আপনজন

মা আমার মা (মে ২০২১)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ৬২
একটি অ্যালুমিনিয়ামের ডিব্বার ঢাকনা খুলে থেঁতো করা সুপোরির এক চিমটি হাতে নিয়ে রহমত শেখ বললেন, ‘হা কর।’

উবার ট্যাক্সিতে পাশে বসা নবতিপর মা হা করে মুখ বাড়ালেন। রহমত শেখ তিন আঙুলের চিমটায় তোলা সুপোরিচূর্ণ মায়ের দন্তহীন মুখে পুরে দিয়ে বললেন, ‘গাড়িতে আর পান চাইবা না।’

মা ফিক করে হেসে বলেন, ‘তুই কইলেই অইল? আমার মন চাইলেই খামু।’

রহমত শেখের বাবা দীর্ঘায়ু না হলেও মা মাশাল্লাহ নব্বই পেরিয়েছেন। এজন্যই হয়ত বৌমা বিভিন্ন খোশগল্পে মৃদুস্বরে শাশুড়ির বেলায় কাক ভূষণ্ডি বাগধারাটি ব্যবহার করেছেন এক আধবার। মা যদিও লাটিতে ভর করে বাথরুম, রান্নাঘর, খাবার ঘরে লঘুপদে যাওয়া আসা করতে পারেন, তিনি বয়সের ভারে কুঁকড়ো হয়ে অনেকটা ১-এর মতো হয়ে গেছেন। খাবার খুব অল্পই খান, তবে তাতে উনিশ-বিশ হলে প্রায়ই পেট বিগড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কাপড় নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ফিফটি-ফিফটি থকে। এ ছাড়াও অনেক সময় প্রস্রাব আটকানোও সম্ভব হয় না। এসব ঝক্কি কবুল করেই অবসরে যাবার সাথে সাথেই রহমত শেখ মাকে ঢাকায় নিজের ছোট ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছেন। দীর্ঘ চাকরি জীবন এমনকি তার আগে ছাত্রাবস্থায়ও মায়ের একান্ত সান্নিধ্য থেকে তিনি বঞ্চিত। তাই মনে মনে ওয়াদা করেছিলেন যে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত মা বেঁচে থাকলে তাঁকে অবশ্যই তিনি নিজের সাথে রাখবেন। সেই সিদ্ধান্তানুযায়ী প্রায় এক বছর ধরে মা রহমত শেখের একান্ত তত্ত্বাবধানেই আছেন।

মা জাবর কাটার মতো মুখ নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করেন, ‘জামা-কাপড় কিনছস কিছু?’

‘কার জামা?’ রহমত শেখ জানতে চান।

‘ক্যান, নিয়ামত, বরকত – তাগো বউ-বাচ্চা…’

রহমত শেখ হো হো করে মাকে আশ্বস্ত করেন, ‘হ কিনছি, কিনছি, তুমি চিন্তা কইরো না।’

মায়ের স্মৃতিশক্তি যে এখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি একথা ভেবে রহমত শেখের খুবই ভাল লাগে। যখন মন ভাল থাকে তখন মা পুরনো দিনের অনেক গল্প করেন। তিন ভাই – রহমত, নিয়ামত, বরকত; দুই বোন – হালিমা, রহিমারা ছোটবেলা কে কেমন ছিল, কীভাবে দুষ্টামি করত, মামার বাড়ির আমতলা জামতলা দাপিয়ে বেড়াত এসব কথা খুব আবেগ নিয়ে বলেন। রহমত শেখ তখন মায়ের পাশে বসে হামানদিস্তায় সুপোরির সাথে পান, চুন, হাকিমপুরি জর্দা মিশিয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দে ছেঁচতে থাকেন এবং হো হো, হা হা শব্দে হাসতে থাকেন। কখনও এই অতৃপ্তিও তার মনে জেগে ওঠে যে মা-হীন প্রায় চল্লিশটা বছরে কত আকরই না জীবন থেকে তিনি হারিয়েছেন। কিন্তু আজকে তিনি মাকে মিথ্যা কথা বললেন। কারুর জন্যই তিনি কাপড়-চোপড় কিনেননি। যদিও মা জানেন তারা বাড়িতে যাচ্ছেন, আসলে সে কথা সত্য নয়।

অভিজাত এলাকায় সম্ভব না হলেও দারুস সালাম এলাকার তেরশ’ বর্গফুটের যে ফ্ল্যাটটি বছর দশেক আগে রহমত শেখ কিনেছেন তা তাদের পরিবারের জন্য মোটামুটি চলনসই। সরকারি ব্যাংকের এজিএম পর্যন্ত হয়েছিলেন শেষপর্যন্ত, তবে বিষয়সম্পত্তি তেমন কিছু করতে পারেননি। এতে অবশ্য তার কোনো আক্ষেপ নেই। কৃচ্ছ্রতা এবং সাদামাটা জীবনযাপনের পুরস্কার হিসেবে সন্তানের সফলতাকেই তিনি বড় করে দেখেন এবং সেজন্য গর্ববোধও করেন। বড় ছেলে মেজর রকিব সস্ত্রীক যশোর ক্যান্টনমেন্টে আছে। মেঝো আকীব টেক্সাসে অ্যাগ্রো ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্রাজুয়েশন করে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছে; কিছুদিনের মধ্যে দেশে এলেই পাকা করে রাখা বিয়েটা পড়িয়ে দেয়া হবে। ছোট রুবি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বর্তমানে রুবিটাই শুধু বাবা-মায়ের সাথে থাকছে। তাই প্রায় ফাঁকা ঘরের তৃতীয় বেডরুমটায় একটি সিঙ্গেল বেড বাড়িয়ে নিয়ে রহমত শেখ মায়ের সাথেই থাকেন। অবশ্য না থেকে উপায়ও নেই। বিশেষ করে রাতের বেলা মা উঠে বাথরুমে যান, কখনও পানি খেতে চান, কখনও ঠাণ্ডা লাগলে ফ্যান বন্ধ করতে বলেন। রহমত শেখ সানন্দেই মাকে এসব সেবা দেন। তবে কখনও মায়ের কাপড় নষ্ট হয়ে গেলে গৃহকর্মি খোদেজার সাহায্য নিতেই হয়। খোদেজা দাদিকে কুসুম গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে কাপড় পাল্টে দেয়। কিন্তু মায়ের এসব ময়লা কাপড় ধোয়ার দায়িত্ব রহমত শেখ অন্য কাউকে দেন না; নিজ হাতে তা পরিষ্কার করেন।

আকীব প্রায় প্রতি সপ্তাহে মায়ের সাথে কথা বলে; কখনও দাদিকে দেখতে চায়। দাদিকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী আনমু দাদি তোমার লাইগা?’ এই বয়সেও দাদির রস ফুরিয়ে যায়নি। বলেন, ‘আমেরিকাত্তন একটা মেমসাব লইয়া আবি।’ আকীব হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ে। সে বলে, ‘ঠিক আছে, সুটকেসে ভইরা তোমার লাইগা একটা মেমসাব নিয়া আমু।’

রকিবের ব্যস্ততা অনেক বেশি। তার কোনো রুটিন নেই। সুযোগ পেলে মোবাইল ফোনে হঠাৎ কখনও বাবার সাথে কখনও মায়ের সাথে দুয়েক মিনিট কথা বলে কুশলাদি জানতে চায়। দাদির কথাও জিজ্ঞেস করে। বাবার কাছে ফোন করলে বাবাই অতি উৎসাহী হয়ে বলেন, ‘নে, দাদির সাথে একটু কথা বল।’ ব্যস্ততা থাকলেও তখন দাদিকে মিষ্টি করে রকিব জিজ্ঞেস করে, ‘দাদি, আমার কাছে আসবা? আমার বউ তোমার পান ছেঁইচ্চা দিব।’ দাদি বলেন, ‘তোর বউ পান ছেঁচব না আমারে ছেঁচব?’ রকিব হাসতে হাসতে বলে, ‘ভয় নাই, আমি আছি না?’

রুবির ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। ডাক্তারি পড়ার ঠেলায় তার দম ফেলার সময় নেই। তবুও মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ফেরার পথে দাদির জন্য কিছু আঙুর, নয়তো আপেল কিংবা কলা নিয়ে আসে। আবার কখনও মোড়ের দোকান থেকে একটা আইসক্রিম বার নিয়ে আসে। সে জানে ঠাণ্ডা খেতে বারণ থাকলেও দাদি আইসক্রিম পছন্দ করেন। আইসক্রিম খেতে গিয়ে সারা মুখ মাখামাখি করে কিম্ভূত আকার ধারণ করেন। মা বকাবকি করলেও রুবি বলে, ‘তোমরা যাই বল, দাদির আইসক্রিম খাওয়ার দৃশ্য সুপার; আমার খুব মজা লাগে।’ দাদি রুবির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তোরে যেন একটা সুন্দর জামাই দে।’ রুবি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ‘ওরে আল্লারে, ঐটা তেমন সুন্দর অইব না দাদি।’ দাদি বলেন, ‘তুই জানস কেমনে?’ দাদি তো আর জানেন না যে নাতনি সেকথা ভালভাবেই জানে।

এক বছর সময় এভাবেই হাসিখুশিতেই কেটে গেছে বলা যায়। রহমত শেখ বলতে গেলে অবসরে গিয়েও বেকার থাকেননি। টুকটাক বাজারসদাই, জরুরি ওষুধপথ্য কেনা, মাঝে মাঝে ব্যাংকে যাওয়া ছাড়া বাকি সময় মায়ের সেবায়ই কাটিয়েছেন তিনি। এ সময়ে মায়েরও তেমন কোনো জটিল শারীরিক সমস্যা হয়নি। একবার নিয়ামত এবং আরেকবার বরকত এসেছিল। তারা দুজনই মাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। মাকে ছাড়া পুরো বাড়ি খা খা করছে। তাছাড়া তাদের ছেলেমেয়েরাও দাদির জন্য কান্নাকাটি করছে। কিন্তু ভাইজান রহমত শেখ মাকে ছাড়তে নারাজ। তার যুক্তি হল, ‘তোরা তো সারাজীবনই মারে লইয়া থাকলি; আমি আর পাইলাম কই? আরোও কিছুদিন যাউক, একবার মারে লইয়া ঘুইরা আমুনে।’

মাকে নিয়ে আসার জন্য যখন রহমত শেখ উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন তখন গিন্নী অর্থাৎ গুলশান আরাও সায় দিয়েছেন। তিনিও শাশুড়ির স্নেহ-ভালবাসা তেমন পাননি। এই শেষ বেলায় যতটুকু সম্ভব শাশুড়ির যত্নআত্তি করে কিছু পুণ্য সঞ্চয় করতে পারলে মন্দ কী? এমন তো নয় যে সারাক্ষণ শাশুড়ির ফাইফরমাশ খাটতে হবে; এ কাজের জন্য রিটায়ার্ড স্বামীবর সোৎসাহে দণ্ডায়মান। বউমা সহাস্যে যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করেছেনও। মাঝে মাঝে নিজেই শাশুড়িকে শ্যাম্পু দিয়ে মাথা ধুয়ে দিয়েছেন, সাবান দিয়ে গা মেজে দিয়েছেন, গায়ে অলিভ অয়েল মাখিয়ে দিয়েছেন, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া প্রায়ই শাশুড়ির জন্য সহজপাচ্য মুখরোচক খাবার তৈরি করে দিয়েছেন। মায়ের প্রতি স্ত্রীর এই বাড়তি মনোযোগ দেখলে রহমত শেখের মুখও কৃতজ্ঞতায় প্রশান্ত হয়ে উঠত। শাশুড়িও বউমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন, ‘আল্লা যেন তোমারে অনেক দিন বাচাইয়া রাখে বউমা।’ বউমা বলতেন, ‘অনেক দিন দরকার নাই আম্মা, দোয়া করেন আল্লাহ যেন সুস্থ রাখেন।’

গাড়ি হেমায়েতপুর ছাড়িয়েছে। মায়ের একটু কাশি উঠলে বলেন, ‘পানি দে।’

রহমত শেখ বোতলের ছিপি খুলতে খুলতে বলেন, ‘পানি বেশি খাওয়া যাইব না মা।’

মা বলেন, ‘ক্যা?’

‘এইতো, আমরা আইসা পড়ছি। একটু পরে বেশি কইরা খাইয়ো; বাথরুমের সমস্যা অইব না।’

হয়তোবা কথার কথা হিসেবে হাবিবুর রহমান কথাটা বলতেন। রহমত শেখের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ছিলেন তিনি। রহমত শেখের এক বছর আগেই তিনি অবসরে গিয়েছেন। প্রাণোচ্ছল ব্যক্তি বলেই তিনি কর্মিমহলে পরিচিত । দূরদর্শী ছিলেন বলে মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটিতে প্লট কিনে ব্যাংকঋণের টাকায় নিজেই পাঁচতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। হলে কী হবে, বেচারা নিতান্তই ইঁদুরকপালে। ঘরের ভেতর ধুন্ধুমার। পাঁচ ছেলেমেয়ের কোনোটাই আশানুরূপ মানুষ হয়নি। শুধু ছেলে দুটোই বিয়ের বাকি। তিন মেয়ের সবাই বিবাহিত। কিন্তু এরই মধ্যে সম্পদ নিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। মেয়েরা তাদের স্বামীদের নিয়ে জোট বেঁধেছে। তাদের কথা, শরিয়াটরিয়া চলবে না; তারা পিতার সম্পত্তির সমান অংশ চায়। হাবিবুর রহমানের স্ত্রী বরাবরই একটু তরলমস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তি। তার কথা, ‘বাকি সাত ইউনিট নিয়ে তোমাদের যা ইচ্ছা কর বাবা, দুই ইউনিটের এই সাজানো বাসা আমি ছাড়ব না; এটা আমার নামেই থাকবে।’ শেষপর্যন্ত নির্ঝঞ্ঝাট হওয়ার জন্য হাবিবুর রহমান বুদ্ধি করে বউয়ের নামে পাওয়ার অব এটর্নি দিয়ে চুপ করে কেটে পড়েছেন। তিনিই মাঝে মাঝে ফোন করে রহমত শেখকে বলতেন, ‘আপনি যদি এখানে থাকতেন কী মজাই না হত।’

রহমত শেখ মাথা ঠাণ্ডা রেখেই দায়িত্ব পালন করেছেন সারাজীবন। মাপাজোঁকা সংসারে রাগ-গোস্বাকে খুব একটা প্রশ্রয় দেননি। বুঝিয়েসুজিয়ে সংসারের সবাইকে সাধ্যমত খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন। আখেরে তার ফলটাও পেয়েছেন। এসবের পরেও মায়ের জন্য একটা হাহাকার সব সময় তার মনের মধ্যে বিরাজ করত। তাই ঢাকাতে নিয়ে আসার পর প্রাণ উজাড় করে মাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা তার প্রশান্তির জলাধারটি ঘোলা করে দিল।

আকীব দেশে আসার তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তারই পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে। আইবিএ’র শেষবর্ষের ছাত্রী। পরিবারও ভাল। আকীব এলেই বিয়ের তারিখটা ঠিক হয়ে যাবে। পরিবারে বিয়ের ধুম পড়ে গেছে বলা যায়। তবুও রহমত শেখের মাথার ভেতরের অস্বস্থিটা ক্রমশই ওজনদার হচ্ছে। গুলশান আরা ইদানীং কথাটা ঘনঘন তুলছেন। তবে আকীব এলে কি আরেকটা বাসা ভাড়া করবেন, আবার সে পিএইচডির জন্য ফিরে গেলে তার বউ কোথায় থাকবে, এসব কথা স্বামীকে শুনিয়ে শুনিয়ে তিনি বার বার বলছেন। কিন্তু কোনো সমাধান দিচ্ছেন না। এসব শুনতে শুনতে রুবিই একদিন খাবার টেবিলে প্রস্তাবটা তুলে ধরে, ‘আচ্ছা, দাদিকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলে হয় না? ভাইয়া তার বউকে নিয়ে গেলে আবার আমরা দাদিকে নিয়ে আসব।’ মেয়ের কথা শুনে রহমত শেখের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তবে গুলশান আরা কথাটাকে লুফে নিলেন। মনে হল কেউ যেন এরকম একটা কথা বলুক তিনি সে অপেক্ষায়ই ছিলেন এতদিন। তিনি বললেন, ‘প্রস্তাবটা মন্দ না। নাতির বিয়ে দিয়ে আম্মা নাহয় কিছুদিন গ্রামে গিয়ে থাকলেন। নিয়ামত-রহমতরাও খুশি হবে।’

রহমত শেখ হা কিংবা না কিছুই না বলে চুপ করে খাবার শেষ করে হাবিবুর রহমানকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘আপনার আপনজন সম্বন্ধে বিস্তারিত বলুন তো।’

‘আরে ভাই, হঠাৎ করে ‘আপনজন’ নিয়ে জানার কী হল, আপনি তো নিজেই ঘুরে গেছেন।’

রহমত শেখ আমতা আমতা করে বলেন, ‘না মানে, একটু ডিটেইল জানতে চাই আরকি…’

হাবিবুর রহমান কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আপনাকে তো বলেছিই এটা কয়েকজন প্রবাসী ফিলান্ত্রপিস্টের একটা ফাউন্ডেশন। তবে সবার জন্য ওপেন না, ফ্রিও না। মাসিক একটা চাঁদা দিতে হয় এবং সদস্যদের মানসম্মত হতে হয়। বাসিন্দাদের মধ্যে ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, শিল্পীসহ বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক আছে। এদের কারুর কারুর প্রবাসী ছেলেমেয়েরা ‘আপনজনে’ ডোনেশনও দেয়। মোদ্দা কথা, এখানে সুনাগরিকদেরই বাস। আমরা তো সুনাগরিকই, কী বলেন, হা হা হা।’

রহমত শেখ বলেন, ‘কথাটা সিরিয়াস! মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমি একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি, আমার খুব ইচ্ছা, আমি আপনার সাথে থাকব, সাথে মাকে নিয়ে।’

হাবিবুর রহমান একটা ধাক্কা খেলেন। বললেন, ‘মাকে নিয়ে? সত্যি বলছেন?’

‘সত্যি। তবে মা’র কেমন লাগবে সেকথাই ভাবছি।’

হাবিবুর রহমানের মাথায় কিছু প্রশ্ন এসে ভিড় করলেও তিনি সেদিকে না গিয়ে বললেন, ‘আমি এ ব্যাপারে এখন কোনো প্রশ্ন করব না। তবে বলতে পারি মা’র খুব ভাল লাগবে। সেদিন দেখেন নাই ভদ্র পরিবারের মহিলারা কেমন গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের বয়স আশি-নব্বুইয়ের ঘরে বলে কি মনে হয়েছিল? আর আপনি তো মায়ের সাথেই থাকবেন। তাই না? তাহলে চিন্তার কিছু নাই।’

রাজাসনের এই ঠিকানায় রহমত শেখ আরোও তিনদিন আড্ডা দিতে গিয়েছিলেন। জায়গাটি তার খুব ভাল লেগেছে। দুই বিঘা জায়গার উপরে নারকেল বিথিঘেরা একটি স্বচ্ছ পুকুর আছে। বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছও আছে সবুজ-সমতল মাঠে। এসবের ভেতর দিয়ে ইটবিছানো পায়ে চলা পথ। আর উত্তর পাশের চারতলা দৃষ্টিনন্দন দালানটি পরিকল্পনামাফিক। এখানেই ‘আপনজন’দের বাস – হল ঘর, ভোজনশালা, ডাক্তারখানা, গোসলখানা সবই পরিপাটি। হাবিবুর রহমান উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘কী সুন্দর পরিবেশ না? এসে পড়েন, দুনিয়ার কোনো ঝুটঝামেলা নেই; খেলাধুলা করব, সাঁতার কাটব, গান-বাজনা শুনব। আনন্দ আর আনন্দ!’

সেদিন রাতে নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করলেন রহমত শেখ। আসন্ন বাস্তবতাকে তো এড়ানো যাবে। আকীবের জন্য একটা আলাদা বাসা ভাড়া করা অশোভন দেখায়। এদিকে রুবি তার রুম ছেড়ে তার মায়ের সাথে থাকতে গেলে পড়ালেখার বিঘ্ন ঘটবে এটাও ঠিক। তাহলে কি মাকে গ্রামের বাড়িতে ফেরত পাঠাতেই হবে? না। এটা কিছুতেই মানতে পারছেন না রহমত শেখ। এই বয়সে মায়ের কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না। নিজের ছেলেমেয়ের সুবিধার জন্য তিনি কি মাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন? কখনও না। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথেই থাকবেন। সারারাত ভাবতে ভাবতে তিনি ভোরবেলা পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন এবং বিকেলে হাবিবুর রহমানের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

স্ত্রী প্রশ্ন করেছিলেন আকীবের বিয়ের আগেই আম্মাকে কেন বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। রহমত শেখ বুঝিয়ে বলেছেন যে আকীব এসে গেলেই বিয়েশাদীর হুলস্থূল পড়ে যাবে। তখন মায়ের কষ্ট হবে; তাই আগেভাগে যাওয়াই ভাল। বিয়ের দিন উনাকে নিয়ে আসা যাবে। আর এ যাত্রায় তিনি নিজেও কয়েকদিন বাড়িতে থেকে আসবেন। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করে রহমত শেখ কৌশলে উবার ঠিক করে বাক্সপেটরা নিয়ে সাভারের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন।

মা একটু উসখুস করতে করতেই গাড়ি এসে থামে ‘আপনজনের’ ফটকে। সেখানকার অবস্থা দেখে রহমত শেখের চক্ষু ছানাবড়া। ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ‘আপনজনের’ এক কর্মকর্তা। তার দুপাশে হাবিবুর রহমানসহ জনাদশেক প্রবীণ-প্রবীণা। গাড়ি থামতেই তারা একসাথে বলে উঠল, ‘স্বাগতম আপনজন’।

মা চোখ বড় করে তাকান রহমত শেখের দিকে, ‘আমারে কই নিয়া আইলি?’

গাড়ি থেকে নামতে নামতে রহমত শেখ বলেন, ‘এইটা কুটুমবাড়ি মা। আমরা কয়দিন এইখানে থাইকা বাড়িতে যামু। তোমার খুব ভালা লাগব দেইখ।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Dipok Kumar Bhadra ভোট দিলাম।
ধন্যবাদ। ভোট নয়, আপনাদের ভাল লাগাটাই মুখ্য।
Dipok Kumar Bhadra খুব সুন্দর লিখেছেন।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৬১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪