রেহানার সহকারী ডাঃ ঐন্দ্রিলা ভুতুড়ে সাজে অর্থাৎ পিপিই-পরিহিত অবস্থায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ম্যাডাম, ওরাও পালিয়ে গেছে।’
রেহানা কাজের ফাঁকে তখন তার মায়ের সাথে ফোনে আতঙ্ক এবং সাবধানতা নিয়ে কথা বলছিল। কারণ বাসায় তার ছোট দুই বাচ্চাকে তার মা-ই সামলাচ্ছেন। কাজের মেয়ে কুলসুম ভয়ে বাড়িতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য গাবতলী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল যদিও দূরপাল্লার বাস চলাচল ততদিনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তখন রেহানা এবং মাহিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কুলসুমের খোঁজে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। ভাগ্যক্রমে সম্ভাব্য জায়গা খুঁজে খুঁজে গাবতলীতে এসে তারা কুলসুমকে পেয়ে ছোঁ মেরে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল। তবে তার আগে তারা কুলসুমকে ভাল করে আপাদমস্তক জীবাণুনাশক স্প্রে করেছিল। যাক শেষপর্যন্ত তাকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে রাখা গেলেও মহামারীর ভয়ে সে সবসময় সবার কাছ থেকে সরে সরে থাকে। ঐন্দ্রিলার কথায় রেহানা থমকে গিয়ে তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়।
‘ওই যে, যে পেশেন্টকে আপনি বারান্দায় দেখে এসেছিলেন।’ ঐন্দ্রিলা তড়বড় করে বলতে থাকে, ‘দুইজন লোক এসেছিল ওর সাথে; তাড়াহুড়ো করে পেশেন্টের নাম-ঠিকানা লিখিয়ে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল। রুগির অবস্থা ভাল না।’
রেহানা ফোন রাখতে রাখতে মাকে বলল, ‘মা পরে কথা বলব।’ ফেস শিল্ড-এর আড়ালে তার কুঁচকানো ভ্রু ভালভাবে দেখা না গেলেও ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে তার বলা কথা থেকে হতাশা ঝরে পড়ল, ‘তোমরা বল, আমার কী করার আছে?’
ঐন্দ্রিলা বলে, ‘এরকম তো প্রায়ই হচ্ছে ম্যাডাম। লোকজন রুগি ফেলে রেখে পালাচ্ছে; তারপর লাশটির খোঁজও নিচ্ছে না।’
‘অক্সিজেন দিতে পেরেছ?’ রেহানা জিজ্ঞেস করে।
‘অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছি কোনোমতে,’ ঐন্দ্রিলা বলে, ‘তবে কোনো সিট খালি না হলে এভাবে কন্ট্রোল করা যাবে না। প্রটোকল অনুযায়ী অন্যান্য ট্রিটমেন্টও শুরু করে দিয়েছি অবশ্য। কিন্তু রুগি বারান্দায় শুয়ে ভয়ানকভাবে তড়পাচ্ছে।’
রেহানা বলে, ‘চল দেখি কোনো সিট খালি হল কি না।’ সিট খালি হওয়া মানে সাধারণত কোনো সুখবর নয়, একথা সবাই জানে। তবুও সিট খালি না হলে অন্য রুগিকে জায়গা দেয়া যাবে না।
করোনা এসে স্বাস্থ্যসেবার লোকজনদের জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড় করিয়ে দেবে ভুলেও এ ধারনা মহামারীর শুরুতে রেহানার মনে আসেনি। ডাক্তারি পেশায় সেবার ব্রত যে এখন কাগুজে একথা ডাক্তারসহ সকল সাধারণ মানুষের কাছে শাদা কাগজের মতো পরিষ্কার। অনুল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া চিকিৎসা অন্য দশটি ব্যবসার মতো একটি ব্যবসা তা সুবিদিত। প্রাইভেট হাসপাতাল আর ডাক্তারের চেম্বারগুলো তার প্রমাণ। মেধাবী রেহানারও ডাক্তার হওয়ার পেছনে সেবাই অগ্রগণ্য ছিল একথা সে নিজেও দাবি করে না। সরকারি হাসপাতালের গৎবাঁধা দায়িত্ব পালন শেষে নামি ডায়গনোস্টিক সেন্টারে তার চেম্বারে রুগি দেখা, রিপোর্ট দেখে প্রেসক্রিপশন লেখা এসবেই তাকে বেশি মনযোগী হতে হয়। কিন্তু করোনা নামক জুজু বিপুল বিক্রমে বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে পড়লে পৃথিবীর অন্যান্য আক্রান্ত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও অচল হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট প্রতিকার-পদ্ধতির অবর্তমানে হাজার হাতুড়ে এবং ঘরোয়া চিকিৎসার কথা গণ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও ছোটবড় সকল দেশের সরকারের মতো বাংলাদেশ সরকারও অনিশ্চিত প্রতিরোধ যুদ্ধের আয়োজন করে। স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি, সচেতনতা, রিলিফ বিতরণ, লকডাউনসহ আরোও অনেক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সরকারকে যেতে হচ্ছে। এবং চিকিৎসার সফলতায় বিশ্বাস হারিয়েও ভীতিকর পরিবেশে হাসপাতালগুলোও চালু রাখতে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কুর্মিটোলা এবং মুগদা হাসপাতালকে করোনা রুগির জন্য বিশেষায়িত করা হয়েছে। মন থেকে না চাইলেও রেহানার দায়িত্ব পড়েছে মুগদা হাসপাতালে।
হাসপাতালের করিডোরে মড়াকান্না প্রায় লেগেই আছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মৃতের স্বজনদের সহযোগিতা কিংবা সহযোগিতা ছাড়াই মুসলিমদের তালতলা কবরস্থানে অতি সাবধানতার সাথে দাফন করা হচ্ছে। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামও ইতিমধ্যে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের সৎকারের আনুষঙ্গিক কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এসব করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, অনেক স্বাস্থ্যকর্মিও কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে একজন ডাক্তারের মৃত্যুর পরই করোনা মানুষের মনে সাক্ষাৎ আজরাইলের রূপ ধারণ করেছে।
রেহানা এসে দেখতে পায় রুগির অবস্থা চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছে। সহকারী স্টাফরা নিজেদের সুরক্ষার প্রবল প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েও লোকটিকে চেপে ধরার নিষ্ফল চেষ্টা করে যাচ্ছে। রেহানা ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জানি না কী হয়, তবে লাংস বোধ হয় আর কাজ করতে পারছে না। তবুও কুইকলি খালি বেডে নিয়ে যাও – এইমাত্র একটা খালি হয়েছে।’
ঐন্দ্রিলা ক্ষীণস্বরে বলে, ‘ভগবান, তুমি রক্ষা কর।’
‘আর শোনো, ঠিকমতো অক্সিজেন লাগিয়ে দিয়ো।’ রেহানা বলে, ‘আমি ওদিকটা দেখে আসছি।’
কিছুক্ষণ পর অন্যান্য রুগি আর তাদের স্বজনদের হৈহুল্লোড়ের মাঝেও রেহানা দোতলায় উঠে ওই স্বজনবিহীন রুগিটিকে দেখতে যায়। অন্যান্য সহকারীদের সাথে ঐন্দ্রিলাও অস্থিরভাবে দৌড়ঝাঁপ করছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও মানবিক কারণে কেউ হুট করে বাসায় ফেরার চিন্তা করতে পারছে না। এদের মধ্যে ঐন্দ্রিলার বিষয়টি একটু পীড়াদায়ক। মাত্র দুমাস আগে বেচারির বিয়ে হয়েছে। স্বজাতির মধ্যে যোগ্য পাত্র খুঁজতে গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে তার একটু দেরিই হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক স্বামী বেচারা অস্থিরভাবে ফোন দিলেও ঐন্দ্রিলা কখনও সময়মত বাসায় ফিরতে পারে না।
রেহানার অসহায়ের মতো কষ্ট নিরীক্ষণ করা আর কিছু করার নেই। রুগির হাত পা সিটের সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে। অক্সিজেন বাড়িয়ে দেয়া হলেও মাঝে মাঝে রুগিটি সর্বশক্তি দিয়ে শরীর মোচড় দিতে চেষ্টা করছে; পাগলের মতো ডানে বাঁয়ে মাথা ঘোরাচ্ছে। হঠাৎ রেহানা খেয়াল করে লোকটার ঘাড়ের ডানপাশে একটি বড় আকারের কালশিটে কাটা দাগ। কী মনে করে সে আরেকটু এগিয়ে এসে দাগটি ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করে।
ঐন্দ্রিলা জিজ্ঞেস করে, ‘কী দেখছেন ম্যাডাম?’
রেহানা কোনো উত্তর না দিয়ে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে উপস্থিত নার্সের কাছে রুগির ফাইলটি নিয়ে আসতে বলে।
কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে রেহানা ফাইল থেকে রুগির নাম ঠিকানা পড়তে থাকে। নাম: আকবর আলি, ঠিকানা: বি.বাড়িয়া, বয়স: ৬৫। রেহানার ধারনার সাথে অনেকটা মিলে যাওয়ার পর নিজের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিলেও সে কুশলতার সাথে তা নিয়ন্ত্রণ করে। তারপর বলে, ‘ঐন্দ্রিলা, দেখ তো আইসিইউ’র অবস্থা কী? যে কোনোভাবে হোক একটা সিট পাওয়া যায় নাকি দেখ। আর শোনো, বিলটিল নিয়ে চিন্তা করো না; এ রুগির জন্য যা খরচ হয় আমি বেয়ার করব।’
ঐন্দ্রিলার চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হলেও রেহানাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই সে দ্রুত আইসিইউ’র দিকে ছুটে যায়। রেহানা এই সুযোগে মাহিনকে ফোন করে। তার স্বামী ডাঃ মাহিন ঢাকা মেডিকেলে ইমার্জেন্সি টিমে দায়িত্বপ্রাপ্ত। মাহিন কল রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি ফিরেছ?’
রেহানা বলে, ‘না, তোমার কী অবস্থা?’
‘আমি অন দ্য ওয়ে’, মাহিন বলে।
‘ভালই হল। তুমি বাসায় গিয়ে সবকিছু সামলাও। আমার আজ একস্ট্রিম ইমার্জেন্সি; আসতে পারব না। তবে মাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলো; বলো আমি খাওয়াদাওয়া করে একটু দেরিতে ফিরব।’ রেহানা এতটুকু বলে থামে।
মাহিন অন্য কিছু জিজ্ঞেস না করে শুধু জানতে চায়, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’
রেহানা বলে, ‘চিন্তা করো না, আমি এখনও ভাল আছি।’
মাহিনের সাথে কথা শেষ করে রেহানা বারান্দায় বেরিয়ে আসে। নার্স এবং অন্য কর্মচারীরা রেহানার অস্বাভাবিক আচরণ অবলোকন করে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ওদের একজন ইশারায় অন্যদের বুঝাতে চেষ্টা করে যে ম্যাডাম হয়ত চোখ মুছতে বারান্দায় গিয়েছে।
চোখে জল আসার যথেষ্ট কারণ আছে রেহানার । নামটা নাহয় আলি আকবর না হয়ে ভুল করে আকবর আলি লেখা হয়ে গেছে, কিন্তু ঢাকার ঠিকানা না দিয়ে ওরা গ্রামের বাড়ির ঠিকানা বি.বাড়িয়া অর্থাৎ ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিতে গেল কেন এসব ভাবতে গিয়ে রেহানার মাথা ঝিমঝিম করছে। যেহেতু ওরা রুগি ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে, তার মানে তারা ইচ্ছা করেই নাম-ঠিকানা অদলবদল করেছে – যাতে কেউ তাদের খুঁজে বের করতে না পারে।
ঠিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে নয় তবে বাঞ্ছারামপুরের দাদার বাড়িতে ছোটবেলায় অনেকবার গিয়েছে রেহানা। তিতাস নদীর পারের অনেক স্মৃতি এখনও তার মনে প্রোজ্জ্বল। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির সুবাদে বাবাকে ঢাকায় থিতু হতে হয়েছিল, কিন্তু দুয়েকদিনের বাড়তি ছুটি পেলেই তিনি স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে হল্লা করে ছুটে যেতেন গ্রামে।
একটু পর ঐন্দ্রিলা দৌড়ে এসে বলে, ‘ম্যাডাম, একজন রুগি অনেকটা ভাল। হাই ফ্লো তার লাগছে না। কিন্তু তার স্বজনরা রুগিকে আইসিইউ থেকে সরাতে চাইছে না।’
রেহানা রেগে গিয়ে বলে, ‘মানুষগুলো কেমন হয়ে গেছে! ওই লোকটাকে তো জেনারেল বেডে নিয়ে এলে চলে; অন্যদের কথা চিন্তা করবে না?’ বলতে বলতে, ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে রেহানা আইসিইউ’র দিকে ছুটে যায়।
শেষপর্যন্ত স্বজনদের অনেক বলেকয়ে বুঝিয়ে সুজিয়ে আইসিইউ’র রুগিকে আকবর আলির সিটে স্থানান্তর করার ব্যবস্থা করে রেহানা। একই সঙ্গে তড়িঘড়ি করে আকবর আলিকে আইসিইউতে ঢুকিয়ে হাই ফ্লো অক্সিজেন দিতে শুরু করে তারা।
আকবর আলির একটা ব্যবস্থা হওয়াতে রেহানার সাথে অন্যরাও একটু স্বস্তি বোধ করে। রুগির অক্সিজেন লেভেল অনেক লো; বাঁচামরা এখন ভাগ্যের হাতে। এ অবস্থায় আইসিইউ’র ডাক্তারকে রুগির প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখার অনুরোধ জানিয়ে রেহানা বেরিয়ে আসে।
ঐন্দ্রিলা নিচুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘ম্যাডাম কি এখন চলে যাবেন? রাত আটটা বাজে।’
রেহানা চমকে উঠে বলে, ‘ওহ্, অনেক দেরি হয়ে গেছে; তুমি চলে যাও, চলে যাও।’
‘আপনি?’, ঐন্দ্রিলা জানতে চায়।
রেহানা বলে, ‘আমি পরে যাব; তুমি চিন্তা করো না। তুমি চলে যাও।’
ঐন্দ্রিলা চলে গেলে রেহানা আবার আইসিইউ ঘুরে আসে। রুগির কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই। রেহানার হাতে কোনো জাদু নেই। নইলে আরোও অনেক রুগির প্রাণ বাঁচাতে পারত। সে হতাশ হয়ে ডক্টরস রুমে চলে গিয়ে একটি চেয়ারে দুম করে বসে পড়ে। অন্য দুয়েকজন ডাক্তার দ্রুত ছুটোছুটি করলেও কেউ কারুর সাথে কথা বলার সময় নেই।
এ দুর্যোগে খাবার মেলানোও কঠিন। রেহানার খিদে পেয়েছে। সে হ্যাণ্ডগ্লাভস, ফেসশিল্ড ইত্যাদি খুলে খুব সাবধানে যখন বাসা থেকে নিয়ে আসা অবশিষ্ট ব্রেড-কলা খাচ্ছিল এবং দূর অতীতের কথা স্মরণ করে চোখ দুটি আর্দ্র করে ফেলেছিল তখন আইসিইউ’র ডাক্তার দ্রুতপায়ে এসে বলে, ‘শুনলাম আপনি যাননি, তাই ভাবলাম……আচ্ছা শুনুন, জানেনই তো রুগির অবস্থা ভাল না। অক্সিজেন লেভেল আরোও ড্রপ করেছে; হাই ফ্লোতেও কাজ হচ্ছে না। লাংস ফাংশন এলার্মিং পজিশনে চলে গেছে…।’
রেহানা কিছু না বলে কয়েক মুহূর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইল।
‘এখন আপনি বললে, আই মিন আপনি দায়িত্ব নিলে, আমরা ভেন্টিলেশনে যেতে পারি। এছাড়া তো আর করার কিছু নেই’, আইসিইউ’র ডাক্তার বলল।
‘ভেন্টিলেটর কি পাওয়া যাবে? পাওয়া গেলে প্লিজ স্টার্ট করে দিন।’ রেহানা তাড়াহুড়ো করে বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলে হ্যাণ্ডগ্লাভস, ফেসশিল্ড ইত্যাদি পরে নিয়ে বলে, ‘চলুন। এটা আমার একটা অবলিগেশন; সবকিছুর দায়িত্ব আমি নিলাম।’
আকবর আলির জন্য ভেন্টিলেটর যোগাড় হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার হাতে সঁপে দিয়ে রেহানা তার রুমে ফিরে এসে টেবিলের ওপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘুম আসার কথা না। মাহিন আরেকবার ফোন করলে সে জানিয়ে দিয়েছে স্বজনদের ফেলে যাওয়া রুগিটি ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, রুগিটিকে তার পরিচিত মনে হচ্ছে। মানবিক কারণে সে তাকে ফেলে আসতে পারবে না।
কথা সত্য; রুগিটিকে রেহানা ভাল করেই চিনতে পেরেছে। তার ঘাড়ের কাটা দাগে ছোটবেলা সে অনেকবার হাত বুলিয়েছে। রেহানা শুনেছিল, লোকটি স্কুলের সহপাঠীদের সাথে ফুটবল খেলা নিয়ে মারামারি করতে গেলে কেউ একজন ডেগার দিয়ে ঘাড়ে আঘাত করেছিল। এই কাটা দাগ দেখেই সে আকবর আলি তথা আলি আকবরকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু রেহানার খারাপ লাগছে এই ভেবে যে হয়ত লোকটার প্রিয় সন্তানেরাই বাবাকে এভাবে ফেলে রেখে পালিয়েছে। রেহানা শুনেছিল লোকটির দুটি ছেলে আছে। ছেলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল বলেই সে প্রথম স্ত্রীর আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে দ্বিতীয় স্ত্রীর পাণি গ্রহণ করেছিল।
মা রাগ করে রেহানাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেও তাদের মোটেই অযত্ন হয়নি। রেহানার নানা সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন। অধিকন্তু, তার মামাও চট্টগ্রামের একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ফলে তার জেদি মাকে যেমন তারা বোঝা মনে করেননি তেমনি রেহানাকেও ভালোভাবে শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। রেহানা তার মামার বাসায় থেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছে।
আইসিইউতে আরেকবার ঘুরে এসে রেহানা এবার ভেঙ্গে পড়েছে। জানাই ছিল এটা খারাপ কেস। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হাইপোক্সেমিয়ার দিকে চলে যাবে তা সে আশা করেনি। রেহানা জানে তার আর কিছু করার নেই। তবুও তাকে শেষপর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এটা কিছুটা আশ্চর্যজনক বটে, উপস্থিত ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের কেউই জানতে চায়নি আকবর আলি ডাঃ রেহানার কে বা কী হয়। তারা হয়ত ধারণা করে নিয়েছে রুগি রেহানার কোনো আত্মীয় বা নিকটজন কেউ হবে। যারা তাকে হাসপাতালের বারান্দায় রেখে পালিয়ে গেছে তারাও হয়ত বা রেহানার দূরের কেউ নয়। রুগির পরিচয় নিয়ে রেহানাই যখন মুখ খুলছে না, তাই অন্যরাও এসব নিয়ে প্রশ্ন করে অকারণ অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে না।
রেহানা সাবালিকা হওয়ার পর থেকেই অল্প অল্প করে বুঝতে পেরেছে তার মা কঠিন সময় পার করছেন। একজন স্বামী-সংসার ছাড়া যুবতী মাতা অনিশ্চিত লক্ষ্যে এক আগুনের সমুদ্র সাঁতরে চলেছেন। নানা-মামারা অনেক বুঝিয়েছেন, কিন্তু মাকে দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি। মা বরং কঠিন পরিশ্রম করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের পরীক্ষা পাশ করে বাঞ্ছারামপুরেই একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে দেন। হয়ত এই কাজটি আঁকড়ে ধরে তিনি জীবন সমুদ্র পাড়ি দিতে চেষ্টা করেছেন।
রেহানার বাবা চেষ্টা করেছিলেন অন্তত মেয়েকে যাতে ফিরিয়ে নিতে পারেন। এতে তার মা-মামারা তো রাজি হনই নি, রেহানাও তার মাকে ছেড়ে যাবে না বলে কঠিন পণ করেছিল। তার মনে হয়েছিল, তাকে পেয়ে তার বাবা খুশি হননি বলে রেহানার জন্মের পর ছয় বছরেও আর কোনো ভাই-বোন না হওয়ায় তিনি জোর করে আরেকটি বিয়ে করে তাকে এবং তার মাকে অবহেলাই করেছেন। আজ প্রায় পঁচিশ বছর পর কেমন নাটকীয়ভাবে আলি আকবরকে সেই মেয়ের হাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে পৃথিবী ছাড়তে হচ্ছে।
মহামারীর ত্রাসের মধ্যে হাসপাতালের দিন-রাত সমান। রুগি আসছে, যাচ্ছে; কিছুক্ষণ পরপর কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালে ডাক্তার নার্স সবাই যান্ত্রিক দ্রুততায় ছুটোছুটি করছে। কিন্তু আকবর আলি তথা আলি আকবরকে সনাক্ত করার পর হতে রেহানার মন থেকে হাসপাতালের কোলাহল, করোনার বিভীষিকা উবে গিয়ে তার চিন্তাভাবনা মা আর বাবাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যদিও প্রৌঢ় মাকে তার সাথে রেখে রেহানা সর্বোচ্চ সুখ দেবার চেষ্টা করছে, তবু সে এতই দুর্ভাগা যে বাবা জীবিত থাকার পরও সে বাবার স্নেহ-আদর হতে বঞ্চিত হয়েছে। আজ আর বাবা-মা’র দোষ-গুণ বিচার-বিশ্লেষণ করা অবান্তর। মায়ের কষ্ট এপর্যন্ত তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করলেও আজ এই অসহায় আলি আকবর – তার বাবার জন্য সে বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে।
ভোরের দিকে আইসিইউ’র ডাক্তার ধীরপদে এসে বলল, ‘ডক্টর, কিভাবে যে বলি, আনফর্চুনেটলি রুগির অ্যাকিউট রেস্পাইরেটরি ফেইল্যুর হয়েছে।’
রেহানা তড়াক করে চেয়ার থেকে উঠে আইসিইউ’র দিকে দৌড়ে যায়। এমনটিই হবে সে জানত। এ অবস্থায় সে অশ্রু লুকাবে কেমন করে? চোখের বাঁধ ভেঙ্গে যে পানি উপচে পড়ছে। তবুও মনকে শক্ত করে চোখের পানি মুছতে মুছতে সে মাথা ঝুঁকিয়ে আকবর আলির স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটি পঁচিশ বছর আগের সেই মুখশ্রী নয়। ভাঙ্গা মুখে খোঁচা খোঁচা শাদা-কাল দাড়ি, মাথায় টাক। সে বিধিনিষেধ ভুলে নির্বিকারভাবে আকবর আলির ঘাড়ের কাটা দাগের ওপর হাত বুলাতে থাকে।
কিছুক্ষণ আইসিইউতে নীরবতা বিরাজ করে। কারণ এই মৃত্যুর জন্য উচ্চস্বরে কাঁদবার যে কেউ নেই। হঠাৎ পেছন থেকে নার্স সাবধানতার সুরে আওয়াজ করে, ‘ম্যাডাম!’
রেহানা তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নার্সের হাত থেকে হেক্সাসলের বোতল নিয়ে নিজের হাতে মাখে এবং আইসিইউ’র ডাক্তারের দিকে তাকিয় বলে, ‘প্লিজ, খুলে ফেলুন।’
আকবর আলির বেওয়ারিশ লাশ সৎকার করার জন্য আঞ্জুমান মফিদুলের হাতে তুলে দেয়ার সময় রেহানা তাদের জিজ্ঞেস করল, ‘গোসল-কাফনের পরে আপনারা লাশ কখন কবর দিতে নিয়ে যাবেন?’
আঞ্জুমানের লোকজন একটু ভড়কে যায়। তারা কোনো উত্তর না দিয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
‘লাশের খোঁজে কেউ এসেছে নাকি, ম্যাডাম?’
রেহানা পেছনে ঘুরে দেখে ইতিমধ্যে ঐন্দ্রিলা এসে দাঁড়িয়েছে। সে ঐন্দ্রিলার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘না, কেউ আসেনি। তবে আমি তালতলা কবরস্থানে যাব।’