যে, এদিক ওদিক না করে করবে কী বেচারি – এই বয়স! এই শরীর!

কালাম্যা বিকেলে খবর দিয়ে গেছে আগামীকাল এমপি সাহেব আসবেন। মফিজও যেন স্কুলের মাঠে গিয়ে হাজির হয়। চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং দলের পাতিনেতারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে এমপি সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন, সবার উপস্থিত থাকা জরুরি। মফিজ রাতের খাবার খেয়ে কুপি নিভিয়ে একটি শেখ সিগ্রেট টানতে টানতে সে কথাই ভাবছিল। তার যাবার ইচ্ছা থাকলেও ছাগলগুলো তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। বিরাট জনসভায় যোগদান করতে গেলে তো ছাগলগুলো না খেয়ে মরবে। আর বাইরে কোথাও দিগদড়ায় বেঁধে রাখা মোটেও নিরাপদ নয়; কে কোন ফাঁকে ছাগল দুটি নিয়ে কাট মারে। মফিজের এই মানসিক দোটানার মধ্যেই বাড়ির পথ থেকে আবুল্যার গলার আওয়াজ শোনা যায়, ‘মফিজ বাই, গুমাইয়া পড়ছুইন নি?’

‘কেডা?’ মফিজ গলার আওয়াজ চিনতে পারলেও ইচ্ছা করে নিশ্চিত হতে চাইল। কেননা, আবুল্যা সাধারণত তাদের বাড়িতে আসে না; সে ধরনের সখ্যও তাদের মধ্যে নেই।

আবুল্যা জবাব দেবার আগেই হাঁটতে হাঁটতে মফিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘আমি আবুল্যা। আন্ধাইর দেহি, হুইয়া পড়ছুইন?’

‘আইও, আইও, বিত্তে আইও। কিতা আশয় বিষয়?’

আবুল্যা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে, ‘ময়নারা আহে নাই?’ মফিজের পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও আশ্রয়শিবিরের কল্যাণে আবুল্যা জানে হাফিজ তার মা-বোনকে গাজীপুরে নিয়ে গেছে।

মফিজ আবুল্যার দিকে প্রায় পুড়ে যাওয়া সিগ্রেট এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘আরো কয়দিন পরে আইবো।’

সিগ্রেটে দু-চার টান মেরে মফিজ একা একা কেমন করে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে ইত্যাদি নানা গার্হস্থ্য প্রশ্ন করে আবুল্যা তার সহমর্মিতা প্রকাশ করে। আরেকটু বেশি দরদ দেখাতে গিয়ে এ-ও বলে, ‘এই কয়দিন আমরার লগে দুই লুকমা শাগ-ভাত কাইন না ক্যারে?’

‘না, কুনু অসুবিদা নাই; দরকার অইলে যাইয়াম, তুমরার লগে কাইয়াম’, মফিজ জানায়।

আবুল্যার অবেলায় আসার আসল উদ্দেশ্য যে এসব খেজুরে আলাপ নয় তা মফিজ আন্দাজ করতে পারে। তবুও মূল কথাটি শোনার জন্য সে একটু ধৈর্য ধরে।

শেষপর্যন্ত আবুল মূল কথায় এসেই যায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কাইল মিটিঙে যাইবাইন?’

‘আমার ছাগল থুইয়া কেবা কইরা যাই?’, মফিজ বলে।

আবুল্যা এক মুহূর্ত মাথা চুলকে বলে, ‘তা ঠিক, ছাগল কার কাছে দিবাইন। আর বন্দো দিগদারা দিয়া রাখলেও চুরে লইয়া যাইব।’ পরে আচমকা বলে, ‘আমার মাথায় একখান বুদ্ধি আইছে।’

মফিজ জিজ্ঞেস করে, ‘কী বুদ্ধি?’

‘আমি কই কি, মফিজ বাই, আফনার মতো মানুষ মিটিঙে গেলে আমার উপকার অইত। হুনছইন না, আমার ঘর তো এক্কেরে ভাইঙ্গা চুইরা শেষ।’

মফিজ বলে, ‘তুমার নাম তো লিস্টে আছেই। তুমি পাইবা।’

আবুল্যা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ‘আফনে থাকলে বুঝাইয়া কইতে পারবাইন। আমি তো বকলম।’

‘কিন্তু আমার যে ছাগল?’, মফিজ তার অসুবিধার কথা আবার বলে।

‘হুনইন, ছাগলের একখান বেবস্থা অইব।’ আবুল্যা আশ্বাস দেয়, ‘ছাগল হনুফা দেখব।’

মফিজ ভাবে এতে আবার বেশি বাড়াবাড়ি, জড়াজড়ি হয়ে যাচ্ছে কি না। মফিজ গেলেও যা না গেলেও তা। কোনো সাহায্য আসলে আবুল্যা ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তা এমনি এমনিই পাওয়ার দাবিদার। তবুও লোকটা এত করে বলছে। যাওয়াই যাক। সে বলে, ‘আচ্ছা কাইল দেখমুনে, এহন বাড়ি যাও।’

এমপি সাহেব চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং দলীয় লোকদের নিয়ে প্রায় পরিত্যক্ত আশ্রয়শিবির ঘুরে এসে অবশেষে ইউনিয়ন অফিস সংলগ্ন মাঠেই আগত জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনেন এবং আশ্বাস দেন, কাউকে বঞ্চিত করা হবে না। তালিকায় কোনো ক্ষতিগ্রস্তের নাম যাতে বাদ না পড়ে তা ওয়ার্ড-মেম্বাররা অবশ্যই নিশ্চিত করবেন। ভুলে কেউ বাদ পড়ে গেলে তারা যেন ইউনিয়ন অফিসে এসে যোগাযোগ করেন।

মফিজের ঘরের তেমন ক্ষতি না হওয়ায় তার নামও তালিকায় নেই; সে জোর করে বা কায়দা করে অন্যায্য সুবিধা নেয়ার পক্ষপাতীও নয়। সে আবুল্যার অনুরোধ রাখতে গিয়ে মিটিং-এ এসেছে এবং চেয়ারম্যান-মেম্বারকে আবুল্যার পক্ষে জোর অনুরোধও করেছে। মেম্বার শুক্কুর আলি বলেছে, ‘তোমার কওন লাগব না মফিজ ভাই, আমি নিজে গিয়া আবুল্যার ক্ষয়ক্ষতি জরিফ কইরা আইছি।’

এমপি সাহেবের আগমন উপলক্ষে দলের নেতা-পাতিনেতারা চাঁদা তুলে খিচুড়ির ব্যবস্থা করেছিল। সভাশেষে মফিজ ও আবুল্যা উপস্থিত ভুখাদের সাথে খিচুড়ি খেতে বসে যায়। তারপর এলোমেলোভাবে ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যার আগে আগে তারা বাড়ির পথ ধরে।

মফিজের বাড়ির সামনে এসে পড়লে আবুল্যা বলে, ‘মফিজ ভাই, আপনি বাড়িত যাইন। আমি আফনার ছাগল দিয়া যাইবাম।’ মফিজের তেমন কোনো কাজ নেই। আবুল্যা বললে তার সাথেও যেতে পারত। কিন্তু যখন সে বলে নাই, সে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে যাও।’

পাড়ার উত্তর পাশের পৈত্রিক জমিতে পিতামাতার জীবদ্দশায় একটি মাটির ঘর বানিয়ে মফিজ পৃথক হয়ে গিয়েছিল। অভাবের সংসারে সাধারণত বনাবনি হয় না। তবে মূল বাড়িতে তার ছোট দুই ভাইকে নিয়ে বাপ-মা মৃত্যু অবধি এক চুলাতেই ছিলেন। মফিজের ছেলে হাফিজ কোনোমতে এসএসসি পাশ করেই পরিচিতজনের সাথে গাজীপুরে চলে যায়। কিছুদিন ঘুরাঘুরি করে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজও যোগাড় করে ফেলে সে। এর পর থেকে মফিজের সংসারে একটু সুখের হাওয়া লাগে। বছর দুয়েক পরে হাফিজ নিজ উদ্যোগেই ঘরের বাঁশের খুঁটিগুলোর জায়গায় চিকন রড দিয়ে বানানো সিমেন্ট-সুরকির পিলার বসিয়ে ঘরকে মজবুত করে। কয়েকমাস পর ঈদ বোনাসের সাথে আরোও কিছু টাকা যোগ করে ছনের চালা ফেলে দিয়ে চালে গরুমার্কা ঢেউটিন লাগায়। এতে মফিজের মনে যেমন আনন্দ হয় তেমনি পাড়ায় তার মর্যাদাও একটু বেড়ে যায়। বাঁশ-বেত ও নলখাগড়ার বেড়া ফেলে ঢেউটিন লাগিয়েছে মাত্র বছরখানেক আগে।

মফিজ আগে অনেক ধরণের কাজ করেছে। কখনও দিনমজুরি, কখনও তরিতরকারির ব্যবসা করেছে। আবার ধান কাটার মৌসুমে কখনও দলবেঁধে সুনামগঞ্জের দিকে চলে গিয়েছে। এখন সে দিনমজুরি ক্ষান্ত দিয়েছে। তরিতরকারির কারবারও এখন তার কাছে ঝামেলা মনে হয়। তবুও ছেলের দেয়া ভাতার পাশাপাশি সে মৌসুমি ফল, যেমন, আম, কাঁঠাল, আমড়া, আঁখ, লটকন, ডাব ইত্যাদি বিক্রি করে মোটামুটি ভালভাবেই চলতে পারে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হলেও সে এখনও বেশ শক্তপোক্ত। তবে স্বভাব একটু আলসে । মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে বলতে গেলে নির্ভার হয়ে যাবে সে । তবে মেয়ে এখনও নবম শ্রেণিতে পড়ে; সহসা বিয়েশাদীর প্রসঙ্গ উঠবে না।

রাত্রে কী খাবে তার জুতযোগাড় করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও আবুল্যা ছাগল নিয়ে আসছে না দেখে মফিজ বিরক্ত হয়ে যায়। কুপি জ্বালিয়ে সে একটি সিগ্রেট বের করে বারান্দায় পিঁড়িতে বসে গজগজ করতে করতে ফুকতে থাকে। একবার ভাবে, সে নিজেই আবুল্যার বাড়িতে যেয়ে ছাগলগুলো নিয়ে আসে। আবার চিন্তা করে অন্ধকারে ওবাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে না; কেউ দেখে ফেললে মন্দ ভাববে। তখনই সে দূর থেকে ছাগলের ভ্যা ভ্যা শব্দ শুনতে পায়। সে স্বগতোক্তির মতো বলে, ‘শালা, এখন ছাগল লইয়া আইছো।’

যখন ছাগলগুলি উঠানে এসে দাঁড়ায় তখন মফিজ চমকে ওঠে। আবুল্যা তো আসেনি, ছাগল নিয়ে এসেছে হনুফা, আবুল্যার বউ। সে সন্তর্পণে মফিজের সামনে এগিয়ে আসে; তার হাতে একটা গামছা-বাঁধা পোটলা। মফিজ পিঁড়ি থেকে উঠতে উঠতে বলে, ‘তুমি! তুমি আইছো ক্যারে? আবুল্যা কো?’

আবুল্যার বউ শাড়ির আঁচলের খুঁটে কামড় দিয়ে একটু মোচড়াতে মোচড়াতে বলে, ‘তাইনে কইল আফনে কষ্টমষ্ট কইরা খাইতাছুইন। হের লেইগা একটু খাবার লইয়া আইছি – বেশি কিছু না; এট্টু হিদলের বত্তা, শাগ আর মাছের ঝোল।’

মফিজের বুকটা কেঁপে ওঠে। এ অবস্থা লোকজন দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সে উঠানে নেমে এদিক ওদিক তাকায়। তারপর আবুল্যার বউকে একটা ধমক লাগায়, ‘আবুল্যা আইতে পারল না, তুমি আইছো ক্যারে?’

আবুল্যার বউ বলে, ‘কুনু অসুবিধা নাই। দেইন, আফনার ছাগলগুলান আমি বাইন্দা রাখি।’

‘না না, তুমি যাও, আমি বাইন্দা রাখবাম’, মফিজ বলে।

আবুল্যার বউ মফিজের কথায় পাত্তা না দিয়েই দেউড়ির দিকে ছাগল খেদিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘আফনে আত দুইয়া ভাতগুলান কাইয়ালান। আমি ছাগল সামলাই।’

ততক্ষণে বিদ্যুৎহীন অজ পাড়াগাঁয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার আরোও ঘন হয়েছে। তবে এত তাড়াতাড়ি রাতের খাবার কেউ খায় না। আবুল্যার বউয়ের জোরাজুরি আর আহ্লাদে মফিজ যুগপৎ বিরক্ত এবং উৎসুক হয়। সে আবুল্যার বউয়ের মতলব আঁচ করার চেষ্টা করতে করতে নিজের ভেতরে চাঞ্চল্য অনুভব করে। সুঠাম দেহের যুবতী হনুফা যে কোনো যুবকের মনে তুফান তুলতে পারে। মফিজ সে অর্থে যুবক না হলেও তার স্নায়ু এখনও শিথিল হয়ে যায়নি। আবুল্যার দৈন্য আর তার স্ত্রীর ক্ষুৎপিপাসার কথা আড়ালে-আবডালে মফিজও জানে। সেকারণেই সম্মান-সচেতন পরিবারের লোকজন ওদের পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। বন্যার কারণে আবুল্যার পরিবারের সাথে মফিজের যোগাযোগ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় সে বেশ অস্বস্তিতে আছে। এমন পরিস্থিতিতে মফিজ আজ সাক্ষাৎ পরীক্ষার মুখোমুখি।

বারান্দার একপাশে ছাগলের জন্য বানানো ছোট খুপরিতে ছাগলগুলো ঢুকিয়ে আবুল্যার বউ ফিরে এসে মফিজকে আবার তাড়া দেয়, ‘বাই, আফনে তরাতরি কাইয়ালাইন; আমি পিলেট-বাসন লইয়া যাইবাম।’

মফিজ এবার হনুফাকে ধমকায় না, কিছু বলেও না। তার মাথায় বিচিত্র ভাবনা গোল পাকিয়ে বসে আছে। সে তার হাতের আধপোড়া সিগ্রেটটি নিঃশব্দে আবুল্যার বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে জগের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে পোটলা খুলে খেতে বসে যায়। কুপির আগুন একটু মিইয়ে আসছে দেখে হঠাৎ তার খেয়াল হয়, হায় হায়, ঘরে কেরোসিন নেই। আবুল্যার সঙ্গে মিটিং-এ যাওয়ায় আজকে তার সবকিছু গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। সে তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে খেতে খেতে আবুল্যার বউকে বলে, ‘সইলতাটা জাগাইয়া দেও, ঘরে কেরাসিন তেল নাই।’

কুপি আর অল্প কিছুক্ষণ জ্বলবে। আবুল্যার বউ ইচ্ছা করলেও বেশিক্ষণ বসতে পারবে না। তাই এই ফাঁকেই সে একটু নরম সুরে বলে, ‘আফনে যহন কইছুইন, আমরার ঘরটা তারা বানাইয়া দিব, ইনশাল্লাহ।’ মফিজ মাথা তুলে আবুল্যার বউর দিকে একবার তাকায় এবং তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বলে, ‘অইব, ইনশাল্লাহ, অইব। চিন্তাআবুল্যার বউ বাসনকোসন বাঁধাছাঁদার আগেই দপ করে কুপিটা নিভে যায়। মফিজের বুক ছ্যাঁত কইরো না।’

করে ওঠে। বাতি নিভে যাওয়ায় তার তোড়জোড় করা উচিৎ। কিন্তু সে তেমন কিছু করল না। আবুল্যার বউও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তার মনের অবস্থা মফিজের জানার কথা নয়। তবে তার ধারণা হল কুপির তেল না থাকা এবং এক সময় বাতি নিভে যাওয়াকে আবুল্যার বউ অপছন্দ করেনি। এ মুহূর্তে তার কী করা উচিৎ এ কথা যখন মফিজ ভাবছিল তখনই খুবই মৃদুকণ্ঠে আবুল্যার বউ বলল, ‘আমি তাইলে যাই…।’

মফিজ ধুকপুকে বুকে চৌকি থেকে নেমে বলে, ‘এই আন্ধাইরে তুমি যাইবা কেমনে?’

অন্ধকার ঘরে বিপরীত লিঙ্গের দুইজন রক্তমাংসের মানুষ। কী থমথমে অবস্থা! আবুল্যার বউ বলে, ‘অসুবিদা অইত না মফিজ ভাই। আন্ধাইরেই আমার চলাচল; আমার জীবনটাই আন্ধাইর।’ আবুল্যার বউয়ের গলার স্বর কিছুটা ভাঙ্গা এবং ভারী শোনায়।

আবুল্যার বউ ছাগল নিয়ে আসার পর থেকেই মফিজের মনের ভেতর অনেক ভাংচুর চলছিল। সেই ভাংচুরের ভেতর লোকলজ্জা ও অপবাদের ভয়ও ঢুকে পড়েছিল বলেই হয়তো আলাদাভাবে কোনো সংকোচ অথবা শঙ্কা মফিজের চোখে ধরা পড়ল না। সে কেমন রোবটের মতো হনুফা অর্থাৎ আবুল্যার বউয়ের দু’কাঁধ চেপে ধরে বলে, ‘কিরাম আজগুবি কতা কও তুমি!’

মফিজের কথার জবাব মুখে দেয়ার পরিবর্তে আবুল্যার বউ তার শক্ত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

অন্ধকার ঘরের পরের কয়েক মিনিটের হালচাল অদৃশ্যই ছিল। তবে কেউ কান পাতলে কিছু অনুচ্চ ও দুর্বোধ্য আওয়াজ অবশ্যই শুনতে পেত। আবার ছাগলের অনিয়মিত ভ্যা ভ্যা ডাকের নিচে সে আওয়াজ চাপা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বিদ্যমান ছিল।

একসময় মফিজের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ঘর নিয়া তুমি চিন্তা কইরো না, আমি আছি না। তুমি এহন হুঁশ কইরা অস্তে অস্তে বাড়িত যাওগা।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

প্রত্যাশার রকমফের স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রকৃতি বদলায়। আবুল্যার নতুন ঘর পাওয়ার প্রত্যাশা উজ্জীবিত হয় মফিজের সহযোগিতায়। হনুফারও একই প্রত্যাশা। তবে ঘরের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে তার আরোও কিছু জৈবিক প্রত্যাশা ছিল। তা বিভিন্ন ঘটনার অবকাশে পূর্ণতার দিকে গিয়েছে।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪