প্রফেসর শাকিল ভর্তি রুগিদের ভিজিট শেষ করে এসে চেম্বারে বসলে ডঃ তাবাসসুম দর্শনপ্রার্থী নতুন ও পুরাতন রুগিদের ফাইল গোছাতে থাকেন। তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সার্জন হলেও হেভেন নার্সিং হোমের সাথে বেশ ভালভাবে যুক্ত আছেন। তিনিও রুগি দেখেন এবং হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। প্রফেসর শাকিলের অবর্তমানে ভর্তি রুগিদের তিনিই দেখাশোনা করেন। জটিল সমস্যায় ফোনে স্যারের পরামর্শও নেন। তাছাড়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া রুগিদের বৃত্তান্ত তিনিই আগেভাগেই নথিভুক্ত করে স্যারের জন্য প্রস্তুত করে রাখেন। তারপর ক্রম অনুযায়ী রুগিদের উপস্থিত করান।
প্রফেসর শাকিল কফি শেষ করে বলেন, ‘তাবাসসুম, শুরু কর।’
নিয়মমাফিক রুগি সালাম দিয়ে ঢুকলেই ডঃ তাবাসসুম গড়গড় করে রুগির বৃত্তান্ত বলে যান। প্রয়োজন হলে স্যার আরোও দুয়েকটি প্রশ্ন করেন। তারপর ওষুধের নাম, পরীক্ষানিরীক্ষার অ্যাডভাইস বলে যান, এবং ডঃ তাবাসসুম খসখস করে ফাইলে লিপিবদ্ধ করেন। একইভাবে সিরিয়্যালের সাত নম্বর রুগি সালাম দিয়ে চেম্বারে ঢুকলে ডঃ তাবাসসুম তার বৃত্তান্ত বলে যান। সাথে এও বলেন, ‘এই রুগিকে আমি আগে দুবার দেখেছি স্যার। অবস্থার খুব একটা উন্নতি না হওয়ায় আপনার কাছে আসার পরামর্শ দিয়েছি।’
প্রফেসর শাকিল তখন রুগির ফাইলটি দেখতে চান। তিনি মনোযোগ দিয়ে ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাম এবং অন্যান্য রিপোর্ট দেখে রুগির মুখের দিকে তাকান। দেখার মতো তেমন কিছুই নেই, আটপৌরে ঘরের মানুষ যেমনটি হয় এ রুগিও তেমন। হালকা-পাতলা গড়ন, মাথা প্রায় ফাঁকা, ভাঙাচোরা মুখে শাদা-কাল সুন্নতি দাড়ি। প্রফেসর শাকিল কিছু একটা ভেবে নিয়ে রুগিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কী করেন?’
‘স্যার, আমি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি’, রুগির উত্তর।
‘এখন তো স্মোক করেন না?’
‘না স্যার। অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।’
প্রফেসর শাকিল বলেন, ‘আপনার তো অ্যানজিওগ্রাফি করতে হবে; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
রুগিকে একটু আতঙ্কিত দেখায়। তিনি আমতা আমতা করে বলেন, ‘স্যার, যতটুকু জানি, অ্যানজিওগ্রাম মূল চিকিৎসা নয়। আমি গরীব মানুষ; মূল চিকিৎসা করতে গেলে অনেক টাকার দরকার। তবুও খরচের ব্যাপারে একটু ধারনা পেলে ভাল হত।’
প্রফেসর শাকিলের কপাল একটু কুচকে যায়। এখনও অনেক রুগি দেখার বাকি। তার এত কথা বলার সময় নেই। তিনি ডঃ তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি ওনাকে বুঝিয়ে দিয়ো। নেক্সট রুগি ডাক।’
ডঃ তাবাসসুম সাত নম্বর রুগিকে বললেন, ‘আপনি বাইরে গিয়ে অনুসন্ধানে একটু কথা বলেন; আমি এক ফাঁকে এসে আপনাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দেব।’
বয়স পঞ্চান্ন পেরিয়ে গেলেও প্রফেসর শাকিল এখনও পূর্ণ কর্মক্ষম। ঢাকাতেও দুটি নামী প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি জড়িত। চাকরির বাইরে প্রতিদিন কমপক্ষে একটি সার্জারি, দুটো স্টেন্টিং করেন। বয়স বেড়ে গেলে হয়ত এত এনার্জি থাকবে না। এ বয়সে অনেকেই নামে বেনামে হাসপাতাল, ক্লিনিক খুলে আমৃত্যু পেশায় যুক্ত থাকেন। প্রফেসর শাকিলের সে রকম কিছু থাকলেও থাকতে পারে। তবে শেয়ারের সুবাদে হোক কিংবা নাড়ির টানেই হোক তিনি ঢাকার বাইরে শুধু সিলেটেই রুগি দেখতে যান। এ শহরে কার্ডিও সার্জন প্রফেসর শাকিলের বেশ নামডাক আছে এবং সেই সূত্রেই হেভেন নার্সিং হোমেরও। তাছাড়া ডাক্তার সাহেব এ জেলার লোক বলে রুগিদেরও এক ধরনের মানসিক পক্ষপাতিত্ব আছে।
রুগি দেখা ছাড়াও প্রতি যাত্রায় দু’চারটা অপারেশন কিংবা রিং লাগানোর কাজ করেন। কদাচিৎ ওটি’র কোনো কাজ না থাকলে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে ছাতকে চলে যান। সেখানে জুমার নামাজ আদায় করে আত্মীয়-স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করে আসেন। আপন আত্মীয়-স্বজন বলতে প্রফেসর শাকিলের এক সৎভাই আছেন, ছোট। থানাশহরে তার বড় ওষুধের ফার্মেসী আছে। অন্য সৎভাই বৈবাহিকসূত্রে লণ্ডনপ্রবাসী হয়েছিলেন এবং দু’বছর আগে ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন। সৎমা-ও বেঁচে নেই।
ছোটবেলায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় মা মারা গেলে বাবা সঙ্গত কারণে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমা’র ঘরে পর পর দুভাই জন্মালেও শাকিলকেও তিনি আপন ছেলের মতো আদর করতে কার্পণ্য করেননি। তবে স্কুলে যাবার বয়স হয়ে গেলে একমাত্র ভগ্নিবিরহে কাতর বড়মামা মাখন মিয়া শাকিলকে নিজের কাছে কোম্পানীগঞ্জে নিয়ে আসেন। মূলত মামার বাড়িতেই শাকিলের বেড়ে ওঠা। মামার বাড়ি থেকেই এসএসসি পাশ করে তিনি এম.সি. কলেজে এইচএসসি পড়েন। ভাল ছাত্র হওয়ার সুবাদে শেষপর্যন্ত ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। বাল্যস্মৃতির অধিকাংশ মামার বাড়ি কেন্দ্রিক হলেও প্রফেসর শাকিলের কোম্পানীগঞ্জে তেমন যাওয়া হয় না। নিঃসন্তান বড়মামা-মামী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন; অন্যরাও বাড়ি ফাঁকা করে কবেই বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছে।
সেদিন সাত নম্বর রুগি, প্রাইমারি শিক্ষক হায়দার আলিকে সবকিছু ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন ডঃ তাবাসসুম। তিনি বলেছেন যে তার আর্টারিতে ব্লক থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তাই দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন প্রস্তুতি নিয়ে চলে আসেন।
হায়দার আলি বলেছেন, ‘দেখেন ম্যাডাম, ছেলে যতই বলুক, মিডিলইষ্টের চাকরি, কত টাকাই-বা বেতন পায়; আমি কম খরচের চিকিৎসায়ই যাব।’
ডঃ তাবাসসুম বলেছেন, ‘অ্যানজিওগ্রাম করলেই পরে বোঝা যাবে আপনার ব্লকের অবস্থা কী। তখন বেশি রিং লাগানোর প্রশ্ন আসলে আপনি বাই-পাসে যেতে পারেন, তাতে খরচ একটু কম পড়বে।’
হায়দার আলির ছেলে দুবাই থেকে এক লাখ টাকা পাঠিয়েছে বাপের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু তিনি জানেন, এই টাকাতে হৃদযন্ত্রের চিকিৎসা হবে না। আবার ছেলে কিছুতেই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। নইলে হয়ত এক লাখের মধ্যে হয়ে যেত। ছেলে বলেছে, ‘আপনি ভাল ডাক্তারের কাছে যাবেন; টাকা আরোও লাগলে বলবেন, আমি ধার করে হলেও পাঠাব।’ কিন্তু হায়দার আলি টাকার মূল্য বোঝেন; তিনি ছেলেকে বিপদগ্রস্ত করতে রাজি নন। তাই ইতিমধ্যেই তিনি প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তোলার জন্য আবেদন করে রেখেছেন।
এক সপ্তাহ পর সম্বন্ধী হুসেন আলিকে নিয়ে হায়দর আলি হেভেন নার্সিং হোমে আসেন। উদ্দেশ্য, সবকিছু আরেকবার ভালভাবে বুঝে নিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা। তারা অনুসন্ধান, হিসাব ইত্যাদি কাউন্টার ঘোরাঘুরি করে ডঃ তাবাসসুমের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
বিকেল পাঁচটায় ডঃ তাবাসসুম হাসপাতালে এসে আবারও সুন্দরভাবে বুঝিয়ে তিনি হায়দার আলিকে নিয়ে হিসাব বিভাগে যান এবং অ্যাডভান্সের টাকা জমা দিতে বলেন।
হায়দার আলি পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে বলেন, ‘বেশি আনি নাই।’
ডঃ তাবাসসুম কী যেন ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে এটাই দিয়ে যান। আগামি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রেডি হয়ে আসবেন। স্যার দেখে যা যা করার বলে দেবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে পরদিন সকালে অ্যানজিওগ্রাম করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
হায়দার আলি ডাক্তারের কথা শুনে যেন একটু ভয় পেলেন।
ডঃ তাবাসসুম এবার বললেন, ‘আরে এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হার্টের চিকিৎসা এখন তেমন কঠিন কিছুই না। আপনি ভাল হয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ।’
ফেরার পথে হুসেন আলি একটি পান মুখে পুরতে পুরতে বললেন, ‘বড় ডাক্তর সাব সিলটি নায়নি?’
হায়দর আলি বলেন, ‘অয়, খুব বড় ডাক্তর।’
‘নাম হুনলাম শাকিল সাব।’ হুসেন আলি বলেন, ‘আমার কিতার লাগি মনে অর, এইন আমরার হউ শাকিল নি কুনো?’
হায়দর আলি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সম্বন্ধীর দিকে তাকান।
‘আরে মাস্টরসাব, অউযে আমরার মাখন মিয়ার ভাগনা। মামুর বাড়িত থাকিয়া যে শাকিল মেট্টিক পাশ করছইন, হুনছি তাইন বড় ডাক্তর অইছইন। আমি দেখলে চিনতাম।’
‘হাছানি? আগে জানলে ভালা অইত’, হায়দর আলি বলেন।
হুসেন আলি বলেন, ‘অয়; পয়সাকড়িতো কম নিতা নায়, তেবো পরিচিত মানুষ অইলে ভরসা পাওয়া যায়।’
প্রয়োজনীয় পুটলাপুটলিসহ বৃহস্পতিবার বিকেলে হেভেন নার্সিং হোমে হাজির হন হায়দার আলি। সাথে এসেছেন স্ত্রী রহিমা খাতুন এবং সম্বন্ধী হুসেন আলি। ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। ইতিমধ্যে ডঃ তাবাসসুম এসে ব্লাড প্রেশার দেখেন, ব্লাড সুগার এবং অন্যান্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। পরদিনের জন্য কীভাবে প্রস্তুত হতে হবে এসব বুঝিয়ে যান। হাসপাতালের ক্যাফেটারিয়ায় রুগির পথ্য ছাড়াও অন্যান্য খাবার পাওয়া যায় সে কথাও তিনি তাদের জানিয়ে যান।
প্রফেসর শাকিল ঢাকা থেকে ঠিক সময়মত এসে পৌঁছেছেন এবং রুটিন মাফিক ভর্তি রুগিদের ভিজিট করে এসে চেম্বারে রুগি দেখেছেন। তিনি সাধারণত চেম্বার শেষ করে যাবার বেলায় শুক্রবারের রুগিদের সাথে কথা বলে যান। আজকের ওটির রুগি হায়দার আলিসহ তিনজন। ডঃ তাবাসসুমসহ আরোও দু’জন অ্যাসিস্টেন্ট নিয়ে প্রফেসর শাকিল হায়দার আলির কক্ষেও দু’মিনিটের জন্য আসেন। রুগিকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘কোনো চিন্তা নেই, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
হুসেন আলির মন প্রফেসর শাকিলকে দেখার জন্য আগে থেকেই উশখুশ করছিল। তাই ডাক্তার সাহেবের কথা শোনার চাইতে তার চেহারা নিরীক্ষণেই তিনি বেশি ব্যস্ত ছিলেন। কিছু একটা বলবেন বলে প্রস্তুত হওয়ার আগেই ডাক্তাররা সমভিব্যাহারে কক্ষ ত্যাগ করেন। রহিমা খাতুন তখন ঘোমটা আড়াল করে বসেছিলেন বলে ডাক্তার সাহেবের মুখ দেখতে পাননি।
প্রফেসর শাকিল চলে যাবার পর হুসেন আলি বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘আমার ভুল না অইলে এই মানুষটাই মাখন চাচার ভাগনা। বয়স অইছে, অইলেও নাক-মুখ আগর লাখান আছে।’
হুসেন আলির এই মন্তব্যে হায়দার আলির মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। শ্বশুরবাড়ির দূরাত্মীয় শাকিল সাহেবকে তিনি আগে কখনও দেখেননি; আর দেখলে কীইবা হত? তিনি তো ফ্রি চিকিৎসা করতেন না; হয়ত একটু আন্তরিকতা দেখাতেন। তবে বড়ভাইয়ের কথা শুনে কিছুটা চমকে গিয়ে রহিমা খাতুন ঘাড় ফিরিয়ে তাকান।
হুসেন আলি বোনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘রহিমা, তোর মনো আছেনি? আমরার বাড়িত আইত যাইত। মাখন চাচার ভাগনা শাকিল। আমিতো আর পড়তাম পারলাম না, তেবো কয় বছর তার লগে পড়ছি।’
রহিমা খাতুনের বুকটা ধক করে ওঠে। তবে এই ডাক্তার সাহেব কি সেই শাকিল ভাই? যাকে দেখার জন্য তিনি নানা অছিলায় মাখন চাচার বাড়িতে যেতেন, ওড়নার নিচে লুকিয়ে পেয়ারা, কামরাঙ্গা নিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিতেন; শাকিল ভাই তাদের বাড়িতে এলে লেবুর শরবত বানিয়ে খাওয়াতেন, বাড়িতে বেশিক্ষণ ধরে রাখার জন্য অ্যালজাবরা আর টেন্স বুঝানোর আবদার করতেন; তিনি কি এই বড় ডাক্তার শাকিল সাহেব? ভাইয়ের কথার জবাবে তিনি বললেন, ‘হউ শাকিল ভাই অত বড় ডাক্তর অই গেছইন নি?’
‘আমি শিওর, ডাক্তার সাব আমরার হউ শাকিল’, হুসেন আলি এখন দৃঢ়তার সাথে বলেন।
হায়দার আলিকে ওটিতে নেয়ার আগে রহিমা খাতুন অনুসন্ধিৎসু চোখে প্রফেসর শাকিলকে একবার দেখে নিয়েছেন; এই সাঁঝবেলায়ও শাকিল ভাই কেমন উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। প্রফেসর শাকিল তখন করিডোরে দাঁড়িয়ে ব্যস্ততার সাথে ডঃ তাবাসসুমের দেয়া কয়েকটি ফাইলে চোখ বুলাচ্ছিলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন। এই সুযোগে রহিমা খাতুন কোনো এক ছুতোয় ওই করিডোরে একটা চক্কর মেরে এসেছেন। তিনি ভাই হুসেন আলির মতো দ্বিধান্বিত নন; বরং একশত ভাগ নিশ্চিত, ইনিই সেই শাকিল ভাই।
ওটির প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কনসেন্ট ফরমে সই করার জন্য রহিমা খাতুনকে ডাকা হলে তিনি বিচলিত হয়ে ওঠেন। একে তো ছাইচাপা স্মৃতির উত্তাপ, অন্যদিকে গুরুতর রুগি স্বামীর কাটাছেঁড়া সংক্রান্ত উৎকণ্ঠা। নবম শ্রেণি অব্দি পড়াশোনা করা রহিমা খাতুন কলম চালনায় স্বচ্ছন্দ হলেও ফরমে স্বাক্ষর করতে গিয়ে তার হাত কেঁপে উঠছিল।
নবম শ্রেণির ছাত্রী থাকা অবস্থায় রহিমা খাতুনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হায়দার আলির সাথে। এমন সদ্বংশীয় যোগ্য পাত্র পেয়ে রহিমার বাবা-মা বেশ খুশিই হয়েছিলেন। তখন সদ্য এসএসসি-পাশ শাকিল মামার বাড়িতে থেকে জেলা শহরের ভাল কলেজে ভর্তির জন্য ছুটোছুটি করছিলেন।
যা ভাবা হয়েছিল তাই হল। হায়দার আলির আর্টারিতে তিনটি মেজর ব্লক ধরা পড়েছে। ডঃ তাবাসসুম রিংয়ের পক্ষে ওকালতি করে বললেন, ‘দেখুন, তিনটা ভাল রিং লাগাতে একটু বেশি খরচ পড়লেও কাটাছেঁড়া ছাড়া কাজটা সহজেই হয়ে যাবে। এখন তো সবাই তাই করে। তাছাড়া অপারেশন করলে কমপক্ষে এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হবে; পরেও আসতে হবে আবার।’
হায়দার আলি হিসেবনিকেশ করে আগেই মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, তাই আর কোনো ভাবাভাবি না করেই তিনি বলে দিলেন, ‘কপালে যা-ই থাক, বাইপাসেই যান।’
দেরি না করে সার্জারির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেল। রহিমা খাতুনের চোখ ভেজা; হুসেন আলির কপালেও চিন্তার ভাঁজ। তবে রুগিকে তত উদ্বিগ্ন দেখা গেল না। হায়দার আলি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চিন্তা করিয়া লাভ নাই; দোয়া করিও।’
হুসেন আলি আক্ষেপ করে বললেন, ‘ডাক্তর সাব’র লগে একটু মাতবার সুযোগ পাইলাম না।’
রহিমা খাতুন কোনো মন্তব্য না করলেও হায়দার আলি বললেন, ‘মাতিয়া আর কতখান আগুয়াইব, খালি দোয়া করলেউ অইব।‘ এরই মধ্যে হাসপাতালের লোকজন এসে সবাইকে তাড়া দিল, ‘আপনারা বাইরে যান, রুগির পাশে থাকা যাইব না; স্যার আসতেছেন।’
প্রায় দুই ঘণ্টা পর অপারেশন শেষ হলে প্রফেসর শাকিল ওটি থেকে বেরিয়ে হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে বললেন, ‘রুগির সাথে কে আছে?’ তার তাড়া আছে; এখনও স্টেন্টিং-এর একজন রুগি বাকি আছে। এরপর জুমা’র নামাজ পড়তে হবে। লাঞ্চের পরেও ভর্তি রুগিদের এক রাউণ্ড দেখে তারপর এয়ারপোর্টে ছুটতে হবে।
রুগির অ্যাটেনডেন্টরা বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন। হুসেন আলি উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলে প্রফেসর শাকিল বললেন, ‘অপারেশন সাকসেসফুল; আল্লাহ্র রহমতে সবকিছু ঠিক আছে।’ ডঃ তাবাসসুমকে দেখিয়ে বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই, এই ম্যাডাম রুগিকে দেখাশুনা করবেন। কিছুদিন থাকা লাগবে, এই আর কি।’
রহিমা খাতুন ভাইয়ের পেছনে পেছনে এগিয়ে এসেছিলেন। তার কিছু বলার বা করার ছিল না। তিনি শুধু স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে পাথুরে দুটি চোখ দিয়ে প্রফেসরের মধ্যে শাকিল ভাইকে চেনার চেষ্টা করছিলেন।
প্রফেসর শাকিল ছুটতে শুরু করলে হুসেন আলি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘ডাক্তার সাব, একটা কথা।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রফেসর সাহেবকে থামতে হল, ‘কী? তাড়াতাড়ি বলুন।’
হুসেন আলি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আফনে কিতা ছোটবেলা কোম্পানীগঞ্জ থাকিয়া পড়াশুনা করছইন নি?’
প্রফেসর শাকিল একটা হোঁচট খেলেন। তিনি চোখ থেকে গ্লাস খুলে বললেন, ‘অয় অয়, কোম্পানীগঞ্জ আমার নানাবাড়ি; আফনে কেমনে জানলা?’ বলে, আবার তিনি হাঁটতে আরম্ভ করলেন।
হুসেন আলি সোৎসাহে ডাক্তার সাহেবের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমি হুসেন আলি; মাখন চাচার পচ্চিমের বাড়ি।’
এবার রীতিমত ধাক্কা খেলেন প্রফেসর শাকিল। তিনি আচম্বিতে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং হুসেন আলির দুই কাঁধ চেপে ধরে বললেন, ‘হুসেন আলি! তুমি হুসেন আলি!’ অন্য কোথাও হলে হয়ত তিনি তাকে জড়িয়ে ধরতেন। কিন্তু এই কর্মস্থলে তা শোভন নয় বলে তিনি সংযত হলেন।
হুসেন আলি হারানো কোনো আপনজনকে ফিরে পাওয়ার মতো আনন্দে উদ্বেলিত হলেন এবং আপনাআপনি তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলেন না।
প্রফেসর শাকিলও কিছুটা স্মৃতিক্লিষ্ট হয়ে পড়েছেন মনে হল। ডঃ তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা জান? এই ভদ্রলোক আমার স্কুলের সহপাঠী! আহা, কত দিন!’ তারপর হুসেন আলিকে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! অত বছর পরে তোমার লগে দেখা। কিন্তু আইজ তোমার লগে গফ করতাম পারতাম নায়। যে কুনো বিরশইত বারে তুমি আইয়ো, আমার লগে থাকবায়, গফ করমু।’
হুসেন আলি আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, ‘ডাক্তর সাব, আপনার লগে দেখা অওয়ায় আমার যে কী খুশি লাগের!’
প্রফেসর শাকিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘হুসেন আলি, তুমি অবশ্যই আইবায়।’ আবার হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, রুগি তোমার কে অয়?’
‘আমার ছুটো বইন’র জামাই, ভগ্নিপতি’, হুসেন আলি বলেন।
প্রফেসর শাকিল বলেন, ‘আচ্ছা! অসুবিধা নাই। আমি তারারে বিশেষ খেয়াল রাখবার কথা কইয়া যাইমু। আগামিতে তুমার লগে ইনশাল্লাহ দেখা অইব।’ তিনি আর দেরি না করে দ্রুত তার চেম্বারে ঢুকে পড়েন।
স্যারের নির্দেশ মোতাবেক ডঃ তাবাসসুম হায়দার আলির বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। কেবিনে নিয়ে আসার পর রহিমা খাতুন এবং হুসেন আলিকে রুগির পরিচর্যার কায়দা-কানুন নিজেই দেখিয়ে দিয়েছেন। এতে রুগির শারীরিক উন্নতি খুব দ্রুতই হয়েছে। রুগি চতুর্থ দিনে হাঁটাহাঁটি করতে আরম্ভ করলে রহিমা খাতুন বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় ডঃ তাবাসসুম এই আপডেটও স্যারকে জানান। প্রফেসর শাকিল তখন হুসেন আলির সাথে কথা বলতে চান। ডঃ তাবাসসুম তাড়াতাড়ি হুসেন আলিকে ডেকে এনে ফোন লাগিয়ে দেন।
প্রফেসর শাকিল বলেন, ‘হুসেন আলি, অত তাড়াহুড়া কেনে, রুগিরে আরো দুই-চাইরদিন রাখ। আমিতো দুইদিন পরে আইমু। অবস্থা ফিট দেখলে ছাড়ি দিমু।’
হুসেন আলি আমতা আমতা করে বলেন, ‘আমার কুনো অসুবিধা নাই; রহিমার যাওয়াগি দরকার। বাড়িত মুরব্বি কেউ নাই।’
‘রহিমা?’ প্রফেসর শাকিল ধন্দে পড়েন, ‘রহিমা কে?’
হুসেন আলি বলেন, ‘ওহ, রহিমাউতো আমার বইন। রুগি তাইর জামাই।’
প্রফেসর শাকিলের ভেতরটা দুমড়াল না, তবে মুচড়ে উঠল। রহিমাকে তো তার চেনা উচিৎ ছিল। গত সপ্তায় বেশ ক’বার হায়দার আলির পাশে একজন মহিলাকে দেখেছেন তিনি। কিন্তু কীভাবে জানবেন সে-ই রহিমা। রহিমা কি তাকে চিনতে পেরেছিল? যদিও রহিমার সাথে শাকিলের গভীরতম কোনো সম্পর্ক ছিল না তবুও সেই চঞ্চল কৈশোরে তার হৃদয়ে কিছু রক্ত ঝরেছিল। মনে পড়ে বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে রহিমা একদিন সন্ধ্যার পর মামাদের পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড়ের নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে জেনেছিল, শাকিল ভাই সেদিন শহর থেকে মামার বাড়ি ফিরেছেন এবং নিশ্চিত ছিল এ পথ দিয়ে তিনি তাদের বাড়িতে ঘুরতে যাবেন।
সেদিন শাকিল কল্পনাও করতে পারেননি যে রহিমার ভেতর এমন বাঁধভাঙা ঢল ছিল। গাঁয়ের সেই সহজ-সরল মেয়েটি সেদিন তাকে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। বলেছিল, ‘শাকিল ভাই, আফনে আমার কেউ না, কিন্তু আফনারে আমি কেমনে ছাড়িয়া যাই?’ শাকিলও সেদিন ভয়ে, উত্তেজনায় এবং একধরনের অধীরতায় রহিমাকে বুকে চেপে ধরে কেঁদেছিলেন। পরদিনই তিনি মামার বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ছাতকে নিজের পিত্রালয়ে চলে যান। অবশ্য এর পরেও তিনি মামার বাড়ি গিয়েছেন, তবে তা রহিমার বিয়ের পর।
প্রফেসর শাকিল হুসেন আলির কথার উত্তরে বলেন, ‘ও আচ্ছা; তে রহিমায় আমার লগে মাতলো না কেনে?’
হুসেন আলি বলেন, ‘মনে কয় তাই শরমাইছে; আর আফনে তো ব্যস্ত মানুষ।’
প্রফেসর শাকিল বলেন, ‘হুসেন আলি, তুমি আমারে আফনে আফনে কইয়া শরম দিরায়। আচ্ছা তুমিতো রুগির লগে আছ? রহিমার লগে দেখা অইল না। আমি বিরশইতবারে আইমু। থাকিও।’
ফোনে কথা শেষ করে প্রফেসর শাকিল কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকেন। ঢাকায় যে ক্লিনিকে তিনি বসেন সেখানে বেশ কয়েকজন রুগি এখনও অপেক্ষমাণ। দরজার খুলে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার, পাঠাব নাকি?’
প্রফেসর শাকিল চমকে উঠে স্থিত হয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঠাও । আর ক’জন?’
বাসায় ফেরার পথে প্রফেসর শাকিল মাথাটা ভারী বোধ করেন। রহিমার বিয়ের কথা চলার সময় একবার তিনি রহিমাদের বাড়িতে গেলে রহিমা তার সামনে আসেনি; দরজার আড়াল থেকে কাতর মুখে শাকিল ভাইয়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। রহিমার মা-ই শাকিলকে বিয়ের খবর দিচ্ছিলেন। শাকিল তখন হৈ হৈ করে বলে উঠেছিলেন, ‘তাইলেতো আমি রহিমারে একখান মনিপুরী শাড়ি উপহার দিমু।’ কিন্তু পরবর্তীতে রহিমার পাগলামির জন্য তিনি নিজেই একটু ভেঙ্গে পড়লে বিয়েতেই তার থাকা হয়নি।
বাসায় ফেরার পর বুকে এক অনির্বচনীয় কষ্ট চেপে ধরলে প্রফেসর শাকিল ডঃ তাবাসসুমকে ফোন করেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘হায়দর আলির অবস্থা কেমন?’
ডঃ তাবাসসুম একটু আশ্চর্য হন। কারণ ঘণ্টাখানেক আগেই এ রুগির ব্যাপারে স্যারের সাথে কথা হয়েছে। তিনি বললেন, ‘ভালই তো, স্যার।’
‘আচ্ছা, তুমি কি বলতে পার তার বিল কত হয়েছে?’
ডঃ তাবাসসুম বললেন, ‘আমি একাউন্টসে কথা বলে আপনাকে জানাব, স্যার।’
প্রফেসর শাকিল তাকে থামিয়ে বললেন, ‘না থাক, ওটার দরকার নাই। তুমি একটা কাজ করো; বিল থেকে আমার চার্জটা ড্রপ করে দাও। ওরা আমার ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ মানুষ; আমার একটা অবলিগেশন আছে।’
‘ওকে স্যার’, ডঃ তাবাসসুম বলেন।
‘আরেকটা কথা।’ প্রফেসর শাকিল বলেন, ‘তুমি একটা ফেবার করো; তুমি মার্কেট থেকে একটি ভাল মনিপুরী শাড়ি আনিয়ে মিসেস হায়দার আলিকে দিয়ে বলো, এটা ডাক্তার সাহেব দিয়েছেন।’
ডঃ তাবাসসুম একটু শিহরিত হয়ে বলেন, ‘স্যার এটা তো খুব ভাল হত, কিন্তু ভদ্রমহিলা শুনেছি কাল ভোরেই রওয়ানা করবেন, কে জানি তাকে নিতে এসেছে।’
প্রফেসর শাকিল একটু মনমরা হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, পারলে তুমি একটা শাড়ি কিনে রেখো, ওদের সাথে নাহয় দিয়ে দেব।