স্বপ্ন পরবাসে

স্বপ্ন (জানুয়ারী ২০২১)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৩৩
এ মুহূর্তে মির্জাবাড়ির ছোট পুকুরের ঘাটে সোহেল মির্জার দুই মেয়ে ফারজানা ও রেহানা নাইতে নেমেছে। দুই বোন এক সাথে গোসলে যাওয়ার সুবিধা হল একজন আরেক জনের পিঠ ঘষে দিতে পারে। এখন রেহানা আপি অর্থাৎ ফারজানার পিঠে পণ্ডস সাবান-মাখানো ধুন্দল মাজনী ঢলছে। ভেতর-বাড়ির ছোট পুকুরে নল-খাগড়ার ঘেরের ভেতরে শুধু মেয়েরাই গোসল করে বলে ওখানে তত লুকোছাপার ত্রস্ততা নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন নয়। তবু ভাসছে শুভ্র মেঘের ভেলা, এক অদৃশ্য নিঃসীম মহাসমুদ্রে। কোথাও যাবার তাড়া নেই বলে বিচ্ছিন্ন ভেলাগুলি আয়েশে গা ভাসিয়ে রেখেছে আকাশ সমুদ্রে। কখনও কোনো ভেলা ভাসতে ভাসতে মুন্সীপুরের মাথার ওপর এসে পড়লে সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী তার ছায়া কোনো না কোনো পাড়া মাড়িয়ে ঢিমেতালে হেঁটে যায়। শেওলাঢাকা পানির উপর দিয়ে এরকম একটি ভেলার ছায়া সাহেবি চালে গড়িয়ে যেতে থাকলে ফারজানার চোখ সেদিকে যায়। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শরত কাল শেষ হয়ে গেছে নারে?’ রেহানা চোখের পুতলি ঘুরিয়ে মুচকি হেসে জবাব দেয়, ‘কী জানি।’

বাঙালিরা শরত চিনবে না, সে কি হয়? কখনও ঝাপটা বৃষ্টি থাকে বইকি; তবে তার বিশেষত্ব এটি নয়। শরত শব্দে তরুণরা শিউরে ওঠে, তাদের মাথার ওপরে শাদা মেঘের ভেলা – অতি আবেগিরা রূপোর ময়ূরপঙ্খী নাওয়ের কষ্টকল্পনাও করে, আর দৃষ্টির রেখায় নৃত্যরত কাশবন। আহা কাশবন! ফারজানারও খুবই পছন্দ। মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে সে অনেকবার দুগ্ধধবল কাশবন দেখেছে। তবে একবারই কাশফুলের সাথে তার মাথাও দুলেছিল।

মির্জাদের ভূসম্পত্তি অঢেল থাকলেও সোহেল মির্জা ওসবের দেখভাল খুব একটা করেন না; ছোট দুই ভাই কামরুল ও মুহিবের ওপর চাষবাসের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। যে ফসলই ভাইয়েরা ফলাক, যতটুকুই দিক এসবে সোহেল মির্জার কোনো প্রশ্ন নেই, উপদেশও নেই। তাদের প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থার কারণে বড় ভাইয়ের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা। তারাও কোনোদিন মিনমিন করে এমন কথা বলেনি যে বড় ভাই কেন ফুলবাবু হয়ে থাকবে আর ওরা খেটে মরবে। তাছাড়া মির্জাবাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে; সমাজে মির্জাদের একটা প্রভাব না থাকলে কি হয়? সোহেল মির্জা সে দায়িত্ব পালন করেন। দু’চার পরগণায় তার নামডাক আছে। বিচার-সালিশ, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে তাকে সবাই সমীহ করে ডেকে নেয়। সোহেলের পরিচিতির কারণে কামরুল-সোহেলকেও সবাই পাত্তা দিয়ে চলে। অবশ্য এসব সামাজিক দায়িত্বের পাশাপাশি সোহেল মির্জার একটি ব্যবসাও আছে। থানা শহরে সারের ডিলারশীপ। ওখানে তার না থাকলেও চলে; নিজের ভাগ্নে একজন কর্মচারি নিয়ে সেটা চালিয়ে নিতে পারে। ফুরসৎ পেলে সোহেল মির্জা দুয়েকদিন পর পর একটা চক্কর দিয়ে আসেন। ডিলারশীপের আয় মূলত ঠাট বজায় রাখতেই খরচ হয়। উদাহরণস্বরূপ, দু’বছর আগের মোটর সাইকেলটি বিক্রি করে দিয়ে সেদিন তিনি একটা নতুন ইয়ামাহা আর-১৫ কিনেছেন।

সোহেল মির্জা একটি সালিশি শেষ করে দুপুরে বাড়িতে ফিরে এলে মেয়েরা চটজলদি পরিপাটি হয়ে খাবার টেবিল সাজাতে চলে যায়। এসব কাজ তারাই করে। মা শুধু রান্নার কাজটা করেন। তা-ও বাপের পক্ষপাতিত্বের জন্য। সোহেল মির্জা বলেছেন, ‘শোন মেয়েরা, বাপের ঘরে এত খাটাখাটুনির দরকার নেই; এখন মায়ের কাছ থেকে শিখে নাও। শ্বশুর-শাশুড়িকে মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়াবে। এখন তোদের মা-ই রাঁধুক।’ মেয়েরা কি এখন ছোট খুকি? তারা সবই বোঝে। বাবা যে মায়ের হাতের রান্না খুবই পছন্দ করেন তা তারা বোঝে এবং মুখ টিপে হাসে।

শিবনগরের ইকবাল চৌধুরীও সোহেল মির্জার মতো গণ্যমান্য মানুষ, তবে তথাকথিত মাতব্বর নন। প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইকবাল চৌধুরীকেও লোকজন চেপে ধরে সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিয়ে যায়। তাই সোহেল মির্জার সাথে তার প্রায়শই দেখাসাক্ষাৎ হয়। থানা শহরে গেলে একবার ঢুঁ মেরে দেখেন সোহেল মির্জা তার ব্যবসাকেন্দ্রে আছেন কিনা। থাকলেতো কথাই নেই, বয়ঃকনিষ্ঠ সোহেল মির্জার সাথে তিনি বন্ধুর মতো আড্ডা দিয়ে ঘণ্টা পার করে দেন। স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার আগে এখানেই তিনি ফারজানা ও রেহানাকে দেখেছেন। ওরা দামুড়হুদা পাইলট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে পড়তে এসে মাঝে মাঝে বাপের দোকানে ঢুকে হৈ চৈ করে যেত। ফারজানা অবশ্য গত বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার পর থেকে আর আসেনি।

সৌখিন হলেও সোহেল মির্জা কিছু ব্যতিক্রমী নীতি মেনে চলেন। এই ইন্টারনেটের যুগেও তিনি সেকেলে ফোন ব্যবহার করেন। স্ত্রীর প্রয়োজন না থাকলেও দুই মেয়েকে তিনি দুটো ভাল ফোন কিনে দিয়েছেন, কিন্তু কোনোটাই স্মার্টফোন নয়। ইতালী প্রবাসী শ্যালক বোনকে একটা ফোন উপহার দিতে চাইলেও তিনি সেটা অনুমোদন করতে চাননি। এতে ঘরের পরিবেশ গুমোট হয়ে উঠলে শেষমেশ শর্ত সাপেক্ষে সেটা গ্রহণ করেছেন। তবে পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, এটা কেউ ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। তাছাড়া হাবিজাবি গান-বাজনা দেখা বা ফেসবুক এসব চালানো যাবে না। শালা হাসতে হাসতে বলেছে, ‘দুলাভাই, দুনিয়াটা এখন হাতের মুঠোয়, আর আপনি একজন মডার্ন মানুষ হয়েও কীসব কথা বলেন!’ সোহেল মির্জা বলেছেন, ‘এতসব বুঝি না, তুই তোর বুবুর সাথে কীভাবে কথা বলবি সেটা দেখিয়ে দিয়ে যা।’

শ্যালক আমীনও বোঝে দুলাভাইয়ের মর্যাদাবোধ টনটনে। ইন্টারনেটের ছোবলে মির্জাবংশে অপ্রীতিকর কিছু ঘটুক তিনি তা চান না। সে তাই ভাগ্নিদের শত অনুরোধেও ফেসবুক চালু করে না দিয়ে শুধু যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো আর ভাইবার ইন্সটল করে সবার জন্য একটা কমন ট্রেনিং দিয়ে গিয়েছে। দিলে কী হবে, এই ফোনের ব্যবহার শুধু ফারজানা এবং রেহানাই জানে। এখন শুধু আমীনই নয়, আরোও কিছু আত্মীয়স্বজন অ্যাপসের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ করে। এই করোনাকালেও আমীন দেশে এসে বিয়ে করে বউকে সাথে করে নিয়ে গেছে। বউকে নিয়ে সে ভিডিও কলে দুলাভাইয়ের সাথে খুনসুটি করে, বোন ভাগ্নিদের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলে। সময়ের সাথে সাথে সোহেল মির্জার কাছেও স্মার্টফোনের ব্যবহার অনেক সহনীয় হয়ে এসেছে।

সোহেল মির্জার আমন্ত্রণে তার বাড়িতে বেড়াতে এসে ইকবাল চৌধুরী মূলত ফারজানাকে উদ্দেশ্য করে প্রস্তাবটা পেড়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটের পর মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য দূরে পাঠাতে রাজি হননি সোহেল মির্জা। চৌধুরী পরিবারের বিয়ের প্রস্তাবে সঙ্গত কারণে খুশি হয়েছেন তিনি। ওই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার এক গোপন ইচ্ছা তার মনেও ছিল। ইকবাল চৌধুরীর মেধাবী ছেলে শাহীনকে তিনি দুয়েকবার দেখেছেন। বিদেশে পড়াশুনা করতে গেছে বলেও শুনেছেন। পাত্র হিসেবে লোভনীয়। তথাপি চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাবে তিনি একটু বেকায়দায় পড়ে যান। অনেক ভেবে তিনি চৌধুরী সাহেবকে একটি কৌশলী উত্তর দেন, ‘চৌধুরী ভাই, আপনার সাথে আত্মীয়তা করা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আচ্ছা, আপনিতো আমার দুইটা মেয়েকেই দেখেছেন; বলেনতো আমার ছোট মেয়ে রেহানাকে আপনার কেমন লাগে?’

ইকবাল চৌধুরী হেয়ালির মধ্যে পড়লেও সত্য কথা উচ্চারণ করলেন, ‘আরে মাশাল্লাহ, আপনার দুই মেয়েইতো ফুলের মত সুন্দর; কেউ কারুর চেয়ে কম নয়। তো এখানে ছোট মেয়ের প্রসঙ্গ আনলেন যে?’

বাধ্য হয়েই সোহেল মির্জাকে গোমরটা ফাঁক করতে হল। তিনি নিচুস্বরে রুবেলের কথা বিস্তারিতভাবে বললেন চৌধুরী সাহেবকে। পলিমার সায়েন্সে পাশ করা চুয়াডাঙ্গা শহরের ছেলে রুবেল বিদেশে পড়তে যাবার আগে ছয় মাস ফারজানাদের কলেজে শিক্ষকতা করেছে এ কথা ইকবাল চৌধুরীও জানতেন। তবে ছেলেটি যে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে মুরব্বিদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ রেখে গেছে এটা সোহেল মির্জার মুখ থেকে শুনে তিনি বললেন, 'জামাই হিসেবে ছেলেটি একটা রাইট চয়েস। সে যখন বলেছে দেশে আসার আগে আগেই সে তার অভিভাবক পাঠাবে, তাহলে সেটা ফাইন্যাল ধরে নেন। আমি তাহলে আপনার ছোট মেয়েটাকেই নিলাম। আর একটা সেমিস্টার শেষ হলে আমার ছেলে ফিরে আসবে ইনশাল্লাহ।'

সোহেল মির্জা বললেন, 'ইনশাল্লাহ। তবে বিশ্বের যে অবস্থা; দোয়া করুন ছেলেগুলা যেন সুস্থ থাকে।'

রেহানার ফোন নম্বর কীভাবে যে শাহীনের কাছে পৌঁছেছে সে এক রহস্য। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কল ধরা নিষেধ থাকলেও বিদেশি নম্বর দেখে কী ভেবে তার ফোনে বাজতে থাকা কল রেহানা ধরে বসে। কিন্তু ওপাশের কণ্ঠস্বর শুনতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে দ্রুতবেগে একটি টিকটিকি নেমে যায়। একটি ছেলের কণ্ঠ, ‘আমি শাহীন চৌধুরী।’ রেহানা থ হয়ে থাকলে ছেলেটি আবার বলে, ‘তুমি কি রেহানা? তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?’

ঝিমধরা রেহানার মুখ থেকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেরিয়ে এল, ‘জ্বী’। এর পর কথা গড়িয়েছে ভীরু কণ্ঠে এবং শম্বুক গতিতে।

নিষেধাজ্ঞা জেনেও শাহীন ক’দিন পর আরেকবার ফোন করে রেহানাকে বলেছে, ‘তোমার ছবি দেখেছি, কথাও হয়ে গেল। এইতো, আগামি ডিসেম্বরেই আমি চলে আসব। তবে এতদিন কথা না বলতে পারলে কষ্ট হবে।’

রেহানা কৈফিয়তের সুরে বলেছে, ‘কথা বলতে আমারও ইচ্ছে করে; কিন্তু বোঝেনইতো…’

‘সে আমি জানি।’ শাহীন বলে, ‘তবে সুযোগ পেলে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে বা ভাইবারে কল করতে পার।’

ফোনের কথা রেহানা মায়ের কাছে লুকোয়নি। কিন্তু মা চোখ গরম করে বলেছেন, ‘সাবধান! তোর বাপ জানতে পারলে খবর আছে।’ ফারজানা অবশ্য বলেছে, ‘এখানে সাবধানতার কী আছে? বিয়ের কথাতো পাকা। ছেলে এসে গেলেই বাজনা বাজবে।’ রেহানা ঘাড় বাঁকা করে বলেছে, ‘ইস্, অসম্ভব। আগেতো তোমার বাজনা বাজবে, তারপর নাহয় আমারটা।’

রেহানার কথায় সবার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও ফারজানার উজ্জ্বল মুখটা তেলবিহীন পিদিমের সলতের আগুনের মত কেঁপে কেঁপে নিভে গেল।

এক শুক্রবার সোহেল মির্জা সস্ত্রীক একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে চলে গেলে ফারজানা রেহানাকে ডেকে বলে, ‘অ্যাই, অ্যান্ড্রয়েড ফোনে শাহীনের নম্বর সেভ কর; পরে মুছে ফেলবি।’

‘কেন?’ রেহানা জিজ্ঞেস করে।

‘আরে বোকা, হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে পারবি’, ফারজানা বলে।

‘নারে বাবা! আব্বু জানলে কল্লা কেটে ফেলবে।’

ফারজানা বলে, ‘জানবে না; মুছে ফেলবি।’

তারপরও রেহানা কাঁচুমাচু করতে থাকলে ফারজানা বলে, ‘তোর অবস্থাতো আমার মত নয়, শাহীন তোকে কল করার জন্য আবদার করেছে।’

রেহানা ঝুঁকি নিয়ে শেষপর্যন্ত শাহীনকে কল করেছে। শুধু তাই নয়, নাছোড়বান্দা শাহীনের চাপাচাপিতে তাকে এক মিনিটের জন্য ভিডিও অন করতে হয়েছে।

ছোটবোনের খুশি খুশি মুখ দেখে ফারজানার আনন্দ হয়। তাছাড়া একথা ভেবে আরোও ভাল লাগে যে তাদের দু’বোনের কপালে দুটি উচ্চশিক্ষিত পাত্র জুটেছে। তবুও প্রায়ই তার মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। লুকিয়ে চুরিয়ে সে দু’বার কথা বলেছিল রুবেলের সাথে। শেষ কথা হয় গত জুনে, করোনার আতঙ্ক যখন বিশ্বব্যাপী। কথা বলতে গিয়ে ফারজানার গলা ধরে আসলে রুবেল বলেছিল, ‘আমার জন্য চিন্তা করো না; আমরা সুরক্ষিত। আমি তোমাদের জন্য চিন্তা করছি।’ এর পর রুবেলও ফোন করেনি, ফারজানাও কল করতে সাহস পায়নি। রুবেল তাদের বাড়িতে এসে ফারজানার মায়ের কাছে যখন আবেদনটা রেখে যায় তখন সোহেল মির্জা স্ত্রীকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে পাত্রের ব্যাপারে তার কোন আপত্তি নেই, ‘তবে কথা পাকাপাকি না হওয়া পর্যন্ত ছেলেমেয়ের মধ্যে যোগাযোগ হোক তা আমি পছন্দ করি না।’

প্রথম দিনের ফোনকল বেশ সময় ধরে চললেও ফারজানা তেমন কিছু বলতেই পারেনি; শুধু রুবেলের কথাই শুনে গেছে। বলবেইবা কেমন করে, একেতো শিক্ষক - অল্পদিনের জন্য হলেও, আবার আধুনিক সংজ্ঞায় প্রেম বলতে যা বোঝায় তা তাদের মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। তবুও রুবেল অল্পদিনের কিছু ছড়ানো ছিটানো মুক্তোমুহূর্ত ফারজানার সামনে তুলে ধরছিল:

- ওই যে আকাশী রঙের শাড়ি পরে তোমরা দু'বোন কাশবনের সাথে মিতালী করছিলে, মনে আছে? আমি তখন মোটর সাইকেলে ব্রীজে উঠতে যাচ্ছিলাম। তোমরা লজ্জা পেয়েছিলে। কিন্তু তোমাকে দেখে আমার সাইকেলের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ফারজানা সব ভুলে গেলেও এই স্মৃতি ভুলবে কেমন করে। মন পাগল করা শরতের বিকেলে তারা দুই বোন মাথাভাঙ্গার তীরে শখ করে হাঁটতে গিয়েছিল। রুবেল স্যার কাছে এসে বলেছিল, 'চমৎকার কনট্রাস্ট! রূপালি কাশবনের ভেতর এক ছোপ নীল আকাশ। তোমাদের খুব সুন্দর লাগছে।' স্যার চলে যাওয়ার পর রেহানা ভুরু নাচিয়ে বলেছিল, 'ধরা খেয়ে গেছ, আপি। স্যার বহুবচনে বললেও কথাগুলো তোমার উদ্দেশে বলেছে।' ফারজানা বলেছিল, ‘ছিঃ, বেশরম!’ বললে কী হবে, রুবেল স্যার ঠিকই তার মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

- আমার ক্লাসে তুমি মাথা নিচু করে থাকতে, আমার দিকে তাকাতে না; অন্য মেয়েরা নিশ্চয়ই টিপ্পনী কাটত।
টিপ্পনী কাটতইতো। সুযোগ পেলেই, যেমন, কলেজের মূল ফটকে, বারান্দায় কিংবা অফিস কক্ষে ফারজানার সাথে দেখা হলেই মিষ্টি করে হেসে কোনো না কোনো অজুহাতে দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করত রুবেল স্যার। ফারজানাও বুঝত স্যারের এই আদিখ্যেতা একটু অন্য রকম; নিশ্চয়ই কোথাও কুচ কুচ হোতা হ্যায়। তখন সে লজ্জায় গুটিয়ে যেত।

- মনে আছে, তোমাকে যেদিন বলেছিলাম যে আমি তোমাদের বাড়ি যাব তখন তুমি কেঁপে উঠে বলেছিলে, 'কেন স্যার?'
রুবেল যখন তাদের বাড়িতে যাবার কথা বলেছিল তখন ফারজানার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল - স্যার যদি কোনো অভিযোগ নিয়ে যায়! কিন্তু পরক্ষণে যখন সে বলল, 'ফারজানা, তোমাকে নিয়ে আমার বিরাট একটি স্বপ্ন আছে, আমি সে কথা তোমার অভিভাবকদের বলতে চাই। তোমার যদি এতে আপত্তি থাকে আমি যাব না।' ফারজানা হ্যাঁ বা না কিছু না বলে লজ্জায় মাথা নিচু করে ভোঁ দৌড় মেরে ক্লাসরুমে ঢুকে পড়েছিল। রুবেল তখন ফারজানার পায়ের ছন্দ দেখে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিল।

- শোনো, আমি মাস্টার মানুষ; মনের ভেতর কথার পাহাড় জমে উঠলেও তোমাকে স্বচ্ছন্দে কিছু বলতে পারিনি। আজ অনেক দূর থেকে কথাটা বলি, আমি তোমাকে খুব খুউব ভালবাসি।
রুবেলের কথার উত্তরে ফারজানা কিছুই বলতে পারেনি। তবে আনন্দে উত্তেজনায় তার বুক ভেঙ্গে কান্না উথলে উঠেছিল। রুবেল তা প্রাণভরে শুনেছিল। এরপর থেকে শিউলি ফুলের মত প্রতিটি দিবসকে রঙিন সুতোয় পুরে স্বপ্নের মালা গেঁথে যাচ্ছিল ফারজানা।

শেষ ডিসেম্বরের বিকেল। কনকনে শীত। নিস্তেজ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার পর থেকেই শীতের বুড়ি শাদা কাঁথা বিছিয়ে দিয়েছে চরাচরে। এমন আবহাওয়ায় জরুরি কাজ না থাকলে বয়স্ক লোকের ঘর থেকে বেরোনোর কথা নয়। ইকবাল চৌধুরী অবশ্য দুপুরের দিকে ফোন করেছিলেন সোহেল মির্জাকে; ছেলে ফিরে এসেছে একথা জানিয়ে তিনি কীভাবে একবার সোহেল মির্জার সাথে দেখা করতে পারেন তা জানতে চেয়েছিলেন। সোহেল মির্জা বেশ উৎফুল্ল হয়েই বলেছিলেন, ‘আমিতো আমার দোকানে আছি, কষ্ট করে চলে আসুন না, গরম গরম ভাপা পিঠা আর কফি খাব।’ ইকবাল চৌধুরী শুকনো হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তাহলেতো জমবে ভাল; দেখি খাওয়া-দাওয়ার পর বেরোতে পারি কিনা।’ এবং শেষ পর্যন্ত কষ্ট করেই ইকবাল চৌধুরী থানা শহরে পৌঁছে আসরের নামাজ পড়েন।

সোহেল মির্জা বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে বাজার থেকে গরম ভাপা পিঠা, সাথে ফ্লাস্কে করে কফি আনান। তিনি হবু জামাই শাহীনের কুশল সংবাদ জানতে চান। তাছাড়া প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা গড়গড় করে বলতে থাকেন। হঠাৎ করে ইকবাল চৌধুরীর মুখে মাস্ক দেখে একটু মুচকি হাসেনও। কারণ মফস্বলে মাস্কের ব্যবহার ইদানীং উঠেই গেছে। করোনাকে কেউ যেন আর পাত্তাই দিতে চায় না। ইকবাল চৌধুরী মজা করে পিঠা আর কফি খেয়ে হবু বেয়াইকে ধন্যবাদ জানান। কিন্তু তিনি অন্যান্য দিনের মত আজ সোহেল মির্জার সাথে তাল মিলিয়ে কথার খই ফুটাতে পারছেন না। ব্যাপারটি সোহেল মির্জার দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি কৌশলে একটা টোকা দিতে চাইলেন। বললেন, ‘ঠাণ্ডা যা পড়েছে; চৌধুরী ভাইয়ের কি খুব কষ্ট হচ্ছে? শরীর ভালতো?’

ইকবাল চৌধুরী তড়াক করে বললেন, ‘না না, শরীর ভাল।’

সোহেল মির্জা কোনো ক্লু আবিষ্কার করতে না পেরে চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর একটু উশখুশ করে ইকবাল চৌধুরী বললেন, ‘যা কুয়াশা পড়েছে, দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাগরেবের আজান পড়ে যাবে এখনই। বাড়িতে ফিরতে হবে, কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল; আমার বলাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।’

মুহূর্তের মধ্যে সোহেল মির্জার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ইকবাল চৌধুরীর আজকের আচরণে তিনি প্রথম থেকেই তিনি অস্বস্থি বোধ করছেন। তার কথা যদি মান-ইজ্জতের ব্যাপার হয় তাহলেতো সর্বনাশ। ছেলেপুলেরা বিদেশে গেলে অনেক অপকর্মও করে বসে। এসব চিন্তা তার মাথায় চক্কর দিলেও সোহেল মির্জা বোকা হয়ে মুখ বন্ধ রাখলেন।

ইকবাল চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ‘চলুন মসজিদে যেতে যেতে কথাটা বলি।’ বলে, তিনি সোহেল মির্জাকে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন।

মাঝপথে হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে সোহেল মির্জার কাঁধে হাত দিয়ে ইকবাল চৌধুরী বললেন, ‘ইনশাল্লাহ কিছুদিনের মধ্যেই আমরা একটা তারিখ ঠিক করে নেব। ছেলে যখন এসেই পড়েছে, আমার আর দেরি করার ইচ্ছা নাই।‘

সোহেল মির্জা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্, এটাতো খুশির কথা, কিন্তু…।’

ইকবাল চৌধুরী বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি; বড় মেয়ের কথা বলবেনতো?’ সোহেল মির্জার উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি বললেন, ‘আমিও সেকথাই ভাবছি, ভাই।’

কলজেয় পানি ফিরে এলে সোহেল মির্জা বললেন, ‘তাহলে কী করা যায়, একটু উপদেশ দেন ভাই।’

ইকবাল চৌধুরী জোরে একটা শ্বাস ফেলে সোহেল মির্জাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এখুনি আজান হবে, আমরা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছ প্রার্থনা করব খবরটা যেন মিথ্যা হয়।’

সোহেল মির্জা এবার পুরোপুরি ঘাবড়ে গেলেন, ‘কী খবর ভাই?’

এরপর ইকবাল চৌধুরী তার সারাজীবনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা দিয়ে অত্যন্ত সহনশীল কায়দায় তার ছেলের কাছ থেকে শোনা তথ্যটি সোহেল মির্জার কাছে বর্ণনা করেন। গত রাতে ছেলের সাথে বিয়ের আলাপ করতে গিয়ে সঙ্গতভাবে ফারজানার প্রসঙ্গটিও আসে। তিনি ভুল করে শুনেছিলেন রুবেল ছেলেটি ইংল্যাণ্ডে পড়াশুনা করতে গিয়েছে। কিন্তু শাহীন যখন জানতে পারল এই ছেলেটি দামুড়হুদা পাইলট গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করেছে এবং তার নাম রুবেল তখনই সে থমকে যায়। সে বলল, ‘বাবা, আমার যদি ভুল না হয়, ওই ছেলের সাথে খুব অল্প সময়ের জন্য এম্বেসিতে আমার দেখা হয়েছিল। সে ইংল্যাণ্ডে নয়, স্টকহোমে অন্য একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। চুয়াডাঙ্গার ছেলে। লকডাউনের জন্য সবার সাথে আমার যোগাযোগ কমে গিয়েছিল; তার সাথেও আর যোগাযোগ হয়নি। স্যরি, গতমাসে করোনার সেকেন্ড ওয়েভে ছেলেটা মারা গেছে শুনেছি।’

ইকবাল চৌধুরীর কথা শোনার পর সোহেল মির্জা কিছুক্ষণ স্থবির হলেন, কিন্তু তাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। হয়ত তিনি ইচ্ছে করেই হৃদয়ে আর রক্তক্ষরণ ঘটাতে চাননি অথবা ইকবাল চৌধুরীর মত তিনিও মনেপ্রাণে কামনা করলেন খবরটি যেন মিথ্যে হয়। তিনি নীরবে অজু সারেন, মাগরেবের নামাজ পড়েন এবং মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসেন। ইকবাল চৌধুরীর চোখের দিকে পাথরচোখে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থেকে তাকে বুকে চেপে ধরেন। দু'জনেরই চোখ তখন আর্দ্র হয়। এরপর শুধু 'পরে কথা হবে' বলে সোহেল মির্জা ইকবাল চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নেন।

বাইরের ঘন কুয়াশার মত সোহেল মির্জার মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও খুব সাবধানে মোটরসাইকেল চালিয়ে তিনি বাড়ি পৌঁছেন। ঘরের ভেতরের হাসির শব্দ তার কানে আসে। মেয়েদের সাথে মাকেও অনেক প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। এ আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সাথে নিশ্চয়ই শাহীনের দেশে ফিরে আসার সংবাদটির সংযোগ আছে।

সোহেল মির্জা মোটরসাইকেল থেকে নেমে খুব ধীরস্থিরভাবে ঘরে ঢোকেন। স্ত্রী দৌড়ে এসে বলেন, 'পিঠা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। গরম পানি দিয়েছি, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আসেন।'

স্ত্রীর কথায় কর্ণপাত না করে তিনি শান্তভাবে বড় মেয়েকে ডাকেন, 'ফারজানা, এদিকে আয়তো মা!' এমন শীতল আহ্বান ফারজানা বাবার মুখে অনেকদিন শোনেনি। সে দৌড়ে এসে বলে, 'আব্বু!' সোহেল মির্জা মেয়ের দিকে দুই কদম এগিয়ে যান এবং সবাইকে চমকে দিয়ে ফারজানাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠেন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাইদুল সরকার সুন্দর।
ভালো লাগেনি ৬ জানুয়ারী, ২০২১
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৬ জানুয়ারী, ২০২১
Yousof Jamil চমকপ্রদ লেখনী। পড়ে অনেক ভালো লাগল।
ভালো লাগেনি ৪ জানুয়ারী, ২০২১
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৪ জানুয়ারী, ২০২১
ফয়জুল মহী অসাধারণ প্রকাশ! মুগ্ধতা অপরিসীম। শুভ কামনা
ভালো লাগেনি ৩ জানুয়ারী, ২০২১
আমার কর্মের চেয়ে আপনার প্রশংসা অধিক। অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ৪ জানুয়ারী, ২০২১
Dipok Kumar Bhadra সুন্দর লিখেছেন।
ভালো লাগেনি ১ জানুয়ারী, ২০২১
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২ জানুয়ারী, ২০২১

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৫৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪