চান্দু পাগলা

অভিমান (এপ্রিল ২০২১)

Jamal Uddin Ahmed
  • 0
  • ১৪৫
‘এখন তোমরা যার যার বাড়িত যাও।’

হাসমত চৌধুরির কাছারিঘর লোকে লোকারণ্য। নিজের পরিবারের অনেকেতো আছেই, জড়ো হয়েছে আশেপাশের বাড়ির কৌতূহলী লোকজন, এমন কি কিছু অচেনা পথিকও। কুড়ি-পঁচিশ জনের জটলাতো হবেই। এই ঔৎসুক্য ও জটলার কেন্দ্রবিন্দু চান্দু পাগলা। চান্দুর জন্য ঘটা করে টেবিলের উপর খাবার সাজানো হয়েছে। অনেক পদের খাবার; সাথে এক বাটি দুধের সর এবং একটি সাগর কলাও।

জোর করে চান্দুর হাত-মুখ ধোয়ানো হয়েছে বটে; কিন্তু কিছুতেই তাকে খাবার টেবিলে আনা যাচ্ছে না। সে খেতে রাজি হচ্ছে না। তামেশগীর আগন্তুকদের একেকজন একেক রকম কসরত করছে, কিন্তু তাকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। অবশেষে জটলা কমানোর জন্য হাসমত চৌধুরী সবাইকে চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন।

মসজিদ থেকে জোহরের নামাজ পড়ে বাড়িতে ফেরার পথে হাসমত চৌধুরির সাথে চান্দুর দেখা। ময়লা লুঙ্গি আর ঝকঝকে একটি টি-শার্ট পরিহিত চান্দু স্বভাবমতো আনমনে লম্বা পা ফেলে বিপরীত দিক থেকে আসছিল। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেদা বলল, ‘দেহইন দেহইন মামা, চান্দু পাগলা!’

হাসমত চৌধুরির মাথায় কী ভূত চাপল। ঝোঁকের মাথায় তিনি বললেন, ‘ওরে আটকা।’

চান্দুকে সাধারণত কেউ থামাতে পারে না, কারুর সাথে সে কথাও বলে না যদি না সে নিজ থেকে থামে বা কথা বলে। আর কথা বললেও কার সাথে বলে আর কী বিষয়ে বলে এসব ঠাহর করা কঠিন। হঠাৎ কোনো চা-দোকানে থেমে বলবে, ‘এক কাপ চা দে।’ নয়তো একটা সিগ্রেট চাইবে। চান্দু পাগল হলেও বেশির ভাগ লোক তাকে সমীহ করে। অন্য পাগলদের মত সে উচ্ছৃঙ্খল বা বিপদজনক নয়। বয়স্ক লোকদের ধারণানুযায়ী কলেজে পড়ার সময়েই তার মাথা বিগড়ে যায়। তার পর থেকে এই প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত সে রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। অপরিচিত কেউ দেখলে ভাববে, লোকটির তাড়া আছে তাই দ্রুতলয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছেলে-বুড়ো সবাই চান্দুকে চিনলেও তার বাড়ির ঠিকানা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না। তাছাড়া ওর ভাল নাম চান্দু কিনা তা-ও কেউ জানে না। অনেকের মতে, চান্দিতে চুল না থাকার কারণে লোকমুখে চান্দু নামেই সে পরিচিত হয়ে ওঠে।

কর্তা হাসমত চৌধুরির অনুমোদন পেয়ে গেদা অতি উৎসাহে চান্দুর সামনে হাত-পা মেলে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চাচা, উবাও; চোধুরি সাব কথা কইবাইন।’

চান্দু থামবার পাত্র নয়। গেদার পাশ কেটে সে সমান গতিতে এগুতে থাকলে হাসমত চৌধুরি নিজে এগিয়ে এসে চান্দুর কাঁধ চেপে ধরে বলেন, ‘আরে মিয়া উবাও, তুমার লগে জরুরি মাত আছে; চল চল, আমার লগে খাওয়া-দাওয়া করবায়।’

চান্দু বিরক্ত হয়ে চৌধুরি সাহেবের হাত ছাড়াতে চাইলে গেদা প্রায় পাঁজাকোলা করে তাকে কাছারি ঘরে নিয়ে আসে, ‘ইতা করইন ক্যারে? চোধুরি সাবের কথা রাখতাইন না?’

গেদা ছোটকাল থেকেই চৌধুরি বাড়িতে আছে। বিলেত প্রবাসী লোকজনের নিজের বাড়িতে বিশালাকৃতির দালান বানানোর রেওয়াজ থাকলেও সাধারণত সে বাড়িতে স্থায়ীভাবে কেউ বাস করে না। তাই বাড়ি পাহারা এবং বিষয়-সম্পত্তির দেখভালের জন্য লোক নিয়োগ করতে হয়। এই সুযোগটি বহিরাগত লোকজন অর্থাৎ অন্য জেলার বাস্তুহারা, বিশেষ করে নদী শিকস্তির লোকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। হাসমত চৌধুরির অবস্থাও যখন এরকম হয়েছিল তখন তিনি জামালপুর থেকে ভাগ্যের খোঁজে ভেসে আসা গেদার মা-বাপের সন্ধান পান। তিনি তাদের অবারিত স্বাধীনতা দিয়ে সে বাড়িতে থাকতে দেন এবং জমিজমার তদারকির দায়িত্ব দিয়ে লন্ডনে ফিরে যান। গেদার বাপ মৃত্যু অবধি বিশ্বস্ততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করে গেছে। তার পুরস্কারও সে পেয়েছে। প্রতি বছর পরিবারের কেউ না কেউ দেশে বেড়াতে এলে গেদাদের জন্য গাদা গাদা উপহার সামগ্রী নিয়ে আসতেন; ফিরে যাবার বেলা বড় অংকের টাকা মুষ্টিতে গুঁজে দিতেন। শুধু তাই নয়, বিশ্বস্ততার পরীক্ষায় পাশ হবার পর বাড়ির উত্তর প্রান্তে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তাদের পাকা ঘর তৈরি করে দেয়া হয়। এত সুবিধা পেয়েও গেদারা কিন্তু লেখাপড়ায় এগুতে পারেনি। দু’বোনের বিয়ে হয়ে গেলে গেদা নিজেও বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছে। বুড়ো মা-সহ সে এখন বেশ আরামেই দিন গুজরান করছে।

দেশের প্রতি হাসমত চৌধুরির টান আগে থেকেই একটু বেশি ছিল। তাই স্ত্রী-সন্তান কেউ সাথে না এলেও সুযোগ পেলেই তিনি দেশে উড়ে এসে কয়েকদিন হৈহল্লা করে যেতেন। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চারা যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে অবসর জীবনটা নিজের দেশের মাটিতেই কাটাবেন। এ ব্যাপারে স্ত্রী ফাতেমা চৌধুরানিকে রাজি করাতে তার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবে শেষমেশ গত দু’বছর ধরে নিজের গ্রামের বাড়িতে বলতে গেলে স্থায়ীভাবে তিনি সস্ত্রীক বসবাস করছেন। সঙ্গত কারণে গেদা এবং তার স্ত্রীকে ফুলটাইম চৌধুরি পরিবারের সহকারী হিসেবে থাকতে হচ্ছে।

চান্দু পাগলা উশখুশ করছেই; কখনও লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ছে। গেদা তাকে প্রায় চেপে ধরে রেখেছে। হাসমত চৌধুরি জেদ ধরেছেন, তাকে খাওয়াবেনই। তিনি চান্দুর উদ্দেশে বললেন, ‘চান্দু মিয়া, তুমিতো বালা মানুষ, তুমার শার্টটা খুব সুন্দর, কিন্তু লুঙ্গিটা পচা।’ তারপর গেদাকে আদেশ করলেন, ‘যা তো আমার একটা নতুন লুঙ্গি লইয়া আয়।’

গেদা লাফ দিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে একটি প্যাকেট করা লুঙ্গি নিয়ে আসে। চান্দু তখনও উশখুশ করছে এবং বিড়বিড় করে কীসব বলছে। সে আবার চান্দু পাগলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘চাচা, ভাত কাইয়ালাইন। দেহইন কত্ত সুন্দর লুঙ্গি; পিনবাইন?’

চান্দু যেন গেদার কথা শুনতেই পায়নি। সে অবশ্য এখন লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠছে না, তবে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের দেয়াল দেখছে। হাসমত চৌধুরি এগিয়ে এসে চান্দুর পাশের চেয়ারে বসেন। তারপর আস্তে করে লুঙ্গিটি চান্দুর হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘ভাত খাইয়া লুঙ্গিটা পিন্দ।’

চান্দুর আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। কিছুটা ক্ষুব্ধ হাসমত চৌধুরির কপালে তখন একটু ভাঁজ পড়ে। তখন কাছারি ঘরের পেছনের দরজায় কার যেন উঁকিঝুঁকি দেখা যায়। হাসমত চৌধুরি হাঁক ছাড়েন, ‘কেগুরে?’

গেদার স্ত্রী জয়তারা মাথাটা বাড়িয়ে চাপা কণ্ঠে বলে, ‘আম্মায় আফনারে ডাকইন।’ অর্থাৎ ভেতর থেকে তলব এসেছে। বেগম সাহেবা ডেকে পাঠিয়েছেন। জয়তারা হাসমত চৌধুরিকে মামা ডাকলেও ফাতেমা চৌধুরানিকে আম্মা ডাকে।

হাসমত চৌধুরি বাধ্য হয়ে গাত্রোত্থান করেন। চান্দুর দায়িত্ব গেদার ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ান। তবে চান্দুকে যেন যেতে না দেয়া হয় এ ব্যাপারে গেদাকে সতর্ক করে যান।

ফাতেমা চৌধুরানি খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে স্বামীর ওপর বিরক্ত হয়ে গেছেন। হাসমত চৌধুরি স্ত্রীকে শান্ত করার জন্য কোনো অজুহাত না দিয়ে সোজা গিয়েই খাবার টেবিলে বসে পড়েন। স্ত্রী রাগ ঝাড়ার সুযোগ না পেলেও ‘পাগলের লগে আফনেও পাগল অই গেছইন নি?’ কথাটা বলতে ছাড়লেন না।

পরিবেশ হালকা করার জন্য হাসমত চৌধুরি হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘বুঝলায়নি, ই এক মজার পাগল।’

‘বুঝছি। ভাত খাইয়া তাড়াতাড়ি পাগলরে বিদায় করইন।’ বলে, বিরক্তিভরা মুখ নিয়ে স্ত্রীও স্বামীর সাথে খেতে বসে পড়েন।

এদিকে চৌধুরি সাহেবের অনুপস্থিতিতে আড়ালে লুকিয়ে থাকা কয়েকজন কৌতূহলী কাছারিঘরে ঢুকে গেদার সাথে যোগ দিয়ে আবার চান্দুকে খাওয়ানোর কসরত শুরু করেছে। এ যাত্রায় তারা সফল হয়েছে। টেবিলের ওপর ঝোল-তরকারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তত এক প্লেট ভাত চান্দু পাগলা খেয়ে ফেলেছে। এতে গেদার আনন্দ দেখে কে। সে দৌড়ে-দাপড়ে চান্দুর মুখ-হাত পরিষ্কার করে তাকে নূতন লুঙ্গিটা পরানোর চেষ্টা করছে। এটা করতে পারলে কর্তার কাছে তার ভাবমূর্তি আরোও উজ্জ্বল হবে। কিন্তু না, চান্দু তার পুরনো-ময়লা লুঙ্গি কিছুতেই ছাড়বে না। অগত্যা সবাই তাকে চেপে ধরে পুরনোটার উপরেই নূতন লুঙ্গিটা পরিয়ে দিল। ইতিমধ্যে হাসমত চৌধুরির চ্যাংড়া রাখাল মজিদ এসে অতি আগ্রহে একটি সিগ্রেট বাড়িয়ে দেয় চান্দুর দিকে। অবিশ্বাস্যভাবে চান্দু সহজেই সিগ্রেটটি নিয়ে নেয়। মজিদই সিগ্রেটটি জ্বালিয়ে দিলে বিড়বিড় করতে করতে চান্দু তা টানতে থাকে। এমুহূর্তে তার উঠে যাওয়ার তাড়া নেই। এমনতর স্থির চান্দুকে কেউ কখনও দেখেছে কিনা কারুর জানা নেই।

হঠাৎ কাছারিঘরের বাইরে হাসমত চৌধুরির গলার আওয়াজ শুনে অনাহূত আগন্তুকরা ঝটিতে হাওয়া হয়ে যায়। স্ত্রীকে একরকম চ্যালেঞ্জ করেই হাসমত চৌধুরি বলেছেন, ‘দেখি তুমি পাগলরে খাওয়াইতে পার নি?’

প্রথমে হাসমত চৌধুরি এবং পেছনে জয়তারাসহ ফাতেমা চৌধুরানি কাছারিঘরে ঢোকেন। তখনই গেদা বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে বলে ওঠে, ‘মামা! ভাত কাইছে। একন সিকারেট কায়।’

হাসমত চৌধুরি চমকে ওঠেন, ‘শাব্বাশ বেটা! কামের কাম করছস।’

ফাতেমা চৌধুরানি স্বামীর কাঁধের উপর দিয়ে চান্দু পাগলাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। মাথায় মস্ত টাক, মুখে খোঁচা খোঁচা সাদাকালো দাড়ি, রোদেপোড়া চামড়ার ওপর অসংখ্য ভাঁজ – আসলেই লোকটাকে পাগলের মতো লাগছে। তিনি নিচুস্বরে স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ই পাগলার বাড়ি কই?’

‘বাড়ির খবরতো কেউ জানে না।’ হাসমত চৌধুরি বলেন, ‘হুনছি, আমরার এলাকার নায়, অন্য কুনো থানার মানুষ অইব।’

চল্লিশ বছর আগে লন্ডনে পাড়ি দেওয়া চৌধুরি-গিন্নী বিলেতি পরিবেশে থেকে অনেকটাই সে দেশি কেতায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। স্বামী মুক্তবিহঙ্গের মত ঘনঘন উড়ে এলেও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফাতেমা চৌধুরানি অল্প কয়েকবারই দেশে আসার সুযোগ পেয়েছেন। সে কারণেই হয়ত দেশের ন্যাকামো-পাকামো হল্লা তার কাছে বিরক্তিকরই লাগে। দুই ছেলে আর এক মেয়ে বিয়ের পর নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে না পড়লে হয়তোবা তিনি দেশে আসতে রাজিই হতেন না। তবে আর যাই হোক ফোনে সবসময়ই তারা মা-বাবার খোঁজ নেয়। মেয়েটা এক পাকিকে পছন্দ করে বিয়ে করলেও সে-ই বেশি যোগাযোগ রাখে। ছেলে-মেয়ে সবাই বাবা-মাকে একবার ঘুরে আসার জন্য ক’দিন থেকে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু করোনার তাণ্ডবের জন্য সবকিছুই গুবলেট হয়ে গেছে।

কোনো দেশি পাগল ফাতেমা চৌধুরি কখনও দেখেছেন বলে তার মনে পড়ে না। আর দেখার সুযোগও তেমন ছিল না। মাত্র এসএসসি পাশ করেছেন, এমন সময় খবর এলো, ভাদেশ্বরের চৌধুরি পরিবারের সুদর্শন লন্ডনী পাত্র বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। পাত্রপক্ষ গোপনে সব খোঁজখবর আগেই সংগ্রহ করেছেন: ফেঞ্চুগঞ্জের সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রিয়দর্শিনী পাত্রী। সার্বিক বিবেচনায় পাত্রও লোভনীয়; সামান্য একটু ‘কিন্তু’ এড়িয়ে গেলেই হয়ে যায়। মুরব্বীরা রায় দিলেন, ‘এটা কোনো বিষয়ই না, ছেলের বয়স খুব একটা বেশি না; মাত্র পঁচিশ।’ অতএব অল্পদিনের মধ্যেই বিয়ের দামামা বেজে ওঠে। এবং পরের বছরই ফাতেমা চৌধুরানি খুশিতে বাগবাগ হয়ে স্বামীর সাথে লন্ডনে উড়ে যান।

চান্দু পাগলার সিগ্রেট পুড়ে শেষ হয়ে গেলেও ফিল্টারটি দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে সে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। কোথাও জিরনো তার স্বভাববিরুদ্ধ, তবুও এখন তার কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। হাসমত চৌধুরি মনে মনে খুব খুশি; তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। চান্দুর সামনে গিয়ে তিনি বললেন, ‘চান্দু মিয়া, তুমার পুরানা লুঙ্গিটা ফালাই দেও। আর আমার বাড়িত থাকি যাও; আমি তুমারে আরোও কাপড়-চুপড় দিমু।’

কিন্তু চান্দুর সাড়া পাওয়া গেল না। ফাতেমা চৌধুরানি তখন ইশারায় স্বামীকে ডেকে বললেন, ‘আফনার একটা বালা শার্ট দিলাউক্কা, খুশি অইব।’

হাসমত চৌধুরি জয়তারাকে বললেন, ‘যা গো মাই, আমার একটা নয়া শার্ট দৌড় মারি লইয়া আয়।’

জয়তারা শার্ট নিয়ে এলে হাসমত চৌধুরি সেটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘তুমি দিয়া দেখ, নিতো পারে।’

ফাতেমা চৌধুরানি রাজি না হলেও সবার জোরাজুরিতে ভয়ে ভয়ে চান্দুর দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছু না বলেই তিনি শার্টটা চান্দুর মুখের সামনে ধরে রাখলেন। কিন্তু চান্দুর সেদিকে খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ পর ফাতেমা চৌধুরানি বিরক্ত হলে বললেন, ‘নাগো সুনা, আমি ইতা পারতাম নায়।’ বলে, তিনি পিছনে সরে এলেন।

তখনই মনে হল চান্দু একটা ঝটকা খেল। সে বিড়বিড়ানি বন্ধ রেখে ফাতেমা চৌধুরানির দিকে তাকাল। তার এই অস্বাভাবিক আচরণে গেদা, জয়তারা, চৌধুরি দম্পতি সবাই একটু ভড়কে গেল। এমন পরিস্থিতিতে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাখাল মজিদও বেকুবের মত ঘরের ভেতরে ছুটে এসে চান্দুর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল।

গেদা বলল, ‘চান্দু চাচা, শাট তুমার পছন্দ অইছে? নিবাইন?’

চান্দু কিছু না বলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ফাতেমা চৌধুরানির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানো দেখে মনে হয় কী যেন একটা খুঁজছে সে। ফাতেমা চৌধুরানি ঘটনার আকস্মিকতায় ভীত হয়ে স্বামীর গা ঘেঁষে দাঁড়ান। চান্দু তখন একটু অস্থির হয়ে নিজের মাথায় খামচাখামচি করতে থাকে। পুরো চান্দি ফাঁকা হলেও তার আচরণে মনে হচ্ছে সে যেন মাথার চুল ছিঁড়ছে।

উপস্থিত কেউই ঘটনার মাথামুণ্ডু না বুঝে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পর চান্দু দড়াম করে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। তারপর বিড়বিড় করতে করতে পরনের নূতন লুঙ্গির গিঁট খুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে। সবাই তখন ‘অ্যাই, অ্যাই……’ রবে চান্দুকে থামাতে চাইলেও সে হনহন করে কাছারিঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

চান্দু চলে গেলেও এটা জানা যায়নি চান্দু কেন এমন আচরণ করল। তার মাথায় হঠাৎ কোনো অতীত স্মৃতি ফিরে এসেছিল কি? মানুষের অনেক স্মৃতি থাকে। চান্দুরও থাকতে পারে। একই গ্রামের দুই ক্লাস জুনিয়র এক সুন্দরী মেয়েকে সে তিন বছর ধরে ভালবেসে আসছিল। সেই মেয়ের গাদা গাদা প্রেমপত্র সে যতন করে সুটকেসে তালাবদ্ধ করে রাখত। শেষদিকের পত্রগুলোর শেষ লাইন থাকত, ‘হেলাল ভাই, তোমাকে না পাইলে আমি আত্মহত্যা করিব।’ সেই মেয়েটি একদিন রঙিন জীবনের হাতছানিতে অবলীলায় তাকে ভুলে গেল।

রাতের বেলা ফাতেমা চৌধুরানি একটু মাথাব্যথা অনুভব করেন। জয়তারা ঘরের বাতি নিভিয়ে আম্মাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর লন্ডন থেকে নিয়ে আসা ভিক্স দিয়ে কপাল ঘাড় ঢলতে থাকে। জয়তারার বোঝার কোনো উপায় নেই যে চান্দুর ছবিটা আম্মাকে বারবার তাড়া করছে। তিনিও চোখ বন্ধ করে অতীতচারী হয়েছেন। অনেক পুরনো টুকরো টুকরো ছবি জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছেন। প্রবাসী হবার চার বছর পর প্রথমবার দেশে বেড়াতে এসে তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে শুনেছিলেন, হেলাল ভাইয়ের মাথায় গণ্ডগোল হওয়ার পর সে এক রাতে কুশিয়ারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তার পর কী হয়েছিল কেউ জানে না। পরিবর্তিত বাস্তবতায় এ খবরটি ফাতেমা চৌধুরির মরমের নাগাল পায়নি। কিন্তু আজকের পাগলটার এমন অভিমানী আচরণ দেখে তিনি ঘাবড়ে গেছেন। এই চান্দুটি কে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
romiobaidya চমৎকার । শুভকামনা রইল।
কাজী জাহাঙ্গীর ভাল হয়েছে, অনেক অনেক শুভকামনা জামাল ভাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী