বুইজ্জা খালার ভাপা মিতার খুব পছন্দ। সাথে দেয়া পুদিনা কিংবা ধনে পাতার চাটনি গরম ভাপা পিঠাকে আরোও সুস্বাদু করে তোলে। সপ্তাহের শুক্র-শনি দুদিনই মাত্র মিতার সাথে আমার দেখা হয়। শীত মরশুমের যতদিন বুইজ্জা খালার পিঠার ব্যবসা থাকে আমি আর মিতা তার ছাউনিতে যাবই এবং ভাপা পিঠা খাবই। অবশ্য মাঝে মাঝে রুচি বদল করে ভাপার পরিবর্তে চিতই পিঠাও খাই। তবে মিতার পক্ষপাতিত্ব ভাপাতেই।
বোটানিক্যাল গার্ডেন-লাগোয়া বেড়িবাঁধের পাশে বিশাল এক রেইন-ট্রি গাছের গোড়ায় হোগলা পাতার পাটি দিয়ে বানানো নিচু ছাউনির নিচে উনুনসহ যাবতীয় পিঠা বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে প্রতিদিন ভোরবেলা বুইজ্জা খালা বসে পড়ে। বয়সের কারণেই হয়ত একা সামাল দিতে পারে না বলে একটি পুচকে মেয়েকে সাথে নিয়ে আসে। এই বৃদ্ধ পিঠাওয়ালির নাম বুইজ্জা কেমন করে হল বা এটা কেমনতর নাম এসব নিয়ে কেউ কখনও ভেবেছে কি না আমার জানা নেই। তবে ছেলে-বুড়ো সকল ক্রেতাই তাকে বুইজ্জা খালা নামে ডাকে। আমরা অবশ্য ওই সহকারী মেয়েটির মুখেই প্রথম এই নামটি শুনেছিলাম। মিতা বলেছিল, এই বুড়ি তার নানীর বয়সী হবে; তাই খালা ডাকা ঠিক হবে কি না। কিন্তু বুইজ্জা খালা নামের জনপ্রিয়তার কাছে তার দ্বিধা উবে যায়।
বসার কোনো ব্যবস্থা নেই বলেই ক্রেতারা পিঠা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোনো রোদেলা জায়গার উদ্দেশে চলে যায়। আমরাও প্রথম প্রথম তাই করেছি। পরে উনুনের তাপের লোভে কিংবা অকারণেই বুইজ্জা খালার দোকানের পাশেই মিতার সাথে নিয়া আসা পুরনো খবরের কাগজ বিছিয়ে আমরা নিয়মিত বসতে আরম্ভ করি। আমাদের অপরিণতিশীল কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে বুইজ্জা খালার সাথেও ভাবজমানো বিচ্ছিন্ন দু’চার কথা বলি। বুইজ্জা খালাও আপনজনের মতো সাড়া দেয়। তবে তার সহকারী পিচ্চি মেয়েটাই – যার নাম পরে জেনেছিলাম ফারজানা – বেশি ফটর ফটর করে। বুইজ্জা খালা ওকে ফাজানা বলে ডাকে, তাই তার শুদ্ধ নাম উদ্ধার করতে আমাদের কিছুদিন সময় লেগেছিল।
মিতা আমার মতোই এক অমীমাংসিত চরিত্র; কোনো রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা না হলেও ঝাপসা। হয়ত এই জায়গাটিতে মিল থাকার সুবাদে তার সাথে আমার জানাশোনা এবং এক অদ্ভুত ধরনের ঘনিষ্ঠতা। পরিচয় এই বোটানিক্যাল গার্ডেনেই। আরোও বিশেষ করে বললে এই বেড়িবাঁধেই। আমি প্রায় প্রতিদিনই আসি; পক্ষান্তরে মিতা শুধু শুক্র ও শনিবারেই প্রাতর্ভ্রমণের জন্য এদিকে আসে। এভাবে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনোভাবে আমাদের দেখাদেখি হয়ে যেত। কখনও বিপরীত দিক থেকে এসে একজন আরেকজনকে অতিক্রম করতাম। কিংবা কখনও আমি পেছন দিক থেকে দ্রুত হেঁটে তার পাশ কেটে সামনে চলে যেতাম। কিন্তু কখনও আমাদের কথা হত না। হয়ত এক সময় তার মন থেকে সন্দেহের ছায়া সরে গেলে তার অতি সতর্কতার ভাবও কেটে যায়। পরবর্তীতে দুয়েকদিন চোখাচোখি হয়ে গেলে সে মুখে আলতো হাসি মেখে সৌজন্য প্রকাশ করেছে। কিন্তু মিতার সাথে প্রথম কথা হয় বুইজ্জা খালার দোকানে পিঠা খেতে গিয়ে।
আমি বুঝতে পারি বাবা-মা’রা আমাকে নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছেন। অস্বস্তি এ কারণে নয় যে পড়ালেখা শেষ করেও আমি কেন আয়-উপার্জন করে তাদের খাওয়াচ্ছি না; তাদের দুশ্চিন্তা বরং এই নিয়ে যে তাদের অনুপস্থিতে আমার জীবন কীভাবে কাটবে। মা প্রায়ই বলেন, ‘তোর কি ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই? এ রকম বাউণ্ডুলে ছেলের কাছে তো কেউ মেয়েও দেবে না।’ আমি বলি, ‘কেউ মেয়ে না দিলে আমার কী করার আছে?’ মা রেগে বলেন, ‘কেন, তুই কি ঘরকন্না করবি না? আর লেখাপড়া জানা একটা ছেলে কোনো কাজ-কর্ম না করে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবি?’
না, আমি আয়-রোজগার না করলেও পরিবারের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না। বড় বোন শম্পা তার স্বামীর বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে আছে। স্বামীর ঠিকাদারি ছাড়াও হোটেল-মোটেলের ব্যবসা আছে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে। আর ভাই শিপলু লন্ডনে পড়তে গিয়ে শাদা চামড়ার সহপাঠিনীকে বিয়ে করে সেখানেই থিতু হয়ে গিয়েছে। আমি ধনকুবের বাবার ছোট সন্তান। বাবা এনবিআর-এর কর্মকর্তা। মাঝে মাঝে ভাবি, বাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অঢেল সম্পত্তি আমি ছাড়া ভোগ করার কে আছে। ভাই-বোন কোনোদিন তাদের অংশ নিয়ে গেলেও যা থাকবে এতেই আমার রাজার হালে থাকার কথা। কিন্তু কেন জানি না, বাবার জৌলুসের জালে আটকা পড়ে আমার হাঁসফাঁশ অবস্থা হয়েছে। ছাত্রাবস্থায় ব্যস্ত থাকার মতো অনেক অনুষঙ্গ ছিল বলে নিজেকে অতটা বন্দী বলে মনে হত না। কিন্তু এখন সময় যতই যাচ্ছে ক্রমে নিজের ভেতরে একটি খ্যাপা ষাঁড়ের উপস্থিতি টের পাচ্ছি।
মিতার সাথে কিছুদিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলে শুক্র ও শনি আমাদের জন্য বিশেষ দিন হয়ে ওঠে। প্রাতর্ভ্রমণের চেয়ে দুজনের দেখা হওয়া এবং গল্প করে সময় কাটানো প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। এ রকম প্রেক্ষাপটে দুজন তরুণ-তরুণীর জন্য প্রেম অনিবার্য হওয়া উচিৎ। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে গত এক বছর সময়েও আমাদের মধ্যে প্রেম মূর্তরূপে এসে দাঁড়ায় নি। তবে শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতিসহ দুনিয়ার তাবৎ বিষয় নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে পারিবারিক প্রসঙ্গ অল্পবিস্তর আসেনি এমন নয়। মিতা যে ট্র্যাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে এ কথা জানাতে গিয়ে তার যে একবার বিয়ে হয়েছিল সেকথাও সে অকপটে বলেছে। মিতার সাথে নিয়মিত আলাপচারিতা ছাড়াও এই পিঠাকালে বুইজ্জা খালার দোকানের পাশে বসে তার সাথে গল্প করাও আমাদের একটি নিয়মিত পর্বে পরিণত হয়েছে।
মিতা একদিন বুইজ্জা খালাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘খালা, আপনার এই নামটা কে রেখেছিল? আপনার কি আর কোনো নাম নেই?’
বুইজ্জা খালা তার একমাত্র দাঁতটা বের করে একটু হাসল। তারপর বলল, ‘নামটা কে রাখছিল মনে নাই। তয় নামে কি আসে যায়। ক্যান?’
মিতা বলল, ‘না, এমনিই। আপনার বাড়ি বিক্রমপুর ছিল, আপনার ছেলেপুলে কেউ নেই, সারাজীবন মানুষের বাড়িতে কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন – এসব তো জানা হয়েই গেছে, হঠাৎ ভাবলাম নামটার কথা জিজ্ঞেস করি।’
ফারজানা কিছু বলার জন্য উশখুশ করছিল। মিতার কথা শেষ হতেই সে মুখ খুলল, ‘খালায় হেই কবে থাইকা আমগো লগে থাকে।’
বুইজ্জা খালার সাথে প্রতিবারই এরকম টুকটাক কথা হয়। সে-ও আপন মানুষের মতো সহজ সরল উত্তর দেয়। মিতা ও আমার মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার ধরণটাও অনেকটা এমন। মিতা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, আমিও তার ব্যাপারে কিছু জানতে চাই। প্রায় প্রতি সাক্ষাতেই আমরা বেড়িবাঁধের পাশে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রিক রেস্টুরেন্ট থেকে কফি খাই। টাকা-পয়সা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, তাই মিতাকে এসব খাবারের ছোটখাটো বিল পরিশোধ করতে দিই না। কফি খেতে খেতেও আমরা বেশ কিছু সময় কাটিয়ে দিই। আশ্চর্য হবার মতো ব্যাপার হল, আমরা অনেক কথা বললেও কোনো সিরিয়াস কথা তার মধ্যে থাকে না।
সেদিন মিতাকে হালকাভাবে বললাম, ‘যার সাথে প্রেম করে ঘর বাঁধলে, হুটহাট তাকে ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়ি চলে এলে। তো এভাবেই কি চলবে?’
আমার কথায় মিতা না কষ্ট পেল, না রাগান্বিত হল। সে বরং বলল, ‘আমি তো একটা আলাদা বাসা নিতে চেয়েছিলাম; বাবাই জোর করে নিয়ে এল।’
‘তো বাবার বাসায় ফিরে এসেই জীবন গতি হারিয়ে ফেলল?’, আমি বললাম।
মিতা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘জীবন গতি হারাবে কেন? তুমি কী বুঝাতে চাইছ, আমি বুঝতে পেরেছি। এখন আমি যদি জিজ্ঞেস করি, তুমি তোমার জীবনের গতি রুদ্ধ করে রেখেছ কেন?’
আমি অবশ্য মিতাকে আগেই জানিয়েছি যে আমার বাবার তৈরি জৌলুশের কাল সরোবরে আমি সাঁতার কেটে কুল পাচ্ছি না। আমার নিয়তি আমি জানি না। নিজেকে নিয়ে আমি গঠনমূলক কিছু ভাবতেই পারি না। মিতাও হয়ত আমাকে নিয়ে তেমন করে কিছু ভাবছে না। নইলে এতদিনে আমি আভাস পেয়েই যেতাম। আমাদের কথাবার্তা শুধু গল্পচ্ছলেই বলা। তার পাল্টা প্রশ্নের উত্তর দেয়া অবান্তর মনে করে আমি চুপ করে থাকি।
মিতাও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বুইজ্জা খালা যে বিয়েই করেনি তা কি তুমি জান?’
‘না তো!’ আমি আশ্চর্য হই, ‘তুমি কীভাবে জানলে?’
মিতা বলল, ‘কিছুদিন আগে এক শুক্রবারে তোমার ঘুম ভাঙেনি বলে তুমি যে আসতে পারনি, সেদিন বুইজ্জা খালার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে।’
‘কেন বিয়ে করেনি? তার কী সমস্যা ছিল?’, আমি জিজ্ঞেস করি।
‘তা জানি না। আরেকদিন জিজ্ঞেস করব’, মিতা বলল।
এজাজ সবকিছু জেনে এবং মেনে নিয়েই মিতাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ের তিন মাস পার হতে না হতেই সে তাকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দিতে আরম্ভ করে। মিতা এজাজকে তাদের শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও তাতে কাজ হয়নি। এজাজের একগুঁয়েমি এক সময় দুর্ব্যবহারে পৌঁছে গেলে প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর আগেই মিতা রাগ করে এজাজের ঘর ছেড়ে চলে আসে। পরে কয়েকবার মিতাকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে এজাজ নতুন করে অন্যত্র বিয়ে করে। এসব কথা মিতাই আমাকে গল্পের মতো করে বলেছে। এসব ব্যাপার নিয়ে তার কোনো দুঃখবোধ আছে বলে আমার মনে হয়নি।
বুইজ্জা খালার একটু জ্বরভাব আছে। কোমরের ব্যথাটাও বেড়েছে। আজ তাই ফারজানার উপরেই কাজের চাপ পড়েছে। অবশ্য এতদিনে ফারজানা পিঠা বানানোতে পটু হয়ে উঠেছে। বুইজ্জা খালা পুরনো একটি মোড়ার উপরে বসে শুধু টাকা-পয়সা লেনদেন করছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুইজ্জা খালা, ওষুধ-পথ্য কিছু খেয়েছেন?’
বুইজ্জা খালা কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ল।
ফারজানা বলল, ‘খালা ডাক্তার দেখাইছিল একবার, কিন্তুক ওষুধ খায় নাই ঠিকমতো।
বুইজ্জা খালা রাগ করে তাকায় ফারজানার দিকে।
আমার মনে হল, শুধু ডাক্তার দেখালেই হয় না। ওষুধও খেতে হয়। হয়ত পয়সার অভাবে ওষুধ কিনতে পারেনি। তাই আমি পকেট থেকে পাঁচ শ’ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বললাম, ‘আজকেই ওষুধ কিনে খাবেন।’
বুইজ্জা খালা দ্বিধান্বিতভাবে টাকা নিতে নিতে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর আপনা আপনি তার দু’চোখ ভিজে যায়।
মিতা বলে, ‘খালা, কোনো চিন্তা নেই; আপনি ভাল হয়ে যাবেন।’তারপর সে ফারজানাকে বলে, ‘তুই খালার প্রেসক্রিপশন নিয়ে দোকান থেকে ওষুধ কিনে দিবি।’
আমি বললাম, ‘বুইজ্জা খালা বিয়ে-শাদী করলে আজ তার ছেলে-মেয়েরাই তার দেখভাল করতে পারত।’
আমি এই কথা বলার পর বুইজ্জা খালাকে একটু অস্থির দেখাল। হয়ত এমন কথা শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
মিতাও আমার কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘আসলেই তো। আচ্ছা খালা, আপনি ঘর-সংসার করলেন না কেন?’
বুইজ্জা খালা চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে থাকলে মিতা লাফ দিয় উঠে গিয়ে বুইজ্জা খালাকে জড়িয়ে ধরল।
বুইজ্জা খালা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘মা রে, এইসব কথা জিগাইও না। আমরা কুরবান অইছি তোমাগো লাইগা, তোমরা ভালা থাইক, এই দেশের মানুষ গুলানও ভালা অইয়া যাউক।’
আমি বুইজ্জা খালার কথায় চমকে উঠলাম। তার কুরবানীর সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে। আমি বললাম, ‘খালা, একটু কি খুলে বলবেন কথাটা?’
বুইজ্জা খালা চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আমার একটা পোলা আছিল।’
আমি চমকে উঠে বলি, ‘তাই নাকি?’
বুইজ্জা খালা আবার বলল, ‘তোমগো লাইগা ইজ্জত হারাইলাম, পরিবার হারাইলাম, বাড়িঘর হারাইলাম, তোমগোরে স্বাধীন করলাম…।’বুইজ্জা খালা কাঁদতেই থাকে।
আমি খালার কথা থেকে কিছু একটা আঁচ করতে পারলাম। তখন মিতা প্রশ্ন করল, ‘আপনার পোলার কী হল?’
‘কইতে পারি না।’ বুইজ্জা খালা মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল , ‘কেম্প থাইকা কারা আইনা হাসপাতালে রাইখা গেল। আমার হুঁশ ফিরলে দেখি আমার পাশে একটা বাচ্চা পোলা কানতেছে। ওরে দুধ খাওয়াইলাম। নিজেরই বাচামরা অবস্থা। দুই-তিনদিন পরে দেখি বাচ্চাটা নাই। আমি আর কাউরে কিছু জিগাই নাই।’
মিতা মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল। আমি অনুচ্চ কন্ঠে বললাম, ‘তারপর…?’
বুইজ্জা খালা একটু রাগতস্বরে বলল, ‘তারপরে আর কী? কারা জানি আমারে বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিল। বাড়িতে যাইয়া আমি চিড়িয়াখানার পশু অইয়া গেলাম। গেরামের মানুষ, আত্মীয়কুটুম আমারে দেখতে আসে, দূরে খাড়াইয়া আড়চোখে তাকায়। মা ভাই ভাবী আমারে যেন সইয্য করতে পারে না। আমিও শেষপর্যন্ত বারাইয়া পড়লাম। তারপর কত ঘাট কত সময় পার অইয়া গেল…।’
তাকিয়ে দেখি মিতা ওড়নায় চোখ মুছছে। আমার বুকটাও ভারী হয়ে এসেছে। আমি মিতাকে বললাম, ‘ওঠ, খালার শরীর খারাপ।’ফারজানাকে বললাম, ‘তুই খালাকে বাসায় নিয়ে যা। আর ওষুধ কিনে আনবি কিন্তু।’
আমি আর মিতা বেড়িবাঁধ থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রবেশমুখের দিকে চুপচাপ হেঁটে গেলাম। অনেকদিন হয় বাগানের ভেতরে ঢোকা হয়নি। চারপাশের সবুজ এবং ফুল-পাখির সমারোহে বুকটা একটু হালকা লাগছে। পাইন বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিতাকে বললাম, ‘এই যে এত মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা কিনতে হয়েছে এটা কি আমরা বুঝি, মিতা?’
মিতা এবার মুখ খুলল, ‘কই? আমি তো এখনও স্বাধীন হতে পারিনি। আমার ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। খামচা মারার জন্য সমাজের শানানো নখর চারদিকে খাড়া হয়ে রয়েছে।’ তারপর সে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তুমি কি স্বাধীন?’
আমার কোনো উত্তর নেই। আমি তো স্বাধীন নই। আমার শুদ্ধতার স্বাধীনতা নেই, পঙ্কিলতা থেকে আমার মুক্তি নেই। আমার সুন্দর স্বপ্নের নীড় নেই। মিতার দিকে তাকিয়ে আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলি মাত্র।