চার দিন ছুটির পর আজ অফিসে আসতেই প্রায় সব সহকর্মিই সুহানার কাছে ছুটে এসে দু’চারটা সান্ত্বনার কথা বলে গেছে; সহমর্মিতা দেখিয়েছে। সুহানার তেমন কিছু বলার নেই; শুধু বারবার টিস্যু দিয়ে চোখ মুছেছে। প্রজেক্ট ম্যানেজার শাহান চৌধুরিও দ্বিধার আগল ভেঙ্গে সুহানাকে প্রবোধ দিয়ে দুয়েকটি কথা বলেছে। শাহান চৌধুরির নতুন প্রজেক্ট রায়ের বাজারে; জরুরি প্রয়োজনেই শুধু তাকে পান্থপথের হেড অফিসে আসতে হয়। আজও হয়ত তেমন কোনো কাজ ছিল।
সকাল দশটার দিকে চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম সাহেব সুহানাকে ডেকে পাঠান। চেয়ারম্যানের কাছে সুহানার সরাসরি কোনো জবাবদিহিতা নেই। হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে সালামের বিনিময়ে কখনও জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছ? আতিক সাহেব কেমন আছেন?’ এ পর্যন্তই।
আজকের ব্যাপারটা আলাদা। সুহানা সালাম দিয়ে চেয়ারম্যানের কক্ষে ঢুকতেই তিনি বললেন, ‘বস।’
সুহানা চাকরির তিন বছরে কখনই চেয়ারম্যানের কক্ষে ঢুকে চেয়ারে বসেনি। চেয়ারম্যান প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড়কর্তা; তার সামনে চেয়ারে বসতে সুহানার সাহস হয় না। তাই সে দাঁড়িয়ে রইল।
‘আরে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, ‘তোমাকে বসতে বললাম না?’
সুহানা বিমর্ষ হয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়ে আরেকবার চোখ মুছল।
হাকিম সাহেবের সামনে হয়ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল। তিনি দ্রুত সেটি দেখে নিয়ে একটা সই করে অদূরে দাঁড়ানো স্টাফের হাতে তা তুলে দেন। তারপর সুহানার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আই অ্যাম ভেরি স্যাড। হঠাৎ করে আতিক সাহেব এভাবে চলে গেলেন। ভাবতে কষ্ট হয়।’
সুহানার দুচোখ আবার ভিজে গেলে সে টিস্যু বের করে চোখ মোছে।
‘আমার জানামতে তিনি তো খুব স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন’, হাকিম সাহেব বলেন।
সুহানা অনুচ্চস্বরে বলে, ‘আগে আরোও দুবার মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছিল, স্যার।’
‘তাই নাকি? আমি শুনিনি।’
‘মা মারা যাবার পর থেকে বাবা কেমন এলোমেলো হয়ে যান’ বলে, সুহানা চোখ মোছে।
চেয়ারম্যান হাকিম সাহেব সুহানাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘শোন, তোমাকে শক্ত হতে হবে। মৃত্যু অবধারিত। একদিন সবাইকে এভাবে চলে যেতে হবে। তুমি চাইলে আরোও দু’চারদিন ছুটি নিতে পার।’
সুহানা বলল, ‘থ্যাংক্যু স্যার, বাসায় থাকলে আমার আরোও বেশি খারাপ লাগবে।’
‘ঠিক আছে, তোমার যেমন সুবিধা হয়; তবে ছুটি লাগলে আমাকে বলো।’
মেরুন বেওয়া চা রেখে গেছে সাইড টেবিলের ওপর। সে-ই সুহানার একমাত্র সঙ্গী এখন। মা দুবছর আগে মারা যাওয়ার আগেই তাঁর বাপের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন মেরুন বেওয়া তথা মেহেরুন্নেসাকে। জানামতে মেরুন বেওয়ার তিনকুলে কেউ নেই। সে ঢাকায় আসার পর কেউ তার খোঁজ নিতে আসেনি। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। নির্ভরযোগ্য মেয়ে বলে পুরো সংসার সে-ই সামাল দিয়ে এসেছে এতদিন। মা তাকে খুবই স্নেহ করতেন। মা মরার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে সে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে থাকতে বাধ্য করেছেন।
সুহানা চায়ে চুমুক দিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে। সেন্ট্রাল রোডের দোতলা বাসার নিচতলায় এক ভাড়াটে ফ্যামিলি থাকে। ওপর তলায় থাকে সুহানারা । আশেপাশের বাড়িগুলো অনেক আগেই বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং হয়ে গেছে। প্রপার্টি ডেভেলপার বন্ধুরা আতিক সাহেবকেও সে পথে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেছিল। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তাঁর কথা, ‘আমার এত খাই নাই ভাই। আমি মাটির কাছাকাছি থাকতে চাই। এই যে লিচু গাছটা, তারপর আম, নারকেল গাছ, এই যে নিজের হাতে লাগানো লাউ গাছ, উচ্ছে…।’ এমন কি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুল হাকিমের প্রস্তাবও তিনি একই ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ডায়াবেটিসের রুগি তাঁর স্ত্রী হঠাৎ একদিন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে পড়ে তিন দিনের মধ্যেই পরপারে চলে গেলে আতিক সাহেবের গাছ-গাছালি, শাক-সবজির নেশা পুরোপুরি উবে যায়। সুহানা অফিস থেকে ফিরে এলে তাকে নিয়ে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে তিনি শুধু স্ত্রীর স্মৃতি রোমন্থন করতেন। সুহানা প্রথম দিকে বাবার কথা শুনত আর কাঁদত। পরে বাবাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সে নিজে শক্ত হয়ে তাঁকে বিভিন্নভাবে প্রবোধ দিত। বলত, ‘বাবা, আমি আছি না? তুমি মা’র কথা বলে বলে আমাকে কাঁদালে আমিও কিন্তু চলে যাব। আর আমি চলে গেলে মেরুন’বুও থাকবে না।’
সুহানার কেবলই মনে হয়, তার জন্যই মা এত তাড়াতাড়ি মরে গেলেন। তাকে সমাজের চোখে ছোট না করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আপন ভাতিজা রুবেলের কাছে বিয়ে না দিয়ে আতিক সাহেব অনাত্মীয় এক পরিবারের ছেলের হাতে সুহানাকে তুলে দিয়ে বেশ স্বস্তি পেয়েছিলেন। কারণ পরিবারটি সম্ভ্রান্ত ছিল এবং ছেলেটিও নিউ ইয়র্কে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায় বেশ পসার জমিয়েছিল। রুবেলের জন্য কিছু কষ্ট পেলেও মা-বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সুহানাও শ্বশুরবাড়িতে বেশ ভালভাবে মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু যেদিন সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে এসে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল তখনই তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সেদিনই সুহানা তার বাবা-মাকে মুখ খুলতে বাধ্য করেছিল।
মা কাঁদতে কাঁদতে সুহানাকে বলেছিলেন, ‘তোর জন্ম যেখানেই হোক, তুই আমার মেয়ে। তোর জন্মদাতা মা-বাবা যে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল একথা কেন আমরা তোকে সেধে বলতে যাব? আমরা কি তোর মা-বাবা হিসেবে সার্থক নই? তুই ছাড়া তো আমার কোনো সন্তান নেই। কেউ কি তোকে কোনোদিন বলেছে যে আমি তোকে পেটে ধরি নাই?’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মা অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। আতিক সাহেবও সুহানাকে জড়িয়ে ধরে ফুফাতে থাকেন।
সুহানা একটু স্থির হয়ে বলেছিল, ‘কেউ বললেও বিশ্বাস করব না যে তোমরা আমার মা-বাবা না। কিন্তু আমি আর ওদের কাছে ফিরে যাব না। ওরা তোমাদের অনেক খারাপ কথা বলেছে’, বলে আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে সে।
‘যাসনে মা’, আতিক সাহেব বলেন, ‘যার সাথে তুই সংসার করবি সে-ই যখন আজেবাজে কথা বলে তার বাপ-মাকে খেপিয়ে তুলেছে, তখন কার কাছে যাবি?’
এ ঘটনার পর পৌনঃপুনিক বাদানুবাদ শেষে কিছুদিনের মধ্যেই সুহানার ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর অনেক বুঝিয়েও সুহানাকে বিয়েতে রাজি করানো যায়নি। রুবেল যদিও তখন পর্যন্ত সুহানার প্রতি দুর্বল ছিল, কিন্তু এতসব ঘটনা-রটনা কবুল করে রুবেলের বাবা-মা অর্থাৎ আতিক চৌধুরির ছোটভাই অ্যাডভোকেট সাদিক চৌধুরি ও তার স্ত্রী ছেলের ইচ্ছাকে মেনে নিতে পারেননি। এবং কিছুদিনের মধ্যে অন্যত্র রুবেলের বিয়ে হয়ে গেলে এ প্রসঙ্গেরও সমাপ্তি ঘটে।
ঘরে বসে থাকলে ক্রমশ মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকবে এই আশংকায় মা সুহানাকে বলেছিলেন, ‘যা না, এমবিএটা কমপ্লিট করে ফেল। ব্যস্ত থাকলে মনটাও ভাল থাকবে।’ কিন্তু কোনোভাবেই আর তাকে পড়ার টেবিলে ফেরানো গেল না। অগত্যা আতিক সাহেব একদিন সিটি বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিমের সাহায্য চান। হাকিম সাহেব আগুপিছু কিছু না ভেবেই তৎক্ষণাৎ আশ্বস্ত করেন, ‘পাঠিয়ে দেন, মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। একটা কিছু করা যাবে।’
সুহানা সৌভাগ্যবান এজন্য যে বাবা রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থাকাকালীন সময়ে আরোও অনেক রিয়েল এস্টেট কর্ণধারের মতো সিটি বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম সাহেবের সাথেও তাঁর খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। অবসরে আসার পরও বাবা পরিচিতজনের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। সেই সুবাদেই সুহানা হিসাব রক্ষকের চাকরিটি পেয়ে যায়।
ছুটি না নিয়েই অফিসে যাওয়াকেই প্রাধান্য দেয় সুহানা। কাজে ডুবে থাকলে কিছুক্ষণ দুঃখ-বেদনা দূরে সরিয়ে রাখা যায়। দুদিন পর মোবাইল ফোনে একটি এসএমএস দেখতে পায় সে, ‘আপনি অনুমতি দিলে একটু কথা বলতে চাই।’ মেসেজটি এসেছে শাহান চৌধুরির কাছ থেকে।
মেসেজটি দেখে সুহানার কপালটা কুচকে যায়। তার সাথে অনেক কথাই তো হয়েছে আগে। বলতে গেলে সব কথা শেষ হয়ে গেছে। বয়স একটু গড়িয়ে গেলেও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুদর্শন ছেলে শাহান। সময়মত বিয়ে কেন করেনি সেকথা সুহানা কখনও জিজ্ঞেস করেনি তাকে; জানার আগ্রহও ছিল না তার। তার জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে জেনেও শাহান চৌধুরি তার পেছনে ফেউয়ের মতো লেগেই ছিল। বাধ্য হয়েই একবার সুহানা খুবই সিরিয়াসভাবে শাহান চৌধুরিকে জানিয়ে দিয়েছিল বিয়ে-টিয়ের ব্যাপারে তার মোটেই আগ্রহ নেই, অতএব এ ব্যাপারে তাকে যেন আর বিরক্ত করা না হয়। এরপর বেশ কিছুদিন তাদের মধ্যে তেমন কোনো কথাই হয়নি।
এই দুঃসময়ে রুটিনমাফিক সুহানা অফিস থেকে ফিরলে মেরুন’বু এক কাপ চা এবং সাথে কিছু কুকিজ বা অন্য কিছু নিয়ে আসে। তারপর এক হাতে নিজের জন্য এক কাপ চা এবং অন্য হাতে প্লাস্টিকের একটি টুল নিয়ে এসে সুহানার কাছে বসে। সুহানার চেয়ে মেরুন বেওয়াই কথা একটু বেশি বলে। অধিকাংশ কথার কেন্দ্রবিন্দু আম্মা আর আব্বার স্মৃতি। অবশ্য এর বাইরেও কিছু সাংসারিক কথা থাকে। ঘরে পুরুষলোকের অবর্তমানে তেমন কোনো অসুবিধা এখনও হয়নি, তবে সারাদিন ঘরে একা থাকলে কেমন ভয় ভয় করে – একথাও সে সুহানাকে বলে মাঝেমাঝে। আজ আবার নতুন দুর্ভাবনার আমদানি করেছে সে। বলে, ‘এইডা কি একটা জীবন অইল আপা, এই ভাবে কি বাচন যায়?’
সুহানা খানিক ভেবে কথাটার শানে নুযূল বুঝতে না পেরে মেরুনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বুঝলাম না।’
‘এই যে আমরা দুইটা মেয়েমানুষ - এই বিশাল ঘরে ঘড়ির কাটার লাহান কি সময় কাটাইতে থাকুম?’ মেরুন নতুন প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তর দেয়।
‘আমাদের পোড়া কপাল, অসময়ে বাবা-মা চলে গেলেন’, সুহানা বলে, ‘এভাবেই থাকতে হবে।’
মেরুন তার কথার মাধ্যমে কী বুঝাতে চেয়েছিল তার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে চায়ের খালি কাপগুলো নিয়ে পাকঘরের দিকে চলে যায়।
মেরুন চলে গেলে মোবাইল ফোনের মেসেজ বাটনে চাপ দিয়ে শাহান চৌধুরির বার্তাটি আবার পড়ে সুহানা। তারপর চোখ বন্ধ করে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে থাকে কিছুক্ষণ।
বাবা মারা যাওয়ার পনর-বিশদিনের মধ্যে অফিসে অনেকটা ধাতস্থ হতে পেরেছে সুহানা। সহকর্মিরাও তার পিতৃবিয়োগ নিয়ে আর কোনো কথা বলে না। এ ক’দিনে আড়চোখে শাহানকেও দু’বার অফিসে আসতে দেখেছে সুহানা। এতে তার একটু ভয় ছিল যদি শাহান চৌধুরি সামনে এসে জিজ্ঞেস করে বসে, ‘কিছু বললেন না যে।’ তবে না, শাহান চৌধুরি তার ওয়ার্কস্টেশনে আসেনি।
একদিন দুপুরের দিকে সুহানার কাছে ফোন আসে সাদিক চাচার কাছ থেকে, ‘কিরে মা, কেমন আছিস?’
‘ভাল, চাচা।’
‘বাসায় ফিরবি কখন?’ চাচা জিজ্ঞেস করেন।
‘এই তো সন্ধ্যায়।’ সুহানা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন চাচা, আসবেন নাকি?’
চাচা বলেন, ‘হ্যাঁ, তোর চাচিকে নিয়ে এসে তোদের একটু দেখে যাব ভাবছিলাম।’
‘তাহলে তো খুব ভাল হয়; আমি সময়মতো চলে আসব।’
প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ি র লোকজন গোত্র পরিচয়হীন বলে তাকে অবজ্ঞা-অপমান করেছিল যখন সুহানা তখন নিজেকে অসহায় বা ছোট মনে করেনি। কারণ তখন তার ভাবনা ও ভালবাসার কেন্দ্রস্থল ছিল যারা তাকে আপন সন্তান হিসেবে নিজেদের সাথে জড়িয়ে রেখেছিল তারা। বাবা-মা’রাই তাকে সব সময় আগলে রেখেছে, বিপদে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু সকল নির্ভাবনার উৎসমূল বাবাকে হারানোর পর মাঝেমাঝে কিছু অসংলগ্ন চিন্তা সুহানার মাথায় উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে ইদানীং। কখনও তার মনে হয় কেন সে তার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করেনি ওই দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া তার জন্মদাতারা কোথাকার লোক ছিল, ওদের পরিবারে কেউ কি ছিল না যারা তার দায়িত্ব নিতে পারত, ইত্যাদি। কিন্তু তখন সে এই পরিবারের সাথে এতই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিল যে তার মাথায় এ প্রশ্ন আসার কোনো সুযোগই ছিল না। মেরুন’বু যখন সুখদুঃখের গল্প বলতে গিয়ে বলে, ‘তিনকুলে আমার কেউ নাইগো বইন, আব্বা-আম্মারাই আমারে আশ্রয় দিছিলো, এহনতো হেরাই নাই’, তখন সুহানার মাথায় ওই প্রশ্নটাই ফিরে আসে।
নিচে গাড়ির শব্দ শুনে সুহানা বারান্দায় গিয়ে দেখে চাচা-চাচীরা এসে গেছেন। মেরুন হন্তদন্ত করে নিচে ছুটে যায়।
চা-নাশতা খেতে খেতে সুহানার কাছে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন চাচা। দুটো মেয়ে মানুষ কেমন করে একটি খালি বাসায় থাকছে সে ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি । চাচীও মাঝেমাঝে দুয়েকটা মন্তব্য যোগ করেন কথার ফাঁকে ফাঁকে। সুহানাকে উদ্দেশ করে চাচী বলেন, ‘তোর একটা সুখী সংসার থাকার কথা, নাতি-পুতি থাকার কথা, কিন্তু কপালের কী ফের!’
যাবার বেলা বসা থেকে উঠতে উঠতে চাচা বলেন, ‘একটা জরুরি কথা বলা হয়নিরে মা।’
‘কী কথা চাচা?’ সুহানা উৎসুক হয়।
‘আচ্ছা বুঝিয়ে বলি’ বলে অ্যাডভোকেট সাদিক আবার সোফায় বসে পড়েন। ‘তুই তো নিশ্চয়ই জানিস, ভাইজান তার বাড়ির কাগজপত্র সবকিছু আমার কাছে জমা রেখেছেন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবা আমাকে বলেছেন তাদের অবর্তমানে যাতে কোনো ঝামেলা না হয় সেজন্য আমার নামে উইল-টুইল করে এবং আর যা কিছু প্রয়োজন সব করার জন্য আপনার কাছে বাড়ির কাগজপত্র দিয়ে গেছেন।’
সাদিক সাহেব এক মূহুর্ত তাঁর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে পর মূহুর্তে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ দলিল-দস্তাবেজ সবই আমার কাছে আছে। তবে তোকে হয়ত ভাইজান বিস্তারিত বলে যেতে পারেননি। বিষয়টা হল এরকম: তুই ভাই-ভাবীর খুব আদরের মেয়ে, তোর ভাল’র জন্য তাদের দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না…’
চাচা এতটুকু বলার পর সুহানার চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে।
চাচা আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘কাঁদিস না, কাঁদিস না; পুরো কথা শোন।’ তারপর মাথা ঘুরিয়ে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে মেরুনকে বলেন, ‘আরেক কাপ চা খাওয়াতে পারবি? মনে রাখিস, চিনি ছাড়া।’
চাচী তখন বলেন, ‘এভাবে বেঁচে থাকা কঠিন রে মা; জীবনটা নিয়ে আবার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর।’
চাচা চাচীকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘সে কথাই বলতে যাচ্ছিলাম আমি। আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। আমরা তোকে সুখী দেখতে চাই। তোকে একটা ভাল ছেলের হাতে তুলে দেয়ার পরই আমরা এখানে অ্যাপার্টমেন্টের কাজে হাত দেব। ভাইজানের কথামতো একটা ফ্ল্যাট তোর নামেই লিখে দেব।’
চাচার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পারায় সুহানার মুখ আপনা-আপনি হা হয়ে যায়। সে বলে, ‘এসব কী বলছেন, চাচা?’
‘বলেছি না, ভাইজান তোকে বিস্তারিত কিছু বলে যাননি’, বলে সাদিক সাহেব উঠে এসে সুহানার কাছাকাছি বসেন। ‘আইনত নিঃসন্তান ভাইয়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে আমিই তার সম্পত্তি পাব এটা ভাইজান জানতেন। তবে একথা তিনি জোর দিয়ে বলে গেছেন, যে করেই হোক তোর বিয়েটা যেন আগে দিই, তারপর অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে গেলে তোকে যেন অবশ্যই একটা ফ্ল্যাট লিখে দিই।’
সুহানার মাথা ইতিমধ্যে চক্কর দিতে শুরু করেছে। তার মুখ দিয়ে কথা বেরোবার আগে চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করে। তারপরও সে বলে, ‘বাবা আর কী কী সম্পত্তি রেখে গেছেন জানি না, তবে তাঁর মেয়ে হিসেবে তিনি এই বাড়িটা আমার নামে উইল করে দিয়ে গেছেন এ কথা তিনি আমাকে অনেকবার বলেছেন। তিনি বলেছেন, আপনি এক সময় আমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। আর এখন এসব কী শুনছি, চাচা?’
চাচা বলেন, ‘দেখ মা, আমি যা সত্য তাই বলছি। তুই ভাইজানের ঔরসজাত সন্তান না হলেও আমাদের আপন। তোর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের। শাহানের পরিবারের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওরা আমার কাছে এসেছিল। আমার খুবই পছন্দ হয়েছে ছেলেটাকে; সে তোর সবকিছু জেনেও একপায়ে খাড়া।’
‘চাচা, আমি বিয়ে নিয়ে ভাবছি না; আপনি বাড়ি নিয়ে যা বললেন বাবা তো ঘুণাক্ষরে এসব কথা বলে যাননি।’
এবার সাদিক সাহেব গলার স্বর পরিবর্তন করে বললেন, ‘দেখ মা, ভাইজান তোকে এসব কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। আমি উকিল মানুষ, আমার সাথেই তিনি বোঝাপড়া করেছেন। চিন্তা করে দেখ, তুই কত ভাগ্যবান। …মনে কষ্ট নিস না, তোর বাবা-মা তোকে এত ভালবাসতেন যে তোকে জানতেই দেননি তুই কীভাবে এ বাড়িতে এসেছিস। …সত্যি কথাটা জানলে তোর খারাপ লাগবে, তবুও তুই আমাদের আপন বলে আসল সত্যটা জানিয়ে দেয়াই ভাল – তোর জন্মদাতা পিতা-মাতা দুর্ঘটনায় মারা গেছে কথাটা সত্য না।’
সুহানা তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ‘আপনি কীসব নতুন নতুন কথা নিয়ে এসেছেন, চাচা; আমি আর হজম করতে পারছি না।’
‘ভাবী তোকে ধানমণ্ডি সাতাশ নম্বরে ডাস্টবিনের কাছে পলিথিনে পেঁচানো অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তারপর ডাক্তার-হাসপাতাল-থানায় কত দৌড়াদৌড়ি। আইনগত ব্যাপার-স্যাপার আমিই সেরেছি; আমার কাছে সেসব কাগজপত্র এখনও আছে…।’
চাচার কথা শেষ হবার আগেই সুহানা যখন মাথা ঘুরে নিচে পড়তে যাচ্ছিল তখন পাশে বসা চাচী তাকে ঝাপটে ধরে ফেলেন। তারপর ধরাধরি করে নিয়ে তার বিছানায় শুইয়ে দেন।
সকালে নাশতা রেডি করে মেরুন ডাকতে আসে সুহানাকে। সুহানা ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে দুটি স্যুটকেসে তার কাপড়চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঢুকাচ্ছিল। মেরুন চমকে ওঠে। জিজ্ঞেস করে, ‘আপা কী করেন?’
সুহানা কোনো উত্তর দেয় না। তার জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে মেরুনকে বলে, ‘তুমি খেয়ে নাও মেরুন’বু। আমি খাব না।’
মেরুন ব্যাপারস্যাপার আঁচ করার চেষ্টা করে। সে বলে, ‘বিষয়টা কী, একটু খুইলা কন, আপা।’
সুহানা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বলে, ‘তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি মেরুন’বু, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমি এখান থেকে চলে যাব।’
‘কই যাইবেন?’, ভ্যাবাচ্যাকার মত বলে মেরুন।
‘তা জানি না।’
মেরুন বলে, ‘তাইলে আমার কী অইব?’
সুহানা চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘ওরা যখন আছে, তোমার একটা গতি হবে। আমি পথে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে, আবার পথেই ফিরে গেলাম।’