নীলাভ শূন্যতা

শূন্যতা (অক্টোবর ২০২০)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৪৫৪
‘এই খালি। যাবে মামা?’

‘কুনদিকে?’

তাইতো। রিক্সাওলাকে দিক নির্দেশ করতে হবে। কায়েস বলে, ‘চল, শাহবাগের দিকে।’

রিক্সায় চড়ে বসতেই শাহবাগ আর মাথায় থাকে না তার। আসলে শাহবাগ তার নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়। বিকেলে টিএসসিতে রাকিবের সাথে আড্ডা দেবার সময়ই মিজানের সাথে ফোনে কথা বলেছিল সে একবার। মিজান বলেছিল, ‘চলে আয়।’ কিন্তু কেমন ঘুর-চক্কর যাত্রা – সেই সাঁতারকুল। কায়েস বলেছিল, ‘কই কোন মফস্বলে থাকিস; সেন্টারের দিকে থাকতে পারিস না?’ মিজান হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ঠিক আছে, আয়, মফস্বলেই ঘুইরে যা।’

যাবে নাকি – ভাবতে ভাবতে রিক্সার ভাড়া চুকায় কায়েস। বস্তুত শাহবাগে তার কোনো কাজ নেই। টিএসসিতেও রাকিবের সাথে আড্ডা দেয়া ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। তবে ঝাঁকে-ঝোঁকে পড়ে গঞ্জিকা-ব্লেনডেড সিগ্রেট শলাকায় দু’চার টান দিয়ে মাথা হালকা করেছে – এই যা বাড়তি পাওনা। রাকিবের সাথে ইউনিভার্সিটি হলে সপ্তাহ খানেক থাকার ফলে গাঁজার ভূতের সাথে তার সখ্য হয়। রাকিবের পড়ার পাঠ বেশ আগে চুকে গেলেও সে এখনও ছাত্রাবাস ছেড়ে যায়নি। নেতাদের সাথে ওঠাবসা আছে বলে যতদিন সম্ভব হলে থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নেবে বলে সে মনস্থ করেছে।

শাহবাগে দেরি না করে বাড্ডাগামী বাসে উঠে পড়ে কায়েস। কিছুদিন যখন ঢাকায় থাকতেই হবে তখন গুলশানও যা সাঁতারকুলও তা। সাথে একমাত্র ব্যাকপ্যাক ছাড়াতো আর কোনো বোঝা নেই। তাই থাকার ঠিকানা নিয়ে ভাববার কোনো মানে হয় না। স্কুলবন্ধু ছিল বলে রাকিব ছাত্র হয়েও তাকে কিছুদিন আশ্রয় দিয়েছে – চাইলে আরোও কিছুদিন থাকতে পারবে। মিজানও হপ্তা দিনে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠবে না। এর পরও যদি তাকে থাকতে হয় তবে শিথিল সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে ধর্না দিতে হবে।

সহপাঠীদের মধ্যে রাকিব যেমন মেধাবী তেমন অধ্যবসায়ী ছিল। মেডিকেলে ভর্তি হতে না পেরে অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছিল। মিজান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অ্যাকাউন্টিং-এ অনার্স করে এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় জাইকায় একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলার এক বছরের মাথায় নিজের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করে ফেলে। ছ’মাস আগে ঘর আলো করা এক মেয়ের বাবাও হয়ে গেছে সে। কিন্তু কায়েস এখনও না ঘরকা না ঘাটকা। বাবার ব্যবসায় তার মন বসে না।

কায়েসের জন্যই খাওয়াদাওয়ায় দেরি হয়ে যায় আজ। ডিনার শেষে মিজান বলে, ‘দোস্ত, কিছু মনে করিস না; আমি আর দেরি করতে পারব না। বুজিসইতো, বিদেশিদের অফিস – কাল অফিস থাইকা ফিরে আসার পর আড্ডা হইব।’

কায়েস বলে, ‘কোনো অসুবিধা নাই। আমিও বনশ্রীতে চক্কর লাগাব একবার; আমার এক মামা ঐখানে কোথায় জানি থাকে – খোঁজ নিয়া আসব আর কি।’

মিজান ত্রস্ততার সাথে বলে, ‘শোন শোন! তোর উশখুশের কোনো দরকার নাই। তোর ভাবী খুবই আন্তরিক মানুষ। দুপুরে বাসায় খাওয়া-দাওয়া করবি। চা-পানির দরকার হইলে ঐ পিচ্চিটাকে বলিস – মেয়েটা খুব স্মার্ট।’

সে মুহূর্তেই একটি ফুটফুটে শিশু কোলে নিয়ে কান্তা অর্থাৎ মিজানের স্ত্রী ছুটে এসে যোগ করে, ‘মামার বাড়ি খোঁজার দরকার নাই, কায়েস ভাই। গরিবের ঘরে ডাল-ভাত যা আছে তাই খাবেন – মামার বাড়ি পরে যাইয়েন।’

সকালে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে কায়েসের। বড় বু’র সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে বেচইন হয়ে পড়ে সে। ইতিমধ্যে মিজানকে অফিসে বিদায় করে তার স্ত্রী বিছানায় গা এলিয়েছে মাত্র। কাজের মেয়েটি মিজানের শিশুকন্যাকে বেবি ট্রলিতে করে এঘর ওঘর করছে । কায়েস জামা গায়ে দিতে দিতে মেয়েটিকে বলে, ‘ভাবীকে বলিস, আমি চলে গেলাম, জরুরি কাজ।’

মেয়েটি ভ্যাবাচ্যাকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট মেয়ে। মিজান বললেও তাকে তত স্মার্ট মনে হয় না। ইতিমধ্যে মিজানের স্ত্রী কায়েসের গলার আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে বলে, ‘কায়েস ভাই, উঠে পড়ছেন; দাঁড়ান নাশতা দেই।’

কায়েস হৈ হৈ করে ওঠে, ‘না ভাবী, প্লিজ, আমি এক মিনিটও দাঁড়াতি পারব না। আমার ইমারজেন্সি। পরে সব জানাব আপনাদের।’ সে আর মিজানের স্ত্রীকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে ফেলে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

বাসে করে বিকেল চারটায় সোজা চৌগাছায় বড় বু’র বাড়িতে গিয়ে ওঠে কায়েস। এ ক’দিন বড় মেয়ের বাড়িতেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন কায়েসের পিতা রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী আজমত শেখ। পুলিশ গত রাতে তাকে তুলে নিয়ে গেহে। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য বহুবিধ চেষ্টা করা হয়েছে – লাভ হয়নি। চেয়ারম্যান হাসিবুল মৃধা আদাজল খেয়ে নেমেছে। জিঘাংসার পরাকাষ্ঠা সে দেখিয়েই ছাড়বে।

কানা হাসমতকে আজমত শেখ খুন করতে পারেন এ কথা শার্শা উপজেলার কেউই বিশ্বাস করতে পারে না। নিতান্ত গোবেচারা আজমত শেখ একমাত্র ব্যবসা ছাড়া আর কারোও সাথে পাঁচে নেই। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হয়েও তিনি কোনো দলাদলি কিংবা বাগাড়াম্বরতায় কখনও ছিলেন না। অবশ্য তাঁর পিতা রহমত শেখ তেজস্বী কিন্তু সৎ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সততার জন্য লোকজন সম্মান করে বিচার সালিশে তাঁকে ডেকে নিয়ে যেত। পারিবারিকভাবেই ব্যবসায়ী ছিলেন বলে তাঁরা যথেষ্ট ভূসম্পত্তি করেছিলেন। লোকজনের সাধাসাধিতে রাজি হয়ে গেলে তিনি আজীবন চেয়ারম্যান থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি ওসবে না গিয়ে পারিবারিক জমিজিরেত এবং ব্যবসার দেখভাল করাতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। একমাত্র ছেলে আজমত শেখকেও তিনি একই তালিম দিয়েছেন।

মাত্র দু’বছর আগে দাদা জীবিত থাকাকালে কায়েস অনেক কসরত করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। দাদা বলেছেন, ‘আমার পৈতার দরকার নাই। দেশের জন্য যুদ্ধ করছি এই কথা সবাই জানে। এই বয়সে সার্টিফিকেট মাগতি যাব?’ কায়েস বলেছে, ‘দাদা, এখন মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের যে কী দাম, আপনি জানেন না। মুক্তিযোদ্ধার আত্মীয়স্বজন সব জাগায় অগ্রগণ্য।’ রহমত শেখ রেগে বলেছেন, ‘দাদার নাম ভাঙ্গায়ে চাকরি খোঁজার দরকার নাই, বাপের সাথে গিয়া বস; ঝুট-ঝামেলা ছাড়া রাজার হালে জীবন কাটাতি পারবি।’

খুন হওয়ার আগের দিন বিকেলে কানা হাসমত আজমত শেখের রড সিমেন্টের দোকানে যখন এসেছিল তখন কায়েসও সেখানে উপস্থিত ছিল। তাকে যে হাসিবুল চেয়ারম্যান পাঠিয়েছিল তা বোঝাই যাচ্ছিল। চেয়ারম্যানের চামচাদের মধ্যে সব চেয়ে খারাপ লোক হিসেবেই সে কুখ্যাত ছিল। চেয়ারম্যান তার চোরাচালানসহ সকল কুকর্মে হাসমতকে ব্যবহার করত এবং সেজন্য তার জন্য বাড়তি সুযোগ সুবিধাও বরাদ্দ ছিল। ছোটবেলায় মারামারি করতে যেয়ে বাম চোখে ছুরির খোঁচা খেয়েছিল বলে চোখের কনীনিকায় আড়াআড়ি একটি দাগ পড়ে যায়। তখন থেকে কানা হাসমত হিসেবে সে পরিচিত হয়ে ওঠে।

আজমত শেখ সহজে রাগবার পাত্র নন। কিন্তু কানা হাসমত অনেক প্যাঁচানোর পর যখন সীমা অতিক্রম করে বলল, ‘আজমত ভাই, আপনিতো জানেন চেয়ারম্যান সাব সরকারি দলের নেতা, তার হাত অনেক লম্বা,’ তখন আজমত শেখ মাথা ঠিক রাখতে পারেননি।

আজমত শেখ লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে বললেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তুই আমারে ভয় দেখাস? তুই চিনিসনা আমি কার ছেলে? তোর চেয়ারম্যান চিনে না? চেয়ারম্যানের বাপ চিনে না? ভাগ আমার দোকান থাইকা, নইলে এক কোপে মাথা নামায়ে দেব।’
শার্শা বাজারে আজমত শেখদের যে দুই শতক জমি পড়ে আছে তার ওপর চেয়ারম্যান হাসিবুল মৃধার চোখ পড়েছে অনেক আগেই। ঐ জমির পাশে তার নিজের তিন শতক জমি আছে। শেখদের জমিটুকু কব্জা করতে পারলে সে একটা আধুনিক মার্কেট তৈরি করতে পারে। কিন্তু রহমত শেখ জীবিত থাকতে সে ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। রহমত শেখের মৃত্যুর পর থেকে সে আজমত শেখকে অনেক কায়দা করে ফুসলাতে আরম্ভ করে। কিন্তু আজমত শেখ এ জমি ছাড়তে মোটেই রাজি নন।

কানা হাসমত অপমানিত হয়ে ফিরে এলে চেয়ারম্যানের মাথায় আগুন ধরে যায়। পুরনো ক্ষত থেকে আবার নতুন করে রক্ত ঝরতে থাকে। একাত্তরে তার বয়স খুবই অল্প থাকায় বিষয়টি সে উপলব্ধি করতে না পারলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে একটি সুপ্ত কষ্ট তার আজীবনের সাথী হয়ে যায়। তার পিতা রকিবুল মৃধা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিল বলে সদ্যফেরৎ মুক্তিযোদ্ধা রহমত শেখ তাকে ধরে এনে শার্শা থানা সদরে চেলাকাঠ দিয়ে পিঠিয়ে রক্তাক্ত করেছিলেন। এ কষ্ট ভুলবার নয়।

পুলিশ কালভার্টের নিচ থেকে হাসমতের লাশ নিয়ে যাওয়ার পরপরই হাসিবুল চেয়ারম্যান আজমত শেখের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলে পরিচিতজনদের মধ্যে এই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে এই খুনটি রহস্যময় – আজমত শেখ এমন কাজ করতেই পারেন না। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে আরোও জানা যায় যে আজমত শেখকে ফাঁসানোর জন্য যেখানে যা করা দরকার হাসিবুল চেয়ারম্যান কোমর বেঁধে তা করে যাচ্ছে।

পিতার গ্রেপ্তার হওয়ার কথার জানার পর থেকে শুধু বড় বু’ই নয় মেঝ বু, ছোট বু সবার পরিবারের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। বাকি দু’বোন বড় বু’র বাড়িতে এসে গলা জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি করতে থাকে। তিন জামাই পরামর্শ করে শার্শা থানার দিকে ছোটে। আজমত শেখ রাজনীতির ধারেপাশে না থাকার কারণে কোনো প্রভাবশালী নেতার সাথেও তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। তবুও জামাইরা খুঁজেপেতে দুয়েকজনের সাথে কথা বলেছিল; কিন্তু তারা উহু আহা করলেও সহায়তার কোনো নিশ্চিত আশ্বাস দেয়নি। আর দেবেই বা কেন? কানা হাসমতের কথাই ঠিক; হাসিবুল চেয়ারম্যানের হাত অনেক লম্বা। দালাল পরিবারের কলঙ্ক মোছার জন্যই হয়তো হাসিবুল ছাত্রাবস্থা থেকেই স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতি করে আসছে। এখন তার শেকড় অনেক গভীরে, শাখা-প্রশাখা অনেক বিস্তৃত; কেন্দ্রের নেতারাও তাকে গোনে।

বিফল মনোরথে সন্ধ্যায় জামাইরা বড় বু’র বাড়িতে ফিরে এলে সবাই আরেকবার কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। থানাওলারা পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আজমত শেখের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তারা কিছু জানে না। তবে হ্যাঁ, থানায় আজমত শেখ গং-এর বিরুদ্ধে খুনের এবং ফেন্সিডিল চোরাচালানের দুটি মামলা আছে। কায়েস বলেছিল সে একবার তার কিছু রাজনীতি-ঘেঁষা বন্ধুর কাছে যাবে। দুয়েক জনের সাথে ফোনে কথাও বলেছে। কিন্তু দুলাভাইরা বলেছে, ‘খবরদার, তুই গেলি তোকেও গং-এর শেকলে বেঁধে ফেলতে পারে।’

ঢাকায় গিয়ে রাকিবের কাছে তার বিপদের কথা জানায়নি কায়েস। বলেছিল বেড়াতে গিয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত খড়কুটো ধরে বাঁচার আশায় রাকিবকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিল সে। কিন্তু ব্যথিত হলেও সত্য কথাটা বলেছে রাকিব। বলেছে, ‘দোস্ত, তুইতো জানিস আমি রাজনীতি করিনা। টিকে থাকার জন্যি একটু তাল মিলায়া চলি। এই সব ছাত্রনেতা এ ব্যাপারে কিছুই করতি পারবে না।’

মধ্যরাত পর্যন্ত সবাই সম্ভাব্য নিজ নিজ সূত্রের সাথে যোগাযোগ করেছে। অনেকেই সাহস দিয়েছে। কেউ কেউ বলেছে তারা তাদের সাধ্যের সবটুকুই করবে; প্রয়োজনে জেলা পর্যায়ের নেতার কাছে যাবে, ইত্যাদি।

চেয়ারম্যানের রুজু করা মামলার কথার শোনার পরপরই আজমত শেখ বিপদ আঁচ করে দোকানে তালা লাগিয়ে দোকানের কর্মচারিদেরও পালিয়ে যেতে বলে নিজেও বড় মেয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেন। বাপের উপদেশমত কায়েসও ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যায়। সগির নামের কর্মচারির বাড়ি চৌগাছায় বড় বু’দের পাশের গ্রামে হওয়ার সুবাদে মালিকের বড় জামাইদের সে আগে থেকেই চিনত। কিন্তু হঠাৎ করে এ বিপদ নামার পর সেও তার বাড়িতে এসে এতদিন ধরে চুপটি করে বসে আছে। আজকের সকাল পর্যন্ত তার জানা ছিল না যে তার মালিকও এতদিন ধরে পাশের গ্রামে অবস্থান করছিলেন। তবে আজমত শেখের গ্রেপ্তারের কথাটা এমুখ ওমুখ করে ছড়িয়ে পড়ার পর সে আর স্থির থাকতে পারছে না। অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে রাত বারটায় সে কায়েসের কাছে ফোন করে বসে।
কায়েস চমকে উঠে ফোন ধরে বলে, ‘কিরে সগির কেমন আছিস?’

‘আর ভাল থাকি কেমনে দাদা?’ সগিরের গলা ধরে আসে। ‘আপনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন?’

কায়েস একটু চিন্তা করল যে তার অবস্থান জানানোটা ঠিক হবে কিনা। হঠাৎ তার মনে পড়ল সগিরের বাড়িতো কাছাকাছিই। সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তুই কি এখন বাড়িতেই আছিস?’

‘এ অবস্থায় আর যাব কই?’, সগির বলে।

কায়েসের কথা বাড়ানোর মত মনের অবস্থা নেই। তবুও বলল, ‘এত রাতে?’

সগির কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দাদা, মনটা ভাল নাই। কাকারে ধইরে নিয়ে গেল…।’ একটু থেমে বলল, ‘আপনার সাথে যদি দেখা কত্তি পারতাম।’

কায়েস সাতপাঁচ না ভেবেই বলে ফেলল, ‘পারলে চলে আয়; আমি বুবুর বাড়িতে আছি।’

‘আমি এখ্খুনি আসতিছি’, বলে লুঙ্গিতে গিঁট দিতে দিতে বসা থেকে উঠে পড়ে সগির।

সগির আসার পর সবার ঘুম পালিয়ে যায়। ভয়ে মুখ খুলতে না চাইলেও তথ্যটা আর গোপন রাখতে পারেনি সগির। সেদিন বদর শেষ রাতের দিকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাঁশঝাড়ের নিচে লুঙ্গি তুলে বসার পর তাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে চেয়ারম্যানসহ আরোও কয়েকজনকে হেঁটে যেতে দেখেছে। অন্ধকার হলেও তাদের গলার আওয়াজ শুনে বদর তাদের চিনতে পেরেছে। তবে সে সঙ্গত কারণেই চুপ থেকেছে। সকাল বেলা মানুষের হাঁকডাক শুনে ছুটে গিয়ে সে কানা হাসমতের লাশ দেখতে পায়। লাশটা যে খালের পাশে পড়ে ছিল তা বদরের বাড়ি থেকে অল্প দূরেই। এ তথ্যটা আজমত শেখের দোকানের অন্য কর্মচারি বদর খুব সাবধানতার সাথে সগিরকে জানিয়েছিল। সগির তখন তাকে বলেছিল, ‘চুপ, একদম চুপ! বাঁচতে চাইলি কাউরে এই কথা কবি না।’ কিন্তু আজ সে নিজেই সেই গোপন কথাটি সবার সামনে বলে একটু হালকা অনুভব করে।

তিন দুলাভাইসহ কায়েস সগিরের সূত্রের ওপর ভিত্তি করে কিছুটা উজ্জীবিত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, পরদিন যশোরে যেয়ে একজন ভাল উকিল ধরে তার পরামর্শমত এগুবে।

আলোচনা আর সলা-পরামর্শ যা-ই চলতে থাকুক না কেন থেকে থেকে মেয়েদের ফোঁপানো আর আহাজারি চলছিলই। বিশেষ করে বড় বু’কে শান্ত করাই যাচ্ছিল না। তাদের চোখের সামনে পুলিশ তাদের বাপকে তুলে নিয়ে গেল, আর এখন তারা বলে কিনা তারা কিছুই জানে না। আজ মা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তার গলা ধরে কান্নাকাটি করে তারা একটু শান্তি পেত। গত এক বছরে মায়ের মৃত্যুর শোক যা-ও ভুলেছিল বাবার এই দুর্গতিজনিত শোকের সাথে আবার তা নতুন করে এসে যোগ হয়েছে। এই দিশেহারা সময়ে সান্ত্বনা দেবার মত লোকও আশেপাশে কেউ নেই। সকাল বেলায় যখন আজমত শেখের গ্রেপ্তারের কথা জানাজানি হয়ে যায় তখন গ্রামের লোকজন দূরে থাক নিজের প্রতিবেশী কেউই ভয়ে এ ঘরমুখো হয়নি।

সগিরকে শুয়ে থাকার কথা বললেও সে গাত্রোত্থান করে না। মালিকের পরিবারের এই দুঃসময়ে সে ঘুমাবে কেমন করে? এই বিভীষিকাময় সময়েও কয়েকবার চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কষ্টের উপশম হিসেবেই যেন সবাই চা খাচ্ছে। এদের মধ্যে মেঝ দুলাভাই-ই একমাত্র ধূমপায়ী; সে মাঝে মাঝে কায়েসকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।

কেউ ঘুমাতে না চাইলেও অবিরাম ধকলের চাপ এড়ানো কষ্টকর। তাই ভোরের আগে আগে সবাই যে যেদিকে পেরেছে একটু এলিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দুলাভাইত্রয়ের চরকি-চক্করের ক্লান্তি তাদের আরোও বেশি কাবু করে ফেলেছে।

সকাল আটটার দিকে বড় দুলাভাইয়ের বড় ভাইয়ের ডাকে মেয়েদের ঘুম ভেঙ্গে যায় সবার আগে। বড়’বু পাশের রুমে ছুটে গিয়ে বড় দুলাভাইকে ডেকে তুলে, ‘বড় ভাইজান আসিছে।’

বড় দুলাভাই চমকে যায়। বড় ভাইজান সেই গতকাল সকাল বেলা একবার মুখ দেখিয়েছিল; এর পর থেকে তার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় নি। আজ সকালে আবার কী মনে করে…? তবু সে তাড়াতাড়ি গায়ে শার্ট চাপিয়ে দরজা খুলে বের হয়।

বড় ভাইজান অর্থাৎ আব্দুস সাত্তার তার ছোট ভাই অর্থাৎ আব্দুল জব্বার মানে কায়েসের বড় দুলাভাইকে বাড়ির একপাশে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর মৃদুস্বরে ছোট ভাইয়ের কাছে কৈফিয়তের সুরে বলে যে আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভীতিকর বলে তারা প্রকাশ্যে এসে জব্বারের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। এতে যেন কেউ ভুল না বোঝে। জব্বার বলে, ‘না না, ঠিক আছে ভাইজান। আমরা বুঝতিছি। তবে আমিতো বড় জামাই, আমার পালানোর উপায় নাই।’

আব্দুস সাত্তার ছোট ভাইয়ের আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, ‘শুনলাম ঐ চেয়ারম্যানটা খুবই খতরনাক; তোর শশুররে নাকি মাদক চোরাচালান মামলায়ও জড়াইছে।’

আব্দুল জব্বার মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, ‘কী যে করব বুঝতিছি না।’

‘মানুষ বিপদে পড়লি মাথায় কত দুশ্চিন্তা আসে।’ আব্দুস সাত্তার উৎকণ্ঠার সাথে বলে, ‘ঐদিককার আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু একটু আগে ফোন করছিল; বলল পুলিশ নাকি বর্ডারের পাশে একটা লোকরে করসফায়ার দিছে – সাথে নাকি অনেক ফেন্সিডিল…।’

‘সে লোকটার পরিচয় জানে?’ তড়াক করে বোকার মত শব্দ কয়টি উচ্চারণ করে জব্বার।

সাধারণ মানুষ রক্তারক্তি ভয় পায়। সাহস করে কে লাশের খবর নিতে যাবে। কিন্তু এ সংবাদটি বড় দুলাভাইয়ের পুরো পরিবারকে উতলা করে ফেলে। অজানা আশংকায় পরিবারের সবাই বিমূঢ় হয়ে যায়। কায়েস মাথায় হাত দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসার পর হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আমি যাব।’

বড় বু বলে, ‘কই যাবি?’

‘বাবার খোঁজে,’ চিবুক শক্ত করে বলে কায়েস।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার মধ্যে ছোট দুলাভাই বলে, ‘তাইলে আমরাও যাব।’

বাবার খোঁজে শেষ পর্যন্ত সবাই এক সাথে বেরোয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে তাদের সবার মানসিক গন্তব্য এক – বর্ডার। বেরোবার আগে বড় ভাইজানের কাছ থেকে তার বন্ধুর ফোন নম্বর নিয়ে নেয় তারা। কায়েস অবশ্য বলে, ‘কাউরে ফোন না করে নিজেরা নিজেরা চেষ্টা করে দেখি আগে।’

বাসস্ট্যাণ্ডে পৌঁছেও কোনো ধরনের উত্তেজনা বা ক্লু আবিষ্কার করতে না পেরে সবাই একটু দমে যায়। শেষে কায়েসই বলল, ‘চলেন, থানায় যাই, শার্শায়।’

বড় দুলাভাই বলল, ‘থানায় গিয়ে লাভ নাই; কাল অনেক চেষ্টা করেছি। তার চেয়ে বরং যশোর সদরে চল, সব খবর নেয়া যাবে। তাছাড়া একজন উকিলের খোঁজ করাও দরকার।’

হতাশা ও অনিশ্চয়তায় কায়েস ইতিমধ্যে অনেকটা কাবু হয়ে গেছে। গং শব্দের মারপ্যাঁচে সে-ও যে যেকোনো সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারে সেই ভয় তার উবে গেছে। বাবার জন্য তার এক অভূতপূর্ব মায়া হচ্ছে। নিজের অজান্তে চোখের কোণ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়ছে। তার এ অবস্থা দেখে মেঝ দুলাভাই এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভেঙ্গে পইড়ো না, আব্বার সন্ধান আমরা নিয়াই ছাড়ব। চল, বাসে ওঠ।’

চুড়ামনকাটিতে বাস থেকে নামতে না নামতেই যে কাণ্ডটি ঘটে তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। কোত্থেকে বদর ছুটে এসে হাউমাউ করে কায়েসকে জড়িয়ে ধরে। কায়েসও বদরকে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আসলে এরাই আপন মানুষ। দুঃসময়ে এরাই ছুটে আসে। কায়েস জিজ্ঞেস করে, ‘তুই এখানে কী করিস?’

বদর চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘সগির বলল আপনারা টাউনে আসবেন, তাই আমি এখানে অপেক্ষা করতিছি।’

বড় দুলাভাই বলল, ‘খুব ভাল হইছে, বদরকে নিয়া আমরা উকিলের সাথে দেখা করব।’

একথা শুনে বদর ডুকরে কেঁদে ওঠে।

বড় দুলাভাই বদরের গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, ‘ভয়ের কিছু নাই, ভয়ের কিছু নাই। আমরা উকিলের সাথে একটু কথা বলব। আর কিছু না।’

বদর বলে, ‘উকিলের কাছে যাইয়া কী করবেন? চলেন হাসপাতালে যাই। চাচা মর্গে শুয়ে রইছে।’ বলে, বিলাপ করতে করতে বদর মাটিতে বসে পড়ে।

এর পরের দৃশ্যের সঠিক বর্ণনা দেয়া কঠিন। কারণ তখন আজমত শেখের খুঁজে আসা দলের কে কীভাবে আচরণ করছিল তা অন্যজন লক্ষ করছিল না। কায়েস শুধু পাথরের মত স্থির হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আকাশে কোনো মেঘ ছিল না, পাখিও ছিল না এক নীলাভ মহা শূন্যতা ছাড়া।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
riktas মন ছুঁয়ে গেল।
অনেক ধন্যবাদ।
নাস‌রিন নাহার চৌধুরী ভীষণ মন খারাপ হ‌য়ে গেল। অন্যায়কারীরা অ‌নেক বে‌শি শ‌ক্তিশালী। সুন্দর গ‌ল্পে ভোট রই‌লো।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ফয়জুল মহী খুব আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত লেখা ।
অনেক ধন্যবাদ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

নির্ঝঞ্জাট জীবনযাত্রার মাঝে হঠাৎ করে দুর্যোগ নেমে এলে জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। কিছু দুর্ভোগ আছে যা মানুষ এড়াতে পারে না। নিয়তির কাছে হার মানে। আমার এই গল্পে কায়েসের দূঃসহ যাত্রাপথে এখন নিঃসীম শূন্যতা

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী