ফ্লাইট কিউআর-৫৭০

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ৬২
আব্বাস সাহেব জায়নামাজ থেকে ব্যথাক্লিষ্ট কোমর টেনে তুলে উঠে দাঁড়ান। প্রতিদিন এশার নামাজের পর নিয়ম করে তিনি বেশ কিছুক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকেন। আগে হাতে তসবিহদানা থাকত, বিদা’ত বলে ওই জপমালা এখন আর ব্যবহার করেন না। জানা সকল দোয়া-দরুদ এখন আঙুলে গোনে গোনেই পড়েন।
গৎ অনুযায়ী পাশের কক্ষে গিয়ে শয্যাশায়ী স্ত্রীর মাথায় কয়েকটি ফুঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কি একটু আরাম পাচ্ছ?’
গুলনাহার বেগম কিছুই বলেন না। পাশে বসে বউমা, রেহানা, দুধেভেজানো কর্ণফ্লেক্স চামচ দিয়ে শাশুড়ির মুখে তুলে দিচ্ছিল। এটাই এখন গুলনাহার বেগমের রাতের খাবার। কোনো খাবারই তার এখন রোচে না; তবুও জোর করে কিছু একটা খাওয়াতে হয়। রেহানা আন্তরিকভাবেই শাশুড়ির সেবাযত্ন করে চলেছে।
রেহানা বলে, ‘আব্বা, আপনার দুধটা গরম করে নিয়ে আসি?’ আব্বাস সাহেব শোবার আগে প্রতিদিন এক গ্লাস ননীবিহীন দুধ খান। মাগরেবের নামাজ পড়েই দুটি সেঁকা রুটি এবং সবজি দিয়ে রাতের খাবার সেরে নেন।
আব্বাস সাহেব রেহানার কথার জবাবে কিছু বলেন না। হয়তো ভাবেন, এটা তো একটা রুটিন; হ্যাঁ কিংবা না বলা তেমন জরুরি নয়। বরং তিনি এক কদম এগিয়ে গিয়ে স্ত্রী গুলনাহার বেগমের মুখের দিকে ভাল করে তাকান। মাথাটা নুইয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ব্যথাটা কি একটু কম আজ?’
কর্ণফ্লেক্স মুখে নিয়ে গুলনাহার বেগম নাড়াচাড়া করছিলেন। এবার স্বামীর প্রশ্নের জবাবে আস্তে করে বললেন, ‘ভাল।’
আব্বাস সাহেব নিজের কক্ষের দিকে রওয়ানা করার আগে রেহানাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রাজীব তো কালকে ফ্লাই করবে?’
‘জ্বী আব্বা’, শাশুড়ির মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে রেহানা জবাব দেয়।
গুলনাহার বেগম মাথা কাত করে উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করেন, ‘রাজীব আসবে?’ তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তার ছেলের আসা নিয়ে কথা হচ্ছে। অবশ্য তিনি আগেও এ ব্যাপারে শুনেছেন বেশ ক’বার। কিন্তু স্মৃতি তা ধারণ করে রাখতে পারেনি।
রেহানা জানায়, ‘হ্যাঁ আম্মা, আপনার ছেলে আসবে, আপনাকে চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া নিয়ে যাবে, আপনি ভাল হয়ে যাবেন।’
ইত্যবসরে হালিমা এসে বলে, ‘দুধ রাইখা আসছি; মামা আপনি ঘুমাইতে যান।’
আব্বাস সাহেব চলে গেলে হালিমা তার বিছানা পরিপাটি করতে করতে রেহানাকে বলে, ‘বউ, তুমি যাও; খাইয়া লও। আমি মামিরে বাথরুম করাইয়া শুইয়া পড়ব।’
রেহানা চলে গেলে হালিমা গুলনাহার বেগমকে উঠিয়ে বসায়। বাথরুমে নেয়া আনা ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টকর বলে তার জন্য পটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে গুলনাহার বেগম পারতপক্ষে বিছানায় বসে পটি করেন না। কষ্ট হলেও তিনি বিছানা থেকে নেমে মেঝেয় বসে কাজ সারেন। শরীর বেশি খারাপ হলে অবশ্য বাধ্য হয়ে বিছানায় শুয়ে-বসে পরিচ্ছন্নতা কর্ম করতে হয়।
কপালগুণেই হালিমাকে জোগাড় করা গিয়েছিল। আব্বাস সাহেবের দুঃসম্পর্কের এক ফুফুতো বোনের মেয়ে সে। রুনার কাছ থেকেই হালিমার সন্ধান পেয়েছিলেন আব্বাস সাহেব। মায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে সাউথ আফ্রিকা থেকে ফোন করে রুনা বলেছিল, ‘বাবা, হালিমা নামে নাকি আমাদের এক আত্মীয় আছে; তোমার তো চেনার কথা।’ আব্বাস সাহেব বলেছিলেন, ‘নারে মা, হালিমা নামে কাউকে তো আমি চিনি না।’ এরপর রুনা জানিয়েছিল কখন কিভাবে হালিমা একবার তার দুরবস্থার কথা জানিয়ে তাকে ফোন করেছিল। দারিদ্রের কারণেই হয়তো ছেলেরা তার ভরণপোষণ দিতে পারত না, ইত্যাদি। কীভাবে সে তার ফোন নম্বর পেয়েছিল এসব কথা রুনা জিজ্ঞেস না করলেও একবার কিছু টাকা সে হালিমাকে পাঠিয়েছিল।
রুনার সূত্র ধরেই হালিমার সাথে যোগাযোগ করা হলে সে মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে যায়। নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা এবং সুখী জীবনের কথা ভেবে আব্বাস সাহেবের আহ্বানে হালিমা এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সে তার ছেলেমেয়েদের পিছনে ফেলে ঢাকায় চলে আসে। হালিমাকে পেয়েই সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ঘরের কাজকর্মের জন্য একজন বাঁধা বুয়া আছেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সে চলে যায়। হালিমাকে আনা হয়েছে মূলত গুলনাহার বেগমকে দেখাশোনার জন্য। তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে গুলনাহার বেগমের কক্ষেই। পরিবারের সবাই তাকে আত্মীয় হিসেবেই দেখেন।
সকাল দশটার দিকে রেহানার ফোন বেজে ওঠে। রেহানা তখন শাশুড়িকে নাশতা খাওয়াচ্ছিল। হালিমা রেহানার কক্ষ থেকে মোবাইল ফোনটি আনতে গিয়ে দেখে রুনা কল করেছে, কেপ টাউন থেকে। হোয়াটসঅ্যাপ কলে রুনার ছবি দেখে সে হুট করে স্ক্রিনে চাপ দিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করে দেয়, ‘কেমন আছ বইন, আমি হালিমা।’ আগেও সে অনেকবার রুনার কল রিসিভ করেছে।
রুনা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, ‘হালিমা আপা, রেহানা কই?’
হালিমা রুনার এমন ত্বরিত সম্ভাষণে একটু ভড়কে গিয়ে বলে, ‘ধর, দিতাছি।’ বলে, সে ফোনটি রেহানাকে এগিয়ে দেয়।
রেহানা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, ‘কী খবর আপা, কেমন আছেন?’
রুনা ঝড়ের বেগে বলে, ‘আমি ভাল। শোন, তুমি বলেছিলে না রাজীব দিল্লি হয়ে দেশে যাবে?’
‘হ্যাঁ, তাই তো।’ রেহানা বলে, ‘ওখানে দু’তিনটা হসপিটাল ভিজিট করে আম্মার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই তবে ঢাকা আসবে।’
‘তুমি শিওর?’ রুনার গলা কাঁপা কাঁপা মনে হয় রেহানার কাছে।
রেহানা বলে, ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘আচ্ছা, সে কি তোমার কাছে তার আইটিনারারি পাঠিয়েছে?’ রুনার কণ্ঠে শঙ্কার উপস্থিতি।
রেহানাও কেমন ধন্দের মধ্যে পড়ে যায়। সে বলে, ‘আপা, আপনাকে এমন শোনাচ্ছে কেন? কোনো জরুরি বিষয় আছে তার সাথে?’
রুনা ত্রস্ততার সাথে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আজকেই তো তার দিল্লি পৌঁছার কথা, তাই না? সে কোন এয়ারলাইন্সে আসছে, তুমি কি তা জান?’
এবার রেহানা অধৈর্য হয়ে বলে, ‘আপা আপনি একটু পরিষ্কার করে বলুন তো, আপনি কী বলতে চাইছেন?’
রুনা এক মুহূর্ত সময় নিয়ে বলে, ‘রেহানা, তুমি টিভি খুলেছ, সকাল বেলা? আই মিন, নিউজ দেখেছ?’
রেহানা তীরবেগে ড্রইংরুমের দিতে ছুটে যায় টিভি অন করতে। যেতে যেতে প্রায় কান্নাকণ্ঠে সে বলে, ‘আপা, আপা, প্লিজ আপনি পরিষ্কার করে বলুন কী হয়েছে?’
রুনা বুঝতে পারে যে তাকে আরোও সংযত হয়ে কথা বলা উচিৎ ছিল। হয়তো তার আশংকা আদতে অমূলক। হয়তো রাজীব সেই বিধ্বস্ত ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জারই নয়। রেহানাকে শান্ত করার জন্য রুনা বলে, ‘রেহানা, শোন, শোন; কিছুই হয়নি। আমি নিশ্চিত হতে চাইছি যে রাজীব কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে আসছে কিনা। বিবিসি বলছে, দিল্লিগামী কিউআর-৫৭০ ফ্লাইটটি আটলান্টিকে ক্র্যাশ করেছে। এজন্য এত কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।’
রেহানা আঁতকে উঠে রিমোট টিপতে থাকে। বিবিসি চ্যানেলে প্লেন ক্র্যাশের কোনো সংবাদ না দেখে সে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘আপা, আমি বিবিসিতে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। এখন আমি কী করব?’
‘কী হয়েছে বউমা?’ শ্বশুরের গলার আওয়াজ শুনে রেহানা চমকে যায়। বউমার হৈচৈ শুনে আব্বাস সাহেব কোমর চেপে ধরে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছেন; রেহানা টের পায়নি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রেহানা বলে, ‘আব্বা, আপা ফোন করেছেন, সাউথ আফ্রিকা থেকে। কোথায় নাকি একটা প্লেন ক্র্যাশ করেছে।’
আব্বাস সাহেব সাউথ আফ্রিকা, প্লেন ক্র্যাশ এবং রেহানার কান্নার কোনো যোগসূত্র মেলাতে না পেরে বোকা বোকা প্রশ্ন করেন, ‘দুঃখজনক; কিন্তু তুমি কাঁদছ কেন?’
ওপাশ থেকে রুনা চেঁচিয়ে বলে, ‘ফোনটা বাবাকে দাও, রেহানা।’
রেহানা তার মোবাইল ফোন শ্বশুরের হাতে দিয়ে বলে, ‘আপা কথা বলতে চায় আপনার সাথে।’
রুনা বলে, ‘বাবা শোন, কিছুই হয়নি; রেহানা মিছেমিছি হট্টগোল করছে। আমি তাকে একটা টেলিভিশন নিউজের কথা বলছিলাম। বিবিসি বলেছে, কাতার এয়ারওয়েজের একটা বিমান আটলান্টিকে বিধ্বস্ত হয়েছে। আচ্ছা, তোমার শরীর কেমন? মা কেমন আছেন?’
‘না, আমি ভাল।’ আব্বাস সাহেব বলেন, ‘কোন ফ্লাইটের কথা বললি? প্লেনটি কোথায় যাচ্ছিল?’
রুনা মনে মনে রেহানার ওপর বিরক্ত হয়। চেঁচামেচি করে অসুস্থ বাবাকেও সে ক্রাইসিসের সাথে জড়িয়ে ফেলছে। সে বলে, ‘ওটা ইণ্ডিয়া নাকি কোথায় যাচ্ছিল। এটি একটা দুর্ঘটনা বাবা; এরকম তো হয়ই। তাতে আমরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়ছি কেন?’
আব্বাস সাহেব মেয়ের কথা শুনে একটু স্বস্তি পান। রাজীবও যে কোনো একটা ফ্লাইটে দিল্লি আসার কথা সে চিন্তা তার মাথায় ঢোকেনি। তিনি বলেন, ‘তাই তো। আমরা কী করব? তো জামাই কেমন আছে? আর আমার নাতি-নাতনি?'
বাবাকে তো সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে রুনা । কিন্তু সে নিজে বোঝে ব্যাপারটা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। রাজীবের ফ্লাইট ডিটেইলস না জানা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হবার অবকাশ নেই। তবুও বাবাকে হেসে হেসে বলে, ‘আমরা সবাই ভাল। তোমার জামাই বিজনেস ট্রিপে জিম্বাবুয়ে গেছে; আগামীকাল ফিরে আসবে।’
আব্বাস সাহেব বলেন, ‘জানিস তো, রাজীব দুতিন দিনের মধ্যে দেশে আসবে?’
রুনা বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি; ও দেশে এলে আমাকে কল করতে বল।’ বাবার সাথে মিষ্টি করে কথা বললেও তার অস্থিরতা কাটছে না। সে আবার বলে, ‘বাবা, ফোনটা রেহানাকে দাও না, একটু কথা বলি।’
‘বউমা নাও’ বলে ফোনটা রেহানাকে এগিয়ে দিয়ে আব্বাস সাহেব তার কক্ষেরে দিকে ফিরে যান।
রুনারা স্থায়ীভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকায় আছে সপরিবারে। তার স্বামী অনেক বড় ব্যবসায়ী। যদিও শুরুটা খুব সহজ ছিল না, তবে অনেক দিনের সাধনা ও পরিশ্রমের ফলে সে আজ সে দেশের প্রথম সারির ব্যবসায়ীর কাতারে শামিল হয়েছে। দুয়েক বছর পর পর দেশে বেড়াতে আসে। ফেরার পথে বউ-বাচ্চা নিয়ে আরোও দুয়েকটি দেশে চক্কর দিয়ে যায়। মাস দশেক আগে তারা শেষবার এসেছিল রাজীবের বিয়েতে।
আব্বাস সাহেব বিষয়-বৈভব কিছু করতে পারেননি ঠিকই, তবে সন্তান দুটিকে জানপ্রাণ সঁপে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। কলেজ শিক্ষক হিসেবে অসৎ হবার তেমন সুযোগ ছিল না। আর থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি সারাজীবন সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন। রুনার পিতার মতো শিক্ষক হবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অনার্স পাশ করার পর পাত্রপক্ষের জোরাজুরিতে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হয়। বিয়ের পর স্বামীর সাম্রাজ্য সামলাতে গিয়ে শিক্ষকতার ইচ্ছেটা তার কর্পূরের মতোই উবে যায়। তবে রাজীবের বেলায় সে রকম হয়নি। আব্বাস সাহেব তার সর্বস্ব একত্র করে ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। আইনে পিএইচডি করে সে এখন লন্ডনের একটি ল’ ফার্মে যুক্ত আছে। এবার দেশে এসে সদ্য বিয়েকরা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যাবে।
রেহানা এই ঘরে নববধূ। স্বামীর সাথে সাকুল্যে পনর দিন কাটিয়েছে। রাজীব বলেছে, ‘তোমাকে রেখে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি না ফিরলে তোমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে পারব না। ইমিগ্র্যাশনের সব কাগজপত্র আমাকেই ঠিক করতে হবে। মাত্র কয়টা দিন অপেক্ষা করো।’ এবার সে সবকিছু গুছিয়েই দেশে আসছে। এই ফাঁকে মাকে একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে নিয়ে যাবার কথা। সেজন্য ইতিমধ্যে পাসপোর্ট ভিসাও করানো হয়ে গেছে। সাথে রেহানাও যাবে। কিন্তু শেষবেলা এ কী হল? প্লেন ক্র্যাশের খবর সত্য; বাংলাদেশের চ্যানেলেও ইতিমধ্যে এসে গেছে।
রুনা যদিও বাবা-মাকে এসব কথা জানাতে বারণ করেছে, রেহানা কি শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারে? সে উন্মাদের মতো যত জায়গায় সম্ভব ফোন করছে আর আড়ালে চোখ মুছছে। আত্মীয়স্বজন সবাই যদিও সান্ত্বনা দিচ্ছে, তবুও রাজীব কেন তার ফ্লাইট ডিটেইল রেহানাকে জানায়নি সেজন্য তাকে দোষারোপ করছে। কেউ আবার বলছে যে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, রাজীব হয়তো অন্য কোনো ফ্লাইটে আছে, তাই তার মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন আছে। দিল্লিতে নেমে সুবিধামতো সময়ে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। কিন্তু এসব সান্ত্বনার বাণী রেহানাকে শান্ত করতে পারছে না।
শাশুড়ি অসুস্থ হলেও রেহানার অস্বাভাবিক আচরণ তার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। কারণ রেহানা শাশুড়ির সাথে যতই অভিনয় করুক না কেন, তাতে তার চেহারার দুশ্চিন্তার ছাপ আড়াল হচ্ছে না। তিনি কিছুক্ষণ পরপরই হালিমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘বউমার কী হয়েছে রে?’ হালিমা আয়াতুল কুরসি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রেহানার পরামর্শমতো বলছে, ‘না, মামি, কিছু না। বউয়ের বাপের বাড়ির কেডা জানি অসুস্থ, তাই মন খারাপ।’
রেহানা দুপুরে কিছুই মুখে তোলেনি। হালিমা অনেক সাধাসাধি করেছে। বলেছে, ‘বউ, ইনশাল্লাহ রাজীবের কিছুই অইব না; তুমি না খাইয়া শরীল খারাপ করলে বিষয়টা বেশি জটিল অইয়া যাইব।’ সে আরোও বলেছে, ‘শুন, তুমি ভাত খাইয়া অজু কইরা আস; আমি তুমারে সালাতুল হাজত আর দোয়া-দরুদ শিখাইয়া দিমু…।’ এটুকু বলে হঠাৎ থেমে গিয়ে রেহানার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে, ‘নামাজ পড়তে পারবা? অসুবিধা নাই তো?’ স্বাভাবিক অবস্থায় এ ধরনের প্রশ্ন শুনলে হয়তো রেহানার মুখ একটু লাল হয়ে যেত। কিন্তু হালিমার কথার উত্তরে তার চোখ থেকে নির্বিকারে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর রেহানা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না। এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় কাজের বুয়াও তাদের ছেড়ে যেতে চাইছিল না। হালিমা তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বিদায় করেছে। সন্ধ্যার আগে রুনার কল পেয়ে রেহানা এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তার মুখ দিয়ে আর স্বাভাবিক কথা বেরুচ্ছে না। রুনা জানিয়েছে যে সে তার দুজন বন্ধুর সাথে কথা বলেছে। ওদের একজন বার্মিংহাম এবং অন্যজন ম্যানচেস্টারে থাকে। রুনা অনুরোধ করেছে যে তারা যেন কষ্ট করে হলেও কাতার এয়ারওয়েজের অফিস থেকে বিধ্বস্ত ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার লিস্টটি জোগাড় করে। ইতিমধ্যে ম্যানচেস্টারের বন্ধু তাকে জানিয়েছে যে ব্যাপারটা খুব জটিল। গোপনীয়তার স্বার্থে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ প্যাসেঞ্জার লিস্ট ওপেন করতে পারবে না। তবে সেই ভদ্রলোক প্রমাণাদিসহ প্যাসেঞ্জারদের অতি নিকটজনকে এয়ারলাইন্সের অফিসে গিয়ে কথা বলে চোখ মুছতে মুছতে ফিরে যেতে দেখেছে। রেহানাকে এ খবরটি জানিয়ে রুনা নিজেই কেঁদে ফেলেছে।
রেহানা শেষপর্যন্ত জায়নামাজে উপবিষ্ট শ্বশুরের কাছে পাগলের মতো ছুটে যায়। আব্বাস সাহেব তখন চোখ বন্ধ করে তসবিহ পড়ছিলেন। বৌমার গোঙানি শুনে তিনি চমকে ওঠেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে বউমা?’
রেহানা এবার গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। হালিমা ছুটে এসে রেহানাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বউ, তুমি শান্ত হও।’ তারপর সে নিজের মতো করে আব্বাস সাহেবকে ব্যাপারটি খুলে বলে।
আব্বাস সাহেব নিজেও অসুস্থ; ডায়াবেটিস এবং ব্লাডপ্রেশার বেশ পুরনো। ব্যাকপেইন আগের চেয়ে বেড়েছে। উত্তেজনা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।এতদসত্ত্বেও এরকম উদ্বেগজনক সংবাদ তাকে না জানানোও সুবিবেচনার কাজ হয়নি। তিনি তসবিহপাঠ থামিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো লাফ দিয়ে জায়নামাজ ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে ককিয়ে ওঠেন, ‘তোমরা আমাকে আগে বল নাই কেন?’ হালিমা হুমড়ি খেয়ে এসে মামার দুই বাহু ধরে টেনে তাকে দাঁড় করায়।
রেহানা চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘আব্বা আমরা কী করব?’
আব্বাস সাহেব কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘তখন আমাকে সত্য কথাটা বললে আমিও তো খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করতে পারতাম। এখন কাকে জিজ্ঞেস করি?’ তারপর তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে তার বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ড্রয়ার খোলেন। সেখান থেকে তার পুরনো নোটবুকটি খুলে একের পর এক টেলিফোন নম্বর খুঁজতে থাকেন। তখন পাশের কক্ষ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠের অসহিষ্ণু আওয়াজ পাওয়া যায়। আব্বাস সাহেব তখন রেহানাকে তাড়া দিয়ে বলেন, ‘তোমার শাশুড়ির কাছে যাও তো বউমা। আর শোন, আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই; আল্লাহ্র উপর ভরসা রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমাদের সহায়।’
রেহানা শাশুড়ির কাছে চলে গেলে আব্বাস সাহেব হালিমাকে বলেন, ‘এক কাপ আদা-চা দেয় তো মা। আর শোন, তোর মামি যেন এসব না শোনে।’
হালিমা জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে, ‘অসম্ভব, মামা; আমরা মামিরে কিসসু বুঝতে দেই নাই। আর আপনে এখন চা খাইলে ঘুম অইব নাতো।’
আব্বাস সাহেব তার মোবাইল ফোনে একটি নম্বর টিপতে টিপতে হালিমাকে বলেন, ‘কথা বলিস নাতো, আমার মাথা ধরেছে।’
হালিমা অগত্যা চা বানাতে চলে গেলে আব্বাস সাহেব রঞ্জু নামের এক ছেলের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করেন, ‘আমাকে চিনতে পেরেছ, বাবা? আমি…’
‘আমি আপনাকে চিনেছি স্যার। কেমন আছেন? ভাইয়া কি দেশে এসেছে?’ রঞ্জুর মতো ছেলেরা যারা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে তাদের মেমোরি সেল সাধারণ মানুষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্টদের ডাটা মগজে সব সময় অ্যাক্টিভ করে রাখে। ঘটনাক্রমে আব্বাস সাহেব রঞ্জুর শিক্ষকও।
‘না বাবা, রাজীব আসেনি, তবে দু’চারদিনের মধ্যে আসার কথা।’ আব্বাস সাহেব বলেন, ‘আমি আসলে একটা হেল্পের জন্য তোমাকে অসময়ে বিরক্ত করছি।’
রঞ্জু বিষয়-বৃত্তান্ত কিছু না শুনেই ফটাফট বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই, স্যার। আপনি কাল সকালে কষ্ট করে আমার অফিসে চলে আসুন; অথবা আপনি বললে আমিই আপনার বাসায় চলে আসব।’
রঞ্জু ধরে নিয়েছে আব্বাস সাহেব এয়ার টিকেট নিয়েই কথা বলবেন। কারণ, রাজীবসহ তার ফ্যামিলির প্রায় সবার বিমানের টিকেট রঞ্জুই করে দিয়েছে। এমনকি অনেক সময় আব্বাস সাহেবকে সে বাকিতেও টিকেট দিয়েছে।
আব্বাস সাহেব তখন রঞ্জুকে শান্তভাবে তার উদ্বেগের কথা আদ্যোপান্ত জানিয়ে কিছুটা কাতর হয়ে বললেন, ‘তুমি কি কোনোভাবে এ ব্যাপারে আমাকে হেল্প করতে পারবে রঞ্জু?’
রঞ্জু এবার আর আগের মত স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্যারের কথার জবাব দিতে পারল না। সে কিছুটা ধীরকণ্ঠে বলল, ‘স্যার, আমরাও শুনেছি কাতার এয়ারের ফ্লাইটটির কথা। হয়তো এটা দোহা হয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু স্যার, আসলে এটি দিল্লি-বাউণ্ড ফ্লাইট। ঢাকা-বাউণ্ড হলে আমরা লোকাল অফিস থেকে কায়দা করে খবর বের করতে পারতাম।’
‘তাহলে…’, আব্বাস সাহেব হতাশার সুরে বললেন, ‘…তাহলে তো তোমাদের কিছু করার নেই?’
রঞ্জু আবার চটজলদি বলল, ‘না-না স্যার, আপনি টেনশন করবেন না। ব্যাপারটা এমনও তো হতে পারে, ভাইয়া এই ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জারই না; তিনি হয়তো অন্য ক্যারিয়ারে রওয়ানা করেছেন; আজ রাতেই অথবা কাল সকালে এসে দিল্লিতে নামবেন।’ এক মুহূর্ত থেমে রঞ্জু আবার বলল, ‘এক কাজ করবেন স্যার। রিজাল্ট যাই হোক না কেন, কাল সকাল নয়টায় আমাকে একটা কল দিবেন, প্লিজ। প্রয়োজন হলে আমি একবার কাতার এয়ারের অফিসে গিয়ে আমার সাধ্যমতো সব চেষ্টা করব।
তাৎক্ষণিক কোনো আশার আলো না দেখে আব্বাস সাহেব কিছুটা ভেঙ্গে পড়লেন মনে হল। তিনি ফোনটি টেবিলের ওপর রাখতে গিয়ে দেখেন পুত্রবধূ রেহানা এবং হালিমা দুজনই তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি শুষ্ক মুখে রেহানার দিকে তাকাতেই সে ফুঁপিয়ে ওঠে। তখন তিনি সতর্ক দৃষ্টিতে পাশের কক্ষের দিকে তাকিয়ে মুখে আঙুল ঠেকিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘বউমা শক্ত হও; এভাবে অস্থির হলে চলবে না। রাজীব হয়তো রাতেই ফোন দেবে; নয়তো কাল সকালে। সে হয়তো অন্য ফ্লাইটে আসছে।’
রেহানা ভ্যাবাচ্যাকার মত চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘কিন্তু যদি ফোন না দেয়, আব্বা?’
আব্বাস সাহেব রেহানার এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য জুতসই শব্দ হাতড়াতে থাকেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী মনোমুগ্ধকর প্রকাশ । অসাধারণ
ভালো লাগেনি ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১
আপনার মতো আপন পাঠকই কেবল আমার রচনা নামের বর্জ্যের ওপর মন্তব্য করেন। ভাল লাগে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী